আলো অন্ধকারে যাই (পর্ব ৫)

গৌতম রায়
গৌতম রায়
9 মিনিটে পড়ুন
১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ ঘাতকদের হাতে নিহত বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের ছবি

পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার শেষ দিকে জাতীয় জীবনে ঘটে যায় অচিন্ত্যনীয়, হৃদয় বিদারক ও ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা।
বৃত্তি পরীক্ষার জন্যে বিদ্যালয়ে কোচিং ক্লাস হতো। সঠিকভাবে মনে করতে পারলে সেই কোচিং ক্লাসের মেয়াদ ছিল তিন মাস। এই তিন মাস বৃত্তি পরিক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের আলাদা করে ক্লাস হতো এবং তার জন্যে শিক্ষার্থীদের প্রতি মাসে অতিরিক্ত ফিস দিতে হতো। হয়তো স্বাভাবিক শ্রেণী কার্যক্রম এরূপ একটি হাই-স্টেক টেস্ট এর জন্যে যথেষ্ট ছিল না তাই এই ব্যবস্থা। অল্প কয়েকজন ছাত্র নিয়ে চলতো ক্লাস। স্যারেরা অতিরিক্ত মনোযোগ দিয়ে পড়াতেন। বাড়ির কাজগুলি দেখতে পারতেন সময় নিয়ে আর ফলাবর্তনও দিতে পারতেন। পড়াশোনা অনেক বেশি গোছানো ও সময়াবদ্ধ ছিলো এই ক’টি দিন বিদ্যালয় প্রান্ত থেকে।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সকাল বেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিদ্যালয়ের দিকে যাচ্ছিলাম কোচিং ক্লাসের উদ্দেশ্যে। আমাদের বাড়ির কয়েকটা বাড়ি পার হয়ে ছিল জুট ট্রেডিং কর্পোরেশান (জেটিসি)-এর অফিস ও গুদাম। জেটিসির সেই অফিস পর্যন্ত যাবার পর আমাদের বিদ্যালয়ের পিয়ন নিমাই দা’র সাথে দেখা। নিমাই দা সাইকেলে করে বিদ্যালয়েই যাচ্ছিলেন। আমাকে দেখেই বল্লেন, স্কুলি যাচ্ছিস? স্কুলি? যা যা বাড়ি যা। আইজ স্কুল হবে না।” আমি কারণ জিজ্ঞেস করলে চলন্ত নিমাই দা একটু থেমে বললেন – “শেখ মুজিবরি ম্যারে ফেলিছে। শিগগির বাড়ি যা। কার্ফু দেছে।” আমাদের সময় বিদ্যালয়ের পিয়নরাও আমাদেরকে ‘তুই’ করে বলতেন অনেক সময়। তখন ‘তুমি’র প্রচলনটা জাকিয়ে বসেনি আর তাতে আমাদের মনে কোনো হিনমন্যতাও আসেনি যেমনটি ইদানিং অনেকেই ‘তুই’ শব্দটির ব্যবহার নিয়ে বলে থাকেন।
যাহোক, নিমাই দার কথা শুনে আমি থেমে যাই। তাঁর কথা আর আচরণ একটু আত্মস্থ করে এক দৌড়ে বাড়ি ফিরে আসি। বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকতেই দিদিদের প্রশ্ন ফিরে এলাম কেনো। হাঁপাতে হাঁপাতে বলি নিমাই দার কাছ থেকে শোনা কথাগুলি। সকাল তখন সাড়ে সাতটা মতো বাজে। আটটায় আমাদের ক্লাস শুরু হবার কথা ছিলো। বাবা সাধারণত সাতটার সংবাদ শুনে ঘুম থেকে উঠতেন। কী কারণে যেন সেদিন তখনও ওঠেননি। আমার কথা শুনে খালি গায়ে বিছানা ছেড়ে উঠে আসেন বাবা। সাথে সাথেই রেডিও অন করেন এবং অবধারিতভাবে সেই ঘোষণাটি, “আমি মেজর ডালিম বলছি …।” বাবা আকাশবাণী ধরেন। সেখানেও সংবাদ পাঠিকা নীলিমা স্যান্যাল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানান। বাড়ির গুরুজনেরা উঠোনে একত্রিত হন। ধীরে ধীরে সেখানে জমা হন প্রতিবেশী সন্তোষ দা, নিমাই মামা, অশোক মামা, কালাম কাকা, এনামুল উকিল কাকা। সবাই ন্তম্ভিত। এটি কী করে সম্ভব – সবার আলোচনার বিষয় এটাই। সেনাবাহিনী, রক্ষীবাহিনী কী করছে সেই আলোচনাও আসে। তবে এই আলোচনা বেশিক্ষণ দীর্ঘ হয় না। কারণ মাইকে কারফিউ-এর ঘোষণা আসে একটু পরেই। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সকলকে বাড়ির ভিতরে থাকতে বলা হয়। বাইরে বা রাস্তায় দেখা মাত্র গ্রেফতার বা প্রয়োজনে গুলির কথাও বলা হয় বলে মনে পড়ে। নিদারুণ এক আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা গ্রাস করে নেয় সমস্ত শহরকে এক লহমায়।
আমাদের বাড়িটি একেবারেই রাস্তার পাশে। তাই জানালা দিয়ে যতটা পারা যায় আমরা রাস্তার অবস্থা দেখতে পারছিলাম। পুলিশের গাড়ি টহল দিতে থাকে। দুপুরের আগেই বিডিআর/সেনাবাহিনীর গাড়িও আসে অস্ত্র তাঁক করে। সারাদিন টানটান উত্তেজনা। মানুষ কথা বলতেও যেন ভয় পাচ্ছে। একটু পর পর শুধু বাংলাদেশ বেতার – যা রাতারাতি রেডিও বাংলাদেশ হয়ে যায় – থেকে “আমি মেজর ডালিম বলছি …” এই সাঙ্ঘাতিক নির্মম ঘোষণাটি প্রচার করা হতে থাকে; খুনি যেখানে বঙ্গবন্ধুকে ‘খতমের’ কথা বলে সদম্ভে।
গৃহবন্দী অবস্থায় কাটলো সারাদিন। এলো বিকেল। শহরে খুব বেশি টেলিভিশন ছিল না সে সময়। বাড়ির পাশের অবস্থাপন্ন নিমাই মামার একটি ফিলিপস টেলিভিশন ছিল। সেখানেই সবাই ভিড় করেছে নতুন মন্ত্রিসভার শপথ নেয়া দেখতে। একঘর ভর্তি লোকজন; দরজা জানালা সব বন্ধ। বেশীরভাগ মানুষ আশপাশের বাসা থেকে এসেছে। একটু দূর থেকে যারা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে পারু মিঞা কাকা, পটল কাকা, আরব আলী কাকা, এনসো কাকার কথা মনে আছে। সকলেই মৃদু স্বরে কথা বলছিলেন যাতে শব্দ বাইরে না যায়। তেমনটি হলে পাছে পুলিশ এসে গ্রেফতার করে! একে একে মন্ত্রীরা শপথ নিলেন। তিন বাহিনী প্রধানও আনুগত্য প্রকাশ করলেন। সবাই বিস্মিত বিশেষত যখন তিন বাহিনী প্রধান আনুগত্য প্রকাশ করেন। বোধ হয় জাতির সামনে প্রতিরোধের শেষ আশার বাতিটিও নিভে যায় সেসময়।
সেদিন সন্ধ্যার কিছু সময় ভেবে এখন ব্যাক্তিগতভাবে আমার খুব ভালো লাগে। আমাদের ইতিহাস বইতে বঙ্গবন্ধুর উপরে একটি অধ্যায় ছিল। সন্ধ্যায় বাড়ির লম্বা লাল বারান্দায় মেজদির ঘরের সামনে পাটি পেতে হারিকেন জ্বালিয়ে পড়তে বসলাম। বলে রাখা প্রয়োজন, সেদিন পড়তে বসার জন্য কোন তাড়া ছিল না বড়দের কাছ থেকে। তবুও সেই শুনশান সন্ধ্যায় যখন কেউ জোরে কথা বলার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছিল, তখন আমি ইতিহাস বই খুলে বঙ্গবন্ধুর উপর রচিত সেই অধ্যায়টি পাঠ করেছিলাম সরবে যদিও সেটি ঐদিন বা পরদিন আমাদের পাঠ্য ছিল না। বাড়ির বড়দের কেউ একজন (মনে নেই কে) ভয় পেয়ে বলেছিলেন – আজ তুই এই অধ্যায় পড়ছিস! । …সম্ভবত আমার মনদি বা কেউ বলেছিলো – পড়ুক না, ওর মন চেয়েছে, পড়ুক।
আসলে পারিবারিকভাবেই বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধ এসব আমাদের আবেগের সাথে মিলেমিশে একাকার। আমার বাবা, প্রয়াত সুধীর কুমার রায়, সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দল না করলেও তিনি আওয়ামী লীগকে ধারণ করতেন চেতনায়। আমার ছোট কাকা, অসিত কুমার রায়, তাঁর কলেজ জীবনে ছাত্রলীগের সমর্থক ছিলেন। ’৭১ সালে আমরা যখন শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে যাই, আমার কাকা সেখান থেকে (সম্ভবত রানাঘাট থেকে) বঙ্গবন্ধুর একটি বাঁধাই করা ছবি কিনে নিয়ে আসেন। খুবই পরিচিত ছবি – বঙ্গবন্ধুর রঙিন ছবি, ব্যাকগ্রাউন্ডে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন পতাকা আর পতাকার উপরে –

“বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ
জীবনানন্দের রূপসী বাংলা
রূপের যে তার নেইকো শেষ।”

এই কটি লাইন এর ইংরিজি অনুবাদ। এই ছবিটি বরাবরই আমার কাকার ঘরে টানানো থাকতো এবং স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে আজও সেই ছবিটি আমার কাকার ঘরেই টানানো আছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর সব জায়গা থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি সরিয়ে ফেলা শুরু হয়। কাকার ঘরের ছবিটি এক ইঞ্চিও সরেনি কোনদিন।

পরের কয়েকদিন ছিল ভয়াবহ। শহর জুড়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেকে গ্রেফতার হন। মাগুরার তৎকালীন এমপি আসাদ কাকা (এ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান), খয়ের কাকা (এ্যাডভোকেট আবুল খায়ের), বাড়ির পাশের বংশী কাকা (বাবু নন্দ দুলাল বংশী), গ্রেফতার হয়ে যান। আরো অনেকেই নিশ্চয়ই হয়েছিলেন। এতদিন পরে মনে নেই সবার কথা। শহর জুড়ে কারফিউ। দু’দিন বা তিনদিন পরে দু’ঘন্টার জন্যে কারফিউ তুলে নিয়ে মানুষকে বাজার-ঘাট করতে দেয়া হয়। আমার মনে আছে শহর থেকে বাজার তুলে নিয়ে শহরতলী পারনান্দুয়ালীতে বাজার বসতে দেয়া হয়েছিল যাতে শহরের মানুষ এক জায়াগায় জড়ো হতে না পারে। সেই বাজারে আমি বাবার সাথে গিয়েছিলাম খেয়া পার হয়ে। বাজার নিয়ে খেয়া পার হবার সময় সেখানেও পুলিশের কনস্টেবল। খুব কষ্ট লেগেছিল যখন সেই কনস্টেবল নৌকার উপর দাঁড়িয়ে এই হত্যাকান্ডকে সমর্থন জানিয়ে বক্তৃতার ঢঙে কিছু বলছিলো। অনেকেই তার কথা পছন্দ করেনি কিন্তু টু শব্দটি করার সাহস কারও হয়নি। বাসায় এসে বাবা ক্রোধে ফেটে পড়েন। সামান্য এক কনস্টেবল মওকা বুঝে সেও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডকে জাস্টিফাই করছে এটাই ছিল বাবার আক্ষেপের মূল বিষয় এবং এই ঘটনাটি বাবা অসংখ্যবার বিভিন্ন আলোচনায় স্মরণ করেছেন তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে চারপাশের অনেক কিছু পাল্টে যাবার সাথে আমাদের বিদ্যালয় আর শিক্ষা কার্যক্রমও পাল্টাতে শুরু করল আস্তে আস্তে। পাঠ্যপুস্তক থেকে বঙ্গবন্ধুর উপরে যে কন্টেন্ট ছিল তা বাদ দেয়া হয়। বিদ্যালয়ের প্রভাব বলয়েও পরিবর্তন আসে। পরিবর্তন আসে বিদ্যালয়ের আচরণ ও চর্চায়।
জাতীয় পতাকায় সম্মান প্রদর্শনের পর যুক্ত হয় শপথ বাক্য। শপথ বাক্যের সেই টেক্সটির শব্দ চয়ন আর যাই হোক অসাম্প্রদায়িক বা কালচার-নিউট্রাল ছিল না। সেটি এখন কতটুকু পরিবর্তীত হয়েছে বলতে পারব না। মনে আছে, একবার আমাদের বিদ্যালয়ে সে সময়ের সংস্থাপন মন্ত্রী এলে স্কাউট দলের পক্ষ থেকে তাঁকে বিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে স্বাগত জানানো হয়। স্কাউট দলের সামনে দাঁড়িয়ে স্কাউট-পরিভাষায় ও অঙ্গভঙ্গি সহকারে আমি উচ্চারণ করি – আজিজি আজিজি আ উ আ/ জিম বুম বা/ সিস ফুস ফা/ আ আ আ। বারী স্যার ও আকবর স্যার তটস্থ হয়ে এটি আমাকে প্রাকটিস করান। সিদ্ধান্ত হয় মন্ত্রী মহোদয় দুই সারি স্কাউটের মাঝ দিয়ে যখন যাবেন, তখন স্কাউটরা সমস্বরে বলবে স্বাগতম, স্বাগতম। কিন্তু মন্ত্রী মহোদয় আসার অল্প আগে সিদ্ধান্ত বদলে স্কাউটদের বলা হয় বাংলা স্বাগতম না বলে তার পরিবর্তে খোশ আমদেদ, খোশ আমদেদ, খোশ আমদেদ বলতে।
এমনতরো আরো অনেক ছোট বড় পরিবর্তনে বিদ্যালয়ের রসায়ন পাল্টাতে থাকে একটু একটু করে। সেগুলি নিয়ে লিখব আগামীতে।
(চলবে)

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
লেখক: গৌতম রায়
গৌতম রায় ইংরেজির অধ্যাপক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজীতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেবার পর বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বেশ তরুণ বয়সেই শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। পড়িয়েছেন দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষার প্রতি ভালোবাসা থেকেই পরবর্তীতে ছাত্র হয়েছেন ইংল্যান্ডের এক্সিটার ইউনিভার্সিটির।‌ যুক্তরাষ্ট্রের অরেগন ইউনিভার্সিটি, ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি ও ওয়ার্ল্ড লার্নিং থেকে নিয়েছেন পেশাগত প্রশিক্ষণ। এখন কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশের জাতীয় ‌শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে। শিক্ষা বিষয়ক বর্ণিল কাজে নিজেকে ‌সম্পৃক্ত রাখার জন্যই বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যাবস্থাকে তিনি দেখেছেন খুব কাছে থেকে। শিক্ষা ক্ষেত্রে গৌতম রায়ের পছন্দের আঙ্গিনা শিক্ষকের অনিঃশেষ পেশাগত দক্ষতা, ইন্টারেক্টিভ মেটিরিয়ালস ডিভ্যালপমেন্ট, ও লার্নিং এসেসমেন্ট।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!