‘ঘোড়েল’ পর্ব – দশ

মুসা আলি
মুসা আলি
25 মিনিটে পড়ুন

টানা ছ’দিন একাজে সেকাজে ব্যস্ত থাকার পর নতুন রবিবার ঘুরে এলেই সুবিমল ভিতরে ভিতরে খুব সচেতন হয়ে উঠলেন। সন্ধের সালিশিতে বসে কত বেশি বিজ্ঞতার সঙ্গে কথা বলতে হবে, তা একবার ভেবে নিলেন। অনুভূতিপ্রবণ বিষয় নিয়ে আলোচনার শুরুতে তোল্লা দিয়ে কথা বলতে পারলেই ইস্যুটা সকলকে গেলানো সম্ভব বলে ভাবছেন। প্লটটা খুব সুন্দর করে সাজাতে পেরেছেন বলেই মনে মনে খুশি হলেন, শক্ত হাতে মোকাবিলা করার জন্য ভিতরের তাগিদে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠলেন। মালতির হাত থেকে রেহাই পেতে হলে তাঁকে এ পথ মাড়িয়ে চলা ছাড়া অন্য কোনো গত্যন্তরও নেই।
হাত ঘড়িতে বারোটা। দুপুরের খাওয়া সেরে একবার ভাবলেন, খটিবরাজারে গিয়ে রঘুর সঙ্গে একটু আলোচনা সেরে ফেলা খুব প্রয়োজন কিন্তু মন চাইল না বলে গেলেন না। মনোসংযোগ বাড়ানোর জন্যে বাড়িতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এত বড়ো সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করা যায় না। মালতি নিজেই যখন রাজি হয়েছে, সুযোগটা কাজে লাগাতেই হবে। কয়েকজন দূর থেকে এসেছে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, তাদেরকে ফিরিয়ে দেওয়াও কোনোক্রমে সম্ভব নয়। মথুরাপুর থানা এলাকার মানুষ, তাই দায়বদ্ধতা রয়েছে সকলের সঙ্গে কথা বলে নিজেকে আরও বেশি মানানসই করে তোলা। একটু বিশ্রাম সেরে নিয়ে মজলিসে এসে বসলেন। সমর বলল, দাদা, খুব চিন্তায় আছি, তাই আপনার কাছে আসতে হল পরামর্শ নিতে।
এতে দুশ্চিন্তার কী আছে?
একটা ব্যবস্থা করে দিন সুবিমলদা।
সব ব্যবস্থা করেই ফেলেছি, শুধু হাতে পেতে বাকি।
সমর ফ্যালফেলিয়ে চেয়ে থাকল সুবিমলের দিকে।
কাল পঞ্চায়েতে গেলে সব জানতে পারবি। তোর নামে পাঁচ হাজার টাকা অনুদান মঞ্জুর হয়েছে।
সমীর অভিভূত না হয়ে পারল না। লোকটা পারেন বটে, যেন ম্যাজিসিয়ান। মাত্র দুদিন আগে দায়ে পড়ে সুবিমলের কাছে এসেছিল সে। ছোটো ছেলে ডায়মন্ড নার্সিং হোমে ভর্তি। এক্সরে ও ওষুধ বাবদ হাজার পাঁচেক তো লাগবেই। তাই নিয়ে স্থানীয় মানুষের কাছে হাত পাতার চেষ্টায় শেষ ছিল না কিন্তু প্রত্যেকের এক কথা,টাকা নিলে শোধ দিবি কী করে? সুবিমলবাবু সেই প্রসঙ্গই তোলেন নি বরং বিশেষ সহানভূতি নিয়ে বলেছেন, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব। এসব প্রসঙ্গ নিয়ে আগেভাগে বললে সুবিধা হয়। সমর সেই কথার কঠোর বাস্তবতা বেশ বুঝতে পেরেছিল দ্বিতীয়বার দেখা করতে এসে— আপনার উপকারের কথা কোনোদিন ভুলব না। ছেলে ফিরলে একদিন বাড়িতে নিয়ে যাব।
এভাবে বলতে নেই সমর, আমি নিজেই যাব তোমার ছেলেকে দেখতে। সমর আবার ভাবাবেগে উদ্বেলিত হল, সুবিমলের নাম জপতে জপতে বাড়ির পথে এগিয়ে চলল।
আর এক নতুন আগতের প্রতি সুবিমলের প্রশ্ন, তুমি কী আজ প্রথম এলে?
ঠিক ধরেছেন দাদা।
স্বাগত জানালাম, কোথা থেকে এসেছ বলো?
ঘোড়াদল থেকে।
সংক্ষেপে প্রয়োজনের কথাটুকু বলো।
খালবিলে মাছ ধরে দিন চলে, গত বছর শেষের দিকে জালটা ছিঁড়তে শুরু করেছিল, এবছর তা আর চলছে না। একটা অনুদান বা লোন পেলে খুব সুবিধা হয়, ছাপোষা সংসার, দশজন খেতে, একা রোজগেরে, জাল না থাকলে সংসার চলবে না দাদা।
দিন পনেরো পরে এসে দেখা করো, একটা ব্যবস্থা করে দেব।
তাহলে আজকের মতো আসছি।
ঘোড়াদলের তমালকে চেনো?
চিনি দাদা।
কীভাবে চেনো?
উনি মিটিং মিছিলে ডাকলে আমরা যাই।
সুবিমল একটু হাসলেন, বুঝলেন, ঠিক খাদ থেকে লোকটা এখানে এসেছে।
বিকেল তিনটে, সুবিমলের মধ্যে তৎপরতা বেড়ে গেল জোয়ারের স্রোতের মতো। বাকি যে কজন ছিল তাদেরকে হুঁ, হ্যাঁ, তা কী করে সম্ভব, পরে এসে দেখা করো, প্রধানকে বলে দেখি, প্রয়োজন হলে পঞ্চায়েত সমিতিতে দরখাস্ত দিতে হবে বলে শেষ করলেন। একবার ভাবলেন, লালপুর থেকে ঘুরে এলে অনেকটা সুবিধে পাওয়া যেতে পারে, সালিশির আসরে কিছু হুজুগে লোককে উপস্থিত করা একান্ত প্রয়োজন। কৃষ্ণচন্দ্রপুরেও একবার যাওয়ার কথা ভাবলেন কিন্তু পাছে দেরি হয়ে যায়, সেই ভয়ে গেলেন না। জয় আসবে একটু পরে, কদিন ধরে সে পড়ে আছে প্লটটা শক্তপোক্ত করতে। সেই সব খবর সবিস্তারে জানাতে আসবে। চলে যেতে উদ্যত সবাইকে উদ্দেশ্য করে সুবিমল আবার বললেন, বাপেরা, কিছু মনে করলে নাতো? তারপর দু’পাটি সাদা দাঁতের ফাঁকে পুরনো মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে জানিয়ে দিলেন, একান্ত অসুবিধার কারণে আলোচনা সংক্ষিপ্ত করতে হলেও তিনি সকলের উপকারে নিজের জীবন সঁপে দিয়ে আছেন।
সকলে বুঝল, সুবিমল ছাড়া এলাকায় আর কেউ নেই যিনি এত ঝক্কিঝামেলা নিতে পারেন। বিকেলের সূর্য ঝুপ ঝুপ করে নামতে শুরু করেছে, সুবিমল মনে মনে রোমাঞ্চিত হতে থাকলেন। সন্ধে এল আরও শিহরণ নিয়ে। একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গ্রামের মানুষ সন্ধের আগে থেকেই ভিড় জমাতে শুরু করেছিল বিষয়ের গভীরতা সকলকে ভীষণ টানছিল বলেই। কুমারী মেয়ে সন্তানসম্ভাবা, কে তাকে এত বড়ো সর্বনাশ করল, সেই কানাকানিতে গ্রামীণ মানুষজন ভিতরে ভিতরে কেমন যেন উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। সালিশিতে বসে তারা খলনায়ককে খুঁজে বের করতে চায়, জানতে চায় ঘটনার আনুপূর্বিক বর্ণনা। সন্ধের পরে সকলে রসালো প্রসঙ্গটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উপভোগ করতে চাইলেও সুবিমল না আসায় তা সম্ভব হচ্ছিল না।
এ প্রথা অনেক বছরের পুরনো। আগে থেকেই সকলের জানা হয়ে গিয়েছিল,আলোচনার শেষে চূড়ান্ত রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে সুবিমলের সমকক্ষ কেউ নেই। সেজন্যে বিরক্তি থাকলেও মানসিক দোলাচলে দোল খেতে বাধ্য হল সকলে।
আরও বেশ কয়েক মিনিট গেল। অনেকের মধ্যে অন্য দোলাচল। তাহলে কী সুবিমলবাবু আসবেন না? অন্য কোনো বিশেষ জরুরি কাজে আটকে পড়েছেন? গুঞ্জন শুরু হল আসরে। একটু পরে সকলে দেখল, সুবিমল সাইকেল নিয়ে হনহনিয়ে স্কুল মাঠে ঢুকছেন। শুরুতেই তাঁর বিনীত স্বীকারোক্তি, দেরিতে আসার জন্য সকলের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। রাণাঘাট থেকে বেশ কয়েকজন এসেছিল কথা বলতে, ফেলে রেখে চলে আসতে পারিনি।
সুবিমলের বিনীত কথায় সকলে গলে জল হয়ে গেল। এত বড়ো নেতৃত্ব পেয়ে সাধারণ মানুষের উপর কী ভীষণ নির্ভরতা। এ সত্য জানেন বলেই এলাকার মানুষ তাঁকে এত উঁচু চোখে দেখে। ক্ষমতার এত শীর্ষে থেকেও ভারিক্কির এতটুকু প্রকাশ নেই। এলাকার একজন তুচ্ছ মানুষ দেখা করতে এলে সুবিমল তার সঙ্গে হেসেমিশে কথা বলেন, সেটাই তাঁর সুদৃঢ় জনভিত্তি। সেই সুবিমল থেমে থেমে বললেন, ইতিমধ্যে মূল সমস্যাটা নিশ্চয় আপনারা জেনে ফেলেছেন। একজন কুমারী মেয়ে সন্তানসম্ভাবা। দুটো দায়িত্ব আমাদের পালন করতেই হবে। মেয়েটার জীবনে নতুন প্রতিষ্ঠা খুঁজে দিতে হবে। যে এত বড়ো অন্যায় করল, তাঁকে খুঁজে বার করে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া খুব প্রয়োজন। এভাবে চলতে থাকলে সমগ্র সমাজ ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে, অভাবী বাড়িতে মালতির মতো মেয়েরা নিরাপদে থাকতে পারবে না।
প্রদীপ হাত পাঁচেক দূরে বসে ছিল, একই দাবি জানিয়ে বলল, আজকের আলোচনার বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে কোনো বিভেদ থাকা উচিত নয়। আমিও সুবিমলদার সঙ্গে একমত হয়ে অপরাধীর উপযুক্ত শাস্তি দাবি করছি।
সেখ জয়নুদ্দিন, নব্বই বছরের বৃদ্ধ, নাতীর হাত ধরে টলতে টলতে এসে আসরের এককোণে এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল। কুমারী মেয়ের সর্বনাশের প্রসঙ্গ শুনে বার দুই মাথা নেড়ে বললেন, এ তো দেখছি, ঘোর কলিকালের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। যে মুখপোড়া এ কান্ড ঘটালো, তাকে আজ ঘোরতর শাস্তি দিতে হবে। বলি, মেয়ের বাপ কেমন ধরনের মানুষ, বয়স বেড়ে বেড়ে ধিঙ্গি হয়ে গেলেও বিয়ে দেবার নাম পর্যন্ত করলে না।
দাদু, বড্ড খেপেছেন দেখছি, টিপ্পনি প্রদীপের।
এ্যাই ছোকরা, আমার কথাটাহ তোমার গায়ে লাগল? শুনবে না যখন ডেকেছ কেন শুনি? নাতীর হাত ধরে টলতে টলতে কত কষ্ট করে এসেছি, সেকথা তো একবারও বললে না। কলিকেত্তন শুনতে শুনতে অপমানে ডুবে যাচ্ছি হে ছোকরা।
এত কীসের অপমান শুনি?
এ্যাই এ্যাই, এভাবে ওরা সমাজকে অপমান করছে না?
সুবিমল হুমকির স্বর বজায় রেখে বললেন, দাদু, ঠিক কথাই বলেছেন। এ অপকান্ড তো অনাসৃষ্টিই। অপরাধীকে ধরে আজকের আসরে গুরুতর শান্তি দিতেই হবে। তা করতে না পারলে সমাজে পারস্পরিক বিশ্বাস বলে কিছু থাকবে না।
সেখ জয়নুদ্দিন গলে জল হয়ে গেল, তার মন্তব্য— রায়বাবু সমাজ বোঝেন বলেই একথা বলতে পারলেন। মনে মনে ভাবল, রায়বাবু অভাবী মানুষের অনুভূতি বোঝার ঈশ্বর হয়ে উঠেছেন। ছেলের ব্যবসার কথা শুনে এক মাসের মধ্যে একটা বড়ো লোন করে দিয়েছিলেন। শুধু সালিশির বিষয় নিয়ে জয়নুদ্দিন এখানে আসেনি, সুবিমলকে দুপলক দেখতেও চেয়েছিল। এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো। একটু কী ভেবে থেমে থেমে বলল, একটা কথা বলব বাবা?
আলোচনার রাশ যে তাঁর হাতের মুঠোয় চলে এসেছে তা বুঝতে সুবিমলের কোনো অসুবিধা হল না, বললেন, একটা নয়, যত কথা মনে পড়ছে বলুন।
তাহলে এত সময় নষ্ট করছ কেন? মাগিটাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেই তো সব কেলোকিত্তি বেরিয়ে আসে।
উপস্থিত কিশোররা হেসে গড়াগড়ি। তাদের সমবেত দাবি, দাদুর কথা মানতেই হবে, মেয়েটাকে এক্ষুণি আসরে ডেকে জিজ্ঞেস করা হোক। শোনার কৌতূহল ভিতরে থাকলেও তাদের মূল সন্দেহ নবীনের দিকে। সে ছাড়া এ কাজ কেউ করতে পারে না, সেই ভাবনায় দুলছিল তারা। গ্রামের ফুটবল টিমের হয়ে সেমিফাইনাল ম্যাচ খেলেনি বলেই নবীনের উপর তারা আগে থেকেই ভীষণ রেগে ছিল। কিছুতেই সেই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না তারা। ব্যাটা নবীন সকলের সামনে শাস্তি পেলে তারা যারপরনাই খুশিই হবে।
সুবিমল আবার সবিনয়ে বললেন, আমি বলতে চাচ্ছি, প্রদীপের মধ্যে অন্যায় বিরোধী প্রবল মনোভাব রয়েছে। ও সরাসরি জিজ্ঞেস করে ব্যাপারটা জেনে নিক।
প্রদীপ কিন্তু কিন্তু করতে লাগল, বয়স্ক কাউকে দিয়ে যদি….
সুবিমলের চড়া মন্তব্য, এতে কিন্তুর কী আছে হে? শুধু জেনে নেবে, তারপর সভায় আলোচনা হবে, সিদ্ধান্ত হবে, আরও অনেক কিছু। ‘ঠাকুর ঘরে কে, কলা খাই নি’ মনোভাব নিয়ে কথা বলছ কেন?
প্রদীপ কোনো উত্তর দিল না।
তাহলে জয়নুদ্দিন দাদু যা বলার বলুন।
সেখ জয়নুদ্দিন যথেষ্ট সম্মানবোধ করলেন সুবিমলের প্রস্তাবে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু করলেন, হুই মেয়েটা, আমার সামনে চলে আয়, সব সরাসরি উত্তর দিবি, নাহলে…কিন্তু….।
মালতি লজ্জায় এত রাঙা হল যে কিছুতেই সামনে আসতে চাচ্ছে না।
রেগে কাঁই হয়ে গেলেন জয়নুদ্দিন, মাথা নেড়ে বললেন, এ্যাই মেয়েটা, সামনে আয় বলছি, গোপনে হোল্লাহুল্লি করতে পারলি, আর এখন নজ্জায় মাথা ধরে বসে আছিস? নচ্ছার মাগি কোথাকার।
কিশোরদের মধ্যে আবার লুটোপুটি হাসি, মালতি পায়ে পায়ে জয়নুদ্দিনের সামনে এসে দাঁড়ালো।
তোকে এ কান্ড ঘটালো কে বল? জোর করে, নাকি তোরও ইচ্ছা ছিল এতে….?
মালতি কাঁদতে শুরু করল।
জয়নুদ্দিনের কাটা কাটা মন্তব্য, ছেনালি মাগি কোথাকার, বেশ তো অভিনয় করতে শিখেছিস।
মালতি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
এত পিরিতের কান্নার কী আছে শুনি? খিঁচিয়ে উঠলেন জয়নুদ্দিন। বাম হাতটা সামনে এনে সজোরে নাড়তে নাড়তে বললেন, কেন ন্যাকা কান্নার শুরু করলি? গ্রামের সব মানুষের মাথা একাই হেঁট করে দিয়েছিস।
কিশোররা আর হাসতে পারল না। এতক্ষণ একটি শব্দের যাদুতে তাদের মধ্যে যে কৌতূহল তৈরি হয়েছিল, তা মুহূর্তে উবে গিয়ে গ্রামের সম্মানহানির প্রসঙ্গটা প্রবল হয়ে উঠল। ভাবতে লাগল, নবীন ছাড়া অন্য যে কেউ এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। বিষয়টা অত সহজ নয়।
সুবিমলের প্রিয় সাকরেদ জয় বলল, নাম বের করার জন্য এভাবে মেয়েটার উপর চাপ তৈরি করা ঠিক হচ্ছে না। কোনো প্রতিবিধান না হলে মালতির সর্বনাশ হয়ে যাবে।
এসব কী বলছ জয়? এভাবেই ভাবছ? সুবিমলের হুমকিতে থেমে যেতে বাধ্য হল জয়। সমগ্র আসর থমথমে। একে অপরের দিকে চোখ রেখে নিজেদেরকে বুঝে নেওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত সকলে। সুবিমল আবার বলতে শুরু করলেন, মাত্র একজন অপরাধ করেছে, তার এত শক্তি যে সকলকে টপকে যাবে আসরে বসে। কিছু করতে পারব না আমরা? দেশে প্রশাসন বলে কিছু নেই? তাহলে সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে থেকে লাভ কী? আমরা কী মগের মুলুকে বাস করছি?
আলোচনার আসরে অন্য মাত্রা ফিরে এল। চারদিকে টুকরো মন্তব্যের ছড়াছড়ি। —রায়দা ঠিক কথা বলছেন।
আজকের রায় সুবিমলদাকেই দিতে হবে। ভালো হিসেবের কথা বলতে পারলেন।
একমাত্র সুবিমলদা পারেন শেষ কথা বলতে।
বর্ষার শুরুতে ঝিরঝিরে বৃষ্টি নামলে চাষীদের মন যেমন আনন্দে ভরে ওঠে, সুবিমলের ভিতরের অবস্থা তেমনি হয়ে উঠল। হৃদয়ের সব আকুতি দিয়ে তা উপভোগ করতে লাগলেন, ভালো করেই জানেন, একমাত্র তিনিই পারেন বিচারের মোড় নিজের মতো করে ঘুরিয়ে দিতে।
বৃদ্ধ জয়নুদ্দিন মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, তাহলে আর দেরি না করে রায়বাবু রায় ঘোষণা করুন। মাগিটা তো এখনও কার সঙ্গে এভাবে ফষ্টিনষ্টি করল, তা স্বীকারই করল না। জানতে পারলে এই সভাতে দুহাত এক করে দেওয়া যেত। হঠাৎ করে জয়নুদ্দিন ক্ষেপে লাল হয়ে গেলেন, মানসিকতায় সম্পূর্ণ বেসামাল, বলতে শুরু করলেন, এ্যাই মেয়েটা, এক্ষুণি বলতে হবে তোকে, কী ভেবেছিস তুই? বলিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব আমার উপর পড়েছে, না বললে তোকে আজ, রাগে কাঁপতে শুরু করলেন।
সমগ্র আসর গরম হয়ে উঠল, ভিতরে ভিতরে সকলে কেমন যেন সরব। পরিতোষের হুঙ্কার, কী ভেবেছে মেয়েটা, আশি বছরের দাদুকে এভাবে অপমান করতে পারল?
পরিমলের মন্তব্য, সকলকেই ফ্যালনা ভাবছে।
তপন বলল, রায়বাবু একটু লাল চোখ দেখালে বলতে বাধ্য হবে।
মালতি মুখ তুলে তাকালো সকলের দিকে। আসরে চাপা উত্তেজনা। তাহলে কী মেয়েটা এবার নামটা প্রকাশ করে দেবে? কে সে? এই আসরে আছে তো? যদি থাকে, ব্যাটাকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। সকলে সেই প্রসঙ্গে দুলতে লাগল। মালতি ডান হাত উঁচিয়ে বলল, ওই প্রদীপদা আমাকে….।
বাকি অংশটুকু আর বলতে হল না। সকলে কথার ঝাঁপি খুলে ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রদীপের উপর, মার শ্যালাকে, এতক্ষণ বসে বসে বড়ো বড়ো বাতেলা দিচ্ছিল। ভাবছিল, শেষ পর্যন্ত আড়ালেই থেকে যাবে।
সমবেত কণ্ঠস্বর এত রাসভ হয়ে উঠল যে আসর জুড়ে চরম বিশৃঙ্খলা, কেউ কারুর কথা শুনতে চায় না, একটা আস্ত মেছোবাজার। জয় থামানোর চেষ্টা করল কিন্তু পারল না, একবার সুবিমলের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। ভালো করেই জানে, একমাত্র তার গুরু কথার কৌশলে সকলকে চুপ করিয়ে দিতে পারেন। একটু পরে দেখল, সেই প্রক্রিয়া শুরু করেছেন সুবিমল রায়। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, এভাবে হট্টগোলে আলোচনা চলতে পারে না। তাহলে কী আমাকে উঠে যেতে হবে? মালতি কারুর নাম বলেছে বলেই তো আমরা এভাবে মারমুখি হয়ে উঠতে পারি না। ব্যাপারটা যাচাই করে দেখতে হবে না?
শুধু হট্টগোল থামল না, সুবিমলকে উদ্দেশ্য করে কাকুতি মিনতিও শুরু হল। —এভাবে চলে যাবেন না।
রায় তো আপনাকে দিতে হবে। জটিল সমস্যা, চলে গেলে হবে কী করে? একমাত্র আপনিই পারেন জটিল সমস্যার বুকে জল ঢেলে দিতে। সেখ জয়নুদ্দিন খিঁচিয়ে উঠলেন, তোমরাই তো হট্টগোল করে লোকটাকে কথা বলতে দিচ্ছ না।
সুবিমলবাবু মনে মনে খুব করে এমন উপরোধ অনুরোধ চাচ্ছিলেন। নির্ভরতা বাড়লে নেতৃত্বের মাত্রাও বেড়ে যায়। আসলে সভা ছাড়ার হুমকি দিয়েই জাঁকিয়ে বসতে চেয়েছেন তিনি, সকলের আকুতি সেই মানসিক যজ্ঞে দারুণ ইন্ধন যুগিয়ে দিল। সুবিমল গোঁপের আড়ালে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললেন, তাহলে বসুন সকলে, সমস্যা থাকলে তা সমাধান করার দায়িত্ব আমাদেরকেই নিতে হবে।
প্রদীপ পাথরবৎ বসে থাকতে থাকতে একবার মালতির দিকে দুচোখ রেখে মুখ নামিয়ে নিল, বুঝল, আলোচনার গতিপ্রকৃতি একেবারে একমুখো হয়ে উঠেছে, সুবিমলবাবু যা বলবেন, সেটাই ফাইনাল হিসেবে গণ্য হবে। তার বাইরে কোনো বাস্তবতা নেই। শত চেষ্টা করে অন্য অবলম্বন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়, মানুষের সমর্থন ঢলে পড়েছে সুবিমলের দিকে।
বৃদ্ধ জয়নুদ্দিন আবার মুখ খুললেন, বলছি কী রায়বাবু, খামাখা অপেক্ষা করছেন কেন? যা বিধান দেওয়ার দিয়ে দিন।
আগে বলুন, আজ কী বার, কত তারিখ?
রবিবার, মাসের পনেরো তারিখ।
তাহলে তো লগ্ন রয়েছে।
বৃদ্ধ জয়নুদ্দিন বললেন, ওই পথেই সমাধান?
তাছাড়া উপায় নেই দাদু।
সকলে চমকে উঠল সুবিমলের কথায়। একটু পরে যে চরম অবস্থান তৈরি হতে চলেছে তা বুঝল সকলে। প্রদীপ নতুন কিছু ভাবতে পারল না, মাথায় হাত দিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকল। সকলকে উপেক্ষা করে আসর ছেড়ে যে চলে যাবে, সেই সাহসও হল না। জয়নুদ্দিন মাথা দুলিয়ে বললেন, কাউকে পাঁজি আনতে বলব নাকি?
তা বলেছেন ঠিক, লগ্নযোগ আছে কিনা আরেকবার দেখে নেওয়া দরকার। সকলকে অবগত না করিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত কার্যকর করা ঠিক হবে না।
জয়নুদ্দিন সামনে দাঁড়ানো এক যুবককে উদ্দেশ্য করে বললেন, এ্যাই ছোঁড়া, রায়বাবুর কথা শুনতে পেলি নে। তারপরেও এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস? পাশের বাড়ি থেকে একটা পাঁজি নিয়ে আয়।
উপস্থিত সকলে আরও স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে থাকল সুবিমলের মুখের দিকে। প্লট তৈরির মহারাজ তখন প্রত্যেকের উপর চেপে বসেছেন কয়েক কুইন্টাল ভারী পাথর হয়ে যা সরানোর ক্ষমতা কারুর নেই। মালতি যা বলছে তা যে যাচাই করা খুব প্রয়োজন, সেই প্রসঙ্গটুকুও কেউ সামনে আনতে পারল না। সুবিমল নিজের মানসিক ইচ্ছা পূরণের বাসনায় পাঁজি আনার অপেক্ষায় গম্ভীর মুখে বসে থাকলেন। সমগ্র আসর জুড়ে গুমোটের ছড়াছড়ি, ভয়ানক থমথমে অবস্থা। প্রদীপ এদিক ওদিক বার দুই তাকিয়ে থপ্ করে সুবিমলের পায়ের কাছে নেতিয়ে পড়ল, আমাকে বাঁচান রায়দা, অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যে।
জয়নুদ্দিনের তীব্র কটুক্তি, প্যাট ফুলিয়ে দিয়ে আবার বাঁচার চেষ্টা করছিস? হারামজাদা, তোকে আজ শুলে চড়াবো রে।
রাত নটা, একটু পরে পাঁজি এল, নটা ত্রিশ মিনিটে লগ্ন। সুবিমল নিজের চোখে আরেকবার ভালো করে পরখ করে নিলেন। ভুলচুক হলে বিপদের শেষ থাকবে না, সব ঝক্কি তার উপরে এসে পড়বে।
জয়নুদ্দিনের মন্তব্য, তাহলে কী এই আসরে দুজনের হাত এক করে দেওয়ার কথা ভাবছেন?
আপনার মতামত কী?
মেয়েটা বলছে হ্যাঁ, ছেলেটা বলছে না, বড়ো ফাঁপরে পড়ে গিয়েছি রায়বাবু।
প্রদীপ তো না বলে নি।
আপনার পায়ের কাছে গড়িয়ে পড়েই তো বুঝিয়ে দিল, সে একাজে নেই। প্রকাশ সমাদ্দার, প্রদীপের ঘনিষ্ট বন্ধু, কৃষ্ণচন্দ্রপুরে বাড়ি, এগিয়ে এসে বলল, কোনো প্রমাণ ছাড়া কী এভাবে সম্ভব?
কী প্রমাণ পেতে চাচ্ছ বলো? প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন সুবিমল কিন্তু সেই প্রশ্নে কেউ সমর্থন দিল না। আসর অন্য মাত্রা পেল। রায়বাবু বুঝলেন, মালতির বক্তব্য শোনার পরে যে আবেগ তৈরি হয়েছিল, প্রকাশের কথায় তা অনেকখানি ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। মুখে না বললেও কেউ কেউ যে প্রদীপের পক্ষে থেকে গেছে, কারুর কারুর মুখের হাবেভাবে তা প্রকাশ পাচ্ছে কিন্তু পারিপার্শ্বিক চাপে সে কথা প্রকাশ করতে পারছে না। একটু জোর খাটাতে না পারলে যে এ সুযোগ কাজে লাগানো সম্ভব নয়, তা মর্মে মর্মে বুঝলেন, জয়কে বললেন, রঘুকে একটু ডেকে আনতে পারবি?
বললেই যেতে পারি।
তাহলে যা।
জয় অন্য একজনের বাইকে খটিরবাজারে চলে গেল। সুবিমল বসে বসে সময় গুণতে লাগলেন। প্রকাশকে থামানো যে আশু প্রয়োজন, তা এক দুবার ভেবে নিলেন, রঘু এলেই যে তা সম্ভব, সে বিষয়ে নিশ্চিত হলেন মনে মনে। মৃদু গুঞ্জন শুরু হল আলোচনার আসরে। প্রকাশ্যে কতজন প্রকাশের পক্ষে আছে, তা পরীক্ষা করে নিতে চাইলেন সুবিমল, বললেন, কারা প্রকাশের সমর্থনে রয়েছ, একটু হাত তুলে জানাবে?
সেলিম এসেছিল লালপুর থেকে। সেই প্রথম হাত তুলে বলল, প্রকাশের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত, এভাবে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না।
সুবিমল মুখ তুলে তাকালেন সেলিমের দিকে, একটু মুচকি হাসলেন, মূল আলোচনায় সেলিমের মতামত যে কোনোরকম গুরুত্ব পাবে না, সে ব্যবস্থা তিনি আগেই করে রেখেছিলেন। যে গ্রামে বিচার হচ্ছে, সেই গ্রামের মানুষজন ছাড়া কেবলমাত্র তিনিই আসতে পারবেন, মতামত দিতে পারবেন ও সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। সেই সিদ্ধান্ত সামনে তুলে ধরে বললেন, তুমি কোন্ গ্রাম থেকে এসেছ?
লালপুর থেকে।
তাহলে কথা বলছ কেন?
আপনি কথা বললে আমিও কথা বলতে পারি।
এ গ্রামের সালিশিতে অন্য নিয়ম আগে থেকে চালু হয়ে আছে।
কী রকম?
কেবল আমিই আসতে পারব আলোচনায় অংশ নিতে।
এটা কী অগণতান্ত্রিক নয়?
জয়নুদ্দিনের মন্তব্য, ও বাবা সুবিমল, এভাবে বিতর্কে যাচ্ছ কেন? ওকে বলতে দাও, মূল সিদ্ধান্ত তো হয়ে আছে।
ঠিক আছে দাদু।
আসর আরও থমথমে হয়ে উঠল।
সেলিমকে উদ্দেশ্য করে জয়নুদ্দিন বললেন, কী বলতে চাচ্ছিলে বলো। ছেলেটা সাহস পেল জয়নুদ্দিনের কথা শুনে, ভাবল, নিশ্চয় দাদুর মতো কেউ কেউ তার কথা শুনে কম্পিত হতে পারে। একেবারে প্রতিবাদী কণ্ঠে বলল, পাঁজির প্রসঙ্গ আসছে কেন শুনি? কেউ অভিযোগ করলেই তা সত্যি বলে গ্রহণ করতে হবে কেন? প্রদীপ স্বীকার করে নিলে আমার কোনো আপত্তি ছিল না। অবশ্যই রক্ত পরীক্ষা করে দেখতে হবে মালতির অভিযোগ সত্যি কিনা। তার আগে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না।
সুবিমলের মুখ গম্ভীর হতে হতে শ্রাবণের মেঘলা আকাশ হয়ে উঠেছে। সেলিমকে প্রদীপের মতো আরেকটা হেঁতাল গাছ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারছেন না। কেন যে সে এত বড়ো প্রতিবাদী হয়ে উঠল, তা মাথায় এল না সুবিমলের, রঘু -ভোল্টে-কেল্টেদের জন্যে অপেক্ষায় থাকলেন। একটু পরে দেখলেন, পাঁচটা বাইকে জনাদশেক আলোচনার আসরে এসে উপস্থিত হল। সুবিমলের বুক পঞ্চাশ ইঞ্চিতে পরিণত হয়ে গেছে। থেমে থেমে বললেন, তাহলে কী আলোচনা এখানেই থেমে থাকবে? মনে হচ্ছে এতদিন আপনাদের পাশে থেকে অনেক বড়ো ভুল করেছি।
রঘুর কণ্ঠস্বর রাসভ হয়ে উঠল, শিকারী বাঘের মতো গর্জন করে সমগ্র পরিবেশকে পাশবিক করে তুলল। সেলিম তো তো করে বলল, না মানে বলতে চাচ্ছিলাম…
তুই কে রে? কেল্টের চড়া তড়পানি।
আরও থমথমে হয়ে উঠল আসর।
জয়নুদ্দিন বলতে শুরু করলেন, এভাবে সেলিম ছেলেটা কেন যে রগচটা হয়ে কথা বলতে গেল, তা মাথায় আসছে না। এতদিন রায়বাবুর সিদ্ধান্ত মেনে সমাজ চলে আসছে, আজ তার ব্যতিক্রম হবে কেন? বলছি কী, বাজার থেকে টোপর আনতে হবে তো?
তা তো লাগবেই, সুবিমলের ছোট্ট উত্তর।
জয়নুদ্দিন সামনে দাঁড়ানো ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে হাঁকতে শুরু করলেন, হুই ছেলেটা, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলি কেন? শুনলি না রায়বাবু কী বললেন?
রঘু সামনে এসে বলল, আমিই বাজারে যাচ্ছি।
প্রদীপ বুঝল, সরে পালানোর আর কোনও উপায় নেই। মাত্র ঘন্টা দুয়েকের ব্যবধান, তাতে কত কিছুই পরিবর্তন ঘটে গেল। বাহুবল আর জনসমর্থনের চাপে সুবিমল ঈশ্বর হয়ে উঠেছেন। যা খুশি তাই করতে পারছেন। যেন শরতের আকাশ জুড়ে হঠাৎ ঘনঘোর মেঘের আনাগোনা শুরু হয়েছে, একটু পরে ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি আসবে, সাবধান হওয়ার আগেই উঠোনে জড়ো হওয়া বহুমূল্যের সব কিছু ভিজে তছনছ হয়ে যেতে পারে।
রাত দশটা, প্রদীপ সুবিমলের কূটনীতি মাথায় নিয়ে সমুদ্রের প্রবল ঢেউয়ে সচল পাথরের মতো ধীরে ধীরে বাড়ির পথে এগিয়ে চলেছে। ইতিমধ্যে অঘটনের খবর গ্রামময় রটে গিয়েছিল। প্রদীপের মা বারান্দার এক কোণে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। প্রদীপ যে কোনো দোষ করে নি, সেই ভাবনা মাথার উপর মেঘলা আকাশ হয়ে চেপে থাকলেও গ্রামের নসুবুড়ির সঙ্গে তার মনোমালিন্য অনেক দিনের। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে প্রদীপকে উদ্দেশ্য করে তার মন্তব্য, এমন ছেলে গ্রামের কেউ প্যাটে ধরেনি।
কম্পিত পায়ে ভর করে প্রদীপ এগিয়ে চলেছে, পিছনে মালতি। বারান্দার উপরে উঠতে উঠতে ভাবল, সমাজের এক অদ্ভুত অনুশাসন আজ তাকে ঘাড় পেতে মেনে নিতে হল। ক’মাস পরে গ্রামের মানুষের চোখে সে বাবা হওয়ার সম্মান লাভ করবে। দুর্লভ ভাগ্য করে এ পৃথিবীতে আসতে পেরেছিল সে। ঘরে ঢুকে সবার আগে সুচরিতাকে মনে পড়ল। জানাজানি হয়ে যাবার পরে সুচরিতা কী ভাবতে পারে প্রদীপ তা ঠিক করতে পারল না। সামনের উঠোনে জমাট বাঁধা অন্ধকার, শিমূল গাছে বসে রাতপেঁচা তারস্বরে ডাকছে। বাতাস শিস মেরে উঠোন পার হচ্ছে। জানালার ফাঁক দিয়ে প্রদীপ ফ্যালফ্যালে দুচোখ নিয়ে চেয়ে থাকল সামনের উঠোনে জমে থাকা অন্ধকারের দিকে। খেলার মাঠে সুবিমলের বিরুদ্ধে না গেলে যে তার জীবনে এত বড়ো দুর্ঘটনা ঘটত না, সেই ছায়া প্রদীপের মনের পটে চিত্রবিচিত্র হয়ে উঠছে বার বার। পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মালতিকে উদ্দেশ্য করে শুধু বলল, আমাকে এত বড়ো শস্তি দিতে পারলে?
মালতি নিরুত্তর, প্রতিকূল স্রোতে ভাসতে ভাসতে সে তখন অন্য মানুষে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। প্রদীপ কেমন, সুবিমল কেমন, কার ভিতরে মানবিকতা বেশি, তাও জেনে নিতে কোনো কষ্ট হচ্ছে না। তাকে যে নতুন বিপদে তলিয়ে যেতে হতে পারে, সেই দুর্ভাবনার গভীরে ঢুকে পড়তে বাধ্য হল।
প্রদীপ দুঃখের গুরুভার মাথায় নিয়ে ভারী পাথর হয়ে উঠল। সালিশিতে বসে ভাঙতে ভাঙতে যে প্রদীপ এতক্ষণ খান খান হয়ে গিয়েছে, সেই ছেলেটার দুচোখে প্রতিবাদের দুরন্ত আগুন, মনের ক্যানভাসে প্রতিশোধের জ্বলন্ত লেলিহান শিখা। দ্রুত পায়ে বারান্দা টপকে একরকম লাফিয়ে নামল উঠোনে, মালতি চেয়ে থাকল তার দিকে। প্রদীপের মা কান্না থামিয়ে বলল, কোথায় যাচ্ছিস রে খোকা? আমাকে ফেলে রেখে এভাবেই চলে যাবি?
প্রদীপ সত্যি সত্যি অন্ধকারে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। কোথায় যাচ্ছে, তা প্রদীপের মা অনুমান করতে পারল না। দুখিনী মায়ের মনে তখন শুধু কালবৈশাখি ঝড়ের তান্ডব। ছেলেটা মনের তাপ সহ্য করতে না পেরে কোথায় কী করে বসে, সেই দুশ্চিন্তা মাথার ভিতরে চরকির মতো ঘুরছে। শুধু অস্ফুটে একবার বলল, আমাকে ছেড়ে এভাবে চলে যেতে পারলি? তোকে ছেড়ে থাকব কী করে বলতো?

চলবে…

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
লেখক: মুসা আলি
শিক্ষক জীবনের ৫৫ বছরে এসে সাহিত্যচর্চা শুরু। ইতিমধ্যে পঞ্চাশের বেশি উপন্যাসের মনসবদার। গল্প উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে দীর্ঘ জীবন পরিক্রমায় কঠোর বিশ্বাসী। এখন বিদগ্ধ পাঠক শুধুমাত্র কাহিনি বা চরিত্র খোঁজেন না বরং তার ভিতরে লেখক এর নিজস্ব গভীর মনন আবিষ্কার করতে চান। ঔপন্যাসিক মুসা আলি দীর্ঘ জীবন পরিক্রমার জাদুতে তার নিজস্ব মনন দিয়ে বাঙালি পাঠককে ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ করে তুলতে বদ্ধপরিকর।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!