‘ঘোড়েল’ পর্ব – আঠারো

মুসা আলি
মুসা আলি
25 মিনিটে পড়ুন

থানার ওসির গুলিতে গুরুতর আহত রঘু নিজেকে নিরাপদে রাখতে গত কয়েকদিন এখানে সেখানে কাটিয়ে শেষমেষ বিষ্ণুপুর মহাশ্মশানের পিছনে একটা পোড়ো ছোট্ট ঝুপড়িতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হল। থাকার অবস্থান ভালো না হলেও পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয় ছিল না। রঘুর ভাবনা, পুলিশের শিকার থেকে বাঁচতে বেশ উপযুক্ত জায়গা। মহাশ্মশানের সামনের মুখ মূল রাস্তার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও শ্মশানের পিছনে গজিয়ে ওঠা ঝোপঝাড়ের আড়ালে উত্তর দিকে রেললাইনের পশ্চিমপাশে একটা ঝুপড়িতে থাকতে থাকতে রঘুর বার বার মনে হতে লাগল, এখনিই চিকিৎসা করাতে না পারলে তার ডান পা’টা চিরদিনের জন্যে নষ্ট হয়ে যেতে পারে কিন্তু কাকে ধরে তা সম্ভব, ভেবে পেল না। গুরুতর ক্ষতস্থান দিন দিন আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। ধরা পড়ার ভয়ে রঘু এত সিঁটিয়ে ছিল যে ক্ষতস্থান থেকে শারীরিক যন্ত্রণা ক্রমে বাড়তে থাকলেও তা বসে বসে হজম করা ছাড়া উপায় ছিল না। কোনো বিকল্প রাস্তা খোলা ছিল না তার সামনে।
শনিবার ভোররাতে প্রবল যন্ত্রণার তোড়ে রঘুর ঘুম ভেঙে গেল। আরেকটু পরে শুনল দূর থেকে ভেসে আসা আজানের বেলালি সুর, সঙ্গে কাঁসর ঘন্টার শব্দ। বাঙালি সংস্কৃতির মেলবন্ধনের দোল রঘুর বুকে। ভাবল, আরও কিছু সময় পরে পূবের আকাশে নতুন সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়বে কিন্তু সেই ভাবনা বার বার থমকে যাচ্ছে ক্ষতস্থানের তীব্র যন্ত্রণায়, গোঙানির শব্দ মনের অজান্তে মুখ থেকে বের হয়ে আসছে। বাজার থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ঘোষাল বাড়ির যে মেয়েকে সে বউ হিসেবে গ্রহণ করেছিল, জয়ন্ত দেবনাথের মার্ডারের পরে সে যে বাপের বাড়িতে চলে যেতে পারে, তা নিয়ে রঘুর মধ্যে কোনো দ্বিধা ছিল না। জোর করে যে ভালোবাসা আদায় করা যায় না, তা বার বার মনে হতে লাগল। সবচেয়ে বেশি অবাক হল এই ভেবে, যে সুবিমলের প্ররোচনায় সে এত বড়ো কান্ড ঘটিয়ে দিতে পারল, সেই লোকটা তার সঙ্গে এভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারলেন?রঘুর স্থির বিশ্বাস, কালিতলা বাগানবাড়িতে থাকার সব তথ্য সুবিমল নিজেই ওসির কানে পৌঁছে দিয়েছিলেন, তা না হলে মার্ডারের মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে দলবল নিয়ে স্বয়ং ওসি এভাবে তাদের উপর আক্রমণ শানাতে পারতেন না। রঘু ভেবে পেল না, এর ভিতরে সুবিমলের কী রাজনীতি থাকতে পারে। জয়ন্ত দেবনাথ তাঁর শত্রুস্থানীয়, পাল্লাপাল্লি অনেক বছরের। অসহনীয়তার তীব্রতা সহ্য করতে পারেন নি বলেই তো তাকে দিয়ে এত বড়ো কান্ড ঘটালেন, তার পরেও কেন যে এভাবে নব্বই ডিগ্রি ঘুরে গেলেন, তা মাথায় এল না রঘুর। ক্ষতস্থানের যন্ত্রণা আর মানসিক যন্ত্রণা রঘুর জীবনে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। তার সামনেই দুজন সাকরেদ পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। নিজে পালাতে সক্ষম হলেও ওসির গুলিতে ডান পায়ের উরু এফোঁড়-ওফোঁর হয়ে গেছে, এখনও চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা করে উঠতে পারে নি। কেল্টে ভোল্টে গুলিতে আহত হয়েছিল কিনা, তা জানা নেই রঘুর। তারা নতুন ডেরার খবর জানলে নিশ্চয় রাতের অন্ধকার ঠেলে দেখা করতে আসত, যত অসুবিধা থাকুক চিকিৎসার ব্যবস্থাও করত। নিজেকে ভীষণ অসহায় ভাবতে বাধ্য হল রঘু।
তখনও সম্পূর্ণ সকাল হয় নি, আবছা থোকা থোকা অন্ধকার ঝোপের আড়ালে আবডালে রয়ে গেছে, রঘু ঝুপড়ির পিছনে মানুষের কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠল। পুলিশ নয় তো? মানসিক আতঙ্কে শরীরটা ঝাঁকিয়ে নিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। গতকাল থেকে কিছুই খাওয়া জোটে নি, তাতেই শরীরটা আরও কাহিল হয়ে পড়েছে। মুখের গোঙানির শব্দ কিছুতেই বন্ধ করতে পারছে না। একজন পুরুষকে শত সহস্র মানসিক জোর নিয়েও হার মানতে হচ্ছে শারীরিক ছন্দপতনের কাছে। সেই ভাবনার গভীরে রঘুর মৃতুভয় ঢুকে পড়েছে। আবার শুনতে পেল, কে যেন ঝুপড়ির পিছনে দাঁড়িয়ে বলছে, কোনো ভয় নেই রঘু।
রঘু সাহস করে বলল, কে?
আমি প্রদীপ।
এখানে আছি জানলে কী করে?
গতকাল কেল্টের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সে কিছুই বলতে পারল না, শুধু বলল, রঘুদার বউ খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছে। তারপর অনেক অনুসন্ধান করে এ ঝুপড়ি আবিষ্কার করতে পেরেছি।
কেল্টে যা বলল, তা কী সত্যি?
কোন বিষয়ে?
দেবশ্রী কি সত্যি বাড়িতে আছে?
কেল্টে আরও বলল, মেয়েটা নাকি ভীষণ কান্নাকাটি করছে।
সুবিমলের সঙ্গে বার বার ঝক্কিঝামেলার মধ্যে রঘু প্রদীপের নাম আগেই শুনে ফেলেছিল। এও জানত যে প্রদীপ সুবিমলের ঘোরতর বিরুদ্ধে। মাচার উপরে উঠে বসতেই হাউমাই করে কেঁদে ফেলল রঘু, আমাকে বাঁচাও প্রদীপদা, সেরে উঠলে তোমার কথা মনে রাখব।
ও প্রসঙ্গ থাক্ রঘু, আগে মুখ থেকে গোঙানির শব্দ বন্ধ করো।
আর পারছি নে প্রদীপদা।
তোমাকে পারতেই হবে। চারিদিকে এত লোকজন। ভোররাতে অনেকেই শ্মশানে এসেছে মৃতদেহ নিয়ে, একটু পরে সৎকার শুরু হবে, তারা জানতে পারলে বিপদের শেষ থাকবে না। রুটি তরকারি এনেছি, এগুলো খেয়ে নিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকো। আজকের মধ্যে ডাক্তার এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি।
রঘু ডান হাত বাড়িয়ে প্রদীপের বাম পা চেপে ধরল।
ছাড়ো ছাড়ো, এসব কী করছ?
আরেকটা কথা রাখবে?
কী বলো শুনি।
বাড়িতে বউ রয়েছে, ক’দিন কী খাচ্ছে জানি নে, পারো না দেবশ্রীর হাতে কিছু টাকা তুলে দিতে?
কত দিতে হবে বলো?
অন্তত হাজার খানেক।
কেল্টের হাতে দিলে হবে তো?
তাই দিও, তারপর দাঁতে দাঁত রেখে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, একটু সারিয়ে তোলো প্রদীপদা, সুবিমলকে নিজের হাতে কুপিয়ে শেষ করব।
এখন ওসব নিয়ে ভাবতে নেই।
রঘু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকল প্রদীপের মুখের দিকে। উদার মনের এই ছেলেটাকে সুবিমল ফাঁসিয়ে দিতে চেয়েছিল। শালা মানুষ নয়, খাঁটি শুয়োরের বাচ্চা। পিছন থেকে লোক লাগিয়ে তাকেও খতম করে দিতে চেয়েছিল।
আর ভাবতে পারল না রঘু, যথাসম্ভব মুখ চেপে গোঙানির শব্দ চাপার চেষ্টায় থাকল। প্রদীপ যেমন এসেছিল গোপনে, তেমনি ঝুপড়ি ছেড়ে চলে গেল।
বিষ্ণুপুর মোড়ে এসে চায়ের দোকানে ঢুকে এক অভিনব সমস্যা নিয়ে দুর্ভাবনায় জড়িয়ে পড়ল। কোন ডাক্তারকে দেখালে গোপনীয়তা বজায় রাখা সম্ভব, সেটাই মূল সমস্যার। প্রদীপের মধ্যে একটা ভয় কাজ করছে প্রবল বেগে। ডাক্তারবাবু এ ঘটনা প্রকাশ করে দিলে নিজেও নতুন বিপদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে। শেষে ভাবল, ঘা শুকোনোর জন্যে এম.বি.বি.এস ডাক্তারের কোনো প্রয়োজন নেই। এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাবার ফলে উরুর ভিতরে গুলি আটকে নেই বলেই মনে হয়েছে প্রদীপের। সেই অর্থে একজন ভালো হাতুড়ে ডাক্তার দিয়েও দেখানো যেতে পারে। মনে পড়ল নিজের গ্রামের সিদ্দিকুর ডাক্তারের কথা, বয়স মধ্যম বয়সী, ভালো অফার পেলে দিব্যি রাজি হয়ে যেতে পারেন, রাজিবুলদাকে দিয়ে চাপ তৈরি করতে পারলে এ ঘটনা প্রকাশ করতেও সাহস পাবেন না। সমস্যা হল, যাতায়াতের পথে সুবিমল লোক লাগিয়ে কোনো বিপদ তৈরি করবে না তো? ভয়ে প্রদীপের বুক কেঁপে উঠল। মনে পড়ল সুচরিতার কথা। রঘু সঙ্গে নেই বলেই নতুন এ্যাকশানে যেতে চাইবে না সুবিমল, বুকের গভীরে একটু সাহস সঞ্চারিত হল। হাত ঘড়িতে দুপুর বারোটা, বাইরে গনগনে রোদের উত্তাপ, প্রদীপের ভিতরটা চনমন করছিল ডাক্তার সিদ্দিকুরের সঙ্গে দেখা করার জন্যেই। সাইকেল নিয়ে এগিয়ে চলল সাহসে ভর করে, আধঘন্টার মধ্যে ডাক্তারবাবুর বাড়িতে পৌঁছে গেল। স্বয়ং ডাক্তারবাবু উপযাচক হয়ে বললেন, গ্রামের সকলে এখন তোমাকে চাচ্ছে প্রদীপ, সুবিমলকে কেউ আর মেনে নিতে পারছে না। পরশু দেখলুম রাজিবুলকে তোমার পক্ষে কথা বলতে।
ওসব পরে শুনব কাকু, বিশেষ দরকারে আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি।
বলো বাবা। চাপাস্বরে প্রদীপ সবকিছু বুঝিয়ে বলল।
কখন যেতে হবে শুনি?
এখনিই গেলে ভালো হয়, দুপুরে লোক চলাচল নেই বললেই চলে।
তোমাকে কোথায় দেখতে পাব?
রেলগেটে অপেক্ষা করবেন।
কত দেবে তা তো বললে না?
কত নিয়ে সন্তুষ্ট হবেন বলুন?
দুহাজার দিও।
তাই দেব।
ওটা কেবল আমার ফিজ, ওষুধের জন্য যা লাগে, তাও দিতে হবে।
অবশ্যই দেব কিন্তু প্রসঙ্গটা পাঁচকান করা চলবে না।
একথা বলতে হয় না প্রদীপ। প্রকাশ করে নিজের বিপদ নিজেই টেনে আনতে পারি না।
তাহলে কী এখনই বের হবেন?
তুমি আগে বের হয়ে যাও, মিনিট পাঁচেক পরে আমি বের হচ্ছি।
তাহলে আসছি সিদ্দিকুর কাকু।
বেলা একটা, প্রদীপ ফিরে এল বিষ্ণুপুরে। শ্মশানের সামনে দাঁড়িয়ে মিনিট পাঁচেক এদিক ওদিক ভেবে নিল। তারপর হনহন পায়ে রেলগেট পার হয়ে ট্রেনলাইনের উপর দাঁড়িয়ে আবার এক পলক এদিক ওদিক দেখে নিল। কেউ কোথাও নেই। আরেকটু সামনে সরে গিয়ে পাশের জলভর্তি নালা লাফিয়ে পার হয়ে ঝুপড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ঘুমে আচ্ছন্ন রঘু প্রদীপকে দেখেই বলল, ডাক্তারবাবু আসছেন?
সেই ব্যবস্থা করে এসেছি।
কখন আসবেন?
একটু পরে।
এ ঝুপড়ি চিনতে পারবেন তো?
রেল লাইনের উপর দাঁড়ালে বুঝতে পারবেন, সেভাবেই বলে এসেছি। এখন কেমন লাগছে?
আর সহ্য করতে পারছি নে।
খুব যন্ত্রণা হচ্ছে?
অসহ্য যন্ত্রণা, ডান পা তুলতে পারছি নে।
প্রদীপ কেমন যেন চিন্তিত হল। রঘু গাল হাঁ করে নিশ্বাস নিচ্ছে।
আরও মিনিট দশেক গেল। রেল লাইনের উপরে গিয়ে দাঁড়ালো প্রদীপ। বেদে চেনে সাপের হাঁচি। ডাক্তারবাবু প্রদীপকে দেখেই সামনে হাঁটতে শুরু করলেন। ঝুপড়ির ভিতরে ঢুকে তাঁর প্রথম প্রশ্ন, গুলি ভিতরে নেই তো?
দেখছেন তো, এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে বের হয়ে গেছে।
ভালো করে নিরীক্ষণ করতে শুরু করলেন ডাক্তার সিদ্দিকুর। শুধু যন্ত্রণা উপশমের ওষুধ দিলেন না, দ্রুত ঘা শুকিয়ে যাওয়ার জন্যে ইঞ্জেকশন করলেন।
দু-তিন দিনের মধ্যে ক্ষতস্থানের মুখ শুকিয়ে যাবে বলেও মন্তব্য করলেন। ঘন্টা তিনেক গেলে যন্ত্রণাও উপশম হয়ে যাবে।
প্রদীপের প্রশ্ন, ওষুধের জন্যে কত দিতে হবে বলুন?
হাজার খানেক দাও, আসার রিস্ক যোগ করেই বলছি।
তাই নিন।
মোট তিন হাজার নিয়ে ডাক্তারবাবু যেমন এসেছিলেন, গোপনে তেমনি সরে পড়লেন। যাবার সময় বলে গেলেন, আরও কিছু ওষুধ লাগবে, আমি সকালে সুবলের হাতে দশটার মধ্যে তোমার বাসাতে পাঠিয়ে দেব। কত লাগবে তা একটা চিরকুটে লেখা থাকবে।
প্রদীপ ডাক্তারবাবুর ব্যবস্থাপনায় বেজায় খুশি, একজন এমবিবিএস-কে ডাকলে এর চেয়ে অনেক বেশি দিতে হত। আসতেন কিনা, তা নিয়েও সন্দেহ ছিল। এ ঘটনা চেপে রাখার গুরুদায়িত্ব পালন করতে চাইতেন কিনা, তা নিয়েও যথেষ্ট সংশয়ে থাকতে হত। রঘু চাপা স্বরে ডাকল, প্রদীপদা—।
কিছু বলবে?
তোমার উপকার কোনোদিন ভুলব না।
এ প্রসঙ্গ এখন থাক না।
আবার রঘু অস্ফুটে ডাকল, প্রদীপদা—।
হ্যাঁ বলো।
বাড়িতে কী টাকাটা পৌঁছে দিতে পেরেছিলে?
পাগল ছেলে কোথাকার, ওটাই প্রথম কাজ ছিল, দুপুরের আগে কেল্টের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি।
সপ্রতিভ রঘু দুচোখ বড়ো বড়ো করে চেয়ে থাকল প্রদীপের মুখের দিকে।
আরও কিছু বলবে?
ওষুধের দাম দেওয়ার সামর্থ তো আমার নেই।
আমি কী চেয়েছি?
একাই তোমাকে এত ভার বইতে হচ্ছে?
এছাড়া তো গত্যন্তর নেই।
রঘু আবেগে প্রদীপের হাতদুটো জড়িয়ে ধরল, দুচোখ জলে পর্ণূ, অস্ফুটে আরও কী বলতে চাইল কিন্তু পারল না। ভিতরে ভিতরে অনুভব করল আত্মসমর্পনের অভিনব পরিতৃপ্তি, নির্ভরতার নতুন যাদু, আবার বেঁচে ওঠার উদ্বেলিত প্রত্যাশা।

একমাস যেতে না যেতেই গুরুতর অসুস্থ রঘু নিজের শরীরে আগের শক্তি অনেকখানি ফিরে পেল। উরুর ক্ষতস্থান প্রায় সেরে গেছে। সে যেন দুই পৃথক সত্তার সম্মিলিত মানুষ, রূপান্তরিত জীবনে প্রদীপ না চাইলেও রঘু তাকে গুরু হিসেবে বরণ করে নিল। বলদর্পীদের জীবনে আশ্রয়দাতাই ঈশ্বর, রঘুও সেই ভাবনার বাইরে আসতে পারল না। কনস্টেবলের সপাট লাঠির আঘাতে বামহাতটা তখনও একটু কমজোরি কিন্তু তা নিয়ে রঘুর মধ্যে কোনো মাথাব্যাথা নেই। মনের জোর দিয়ে শরীরের শক্তিকে টপকে যেতে চায় সে।
ঘড়িতে রাত বারোটা, রঘু গা ঢাকা দিয়ে দুর্ঘটনার পরে সেই প্রথম খটিরবাজারে ফিরল। দরজার গায়ে টোকা দিয়ে ডাকল, এ্যাই, দোর খোলো না?
পাশের ঘরে রঘুর মা শুয়ে ছিল, ডাক শুনতে পেয়ে বলল, রঘু না?
হ্যাঁগো মা।
এখন কেমন আছিস?
লাঠির আঘাতে বাম হাতের শক্তি একটু কমেছে।
সুবিমলকে শেষ করবি কবে?
তুমিও তাই চাচ্ছ?
আমার ছেলেকে যে মারতে চেয়েছে আমি কেবল তার মৃত্যু কামনা করতে পারি।
তোমার কথা রাখতে চেষ্টা করব মা।
মা ছেলের কথোপকথনে ঘুম ভেঙে গেল দেবশ্রীর। দোর খুলে দিয়ে বলল, কখন এলে?
এই তো।
ভিতরে এস, কতদিন তোমাকে দেখিনি।
তাহলে ভাবতে পেরেছ আমাকে নিয়ে?
স্ত্রী হিসেবে এ কর্তব্য ভুলে যেতে পারি? সুবিমল ঘোষাল পাড়ার অনেককে প্ররোচিত করেছিল এখান থেকে আমাকে নিয়ে যেতে। বাপের বাড়ির লোকজনও সেই মতামতে সায় দিয়েছিল, আমি রাজি হই নি। শরীরের ভিতরে যে এসেছে, তার পরিচয় মুছে ফেলতে পারি কী? সে তো তোমার আমার দুজনের। তোমার জন্যে আজ পূজো দিতে গিয়েছিলুম। প্রসাদ এনে রেখেছি, ওগুলো আগে খেয়ে নাও। তোমার আরোগ্য কামনা করে ঠাকুরের কাছে খুব করে কেঁদেছি, একটাই দাবি করেছি, স্বামীকে আর রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে দিও না।
তাহলে সুবিমলের কথা ভুলে যেতে বলছ?
দেবশ্রী মুহূর্তে অন্য নারীতে পরিণত হল।—ওই লোকটার উপর চরম প্রতিশোধ নিতে হবে তোমাকে।
তুমিও এভাবে ভাবছ?
যে আমার স্বামীকে নিতে চেয়েছে, আমিও তোমার কাছে সেই দাবি করছি। রঘু ভাবাবেগে দুলল বেশ কিছু সময়। খাটের উপর উঠে বসতেই দেবশ্রী মাথার কাপড় টেনে দিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল, পূজোর প্রসাদের পাত্র এনে রঘুর হাতে দিয়ে বলল, এগুলো খেয়ে নাও। আরও অনেক কথা হল দুজনের কিন্তু সকাল না হতেই বিষ্ণুপুরে ফিরে যেতে বাধ্য হল। তখনও একটা ভয় রঘুর মধ্যে কাজ করছে। বিষ্ণুপুরে থাকা অনেক বেশি নিরাপদ, সঙ্গে আরও অনেক সাঙ্গপাঙ্গ রয়েছে। প্রদীপদাও রয়েছে সেখানে। রঘু আগেই শুনেছিল, প্রায়দিন রাজিবুলদা বিষ্ণুপুরে আসেন প্রদীপদার সঙ্গে দেখা করতে।
পরের দিন সন্ধেয় চায়ের দোকানের আড্ডায় মসগুল ছিল রঘু। প্রদীপ প্রবেশ করতেই রঘু ‘এস প্রদীপদা’ বলে সম্ভাষণ জানালো। সেই সঙ্গে একটা নতুন তথ্য পেল। তার চিকিৎসার সব খরচ দিয়েছিলেন রাজিবুলদা নিজেই কিন্তু প্রদীপদা তখন তা প্রকাশ করতে পারেন নি কেন, সেই প্রশ্নটা রঘুর মাথায় ঘুরছে। তার কৌতূহলী প্রশ্ন, কেন এত বড়ো সত্য চেপে রাখলে তা বলবে?
ঝুপড়িতে থাকাকালীন ধরা পড়লে সেই তথ্য ফাঁস হয়ে যেত, পুলিশ রাজিবুলদাকে নিয়ে টানাহ্যাচড়া না করে ছাড়ত না।
আরও মাসখানেক পরে আমূল পরিবর্তন ঘটে গেল রঘু বনাম থানার ওসির তীব্র টানাপোড়েনে। গুরুতর অভিযোগ নিয়ে মথুরাপুর থানার ওসি রঘুর বিরুদ্ধে কোর্টে যে মামলা ঠুকে দিয়েছিল, তাতেই ওয়ারেন্ট বের হয়েছে রঘুর নামে।
ক’দিন আগে রাজিবুল নিজের উদ্যোগে রঘুকে কোর্ট থেকে জামিন করিয়ে এনেছেন। তারপর থেকে লোকালয়ে বুক ফুলিয়ে চলতে রঘুর কোনো অসুবিধা হচ্ছে না, তবে একটা ভয় থেকে তখনও মুক্ত হতে পারে নি সে। বিবাহঘটিত কারণে ঘোষালদের সঙ্গে যে বৈরিতা তৈরি হয়েছে, সেই ভয় রঘুর মন থেকে মুছে যায় নি।
গতকাল সন্ধেয় মহাশ্মশানের সামনে সদর রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল রঘু, কুল্পি থেকে সভা সেরে প্রদীপ ফিরলে তাকে সঙ্গ দিতে হবে। এক সময়ের প্রাইভেট টিউটর প্রদীপ এখন পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ। তরুণ নেতৃত্ব, কূটনীতির মূল শাঁস আত্মগত করার চেষ্টায় একান্তই নিবেদিত প্রাণ। সেই আন্তরিকতা রঘুকে ভীষণ ছুঁয়ে যায়। কথায়, আন্তরিকতায় ও কাজে এক হওয়ার সূত্রে প্রদীপ রঘুর চোখে নতুন মডেল হয়ে উঠেছে। তাছাড়া জীবনরক্ষক হিসেবে প্রদীপের কাছে রঘুর কৃতজ্ঞতারও শেষ নেই।
নির্দিষ্ট সময়ে প্রদীপ পৌঁছাতে না পারায় রঘু কেমন যেন চিন্তিত হয়ে পড়ল। তাহলে কী বাস থেকে নেমে পশ্চিমে সরে গিয়ে কারুর সঙ্গে কথা বলছে? রঘু পায়ে পায়ে সামনে সরে এসে দেখল, তাকে দেখেই ত্রস্ত সুবিমল লক্ষ্মীকান্তপুরগামী অটোতে উঠে বসেছেন। গায়ের রক্ত গরম হয়ে উঠলেও কিছুই করার ছিল না।
সেই কৌতূক নিয়ে রঘু গতকাল থেকে বেশ মজায় রয়েছে। ঘোষালদের কারণে সে খটিরবাজারে যেতে ভয় পায়, তার ভয়ে সুবিমল পালিয়ে বাঁচতে অটোতে উঠে বসতে বাধ্য হলেন। একটা বিশেষ অনুভূতি রঘুকে বার বার ধাক্কা দিতে থাকল। ভিতরে পাপচেতনা থাকলে মানুষকে এভাবেই কী পলায়নমুখী হয়ে চলতে হয়? আভ্যন্তরীণ তাগিদ কী সাংঘাতিক, তাতেই মজে থাকল রঘু।
দেবশ্রীর বিপরীতমুখি ভাবনায় জীবনের আরেকটা নতুন সত্য আবিষ্কার করতে পেরেছে রঘু। গুলিতে আহত হওয়ার পরে মেয়েটা দিব্যি তার বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারত কিন্তু সেই পথে হাঁটেনি দেবশ্রী, বরং তার সুস্থতা কামনা করে ঠাকুরের কাছে পূজো দিয়েছে অথচ বিয়ের পরে এই মেয়েটির উপলব্ধি ছিল, তার পরিচয়ে কিছুতেই সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে পারবে না সে।
রঘুর হাতের মুঠো শক্ত হয়ে উঠল, নিজেই শরীরের ভিতরে অভিনব কাঁপুনি অনুভব করতে পারছে। সুবিমল এতই নিষ্ঠুর? পরাজিতদের স্বভাবসিদ্ধ বৈশিষ্ট্য হল অন্য জয়ীদের টেনে এনে নিজের সমতলভূমিতে নামিয়ে আনা। ক্ষেত্রবিশেষে সেই ধারণা প্রাগৈতিহাসিক। সেই চেতনার গভীরে ঢুকে রঘু একান্তভাবে চাচ্ছে সুবিমলকে টেনে নিজের স্তরে নামিয়ে আনতে। সুবিমলের কূটনৈতিক ক্যারিশমাকে রঘু নিজের শরীরী যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছে না।
প্রদীপ ফিরল সাতটার পরে, রঘু ততক্ষণ পর্যন্ত মহাশ্মশানের সামনে অপেক্ষায় ছিল। শরীর দিয়ে পৃথিবী জয়ের নেশা তার আজন্ম অধিকার, কোথাও তা লঙ্ঘিত হলে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না সে। না পারার যন্ত্রণা দূর করতেই তো প্রদীপকে বস হিসেবে মেনে নিতে হয়েছে। বুকের গভীরে সুপ্ত প্রত্যাশা, প্রদীপকে ধরে সে শুধু নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না, আগের প্রতিপত্তিও ফিরে পেতে পারে। সেই ইচ্ছার টানে একটু সাহস দেখিয়ে সন্ধের পরে গা ঢাকা দিয়ে বাপুলি বাজার পর্যন্ত যেতে সাহস দেখাতে শুরু করল রঘু। কেল্টে ভোল্টেকে সঙ্গে নিয়ে থানার চারপাশে চক্কর মেরে বিষ্ণুপুরে ফিরে আসাই রঘুর জীবনে সাম্প্রতিক রুটিন হয়ে উঠেছে।
প্রদীপ বাস থেকে নেমে যে খবর দিল, তাতে রঘু রাগে অগ্নিশর্মা না হয়ে পারল না। মথুরাপুর থানার পাশে হাইস্কুল মাঠে সভা করার জন্য যে আবেদন করা হয়েছিল, ওসি তা সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন। শান্তি শৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে বলেই তাঁর এই সিদ্ধান্ত। পিছনে যে সুবিমলের কূটনৈতিক চাল রয়েছে, তা রঘু যেমন বুঝল, তেমনি বুঝল প্রদীপ ও রাজিবুল, শারীরিক শক্তি প্রয়োগের গ্রুপটা প্রদীপের পক্ষে চলে আসায় সুবিমলকে কেমন যেন ভয়ে ভয়ে থাকতে হচ্ছে। সেই ভয় কাটাতে ওসিকে ধরে সভা বানচালের সিদ্ধান্তটুকু করিয়ে নিতে পেরেছেন। একটু আগে এসে প্রদীপকে না পেয়ে রাজিবুল সাফ জানিয়ে দিয়ে গেছেন, নির্দিষ্ট দিনে সভা হবেই, প্রয়োজন হলে S.D.O.-র কাছ থেকে তিনি স্পেশাল পারমিশন করিয়ে আনবেন।
শরীরী ভাবনার নায়ক রঘু রাজিবুলের ভাবনাকে ধর্তব্যের মধ্যেই নিল না। ওসি, এসডিও নামগুলো উচ্চারিত হলেই তার শরীরী প্রভাব কেমন যেন থিতিয়ে যায়, নেতিয়ে পড়ে। বলিষ্ঠ চেহারার রঘু মুষ্টিবদ্ধ দুহাত মাথার উপরে তুলে প্রদীপকে জানিয়ে দিল, সে সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে সভার নিরাপত্তা সম্পূর্ণভাবে দিতে পারবে। প্রদীপকে শুনিয়ে বলল, ওসব নিয়ে কিস্সু ভেব না প্রদীপদা, আমিই তো রয়েছি, সভায় এসে কোনো ব্যাটাকে হাঙ্গামা করতে দেব না। মাঝে কটাদিন এখানে থাকব না, একটু সাবধানে থেকো।
কেন রে, যাবি কোথায়?
ফিরে এসে বলব।
আরে, বল না শুনি।
মেদিনীপুরে একটা খেপ দিতে হবে, হাত একেবারে ফাঁকা।
প্রদীপ গুম হয়ে চেয়ে থাকল রঘুর দিকে। সুন্দরবনের কূটনীতির আড়ালে লুকিয়ে থাকা এমনি দেহজ ভাবনা ও কাজকর্মকে তাকে প্রশ্রয় দিতেই হবে।
পরের দিন সকালে রঘু সত্যি সত্যি নিজের চত্বর থেকে উধাও হয়ে গেল। বিষ্ণুপুরকে শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে প্রতিপন্ন করতে বাইরের বেশ কিছু সঙ্গীসাথী বিশেষ প্রয়োজন। কখনো নিজে গেল তাদের দরকারে, ইচ্ছা করলেই নিজের প্রয়োজনে তাদের ডেকে নিতে পারবে। আত্মনিমগ্ন নতুন পাশবিক নায়কের নাম রঘু। সুন্দরবনের রাজনীতি আবহমানকাল মাড়িয়ে এদের বাহুবলের উপর নির্ভর করে চলে আসছে।
রাজিবুল এসডিও অফিস থেকে সভার জন্য সরাসরি পারমিশন করিয়ে এনেছেন, তাতেই প্রাথমিক সমস্যা মিটে গেলেও রঘুকে দেখতে না পেয়ে প্রদীপের দুশ্চিন্তা রোজ রোজ বেড়ে চলেছে। সভার দিনও এগিয়ে আসছে। হাতে মাত্র দুটো দিন বাকি। অনেক কাজ পড়ে রয়েছে, জয়নগর সংগঠনকে সঙ্গে নিতে হবে, কুল্পিতে ইতিমধ্যে কর্মীসভা করা হয়েছে, রায়দিঘী থেকে সকলে আসার জন্যে কথা দিয়েছে। ঢোলা সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অন্তত হাজার তিনেক লোক যাবে কিন্তু তাদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে হবে। এ নিয়ে একটা ঝক্কিঝামেলা রয়েছে যদিও রাজিবুলদা বলে দিয়েছেন, ওসব নিয়ে ভেবো না, সব সামলে নেব।
পরের দিন সভা, প্রায় সব আয়োজন শেষ। প্যান্ডেল বাঁধার কাজ দুপুরের মধ্যে শেষ হবে। প্রদীপ লোক পাঠিয়ে খবর নিয়ে জানতে পারল যে মিনিট কুড়ির মধ্যে মঞ্চ সাজানোও শেষ হয়ে যাবে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, তবুও রঘুর দেখা নেই। প্রদীপের মাথায় দুশ্চিন্তার খেলা শুরু হয়ে গেছে। ছেলেটা কোনো বিপদে জড়িয়ে পড়ল না তো? তা না হলে এভাবে দেরি করছে কেন? অবশ্য একান্ত খারাপ খবর থাকলে তা পেপারে প্রকাশ পেত। সন্ধের পরে প্রদীপ রেলগেটের উপরে দাঁড়িয়ে দেখল, মহাশ্মশানের পিছনে সেই ঝুপড়ির ভিতরে মিটমিট করে ল্যাম্প জ্বলছে, হতভম্ব হল, নতুন কেউ এসে রঘুর ডেরা দখল করে নিল নাতো? পায়ে পায়ে উত্তরে সরে গিয়ে পাশের জলভর্তি সরু নালা টপকে ঝুপড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
কে প্রদীপদা?
ফিরলি কখন?
আজ বিকেলে।
একটা খবর পর্যন্ত দিতে পারলি নে?
খুব ভুল হয়ে গেছে প্রদীপদা।
তো এখানে এসেছিস কেন?
এটাই আমার নতুন করে বেঁচে ওঠার ডেরা, কাজ সেরে আসার পরে কেমন যেন মায়া হল, তাই ল্যাম্প জ্বালিয়ে বসে আছি।
কাল বিকেলে সভা, তা মনে আছে?
জেনে গিয়েছিলুম, ঠিক সময়ে ফিরেও এসেছি। বেশ কয়েকজন নতুন সাকরেদ সঙ্গে আনতে পেরেছি। পাশে বসে থাকা একজনের গজরানি, আপনার সভা রুখে দেওয়ার ক্ষমতা কোনো শ্যালার নেই, কাল দলবল নিয়ে উপস্থিত থাকব।
নীরব থেকে প্রদীপ রঘুর নতুন শক্তি সঞ্চয়ের মজা উপভোগ করতে লাগল তারিয়ে তারিয়ে। বলল, এখানে থাকবি কতক্ষণ?
এইতো এক্ষুণি চলে যাব, তুমি বসবে না?
নারে, অনেক কাজ বাকি, একবার জয়নগরে যেতে হবে। হরির দোকানে বলে যাচ্ছি, খাসির মাংস আনিস, নতুন সঙ্গীদের ভালো মতো আপ্যায়ণ করতে হবে তো।
রঘু হাসল মুখ মুচকে, প্রদীপদা এমনিই জীবনভোক্তা। তা কদিনেই টের পেয়েছিল সে। সুবিমলের তুলনায় মানবিকতায় অনেক ভালো। কূটনীতির কন্দরে মানবিকতা প্রথম স্থানে থাকলে তা মানুষের প্রকৃত মঙ্গলে পরিণত হয়। প্রদীপদা সেটাই করে দেখাতে পারে। রঘুর নতুন সাকরেদরা সেই মূল্যায়ন শুনে বেশ আপ্লুত হল।
মজার ব্যাপার, এত আয়োজনের পরেও পরের দিন জনসভায় তেমন লোকসমাগম হল না। রঘুরা যথারীতি সদলবলে উপস্থিত থাকলেও সুবিমল সুকৌশলে লোক লাগিয়ে সাধারণ মানুষের যোগদানে এমনিই বাধা সৃষ্টি করলেন যে প্রদীপ শত চেষ্টা করেও আসর জমাতে পারল না, খুব বেশি হলে হাজার তিনেক মানুষ জড়ো হল প্রদীপ-রাজিবুলের বক্তব্য শুনতে, অবশ্য কিছু কৌতূহলী শিক্ষিত মানুষ জড়ো হয়েছিল, সেই ভিড়ে জয় চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। ছেলেটা সত্যি সত্যি মাকাল ফল, Night Watch Man-এর ভূমিকায়ও দারুণভাবে সফল।
মিনিট চল্লিশের বক্তব্যে প্রদীপ সবিস্তারে বর্ণনা করল তাদের মতাদর্শের কথা, জনকল্যাণে কতটা ফলবতী হতে পারে, তা নিয়েও বিস্তৃত বিবরণ দিল। তারপর শুরু করল সুবিমলের উপর ঝাঁঝালো আক্রমণ। যুক্তি দিয়ে, তাৎক্ষণিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা করে, মননশীলতা দিয়ে বেশ জোরের সঙ্গে জানালো, জয়ন্ত দেবনাথের অকালমৃত্যুর জন্যে সুবিমল দায়ী। সুবিমল কাকে দিয়ে খুন করিয়েছেন, আপনারা অনেকেই তা জানেন। মানুষের মঙ্গল নিয়ে নানা কথা বলে থাকেন কিন্তু নিজেই গণতন্ত্র মানেন না, খুনের রাজনীতিতে হাত পাকাতে পাকাতে নিজেই নিজেকে পাকা খুনি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন।
রাজিবুল শেষ বক্তা হিসেবে জানালেন, আপনাদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও পরে পরে উপলব্ধি করতে পারবেন, প্রদীপ আজ কত বড়ো সত্য প্রকাশ করে দিল। হাসপাতালে শিশুপাচারের সঙ্গেও এই সুবিমল জড়িত। সরকারি দলে আছে বলেই হয়তো ভাবছেন, যা খুশি তাই করতে পারেন, কিন্তু তা কী সম্ভব? মানুষের বিচার হল আসল বিচার, তাতে ফেল করলে জনসমর্থন হারিয়ে আস্তাকুড়েই পড়ে থাকতে হবে।
জনসভা শেষ হতেই প্রদীপ ফিরে গেল বিষ্ণুপুরে, রঘুরাও চলে গেল সেখানে। পরের দিন এক দৈনিক খবরের কাগজ ফলাও করে সুবিমলের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগগুলোর সূক্ষ্ম পর্যালোচনা বের করল, তাতেই সাধারণ মানুষের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হল, তাহলে কী সুবিমল প্রকৃত অর্থে এই ধরণের লোক? ওই ছেলেটাই তো এতদিন সুবিমলের পক্ষে ছিল, তাকে দিয়ে এত বড়ো অপকান্ড করিয়ে নিতে পারলেন?
সভা থেকে ফিরে যাওয়া একজনের মন্তব্য, রঘু ঘোষালের মেয়েকে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল, মেয়েটা এখন ওর সঙ্গে আছে কী? আরেকজনের টিপ্পনি, নিজেই গ্রামে থাকে না, ঘোষালদের শিক্ষিত মেয়ে ওর কাছে থাকবে কেন? কিসে আর কিসে, কতদিন চলবে ন্যায় অন্যায় মিশে।
তৃতীয়জনের কৌতুক প্রশ্ন, দাদা কবিতা লেখেন নাকি? বেশ তো মিল করে বলে দিতে পারলেন।

চলবে…

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
লেখক: মুসা আলি
শিক্ষক জীবনের ৫৫ বছরে এসে সাহিত্যচর্চা শুরু। ইতিমধ্যে পঞ্চাশের বেশি উপন্যাসের মনসবদার। গল্প উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে দীর্ঘ জীবন পরিক্রমায় কঠোর বিশ্বাসী। এখন বিদগ্ধ পাঠক শুধুমাত্র কাহিনি বা চরিত্র খোঁজেন না বরং তার ভিতরে লেখক এর নিজস্ব গভীর মনন আবিষ্কার করতে চান। ঔপন্যাসিক মুসা আলি দীর্ঘ জীবন পরিক্রমার জাদুতে তার নিজস্ব মনন দিয়ে বাঙালি পাঠককে ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ করে তুলতে বদ্ধপরিকর।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!