ঘোড়ামারা: দ্বীপের চোখে জল

লিটন রাকিব
লিটন রাকিব - সাহিত্য সম্পাদক
6 মিনিটে পড়ুন
ছবি: দেবদুলাল পাঁজা

সাগর বিধানসভার দুটি খন্ডিত অংশের একটি ঘোড়ামারা দ্বীপ। এই দ্বীপের ভৌগোলিক অবস্থান এইরকম পূর্বে হুগলি নদীর মোহনা এবং কাকদ্বীপের হারউড পয়েন্ট। পশ্চিমে হুগলি ও হলদি নদীর মোহনা নয়াচর দ্বীপ এবং পূর্ব মেদিনীপুরের তালপাট্টি। উত্তরে হুগলি নদীর মোহনা এবং হলদিয়া বন্দর। আর দক্ষিণে হুগলি নদীর মোহনা এবং সাগরদ্বীপের কচুবেড়িয়া। অতিবৃদ্ধদের মুখে শোনা যায়, একটা সময় ঘোড়ামারার এই দক্ষিণ দিকটি পার্শ্ববর্তী লোহাচড়া (অধুনা নদীগর্ভে বিলুপ্ত) দ্বীপ হয়ে সাগরদ্বীপের সংগে ছোট একটি খালের ব্যবধানে অবস্থিত ছিল। এখন লোহাচড়া দ্বীপ বিলুপ্ত হওয়ার পর সাগর এবং ঘোড়ামারার মধ্যে কয়েক কিলোমিটারের ব্যবধান। সে সময় লোহাচড়াকে বলা হতো দক্ষিণ ঘোড়ামারা আর এখনকার ঘোড়ামারাকে উত্তর ঘোড়ামারা। বলাবাহুল্য, হুগলি নদীর এই যে মোহনা তা কিন্তু আঞ্চলিকভাবে মুড়িগঙ্গা নামেই পরিচিত।

ক ঘোড়ামারা: দ্বীপের চোখে জল
ছবি: দেবদুলাল পাঁজা

ঘোড়ামারা, যার ডাকনাম ডুবন্ত দ্বীপ যা বর্তমানে সেখানে সাড়ে তিন হাজার ভোটার সহ প্রায় কমবেশি পাঁচ হাজার মানুষের বসবাস। ১৯৬৯ সাল থেকে এই দ্বীপের অবিরাম ভাঙন চলছে আর ছোট হতে হতে এই দ্বীপ নদীগর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। আস্ত লোহাচড়া দ্বীপকে হুগলি নদী শুধু খায় নি। ঘোড়ামারার বৈষ্ণব পাড়া, খাসিমারা গ্রামের ৯৫ ভাগ, হাটখোলা গ্রামের প্রায় সবটাই, রায়পাড়া ও চুনপুড়ি পুবপাড়ার ৮০ ভাগ আর বাগপাড়া গ্রামের প্রায় ৫০ ভাগ এখন নদীগর্ভে। বৈষ্ণব পাড়াতেই একদা ছিলো “মার্ড পয়েন্ট ডাকঘর।” এই ডাকঘর ভারতবর্ষের প্রাচীনতম ডাকঘরগুলির একটি ছিলো। ইংরেজরা তিন তলা প্রাসাদোপম এই ডাকঘরটি বানিয়েছিল। সেইসংগে এটি ছিলো পশ্চিমবঙ্গের দুটি প্রথম ডাকঘরের একটি যেখান থেকে উন্নত প্রযুক্তিগত সুবিধায় টেলিগ্রাফ করা যেতো। ঠাঁইনাড়া হতে হতে আজও সেই প্রাচীন ডাকঘর এই দ্বীপের প্রাণ হয়ে আছে। অধিবাসীদের ব্যাঙ্কও এই ডাকঘর। কেননা কোনো ব্যাঙ্ক এখানে নেই। ভূমি দপ্তরের নথি অনুযায়ী একদা ২৯ হাজার বিঘের এই দ্বীপের অবশিষ্ট আর মাত্র ৩ হাজার বিঘে ভূমি। বৃক্ষরোপণ করে, বাঁধ দিয়ে, দক্ষিণ ভারত থেকে এনে “ভেটিভার” নামের ভূমিরক্ষক ঘাস লাগিয়েও ঘোড়ামারার ভাঙন রোখা যায় নি। ২০১০ সালের পর থেকে ভাঙন ক্রমশ তীব্র হচ্ছে, বিশেষত দ্বীপের উত্তর-পূর্ব দিক বরাবর। বঙ্গোপসাগর থেকে ৪০ কি.মি. উজানে হুগলি নদীর মোহনায় অবস্থিত ঘোড়ামারা দ্বীপটি সমুদ্র সমতল থেকে মাত্র ১ মিটারের মতো বা তারও থেকে কম উঁচু। ফলে বিপদ এই দ্বীপের সর্বাঙ্গ জুড়ে।

খ ঘোড়ামারা: দ্বীপের চোখে জল
ছবি: দেবদুলাল পাঁজা

যুগ যুগ ধরে বাস করা বহু মানুষের ভিটেমাটি জলস্রোতে হারিয়ে যাওয়ায় কেউ চলে গেছেন সাগরদ্বীপে, কেউ কাকদ্বীপে বা সুন্দরবনের অন্যত্র। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, একটি পঞ্চায়েত (৫ টি বুথ), সুফলা মাটি সবই আছে এখানে। তবু্ও মানুষ এখানে প্রতিমুহূর্তে নিরাপত্তাহীন। দ্বীপ যা পাওয়া যায় না তার জন্য জলপথে কাকদ্বীপে যাওয়া ছাড়া এখানকার মানুষের কাছে আর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু, আর কতদিন এই দ্বীপের অস্তিত্ব থাকবে কেউ জানে না। সঙ্গিনী লোহাচড়ার মতোই কী তাহলে একই ভবিতব্য লেখা আছে ঘোড়ামারার কপালে! রাজ্যের বাম সরকার এই দ্বীপকে বাঁচানো অসম্ভব বুঝে ২০০১ সালে ঘোষণা করেছিলো “নো ম্যানস্ ল্যান্ড” হিসেবে। সাগরদ্বীপে পুনর্বাসনের পরিকল্পনাও করা হয়েছিলো তখন। কিন্তু ভিটেমাটি ছেড়ে কেউ কেউ গেলেও অনেকেই থেকে গেছেন মাটির টানে। এক একজন ৮-১০ বার ভিটে হারিয়েও থেকে গেছেন এখানেই।

g ঘোড়ামারা: দ্বীপের চোখে জল
ছবি: দেবদুলাল পাঁজা

বাড়ছে সমুদ্রের জলস্তর, প্রতিদিন মাটি গিলে খাচ্ছে নদী। তার সংগে বছর বছর, ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস দ্বীপ আগলে থাকা হাজার খানেক পরিবারকে সর্বস্বান্ত করে রেখেছে প্রতিনিয়ত। ২০২১ -এর এই মে মাসের শেষে ইয়াস (যশ) নামের দামবটি দ্বীপ ঘোড়ামারাকে বিষাক্ত ছোবলে তছনছ করে দিয়েছে। ধানের জমি, পুকুর -জলাশয়, সবজীর ক্ষেত এবং পানের বরজ সবই বিষাক্ত নোনা জলে প্লাবিত। মরা মাছ আর গবাদি পশুর লাশ ভাসছে কাছে-দূরে। ঘরবাড়ি ধূলিসাৎ।

- বিজ্ঞাপন -
gh ঘোড়ামারা: দ্বীপের চোখে জল
ছবি: দেবদুলাল পাঁজা

পানীয় জলের জন্য দুমুঠো ভাতের জন্য হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ আজ হাহাকারে আকাশ ভরিয়ে তুলছে। স্থানীয় প্রশাসন পাশে থাকলেও দ্বীপের সর্বত্র পৌঁছনোই একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। কারণ সব পথই জলের তলায় এখনো। আশার কথা কাকদ্বীপ এবং দূর-দূরান্ত থেকে বহু মানুষ ও সংস্থা কেউ রান্না করা খাওয়ার, কেউ আবার শুকনো খাবার, জল এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে আসছেন মেসিনচালিত নৌকো করে। একগলা জলে নেমে সেই ত্রাণ তুলে দিচ্ছেন দুর্গত মানুষের হাতে। প্রায় প্রতিদিনই। জল না-নামা পর্যন্ত, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না-হওয়া পর্যন্ত এই মানবিক কর্মসূচি চালিয়েই যেতে হবে।

7 ঘোড়ামারা: দ্বীপের চোখে জল
ছবি: দেবদুলাল পাঁজা

হুগলি নদীর মোহনায় জেগে থাকা ঘোড়ামারা দ্বীপটি লোহাচরা দ্বীপটির মতন পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়নি এখনো, কিন্তু ১৯৬৯ সাল থেকে অবিরাম ভাঙনে এই দ্বীপের খাসিমারা গ্রামের ৯৫ ভাগ, হাটখোলা গ্রামের প্রায় সবটাই, রায়পাড়া ও চুনপুড়ি পুবপাড়ার ৮০ ভাগ, আর বাগপাড়া গ্রামের ৫০ ভাগ ইতিমধ্যে চলেই গেছে নদীগর্ভে! ২৯ হাজার বিঘের আর অবশিষ্ট মাত্র ৩ হাজার বিঘে….

6 ঘোড়ামারা: দ্বীপের চোখে জল
ছবি: দেবদুলাল পাঁজা

সাম্প্রতিক ইয়াস এসে সেটুকুও এক্কেবারেই তছনছ করে দিয়েছে, সুন্দরবন অঞ্চলের অন্যান্য বহু অংশের মতনই। ঘরবাড়ি ধুলিস্যাৎ, ধানের জমি, সবজির খেত, পুকুর-জলাশয়, পানের বরজ সবই বিষাক্ত লোনা জলে প্লাবিত। গবাদি পশুর লাশের গন্ধ, আর মানুষের করুণ হাহাকারে ভরে উঠেছে বাতাস, কোথায় পানীয় জল, আর কোথায় দু-মুঠো খাবার, ভাড়া করা যন্ত্রচালিত নৌকা বা ট্রলার ছাড়া ওখানে যাওয়া সম্ভবই নয় একেবারেই, দ্বীপের ভেতরে যাওয়াও প্রায় দুঃসাধ্য। কোনো সহৃদয় মানুষ বা প্রতিষ্ঠান যদি এগিয়ে আসতে চান অন্তরের সহযোগিতা বা ত্রাণকার্য্যে “মানুষ বড়ো কাঁদছে।” এই লেখা পড়ে যদি কারোর হৃদয় কাঁদে… মনে হয় মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াবেন।যোগাযোগ করতে পারেন এই নম্বরে দেবদুলাল পাঁজা +918918371004

ছবি ও কৃতজ্ঞতা: দেবদুলাল পাঁজা, কাকদ্বীপ শিশু শিক্ষায়াতন হাইস্কুল (উঃ মাঃ)

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
সাহিত্য সম্পাদক
লিটন রাকিব মূলত কবি। সহজ সরল ভাষা ও গভীর জীবনবোধ থেকে উৎসারিত তাঁর সৃষ্টি। ভালোবাসেন অরন্যের মত নির্জনতা। প্রথম কবিতা গ্রন্থ 'ঋতুর দান', ছড়া গ্রন্থ 'ছড়া দিলেম ছড়িয়ে' এবং সম্পাদিত গ্রন্থ 'গ্রামনগর ' এছাড়াও দীর্ঘদিন সম্পাদনা করে আসছেন 'তরঙ্গ ' পত্রিকা। প্রতিষ্ঠা করেছেন ভিন্নধর্মী সংগঠন 'আলোপথ'। তিনি নিয়মিত একাধিক দৈনিক সংবাদ পত্র সহ অনান্য পত্রিকায় লিখে চলেছেন। দেশে বিদেশে একাধিক সম্মানে সম্মানিত তরুন এই কবি ও গবেষক। এছাড়াও তিনি সাময়িকী'র সাবেক সাহিত্য সম্পাদক।
মন্তব্য নেই

Log In

Forgot password?

Don't have an account? Register

Forgot password?

Enter your account data and we will send you a link to reset your password.

Your password reset link appears to be invalid or expired.

Log in

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!