বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ৭ আন্তর্জাতিক সংগঠন
আগামী ৭ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি ও নাগরিক অধিকার সংকোচনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ৭ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন। মার্কিন মানবাধিকার সংগঠন রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস স্থানীয় সময় আজ বুধবার তাদের ওয়েবসাইটে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আকারে এই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এতে সংগঠনগুলো বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকারের কাছে ৫টি সুপারিশও করেছে।
রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস ছাড়াও অন্য সংগঠনগুলো হলো—ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট জাস্টিস প্রজেক্ট, ইউনাইটেড অ্যাগেইনস্ট টর্চার কনসোর্টিয়াম, এশিয়ান ফেডারেশন অ্যাগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স, অ্যান্টি-ডেথ পেনাল্টি এশিয়া নেটওয়ার্ক, ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন অ্যাগেইনস্ট এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ও এশিয়ান ফোরাম ফল হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষের দিক থেকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো আয়োজিত সমাবেশ ও বিক্ষোভের পর থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বিক্ষোভ ও রাজনৈতিক ভিন্নমত দমন করতে সহিংসতার আশ্রয় নিয়েছে। এই ক্র্যাকডাউনের ফলে এক সাংবাদিকসহ ১৭ জন নিহত হয়েছে এবং ৮ হাজার ২৪৯ জন বিরোধী নেতা আহত হয়েছে। বিবৃতিতে আরও কিছু এমন ঘটনার উল্লেখ করে এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় আনা, সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ডের সম্পূর্ণ ও স্বাধীন তদন্তের ওপর তাগিদ দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর যেসব কর্মকর্তা ক্ষমতার অপব্যবহার ও বল প্রয়োগ করেন তা মোকাবিলায় অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার বলেও উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে। এতে পুলিশের লাঠি চার্জ, টিয়ার গ্যাসের ব্যবহার রাবার বুলেট ব্যবহারের প্রসঙ্গে বলা হয়—এ ধরনের হাতিয়ারের অসম ব্যবহার কেবল নাগরিকদের মৌলিক অধিকারই লঙ্ঘন করে না বরং উত্তেজনা উসকে দেয়। এমন পরিবেশ তৈরি করে যা ভিন্নমত, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে। এতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে জাতিসংঘের মৌলিক নীতি ও মানবাধিকার নির্দেশিকা মেনে চলার ব্যাপারেও আহ্বান জানানো হয়।
সংস্থাগুলোর যৌথ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, গত অক্টোবর মাসের শেষ থেকে বাংলাদেশ সরকার ব্যাপক আকারে ধরপাকড় চালিয়ে ২০ হাজারেরও বেশি বিরোধী নেতা-কর্মীকে আটক করেছে। তাদের বিরুদ্ধে ৮৩৭টি বানোয়াট মামলা রয়েছে এবং এসবের বিপরীতে তাদের জামিন বারবার প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে। এসব বন্দীদের শারীরিক নির্যাতন করা হচ্ছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে বিবৃতিতে।
![বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ৭ আন্তর্জাতিক সংগঠন 36 বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ৭ আন্তর্জাতিক সংগঠন](http://www.samoyiki.com/wp-content/uploads/2022/12/bnp-1024x542.jpeg)
আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সম্ভাব্য বিরোধী প্রার্থীদের অযোগ্য ঘোষণা করার জন্য আদালতের কার্যকাল বাড়িয়ে বিচারের মাধ্যমে প্রধান বিরোধী নেতাদের ব্যাপকভাবে দোষী সাব্যস্ত করতে সরকার বিচার বিভাগকে পদ্ধতিগতভাবে ব্যবহার করছে বলেও উল্লেখ করা হয় ওই যৌথ বিবৃতিতে। এতে বলা হয়, ব্যাপক আটক ও দোষী সাব্যস্ত করার বিষয়টি কেবল মত প্রকাশ, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার, স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত অধিকার ও ন্যায় বিচারের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করে না বরং অসংখ্য পরিবারকে দুর্দশায় ফেলে দেয়, কারণ আটকেরা প্রায় ক্ষেত্রেই তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
আন্তর্জাতিক এই সাতটি সংগঠন তাদের যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশে সহিংসতা ও নির্বিচারে আটক দেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের অবস্থার এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। এই অপব্যবহার একটি সামাজিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সংঘটিত হয়েছে—যেখানে জনগণ আগামী জানুয়ারিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি করছে। গণতন্ত্রের মৌলিক নীতিগুলোকে সমুন্নত রাখার পরিবর্তে, বাংলাদেশ সরকারের সহিংস ও দমনমূলক প্রতিক্রিয়া ‘নাগরিকদের মধ্যে ভয়, উদ্বেগ ও চরম নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ তৈরি করেছে।’
বাংলাদেশের খসড়া ডেটা সুরক্ষা আইনকেও আরেকটি উদ্বেগজনক বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেছে উল্লিখিত সংগঠনগুলো। খসড়া এই আইন অনুসারে—‘জাতীয় সুরক্ষা, কোনো ধরনের অপরাধ ঠেকানো বা শনাক্তকরণের জন্য প্রয়োজনীয় বলে মনে হলে আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের ডেটা অ্যাকসেস করতে পরাবে।
![বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ৭ আন্তর্জাতিক সংগঠন 37 বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ৭ আন্তর্জাতিক সংগঠন](http://www.samoyiki.com/wp-content/uploads/2023/06/bnp.jpg)
এ বিষয়ে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘এ ধরনের ক্ষমতার অপব্যবহার ব্যাপক নজরদারির দিকে পরিচালিত করতে পারে। এটি রাজনৈতিক ভিন্নমত পোষণকারীদের এবং মানবাধিকার, বিশেষ করে গোপনীয়তার অধিকারের জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। যেসব ক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহ ও অ্যাকসেসের প্রয়োজন সেগুলোকে অবশ্যই স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা উচিত।’
আন্তর্জাতিক এই সংগঠনগুলো তাদের যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, ‘একটি সুষ্ঠু, গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ সমাজের লক্ষ্যে বাংলাদেশের জনগণের যে সংগ্রাম তার সমর্থনে আমরা তাদের পাশে আছি। আমরা দৃঢ়ভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য করে সহিংসতা, দমন-পীড়ন এবং ভয় দেখানো অবিলম্বে বন্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছি।’
![বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ৭ আন্তর্জাতিক সংগঠন 38 বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ৭ আন্তর্জাতিক সংগঠন](http://www.samoyiki.com/wp-content/uploads/2022/12/bnp-1-1024x524.jpg)
সংগঠনগুলো বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিসহ সার্বিক অগ্রগতির লক্ষ্যে ৫টি সুপারিশ করেছে। প্রথমত, অবিলম্বে প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করুন এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা, জানমালের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত অখণ্ডতার অধিকারগুলোকে সম্মান ও সুরক্ষিত করা নিশ্চিত করুন। দ্বিতীয়ত, অবিলম্বে ও নিঃশর্তভাবে সব রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা প্রত্যাহার করে নির্বিচারে আটক সব কর্মী ও বিরোধী দলের সদস্যদের মুক্তি দিন এবং সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করুন।
তৃতীয় সুপারিশে বলা হয়, মোটা দাগে মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করুন। বিশেষ করে মৃত্যু এবং নির্যাতনের অভিযোগ জড়িত মামলাগুলোকে আমলে নিন। চতুর্থ সুপারিশে ডেটা সুরক্ষা আইন প্রসঙ্গে বলা হয়—খসড়া ডেটা সুরক্ষা আইনের পুনর্মূল্যায়ন ও সংশোধন করুন। যাতে এটি নাগরিকদের গোপনীয়তা ও অধিকার রক্ষা করে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে একই কাতারে থাকে। পঞ্চম সুপারিশে বলা হয়, আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার ও মৌলিক অধিকার রক্ষার পক্ষে সমর্থনের প্রতি আহ্বান জানাই।