গ্রাম বাংলার লোক উৎসব ‘ভাদু পরব’

উৎপল কান্তি ধর
উৎপল কান্তি ধর
4 মিনিটে পড়ুন

ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির দিনে ভাদু পুজো হয়ে থাকে। বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম জেলাতে এবং ঝাড়খণ্ডের রাঁচি, টাটা, হাজারিবাগ জেলায় প্রধানত ভাদু উৎসব হয়।

কয়েকটি বিখ্যাত ও প্রচলিত ভাদু গান হল:
ভাদু লে লে লে পয়সা দু-আনা/ কিনে খাবি মিছরির দানা…

ভাদু রানী আইলো আজি মোদের প্রাঙ্গণে/ খুশির জোয়ার বইছে মোদের পরা।…

ভাদু খাবেক কড়কড়া/ মোতির দাঁতে আওয়াজ দিবে/ কুটুর মুটুর মড়মড়া… প্রভৃতি

ভাদু গান-কেন্দ্রিক লোক-উৎসব। ভাদু উৎসব নিয়ে নানা কিংবদন্তী রয়েছে। যেমন, অনেকে মনে করেন ‘ভাদ্র’ মাস থেকে ভাদু শব্দটি এসেছে। আবার কেউ বলেন, ভাদু মানে লক্ষ্মী। যেহেতু দেবী লক্ষ্মী বিভিন্ন সময়ে পূজিত হন, তাই ভাদ্র মাসের লক্ষ্মীকে পৃথক ভাবে চিহ্নিত করার জন্য ভাদু পুজোর প্রচলন হয়। অন্য মতও রয়েছে। সেই মতে ভাদুর সঙ্গে বাস্তবের কাহিনী জড়িয়ে আছে। এই মতে ভদ্রাবতীর সংক্ষিপ্ত নাম ভাদু। তিনি পুরুলিয়ার এক রাজা নীলমণি সিংহদেওয়ের কন্যা। তিনি অন্ত্যজ শ্রেণির এক জনকে ভালবাসতেন। পিতা মেনে নিতে পারেননি। তাই ভাদু আত্মহত্যা করেন। রাজা মেয়ের স্মৃতিতে শুরু করেন ভাদু পুজো। কেউ কেউ বলেন প্রেম নয়, ভাদু ব্যাধির কারণে মৃত্যুবরণ করেন। রাজা মেয়েকে হারিয়ে তাঁর নামে চালু করেন স্মৃতি-তর্পণ। আবার এক মতে, ভাদু কাশীপুরের রাজার মেয়ে। বিয়ে ঠিক হয়েছিল বর্ধমানের রাজকুমারের সঙ্গে। বিয়ের দিন বর বেশে যাত্রা পথে রাজকুমারের ম়ৃত্যু ঘটে লেঠেলদের হাতে। ভাদু আত্মহত্যা করেন। অনেকে আবার ভাদুর সঙ্গে মীরাবাই-এর মিল পান। সে খানে রাজকন্যা ভাদু, জন্ম থেকে তিনি মীরার মতো কৃষ্ণভক্তি পরায়ণা। রাজা তাঁর বিবাহ ঠিক করলে ভাদু মন্দিরে নিজের প্রাণ ধ্যানস্থ অবস্থায় ত্যাগ করেন। কেউ কেউ ভাদুকে বাঁকুড়ার মল্ল রাজাদের কন্যা ভদ্রাবতী বলে মনে করেন। তাঁর অকালমৃত্যুতে ভাদু পুজোর প্রচলন। আবার বর্ধমানের সঙ্গে ভাদুর যোগ খুঁজে পান কেউ কেউ। অবিভক্ত বর্ধমানের খনি অঞ্চলে ‘ভাদা গান’ বলে একটি লোক-সংস্কৃতি প্রচলিত ছিল। এখনও কিছু কিছু জায়গায় তার প্রচলন রয়েছে। তার নামে ভাদু পুজো। ভদ্রাবতী সম্বন্ধে জানা যায়, তিনি পুরুলিয়ার রঘুনাথগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত কাশীপুরের রাজা নীলমণি সিংহদেওয়ের কন্যা। তাঁর মায়ের নাম অনুপকুমারী বা কলাবতী। যদিও অনেকের মতে দু’টি নামই একই ব্যক্তির। স্থানীয় গবেষকদের অনুমান, ভদ্রাবতীর জন্ম ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে। যদিও পঞ্চকোট রাজবংশলতিকায় ভদ্রাবতীর নাম নেই। কিন্তু নীলমণি সিংহদেওয়ের নাম রয়েছে। গবেষকদের একাংশের দাবি, ভদ্রাবতী ১৭ বছর বেঁচে ছিলেন। ১৮৫৮ সালে বিয়ের আগের দিন কোনও এক আকস্মিক কারণে তাঁর মৃত্যু হয়। একমাত্র কন্যার মৃত্যুতে রাজা শোকাহত হয়ে পড়েন। প্রজাকুলের ইচ্ছায় মিত্র-মন্ত্রীদের সহযোগিতায় শুরু হয় ভাদুর স্মৃতি তর্পণ। একটা কথা জানিয়ে রাখা ভাল, ভাদুর জন্ম এবং মৃত্যু দুই-ই ভাদ্র মাসে। তাই, ভাদ্র মাসে হিন্দুদের কোনও বিবাহ থাকে না। তবুও একটা প্রশ্ন জাগে যেখানে পঞ্চকোট রাজবংশের বংশলতিকায় ভাদুর নাম নেই, সেখানে কি করে বোঝা যায় যে ভাদু নীলমণি সিংহদেওয়ের কন্যা?

পুরুলিয়ার কিছু গবেষক যেমন সুনীল মাহাতো, হারাধন মাহাতো, রবীনকুমার পান্ডে, ভোলানাথ চক্রবর্তী, মৌসুমী কোলে প্রমুখদের মতে—যদি ভদ্রাবতীর পিতা নীলমণি না-ই হবেন, তবে এত দিন ধরে তাঁদের বাবা-মেয়ের নামে গান বাঁধা হচ্ছে কেন? নীলমণি তো কাল্পনিক চরিত্র নন। ধর্মীয় মতে ভাদ্র মাসে যে রমণী লক্ষ্মীপুজো করেন তাঁর উপরে যশোলক্ষ্মী, ভাগ্যলক্ষ্মী, কুললক্ষ্মী প্রসন্ন হন। সেই সূত্রে মনে হয়, ভাদু আসলে শস্যদেবী। ধান ওঠার ফলে চাষিদের ঘরে শস্য বন্দনার যে রেওয়াজ ছিল, তা নানা বিবর্তনের ফলে গড়ে ওঠে ভাদুদেবী রূপে। ভাদু উৎসবে ভাদু গান গাওয়া হয়। ভাদু গান একপ্রকার লোকসঙ্গীত। গ্রামীণ বাংলার একটি বিশেষ সংস্কৃতি হল ভাদু গান। ভাদ্র মাসের প্রথম দিন থেকেই ভাদু উৎসব শুরু হয়। ভাদুর আগমনী গান দিয়ে শুরু হয় সারা ভাদ্র মাসব্যাপী ভাদু গান। ভাদু গানের বিষয়বস্তু তাঁর কুমারী জীবন, ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, অভিপ্রায়, বিয়ে, বেদনা বধূর করুণ অকাল মৃত্যু এবং সাম্প্রতিক আঞ্চলিক কিছু ঘটনা ও বৈশিষ্ট্য।

সূত্র: বাংলার উৎসব

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
জন্ম বাংলাদেশের জামালপুরে। চল্লিশ বছরের অধিক সময় ধরে সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত আছেন। বর্তমানে তিনি জামালপুর 'মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘর' এর পরিচালক।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!