সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় কারা?

অপূর্ব দাস
অপূর্ব দাস
7 মিনিটে পড়ুন
ছবি: প্রতীকী ও সংগৃহীত।

কোভিড-১৯ এর শুরুর দিকে যখন, কোভিড টেস্ট করার জন্য লোক এক কোভিড ডেডিকেটেড এক হাসপাতাল গুলিতে করোনার লক্ষণ নিয়ে প্রতিদিন হাজারো মানুষের সারি, প্রথম দিনে এসে নমুনা দিতে পারা যখন সৌভাগ্যের ব্যাপার এবং নমুনা দিয়ে রেজাল্ট জানতে না পারা মানুষের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য, তখন সরকারের তরফ থেকে বলা হত, নমুনা সংগ্রহের জন্য, ল্যাবে কাজ করার জন্য নাকি যথেষ্ট পরিমাণ লোকবল নাই! ঠিক একই সময়ে প্রশাসন ক্যাডারের একশোএর বেশি কর্মকর্তার পদোন্নতি হল! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমি লিখেছিলাম, করোনা রোগীদের নমুনা সংগ্রহের জন্য এই পদোন্নতি খুব জরুরী ছিল! প্রশাসন ক্যাডারে যুক্ত আমার এক বন্ধু আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, কেন সমস্যাটা কোথায় হয়েছে? এই পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো নিয়মতান্ত্রিকতার কোনো ব্যত্যয় ঘটেছে কিনা? আমি বলেছিলাম, ব্যত্যয় ঘটেছে কিনা সেটার চেয়ে বড় কথা হল, আমি সরকারের অগ্রাধিকারের জায়গাগুলি নিয়ে প্রশ্নটা করেছি- যে মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টদের অপ্রতুলতার কথা তখন বলা হয়েছিল, অদ্যাবধি সেই পদগুলোতে লোক নিয়োগ কিংবা পদ সৃষ্টি হয়েছে কিনা আমার জানা নেই! আমার স্বভাবই হচ্ছে আমি ধান ভানতে শিবের গীত গাই! আসলে আজ কথা বলতে চাই, তেলের দাম বৃদ্ধি নিয়ে! কিন্তু শুরুতেই কোভিড-১৯ কে টেনে আনলাম! আসলে শুধু একটি ঘটনা তো নয়, প্রত্যেকটা ঘটনা যদি আমরা খুব সাদা চোখেও দেখি, তাহলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, সরকারের প্রায়োরিটির জায়গাতে আসলে জনগণ নাই! যখন দেশে বেশ প্রকট মাত্রায় বিদ্যুৎ সংকট, জনগণের সাথে কোনো আলোচনা ছাড়াই, বিশেষজ্ঞদের সাথে কোনো রকম পরামর্শ ছাড়াই সব রকম জ্বালানি তেলের দাম অসহনীয় মাত্রায় বাড়ানো হল, একই সময়ে ঢাকা উত্তর এবং দক্ষিণের মেয়রকে পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদায় উন্নীত করা হয়েছে! অন্য সিটি কর্পোরেশনগুলির কথা নাইবা টানলাম! সে প্রসঙ্গে গেলে নানা কথা বলতে হবে! একটা সিটি কর্পোরেশনকে দুইভাগ করে দু’জন মেয়র বানানো হল! তাতেও পোষাচ্ছে না! বৃদ্ধি কর মর্যাদা! তাহলে যারা একটা গোটা সিটি কর্পোরেশন এর মেয়র নির্বাচিত হলেন তারা কি দোষ করলেন? এখানেও প্রায়োরিটির প্রশ্ন অনিবার্যভাবে চলে আসে! আগেই বলেছি, সেই প্রসংগে আজ যেতে চাই না!

প্রশ্ন হল, সরকারের তরফ থেকে যখন বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে বলা হচ্ছে, যখন তেলের এই অসহনীয় মুল্যবৃদ্ধিকে হজম করতে বলা হচ্ছে, ঠিক সেই সময় জনতার সেবকদের, কথিত নাগরিককদের কথিত সেবকদের এই পদমর্যাদা বৃদ্ধি কি খুব জরুরী ছিল? গ্যাসের দাম, তেলের দাম, নিত্যপণ্যের দাম সব মিলিয়ে জনগণের যখন নাভিশ্বাস, ঠিক সেই মুহূর্তে কথিত নগরপিতাদের মর্যাদা বৃদ্ধির নামে তো আসলে সুযোগ সুবিধায় বৃদ্ধি করা হল এবং সেই সুযোগ সুবিধার ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য পকেট কাটা যাবে সর্বংসহা জনতারই! সরকার তো বটেই, আমাদের কথিত গণমাধ্যমগুলির ভূমিকাও নিয়েও এই সকল ক্ষেত্রে সব সময় প্রশ্ন ছিল, এবারও তার ব্যতিক্রম হয় নাই! তেলের দাম বৃদ্ধি নিয়ে প্রতিবেদন দেখাতে গিয়ে দেখলাম কোনো কোনো প্রাইভেট টিভি চ্যানেল বিশ্বের নানা দেশগুলি থেকে দেবদূতের মত একেকজনকে হাজির করছেন এবং তাদের জবানীতে আমাদের দেখাচ্ছেন, শোনাচ্ছেন বাংলাদেশের তুলনায় সেসব দেশে ডিজেল, পেট্রোল এবং অকটেনের দাম কত টাকা বেশি! প্রতিবেদনগুলি দেখলে মনে হয়, সরকারের এই সিদ্ধান্তকে একটা জন বৈধতা দেবার দায়িত্ব তারা নিজে থেকেই কাঁধে তুলে নিয়েছেন! শুধু জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির তুলনা করলে হবে? বলতে হবে, আলোচনা ছাড়ায় রাত বারোটায় তেলের দাম বাড়ল, পরদিন সকালে রাস্তায় কোনো গণপরিবহন নাই! বলতে হবে সব দেশে তেলের মুল্য অসহনীয় মাত্রায় বাড়িয়ে মন্ত্রীরা এসি রুমে বসে দেশবাসীকে সেটা হজম করার ছবক দেন কিনা! বলতে হবে, ঠিক এই রকম পরিস্থিতিতেও জনগণের কথিত সেবক হিসাবে আরাম আয়েশ ভোগ করা মানুষের সংখ্যা বাড়ানো হয় কিনা! তাহলেই না, সরকারের প্রায়োরিটি বোঝা যাবে!

পত্রিকা মারফত আরো জানতে পারলাম, আইএমএফ নাকি জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমাতে বলেছে, জ্বালানি ঘাটতি যাতে না হয় সেই দিকে খেয়াল রাখতে বলেছে! ভর্তুকি না দিলে তো এই খাত থেকে লাভও সরকারের করার কথা নয়! কিন্তু সরকার কি আইএমএফ এর এই শর্তের আগে লাভ না করার পথে হেঁটেছে? আর ঘাটতি যাতে না হয়, সেইজন্য জ্বালানি তেলের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণও একটা পন্থা! কই সরকারি কর্মকর্তাদের সরকারি গাড়ি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতন হতে বলেছেন! তার ফলাফল তো আমরা দেখছি! অফিসের গাড়িতে বাজার সরকার গেছেন বাজার করতে! বাজারের পাশে এসি চালিয়ে ড্রাইভার রেস্ট নিচ্ছেন! এই হল অবস্থা! এই দেশে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, সচেতন থাকতে বলা হয়েছে এইগুলিতে কখনো কাজ হয়? কাজ যে হয় না, সেটার উৎকৃষ্ট উদহারণ হল, কোভিডকালীন সরকারি নির্দেশনা! না মেনেছে জনগণ, না মেনেছে তাদের সেবকেরা! তারপরও আপনারা বাধ্য করেন জনগণকেই! আলোচনা ছাড়াই রাতের বেলা তেলের দাম বাড়িয়ে দিলেন, গণ পরিবহনের ভাড়া বাড়িয়ে দিলেন! লোডশেডিং এর রুটিন ধরিয়ে দিলেন! যদিও সেই রুটিন খুব কমই মেইন্টেইন করতে পারছেন! কই, সরকারি কর্মকর্তাদের তো বলতে পারলেন না, একই মাইক্রোবাসে করে আপনাদের আসতে হবে! কোর্ট-টাই পরা আপাতত বন্ধ রাখেন! ফ্যানের বাতাসে অফিস করেন, এসি বন্ধ রাখেন! সেটা পারবেন না, কারণ আপনাদের প্রায়োরিটিতে তারা রয়েছেন সবার আগে! নিন্দুকেরা বলেন, সরকার নাকি এখন জনতার ভোটে ক্ষমতায় আসে না! তাহলে কে সরকারকে ক্ষমতায় আনে? সে তো প্রায়োরিটি দেখলেই বোঝা যায়!

কথিত আছে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে মানুষের মনুষ্যত্ব কমে যায়! কথাটা অন্য দেশের বেলায় জানিনা, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যে সর্বৈব সত্য সে ব্যাপারে বোধহয় আমাদের কারো সন্দেহের অবকাশ নাই! তাই তো দেখলাম মূল্যবৃদ্ধির আগে ফিলিং সেটেশনগুলি কি কাহিনী করলো, এই উচ্চমূল্য ততদিন থাকবে, ততদিন এই নৈরাজ্য থাকবে! কিন্তু জনগণ যাতে হয়রানির শিকার না হন, লোকসানের শিকার না হন, তার জন্য ব্যবস্থা কি পর্যাপ্ত? এইখানেও কথা একই প্রায়োরিটির তালিকায় জনগণ নাই! তাই তো একের পর এক বাস চাপা দিয়ে, বাস থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে মানুষ হত্যা করার পরও সেই বাস মালিকের রুট পারমিট বাতিল হয় না! ফিলিং স্টেশন, বাস মালিকদের সেচ্ছাচারিতার পরও তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গৃহীত হয় না! কারণ, সরকারের প্রায়োরিটির তালিকায় এরা আছেন! কিংবা অন্যভাবে বলা যায়, সরকারের প্রায়োরিটির তালিকায় থাকা মানুষেরাই এগুলি পরিচালনা করেন! আমি দুঃখিত যে আলোচনা একটু এলোমেলো হল! কিন্তু সরকারের, রাস্ট্রের প্রায়োরিটির তালিকা যে আমরা নেই, সেটা বোধহয় আমরা ভুলতেই বসেছি! নইলে সব কিছু মেনে নিয়ে এমন সর্বংসহা জাতি আমরা কিভাবে হলাম?

নাগরিক হিসাবে আমি, আপনি, আমরা যতদিন না নিজেদেরকে রাষ্ট্রের প্রায়োরিটির জায়গায় না নিতে পারব, ততদিন তেলের দাম বৃদ্ধি নিয়ে, গ্যাসের দাম বৃদ্ধি নিয়ে, দ্রব্যমুল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে টিভি টক শো হবে, পত্রিকায়, পোর্টালে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার মত কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করবে কিন্তু তাতে সমস্যার কোনো সুরাহা হবে বলে মনে হয় না! কিভাবে প্রায়োরিটি লিস্টে আসা যায়? ভাবতে থাকুন, চিন্তা করতে থাকুন! চিন্তা করতে শিখুন! আসুন সবাই মিলে ঋত্বিক ঘটকের সেই বাণীকে বাস্তবে রূপ দেয়! ভাবা প্রাকটিস করি!

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
তিনি একজন মানবাধিকার কর্মী। জন্ম এবং বেড়ে ওঠা যশোর জেলায়। লেখাপড়া সম্পন্ন করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মানবাধিকার, নারীর মানবাধিকার, জেন্ডার এবং নারীর ভূমির অধিকার নিয়ে তিনি কাজ করেছেন একাধিক জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনে। এছাড়াও যুক্ত আছেন লেখালেখি এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথেও। কর্মসূত্রে বর্তমানে বসবাস করছেন ঢাকাতে!
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!