জন্ম থেকে জ্বলছি মা গো …

গৌতম রায়
গৌতম রায়
6 মিনিটে পড়ুন

১৯৪৭ এর দেশভাগের পর এদেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর যে সকল সদস্য এদেশেই থেকে গিয়েছিলেন, তারা এই দেশকে ভালোবেসেই থেকে গিয়েছিলেন। জন্মভূমি বা মাতৃভূমির প্রতি তাঁদের প্রগাঢ় ভালোবাসা, আস্থা, ও শিকড়ের টান এড়াতে পারেননি বলে তাঁরা নিশ্চয় অপরাধী নন।

এরপর ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ এর ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভুথ্যান, ১৯৭০ এর নির্বাচন, ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ – এই সকল ঐতিহাসিক মুহূর্ত ও সেসকল সময়ে জাতির অর্জনে এদেশের হিন্দুরা যতই সংখ্যালঘিষ্ট হোক না কেন তাঁরা তাঁদের শতভাগ দিয়ে এদেশের ইতিহাস বিনির্মাণে অংশ নিয়েছে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মতোই ।

এই দেশ ও জাতি নিশ্চয় ভুলে যাবে না একজন শহীদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্তকে, ভুলে যাবে না বা যেতে পারেনা মাস্টার দা সূর্যসেন, জি সি দেব, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, সুখরঞ্জন সমাদ্দার, রণদা  প্রাসাদ সাহা, নতুন চন্দ্র কুন্ডু, নিতুন কুন্ডু, সত্যেন বোস, সমর দাস এর মতো শহীদ ও গুণীজনদের। এই দেশ, এই জাতিসত্বা বিনির্মাণে এঁরা প্রত্যেকে স্বকীয়তায় ভাস্বর। দেশের যে কোনো বিপদে তাঁরা সংখ্যাগুরুদের তুলনায় কোনো অংশেই কম অবদান রাখেননি, কম অকুতোভয় ছিলেন না। বাংলাদেশের এমন কোন জনপদ পাওয়া যাবে না যেখানের মাটি একাত্তরে কোন শহীদের রক্তে রঞ্জিত না হয়েছে। আর শহীদের সেই  তালিকাতে এদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যাটিও নিতান্তই মামুলি নয়। এবং তাঁদের উপর অত্যাচার, নিপীড়ন, নির্মমতা তো বিশ্ববাসীকে শিউরে দিয়েছে।

তবুও অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও এক শ্রেণির মানুষের কাছে এদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর কোন আত্মত্যাগের কোন মূল্য নেই। দিনে দিনে তাঁরা ‌‌শুধুই অচ্ছুৎ বিবেচিত হচ্ছে। আত্ম পরিচয়ের সংকটের বাইরে আজ তাঁরা রীতিমতো জীবন বাঁচানোর ভয়ে ভীত। নিজ চোখে না দেখলেও শুনেছি ও পড়েছি একাত্তরে মানুষকে টুকরো করে হত্যা করেছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তার দোসররা। আজ সেই পাকি হানাদার বাহিনী নেই। কিন্তু তাদের রক্তবীজ রয়ে গেছে এদেশে। তাই এই ২০২১-এ এসেও মানুষকে একই কায়দায় হত্যার দৃশ্য দেখে যে মানসিক ট্রমা তৈরী হচ্ছে তা থেকে এ জীবনে আর বের হতে পারবো বলে মনে হয়না। নো ম্যাটার, কর্তিত হতভাগ্য মানুষটি হিন্দু না মুসলিম না বৌদ্ধ না খ্রিস্টান। এই পাশবিকতা, এই আসুরিক বীভৎসতা অকল্পনীয়।

একথা বলা খুবই সহজ – ‘আপনারা ভয় পাবেন কেন? শক্ত হয়ে দাঁড়ান’। কিন্তু শক্ত হয়ে দাঁড়ানোর জন্যে যে শক্তি, আস্থা ও‌ নির্ভরতার প্রয়োজন হয় – সেটি এই সংখ্যালঘুদের কি আছে? আমার এই পঞ্চাশ অতিক্রান্ত জীবনে একটি বার দেখতে পেলাম না কোথাও দূর্গা পূজাতে প্রতিমা বা মন্দির ভাঙচুর হয়নি। আর এই পঞ্চাশ বছর ধরেই সেই একই ভাঙা রেকর্ড – ‘ষড়যন্ত্র তত্ব, আমরা নই- ওরা এর পিছনে দায়ী’ এসব সুবচন। সবাই ‘ওদেরকে’ দায়ী করেন কিন্তু সত্যিকার একজন ‘ওরা’ও ধরা পড়ে না, পড়লেও বিচার হয় না। অথচ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের দক্ষতা নাকি এখন উন্নত দেশ থেকে বিন্দুমাত্র কম নয় বলে আমরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলি।

সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জন্যে বিচার হয়নি একজনেরও ১৯৯১ তে, বিচার হয়নি ২০০১ এ, বিচার হয়নি রামুতে, নাসিরনগরে, শাল্লাসহ অন্যান্য স্থানে।  এ সকল বিষয়ে বিচার ও শাস্তির কোনো কথা অন্তত আমার জানা নেই। আর এর ফল সংখ্যালঘু সম্প্রদায় লঘিষ্ট হতে হতে এখন সাত শতাংশের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আজও পূর্ণিমাদের কান্না থামেনি। অথচ ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ বাংলাদেশ অন্য কোনো রোল মডেল হবার দ্বার প্রান্তে। এই দেশ থেকে সকল হিন্দু বা বৌদ্ধ বা খ্রিস্টানকে ঝেঁটিয়ে বঙ্গোপসাগরে নিয়ে ফেললে এই দেশের সোশ্যাল ফেব্রিকের যে চূড়ান্ত ক্ষতি হবে তার শিকার এক সময় হবেন এই দেশেরই সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় যেমনি হয়েছে পাকিস্তান বা আফগানিস্তানে। 

প্রতি বছর এই যে ঘটা করে আমাদের অভিভাবকেরা বলেন – বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রোল মডেল – গত কদিনের ঘটনা কি সেই কথাগুলি প্রমাণ করতে পারছে! একবার আমার এক পূজো অন্তপ্রাণ বন্ধু বলেছিলো – ঘটনা যাই হোক, আমাদের সব মনের কষ্ট চেপে রেখে পূজাও করতে হয় আর বলতেও হয়- পূজা খুব সুষ্ঠু ভাবে হচ্ছে। বিষয়টা সত্যি যদি তা হয় তবে তা ভয়ানক বই কি!

ঈশ্বর পুত্র যীশুর মতো বলতে ইচ্ছে হয় না – হে ঈশ্বর, তুমি এদের ক্ষমা করো কারণ এরা জানে না এরা কী করছে। বরং এটুকু আর্তি জানাতে খুব ইচ্ছে হয় – ভয় শূন্য চিত্তে আমার শিকড়ে আমার সংস্কৃতির চর্চা করার অধিকারটুকু চাই; আমার ঘরবাড়ি, সামান্য সহায় সম্পত্তি আগুনে পুড়ে ছাড়খার না হবার গ্যারান্টিটুকু  চাই, আমার স্বজনদের চোখের সামনে আমাকে যেন টুকরো হয়ে যেতে না হয়। গোয়েন্দা সংস্থা ও নিরাপত্তাবাহিনীর সেই তৎপরতা ও দক্ষতা দেখতে চাই যে তারা দুষ্কৃতকারীদের শুধু সনাক্ত করেই ক্ষান্ত হন না, তাদের ধরতেও যেন সক্ষম হন। অপরাধীর যেন দৃশ্যমান শাস্তি হয়। আর যারা সংবিধান ছুঁয়ে শপথ নেন অনুরাগ ও বিরাগের বশবর্তী না হয়ে তারা সংবিধানের রক্ষণ করবেন, তাঁরা যেন সেটুকু করতে পারার সাহসটুকু হারিয়ে না ফেলেন।

রবি ঠাকুরের এই মহান বাণীও এখন আর সান্ত্বনা দিতে পারছে না – বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয় … কিংবা …. সংকোচেরই বিহ্বলতা নিজেরই অপমান…।

এই লেখাটুকুর জন্যেও হয়তো দু’একজন ‘প্রগতিশীল’ বন্ধু আমাকে আনফ্রেন্ড করতে পারেন। কারণ এমন একটি লেখার মধ্যে নামকরা বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ‘প্রগতিশীল অধ্যাপক’ ‘সাম্প্রদায়িকতার’ গন্ধ পেয়ে আমকে আনফ্রেন্ড করেছেন। তার মানে আমি পূজা করলেও দোষ, আমি পূজা না করলেও দোষ, আমি বা আমার স্বজন নির্যাতিত হলে আর আমি সেই কষ্টের কথা বললে বা আইনের শাসনের ও অধিকারের কথা বললেও দোষ। আমি তাহলে করবো টা কী?

জন্মই আমার আজন্ম পাপ – এটি স্বীকার করে নিলেও আমার যন্ত্রণা তো হয় কারণ আমি তো কোনো মৃত ব্যক্তি নই।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
লেখক: গৌতম রায়
গৌতম রায় ইংরেজির অধ্যাপক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজীতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেবার পর বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বেশ তরুণ বয়সেই শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। পড়িয়েছেন দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষার প্রতি ভালোবাসা থেকেই পরবর্তীতে ছাত্র হয়েছেন ইংল্যান্ডের এক্সিটার ইউনিভার্সিটির।‌ যুক্তরাষ্ট্রের অরেগন ইউনিভার্সিটি, ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি ও ওয়ার্ল্ড লার্নিং থেকে নিয়েছেন পেশাগত প্রশিক্ষণ। এখন কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশের জাতীয় ‌শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে। শিক্ষা বিষয়ক বর্ণিল কাজে নিজেকে ‌সম্পৃক্ত রাখার জন্যই বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যাবস্থাকে তিনি দেখেছেন খুব কাছে থেকে। শিক্ষা ক্ষেত্রে গৌতম রায়ের পছন্দের আঙ্গিনা শিক্ষকের অনিঃশেষ পেশাগত দক্ষতা, ইন্টারেক্টিভ মেটিরিয়ালস ডিভ্যালপমেন্ট, ও লার্নিং এসেসমেন্ট।
2 টি মন্তব্য

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!