গল্প: হেড মাষ্টার

ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী
ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী
18 মিনিটে পড়ুন

চেয়ারে বসবার একটু পরেই প্রশ্নের সমাধান সূত্রটা খেলে গেল মাথায়। বড় বেয়াক্কেলে ধরণের প্রশ্নটা ছিল। এগার ক্লাশের ছাত্রের কাছে এত কঠিন প্রশ্ন প্রত্যাশিত নয়। তবু প্রশ্নটা বেরিয়ে এল ক্লাশের ফার্স্ট বয়ের মৃদু কণ্ঠের স্পষ্ট উচ্চারণে। উত্তরটা জানা ছিল না শঙ্করনাথের। কোন পথ ধরে এগোলে সমাধান মিলবে সেটাও মাথায় আসছিল না। একটু বেকায়দায় পড়ে গেছিলেন শঙ্করনাথ। মাথার মধ্যে ঘুরছিল এক ধরনের অস্বস্তি।
গত শুক্রবার বিমান মজুমদার ছুটিতে ছিলেন। স্কুলের একমাত্র রসায়ন-শিক্ষক উনি। বোনের বিয়েতে ক’দিনের ছুটি নিয়েছেন। ওঁর অনুপস্থিতিতে ক্লাসটা নিতে হোল হেড মাষ্টার শঙ্কর নাথ রায়কে। নোতুন হেড মাষ্টার শঙ্কর নাথ পদার্থবিদ্যা বিষয়টা গুলে খেয়েছেন। ওই বিষয়েই অনার্স তারপর মাষ্টার ডিগ্রী করেছেন। দীর্ঘ দিন ছাত্র পড়ানোর অভিজ্ঞতা। পদার্থ বিদ্যার যে কোন কঠিন প্রশ্নের উত্তর ওনার জিভের ডগায় লেগে থাকে। কিন্তু রসায়ন বিষয়টাতে তেমন সরগর নন। তবু এগার ক্লাশের এ-সেকশনে রসায়ন পড়াতে ঢুকতে হোল।
অনেক গুলো বেয়াদপ ছেলে আছে এগারোর-এ তে। কয়েকজন ছাত্র অবশ্য প্রচণ্ড বুদ্ধিমান। বেশ কঠিন কঠিন প্রশ্ন করে। এসব জেনেও ক্লাশ কক্ষে ঢুকতে হোল। পড়ানো ভালোই চলছিল। বিষয়—ওয়াটার। মানে জল। ধীরে ধীরে ভরাট কণ্ঠস্বরে উচ্চারণ করছিলেন, ‘দু’টো হাইড্রোজেন আর একটা অক্সিজেন পরমাণু মিলিত হয়ে তৈরি করে এক অনু জল। জল আয়নিত হলে তৈরি হয় হাইড্রোজেন আয়ন আর…।’
কথা শেষ না হতেই দ্বিতীয় বেঞ্চের লম্বা ছেলেটা, সুবীর সরকার, দাঁড়িয়ে উঠ প্রশ্নটা ছুঁড়ল, ‘স্যার, একফোঁটা জলে কয়টা হাইড্রোজেন আয়ন থাকে’?
প্রশ্নের ধাক্কায় একটু থতমত খেয়ে ঢোঁক গিললেন শঙ্করনাথ। এমন প্রশ্নের সামনে আগে পড়েন নি। উত্তরে কী বলবেন ভাবছেন। নিস্তব্ধ শ্রেণী কক্ষ। ডান হাতে চক বাঁ হাতে ডাস্টার নিয়ে চল্লিশ জন ছেলের সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন শঙ্করনাথ। ফর্সা সপ্রতিভ মুখে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। ডিসেম্বর মাস কিন্তু শঙ্করনাথের নাকের দু’পাশে বিজবিজে ঘাম। মনে মনে ভাবছেন, এরা আমাকে মহাজ্ঞানী ভাবে। স্কুলের ছাত্ররাই নয়, সব মাষ্টার এমনকি অঞ্চলের সব লোক। আধা গ্রাম আধা শহরের সবজান্তা হেড মাস্টার আমি…।
ভাবনা ধাক্কা খেল শঙ্করনাথের। কালীরাম ভকত্‌ নামের একটা নাদুসনুদুস ছেলে ঠোঁটের দুপাশে ফিচেল হাসি ঝুলিয়ে বলল, ‘না পারলে বলে দিন স্যার’।
শঙ্করনাথ ঘড়ির দিকে তাকালেন। মুখের গাম্ভীর্য আরেকটু বাড়িয়ে বললেন, ‘এখনই ঘণ্টা পড়বে। উত্তরটা পরে দেব। আপাতত তড়িৎ-বিশ্লেষণ বিষয়টা বলি’।
ক্লাশ শেষ হোল। ছুটির ঘণ্টা পড়ল চারটে কুড়িতে। ছাত্ররা চলে গেল লাইন বেঁধে। একটু পরে শিক্ষকরাও বাড়ি চলে গেলেন। কিন্তু শঙ্করনাথ তখনও স্কুলে। হাল ফ্যাশনের আসবাবে সাজানো হেড মাস্টারের বড় ঘরে গদি আঁটা নরম চেয়ারে বসে আছেন। সানমাইকা মোড়া টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে গালে হাত দিয়ে নাগাড়ে ভেবে চলেছেন শঙ্করনাথ। সুবীরের প্রশ্নটা কেবলই খোঁচা মারছে মাথায়। যেন গলায় মাছের কাঁটা বিঁধে আছে।
প্রশ্নের খোঁচা মাথায় নিয়ে কেটে গেল আরও তিন-চার দিন। স্কুলের হাজার কাজকর্ম – স্পোর্টস, পরীক্ষার রুটিন বানানো, বেয়াদপ ছেলেদের শাসন করা, অভিভাবকদের অভিযোগ — এ সবের মধ্যেও প্রশ্নটা ঘুরে ফিরে আসছে মাথায়। শঙ্করনাথের পঞ্চাশ বছরের দেহটায় ক্লান্তি নামছে। কোমরটা টন টন করছে।
কোমরের টনটনানি শঙ্করনাথের পারিবারিক রোগ। ওঁর বাবা ভুগতেন, মাথার উপর দুই দাদারও একই ব্যাধি। বাবার কথা মনে পড়ল শঙ্করনাথের। বলতেন, ‘রোগটার নাম লাম্ব্যাগো। ব্যায়াম করলে কম থাকে’। দুবেলা নিয়ম করে শলভাসন আর ভুজঙ্গাসন করতেন। শক্ত বিছানায় শুতেন। বাবার উপদেশ উঁকি দিল শঙ্করনাথের মাথায়। ‘গদি আঁটা চেয়ারে বসবি না। বসবি টানটান হয়ে। শক্ত কাঠের চেয়ারে’।
কাঠের চেয়ার? কোথায় যেন দেখেছেন! মনে পড়ছে না শঙ্করনাথের। মাথা ঝিম মেরে আছে। খিদে চাগিয়ে উঠেছে। শঙ্করনাথ দারোয়ান রামজি মিশ্রকে ডেকে চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন।
পরদিন মনে পড়ল শক্ত কাঠের চেয়ারটার হদিশ। ক্যাশিয়ার বিভুতি সামন্তর ঘরে বড় স্টিল আলমারির পাশে রাখা আছে পুরনো একটা কাঠের চেয়ার। নিজের গদি আঁটা চেয়ারে একটু বসে নিয়ে দিনের রুটিনটায় চোখ বুলালেন শঙ্করনাথ। তারপরেই সামন্তবাবুকে ডেকে পাঠালেন।
সামন্তবাবুর রোগা পাতলা শরীর। তার উপর একটা ঢোলা সোয়েটার চাপিয়েছেন। গলার মাফলারটা সরিয়ে হেডমাস্টারের মুখের দিকে তাকালেন। একবার কেশে নিয়ে বললেন, ‘আমাকে ডেকেছেন স্যার’?
সামন্তবাবুর মুখের দিকে পলক তাকিয়ে আদেশের সুরে শঙ্করনাথ বললেন, ‘আপনার টেবিলের পাশে রাখা কাঠের চেয়ারটা আমার ঘরে পাঠিয়ে দিন’।
‘ওই চেয়ারে বসবেন স্যার’? সামন্তবাবুর অবাক প্রশ্ন।
‘হ্যাঁ বসবো’।
‘ওটা অনাদি বাবুর চেয়ার ছিল। এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম হেড মাস্টার। ফ্রিডম ফাইটার ছিলেন, স্যার’।
‘চেয়ারে বসলে কি তাঁকে অসম্মান করা হবে?
‘না স্যার। তবে চেয়ারের হাতলটা কিন্তু নড়বরে’।
‘তা হোক’, বাঁ-দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে সংক্ষিপ্ত উত্তর শঙ্করনাথের।
চেয়ারের ডান হাতলটায় দুটো পেরেক মেরে ঠিক করে দিল দারোয়ান। সোমবার সকালে নিজের ঘরে ওটা ঢোকালেন শঙ্করনাথ। একটু দূরে পরে রইল তাঁর গদি আটা নরম চেয়ার।
শক্ত চেয়ারটায় বসে নিজের শরীরটা বেশ চনমনে লাগলো। পুরনো দিনের মেহগনি কাঠের চেয়ার। শক্তপোক্ত। পেছন দিকটা বেশ উঁচু। পালিশ চটে গেছে চেয়ারে। কাঠের বাদামী রঙে কালো ছোপ ধরেছে। ঝাড়পোঁছ করে দু’বার ভালো করে মুছতেই চকচকে একটা ভাব বেরিয়ে এল। ভালো করে পালিশ করলেই আগের লাল আভা ফুটে বেরোবে। ভাবলেন শঙ্করনাথ। বাবার কথা মনে পড়ল শঙ্করনাথের। উত্তরবঙ্গে চাকরি করেছেন অনেক দিন। মহানন্দা ফরেস্টের বিট অফিসার ছিলেন। বলতেন, ‘পুরনো জিনিসের কদর করতে হয়, বুঝলি’!
পুরনো চেয়ারটার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন শঙ্করনাথ। প্লাই উড আর সানমাইকা পেস্ট করা আসবাবের পাশে সৌন্দর্যের দীপ্তি ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন চেয়ারটা। কয়লার স্তুপে যেন এক খণ্ড হীরা জ্বল জ্বল করছে। দারোয়ান রামজি মিশ্র ওদিকে তাকিয়ে বলল, ‘বহত বড়িয়া চিজ, মাস্টারবাবু’।
পুরনো চেয়ারের পেছনে মাথা হেলিয়ে রেখে বসলেন শঙ্করনাথ। বেশ আরামের ভঙ্গি। চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তার পরেই এক অদ্ভুত ব্যাপার! মাথায় যেন একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে গেল। শিরদাঁড়া সোজা করে বসলেন শঙ্করনাথ। হাতের কাছে জল ভর্তি গ্লাস। এক ঢোঁক জল গলায় ঢেলে আরেকবার চোখ বন্ধ করতেই সমাধান সূত্রটা মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠল। আর মুহূর্তেই রসায়নের সেই শক্ত প্রশ্নটার মীমাংসা হয়ে গেল।
মনে মনে বললেন, এই ব্যাপার!। এক ফোঁটা জলে হাইড্রোজেন আয়নের সংখ্যা? আরে, জল নিউট্রাল। অ্যাসিড নয়, ক্ষারও নয়। জলের পিএইচ সাত; মানে জলে হাইড্রোজেন আয়নের সংখ্যা…. সব ছবির মত ভেসে উঠল। হাতে কলম তুলে নিলেন শঙ্করনাথ। সামনেই টেবিলের উপর অনেকগুলো এ-ফোর সাইজের সাদা কাগজ রাখা। একটা কাগজ টেনে নিয়ে ঝপ ঝপ করে কষে ফেললেন অঙ্কটা। তারপরেই টিফিনের সময় এগার ক্লাশের ওই ছেলেটাকে ডেকে বুঝিয়ে দিলেন।
ছেলেটা হাসি মুখে চলে যাবার পর স্পোর্টসের মাষ্টার সদাশিব বাবু গম্ভীর মুখে ঘরে ঢুকলেন। বেশ বিমর্ষ মুখ। ধীরে ধীরে বললেন, ‘স্যার, বড় একটা বিপদ…’!
‘কী ব্যাপার’? শঙ্করনাথের কপালে ভাঁজ।
সদাশিব বাবু ধীরে ধীরে বললেন, ‘মন্ত্রীর সাথে এসডিও সাহেবের ঝামেলা চলছে। এ ওর মুখ দেখে না। আমাদের স্পোর্টসে একজন এলে আরেক জন আসবে না। কী করবো এখন’?
‘ও বাবা তাই নাকি’? একটু ঘাবড়ে গেলেন শঙ্করনাথ। স্কুলের অনেক কাজে দুজনেরই সাহায্য দরকার। কী করা যায়। চোখ বন্ধ করে ভাবতে বসলেন শঙ্করনাথ।
চেয়ারের হাতলে হাত দুটো ছড়িয়ে পেছনে মাথা রাখলেন। একটু পরেই বিদ্যুৎ খেলে গেল মাথায়। আরে, শনিবার তো এসডিও সাহেব মাছ ধরতে যান! যুবক বয়স থেকেই এই লোকটির মাছ ধরার নেশা।
সদাশিব বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন শঙ্করনাথ। ঠোঁটের দু’পাশে হাসির রেখা এঁকে বললেন, ‘শনিবার দেখে স্পোর্টসের দিন ফেলুন। বাকি ঝামেলাটা আমি সামলে দেব’।
সদাশিব বাবু চলে যেতেই মুচকি হাসলেন শঙ্করনাথ। মনে মনে বললেন, হেড মাস্টারের চাকরিটাই এই। শুধু ঝামেলা আর ঝামেলা। একটার পর একটা সমস্যা স্রোতের মত চৌকাঠ ডিঙিয়ে আছড়ে পড়ছে ঘরের ভিতর। এখনই আবার কেউ ঢুকে বড় কোন বিপদের কাহিনী শোনাবে।
ঠিক তাই ঘটল। বদখৎ একটা ঝামেলা নিয়ে হাজির হলেন বায়োলজির টিচার পরমেশ হালদার। ভারী শরীরটা নিয়ে ধপ করে বসেই বললেন, ‘স্যার তিন দিন ধরে নাইনের ইংরাজি ক্লাশ হচ্ছে না। রমেন বাবু দুম করে চাকরিটা ছেড়ে দিল…’!
‘ছাড়বেই তো। কলেজের মাস্টারি পেলে কেউ কি স্কুলে পড়ে থাকে’?
‘কিন্তু স্যার, ছাত্রদের কী হবে’?
‘কী হবে আপনি একটু ভাবুন। সব দায়িত্ব কি একা হেড মাষ্টারের?
‘গার্জেনরা খেপে আছেন। আমি কী করবো স্যার? আমার উপর চাপ আসছে খুব। আমি তো ক্লাশ টিচার’।
‘একটু ভাবি’। শঙ্করনাথ বললেন। তারপর চেয়ারে হেলান দিলেন। চোখ বন্ধ। হঠাৎ একটা মুখ মনের আকাশে ভুস করে ভেসে উঠল। স্কুলের পরিচালন সমিতির সভাপতি রমাপদ মণ্ডলের ছেলে। ইংরজিতে এম এ পরীক্ষা দিয়ে বেকার বসে আছে। রমাপদ বাবুর ইচ্ছে এই স্কুলে ও পড়াক।
মুকে হাসি ফুটল শঙ্করনাথের। পরমেশ হালদারের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কাল-পরশু নতুন মাষ্টার পেয়ে যাবেন। টেম্পোরারি, তিন-চার মাস পড়াক’।
পরমেশ হালদার চলে যেতেই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন শঙ্করনাথ। পেছন ফিরে ফাইল-বই-কাগজ পত্র ঠাসা টেবিলটার পাশে পুরনো চেয়ারটার দিকে তাকালেন। মনে মনে বললেন, চেয়ারটায় কোন রহস্য নেই তো? বসলেই সমস্যার চটপট সমাধান হয়ে যাচ্ছে! চেয়ারের মাথায়, যাকে বলে টপ রেল, হাত বুলিয়ে হাসলেন শঙ্করনাথ। মনে মনে বললেন, বিক্রমাদিত্যের জাদু সিংহাসন! বসলেই সমস্যার উত্তর হাজির হয়ে যায়।
কিন্তু পরের সমস্যার সমাধান মিলল না। চেয়ারে বসে অনেক ভাবলেন কিন্তু সমাধান অধরা। সমস্যাটা বেয়াড়া ধরণের। বেয়াদপ বাচ্চাদের কারবার। এরা মাঝে মাঝে অমানুষিক আচরন করে। এদের শাসন করার হ্যাপা অনেক। বাবা-মার আদুরে ছেলে সব। এদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নিলেই আভিভাবকরা ঝাঁপিয়ে পড়বে। কোন্‌ ছাত্রের বাবা মন্ত্রীর ঘনিস্ট, কে নেতার আত্মীয় এ সব আগে জনা যায় না। তাই কঠিন কোন শস্তি দিলে বড় সর বিপদ ঘটে যেতে পারে।
বিষ্ণু বাবুর মুখে ঘটনাটা শুনে এরকমই মনে হোল। ভূগোল পড়ান বিষ্ণু ভূষণ দাস। পুরনো ধ্যান ধারণার মাষ্টার। একটু ভীতু ভীতু ধরনের। পোশাক আশাকেও এ-যুগে বেমানান। ধূতি-পাঞ্জাবী আর বাঁ-দিকের কাঁধে ভাঁজ করা চাদর। প্রশান্ত চোখমুখ।
দুটো ত্রিশ নাগাদ হাঁপাতে হাঁপাতে উত্তেজিত মুখে হেড মাস্টারের ঘরে ঢুকে বললেন, ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে স্যার। এইটের বাঁদর ছেলেগুলো বাংলার নোতুন মাস্টারকে বড় অপদস্ত করে। ক্লাশে বিড়াল ডাক কুকুর ডাক দেয়। আজ ক্লাশের পর দ্বোতলা থেকে নামবার সময় ওনাকে পেছন থেকে ধাক্কা মেরেছে কয়েকজন। সিঁড়িতে পড়ে গিয়ে হাঁটুতে চোট পেয়েছেন বাংলার মাষ্টার পরেশ বাবু’।
‘সে কি’? উত্তেজিত হয়ে বললেন শঙ্করনাথ, ‘আপনার কাকে সন্দেহ হয়’?
‘অমু, মানে অমরেশ রায় আর বিপুলকে’।
‘ওদের টি সি দিয়ে দিই’।
‘ও কাজ করবেন না স্যার। ঝামেলা হবে। পুলিশ আমাদের নিয়ে টানাটানি করবে’?
‘কেন’?
‘অমুর বাবা কনট্রাক্টর, নেতা মন্ত্রীর ঘনিস্ট। আর বিপুলের মা পার্টি করে। বেশ হোমরা চোমরা নেত্রী। ওদের চটাবেন না’।
‘তাহলে কী করবো আমি? ওদের বেয়াদপি মেনে নেব’?
‘আমি জানি না স্যার। তবে দিনকাল খুব খারাপ। আপনি অন্য উপায় ভাবুন’।
‘ঠিক আছে। আমি ভাবছি। আপনি আসুন’। শঙ্করনাথের কণ্ঠস্বরে রাগ আর উত্তেজনা। চেয়ারে হেলান দিলেন শঙ্করনাথ। মাথায় ঘুরে ফিরে আসছে অনেক ভাবনা। সমাজ দিনকাল রাজনীতি। আধুনিক সমাজে কী ছাত্রদের মুল্যবোধের অধঃপতন ঘটছে? বেয়াদপ ছাত্রদের শাসন করতে কী করনীয় এখন? ঠাণ্ডা মাথায় ভাবছেন শঙ্করনাথ।
অনেকক্ষণ ভাবলেও মাথায় কোন সমাধান সূত্র আসছে না। বারবার চোখ যাচ্ছে অগোছাল টেবিলটার দিকে। বিস্তর কাগজপত্র, তার পাশে প্রকাশকদের রেখে যাওয়া বইয়ে ডাই হয়ে আছে টেবিলটা।
সামন্তবাবুর ঘরের আলমারিতে বইগুলো ঢুকিয়ে দেওয়া যায় না? ভাবলেন শঙ্করনাথ। আর সঙ্গে সঙ্গেই ডেকে পাঠালেন।
‘আপনার ঘরের আলমারিতে একটু জায়গা হবে?’
‘কেন স্যার’।
‘এই বই গুলো ঢুকিয়ে রাখি। স্যাম্পল কপি। পাবলিশাররা দিয়ে গেছে’।
‘কিন্তু স্যার, আলমারির চাবিটা তো আমার কাছে নেই?
‘কার কাছে আছে’?
‘জানিনা স্যার। বিষ্ণু বাবু, বিধু বাবু কিম্বা হেমন্ত সরকার জানতে পারেন’।
বিধু বাবু, বিষ্ণু বাবু, হেমন্ত সরকার সবাইকে ডাকা হোল। এক এক করে মাথা নাড়লেন সবাই। ডেকে আনা হোল রমানাথ চৌধুরীকে। উনি এই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র তথা প্রাক্তন শিক্ষক। এক সময় অস্থায়ী ভবে হেডমাস্টারের দায়িত্ব সামলেছেন। দু-বছর আগে অবসর নিয়ে স্কুলের কাছেই বাড়ি করেছেন। শরীর স্বাস্থ্য ভালো তবে কানে একটু কম শোনেন।
রমানাথ চৌধুরীর দিকে একটু ঝুঁকে গলা উঁচু পর্দায় তুলে প্রশ্ন করলেন হেড মাষ্টার শঙ্করনাথ, ‘আলমারির চাবিটা কোথায় থাকতে পারে স্যার’? অনেকক্ষণ ভাবলেন রমানাথ চৌধুরী। কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে নিজের মনে কথা বললেন। তারপর একটু কেশে নিয়ে স্বর উঁচু করে বললেন, ‘স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম হেড মাষ্টার অনাদি নাথ ভট্টাচার্য ব্যবহার করতেন ওই আলমারিটা। অবসর নেবার কয়েকমাস পরেই উনি মারা যান। সে আজ থেকে পঁচিশ বছর আগের কথা’।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার মুখ খুললেন রমানাথ রায়। বললেন, ‘অনাদি বাবু মানুষটা ছিলেন অবিবাহিত। স্কুলের ছাত্ররা ছিল ওঁর প্রাণ। পুত্রসম ভালো বাসতেন ছাত্রদের। তবে… ‘?
‘তবে কী’? শঙ্কর নাথের চোখে মুখে উৎকণ্ঠা।
‘তবে ছাত্রদের বেয়াদপি দেখলে…কঠোর শাস্তি দিতেন’।
‘কী শাস্তি’?
‘নির্মম বেত্রাঘাত’।
‘ওসব আজকাল চলে না’। বিষ্ণু বাবু দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বললেন।
রমানাথ রায় কথাটা শুনতে পেলেন। পাশে বসা বিষ্ণু বাবুর দিকে তাকিয়ে গাল ছড়িয়ে হাসলেন। তারপর গলা উঁচু পর্দায় তুলে বললেন, ‘অনাদি মাস্টারের বেত খাওয়া ওই সব ছাত্ররা… কেউ ডাক্তার, কেউ বিজ্ঞানী, কেউ অধ্যাপক…’।
রামানাথ বাবুর কথা থামিয়ে প্রশ্ন করলেন শঙ্করনাথ, ‘আপনি জানেন, ওই আলমারিতে কী রাখা আছে’?
‘দু’পাশে মাথা নাড়লেন রমানাথ চৌধুরী। বললেন, ‘জানি না। অন্য কেউ জানে বলে মনে হয় না’।

বড় একটা শ্বাস ফেললেন শঙ্করনাথ। হেডমাস্টারের ফাঁকা ঘরে শক্ত কাঠের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন একা। কী করা উচিৎ, ভাবছেন। চেয়ারটায় বসে একটু ভাবলেই কঠিন সমস্যা গুলোর সমাধান সূত্র পেয়ে যাচ্ছিলেন এই কয়েকদিন। এখন আর পাচ্ছেন না। বেয়াদপ ছাত্রদের শায়েস্তা করবার কোন উপায়ও মাথায় আসছে না। ভাবতে বসলেই ঢাউস আলমারিটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ‘হেডমাস্টার সাব, তবিয়ৎ ঠিক আছে তো’? দারোয়ানের কথায় ভাবনার সুতো কেটে গেল। রামজি মিশ্রর দিকে তাকালেন শঙ্করনাথ। ‘সব শুনলাম স্যার। আলমারির তালাটা খুলিয়ে দেব’? ‘চাবি আছে তোমার কছে’? ‘নাই স্যার। তবে চাবি আলা দোস্ত আছে। নোতুন চাবি বানিয়ে আলমারি তুরন্ত খুলে দিবে’। পরদিন স্কুলে ঢুকবার একটু পরেই মাথাটা গরম হয়ে গেল শঙ্করনাথের। দূর থেকে হল্লা-চিৎকার ভেসে আসছিল। খোঁজ নিয়ে জানলেন, ইতিহাসের ক্লাশে এবার জোর গণ্ডগোল করেছে ক্লাশ এইটের ছেলেগুলো। কেউ একজন শিক্ষকের পিঠে ক্রিকেট বল ছুঁড়েছে’। কী করা উচিৎ, গভীর ভাবে ভাবছেন শঙ্করনাথ। অনাদি নাথ ভট্টাচার্যের চেয়ারে বসে কোন নির্দেশ পাচ্ছেন না। বিষ্ণু বাবু এসে ভয় ধরিয়ে গেলেন। কাঁপতে কাঁপতে বলা ওনার কথা গুলো কান গরম করে দিল, ‘দিনকাল খারাপ স্যার। ছেলেদের কিছু বলতে যাবেন না’। কিছু তো বলতেই হবে, ভাবছেন শঙ্করনাথ। ঠিক তখন চাবিওয়ালা ধরে নিয়ে এসেছে দারোয়ান। পঁচিশ বছর বন্ধ পড়ে থাকা মোটা গেজের ঢাউস আলমারি খোলা হবে। কী আছে ভিতরে? উৎকণ্ঠায় শিক্ষকরা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে। সবার আগে শ্বাস চেপে আলমারির ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছেন শঙ্কর নাথ। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর চাবিওলার খোঁচাখুঁচিতে আলমারির বন্ধ তালা খচ খচ আওয়াজ করল। তারপর একটু তেল ঢুকিয়ে তালার হ্যান্ডেলে বার কয়েক হাতুড়ির ঘা দিতেই ধীরে ধীরে ওটা সমকোণে ঘুরে গেল। মুখে হাসি ছড়িয়ে পাল্লা খুলে এক পা এগোলেন হেডমাস্টার। রহস্যের যবনিকা উঠতে যাচ্ছে। একটু পরেই সবার চোখের সামনে আলমারির দু’টো পাল্লা আস্তে আস্তে খুলে গেল। ভিতরটা খানিক দেখা যাচ্ছে। ধুলোর মোটা স্তর সব গুলো তাকে। নিচের তাক গুলো খালি। উপর তাকে কিছু কাগজ পত্র আর লম্বা মত কি যেন! সাপ নয় তো? দু’পা পিছিয়ে এলেন শঙ্করনাথ। জড়াজড়ি করে দু’টো সাপ যেন শুয়ে আছে! খানিক দূর থেকে এবার ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন শঙ্করনাথ। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এখন। বাদামী রঙের গায়ে গায়ে লাগানো দুটো বেত। বাঁকানো ধরণের। বেশ বড় আর শক্ত দু’হাতে দু’টো বেত তুলে নিলেন শঙ্করনাথ। বিষ্ণু বাবু মিন মিন করে বললেন, ‘এ সবে তো আজকাল কোন কাজ হবে না। ফেলে দিন স্যার’। হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন শঙ্করনাথ, ‘ফেলবো কেন? সব পুরনো জিনিষ ফেলতে নেই, জানেন’! ‘কী করবেন এ দু’টো নিয়ে’? ‘যত্ন করে রেখে দেব। অনাদি বাবুর দেওয়া দাওয়াই । ‘মানে’? ‘মানে, বদমাশ ছাত্র গুলোকে শায়েস্তা করবার ওষুধ’। ‘রিস্ক হয়ে যাবে স্যার’, সামন্ত বাবু কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন। একটু পরে সামনে দাঁড়ানো শিক্ষিকদের মুখের দিকে নিস্পলক তাকিয়ে রইলেন শঙ্করনাথ। কিছুক্ষণ চুপ থেকে গলার স্বর সামান্য উঁচুতে তুলে বললেন, ‘আপনাদের কী মনে হয়? আগেকার শিক্ষকরা ছাত্রদের পিটুনি দিয়ে ভুল করতেন’? কোন জবাব পেলেন না শঙ্করনাথ। বিষ্ণু বাবু মৃদু স্বরে আগের প্রশ্নটাই আবার করলেন, ‘আপনি ছাত্রদের বেত মারবেন নাকি’? চোখ বন্ধ করে বিষ্ণু বাবুর প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে লাগলেন শঙ্করনাথে। হঠাৎ মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। কানের কাছে কে যেন বলল, ‘ছাত্রদের আগে পুত্রসম ভাবুন, তারপর নহে বেত চালাবেন’। চমকে উঠলেন শঙ্করনাথ। খানিক চুপ থেকে বিষ্ণু বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ঘরের নীরবতা ভেঙে নরম গলায় বললেন, ‘বেত তো মারবোই। তার আগে যোগ্যতা অর্জন করি’। পুরনো দিনের মেহগনি কাঠের চেয়ারে বসা হেডমাস্টারের মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পাড়ল না কেউ।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
ড.সৌমিত্র কুমার চৌধুরী, ভূতপূর্ব বিভাগীয় প্রধান ও এমেরিটাস মেডিক্যাল স্যায়েন্টিস্ট, চিত্তরঞ্জন জাতীয় কর্কট রোগ গবেষণা সংস্থাণ, কলকাতা-700 026. প্রকাশিত গ্রন্থ- বিজ্ঞানের জানা অজানা (কিশোর উপযোগী বিজ্ঞান), আমার বাগান (গল্পগ্রন্থ), এবং বিদেশী সংস্থায় গবেষণা গ্রন্থ: Anticancer Drugs-Nature synthesis and cell (Intech)। পুরষ্কার সমূহ: ‘যোগমায়া স্মৃতি পুরস্কার’ (২০১৫), জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকায় বছরের শ্রেষ্ঠ রচনার জন্য। ‘চৌরঙ্গী নাথ’ পুরস্কার (২০১৮), শৈব ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত উপন্যাসের জন্য। গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরষ্কার (2019), পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও জৈবপ্রযুক্তি দফতর থেকে), পঁচিশ বছরের অধিক কাল বাংলা ভাষায় জনপ্রিয় বিজ্ঞান রচনার জন্য)।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!