একবার কোরবানির ঈদে

তামান্না ঝুমু
তামান্না ঝুমু - উন্নয়ন পরামর্শক
5 মিনিটে পড়ুন
সাময়িকী আর্কাইভ

দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি তখন। সেবারের কোরবানির ঈদে আব্বার শরীর খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। সঙ্গে আর্থিকও একটু সঙ্কট চলছিল বোধ করি। আমাদের তাই কোরবানি দেওয়া হয় নি। কোরবানির দিন একটা মুরগি জবাই করা হয়েছিল। প্রতিবেশীদের সবার ঘরে-ঘরে কোরবানি হয়েছিল, শুধু আমাদের ছাড়া। ঈদের দিন আমাদের মনটা একারণে বেশ মলিন ছিল।

ঈদের ছুটি শেষ হবার পর স্কুল খুললো। আমরা স্কুলে গেলাম। স্কুলের বারান্দায় আমারা অনেক ছেলেমেয়ে একসঙ্গে হয়েছিলাম। বিবেক স্যার আমাদের কার ঈদ কেমন গেল, জিজ্ঞেস করলেন। তিনি আরেকটি প্রশ্ন করলেন, তোদের কার বাড়িতে কী দিয়ে কোরবানি হয়েছে রে? কেউ বললো, গরু, কেউ বললো, ছাগল। আমি চুপ ক’রে রইলাম। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, তোরা কী দিয়ে কোরবানি করেছিস? আমি মাথা নিচু ক’রে আমতা-আমতা করতেই আমাদের এক প্রতিবেশী মেয়ে খুব হাসতে হাসতে বললো, স্যার, ওরা এবার মুরগি দিয়ে কোরবানি দিয়েছে। উপস্থিত সবাই ওর কথা শুনে হেসে কুটিকুটি হয়ে গেল। ওরা যতো হাসতে লাগলো, আমি ততো লজ্জা ও অপমানে ধুলিস্যাৎ হয়ে যেতে থাকলাম। চারিদিক থেকে নানা রকমের হাসির শব্দে পরিবেশ মুখরিত হতে থাকলো। নানা বাক্যও ভেসে আসতে থাকলো সবার মুখ থেকে। কেউ বলছে, মুরগি দিয়ে কোরবানি! কেউ বলছে, বাঃ, দারুণ অভিনব জিনিস তো! বিমল আনন্দ, আমি ছাড়া বাকিদের সবার।

বিবেক স্যার ভালো মানুষ ছিলেন। তাঁর ছাত্রছাত্রীদের কেউকে ছোট করা স্যারের উদ্দেশ্য ছিল না। কয়েকদিনের ছুটির শেষে স্কুল খোলায় কুশল হিসেবেই স্যার কথাগুলো জিজ্ঞেস করেছিলেন। তাছাড়া, স্যার হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন ব’লে কোরবানি নিয়ে হয়ত তাঁর কিছুটা কৌতূহলও ছিল। কিন্তু স্যারের প্রশ্নের রেশ ধ’রে একজন যখন, “ওরা মুরগি দিয়ে কোরবানি দিয়েছে” কথাটি বললো, এবং তা শুনে সবাই অপার আনন্দে আমাকে টিটকিরি দিতে দিতে হাসতে লাগলো; এবং সেই পরিস্থিতিতে আমি লজ্জায় কুঁকড়ে গেলাম, তখন স্যার চুপ থাকলেন। কাউকে থামাতে চেষ্টা করলেন না। বললেন না, কোনো কারণে কারুর কোরবানি না দেওয়া বা না দিতে পারা হাসির কিছু নয়। তিনি লজ্জিত আমাকেও বললেন না, কোরবানি না দেওয়ার কারণে তোর লজ্জিত হবার কিছু নেই। এই ঘটনার পরে বেশ কয়েকদিন আমি হীনমন্যতায় ভুগেছিলাম। স্কুল-পাগল আমার স্কুলে যেতে কুণ্ঠাবোধ হচ্ছিল।

ইসলাম ধর্মের গ্রন্থে কোরবানি দেওয়ার বিধান দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র হজযাত্রীদের ওপর। অর্থাৎ এই বছর যারা হজে যাবে, শুধু তাদেরকেই কোরবানি দিতে হবে। অন্য কেউকেই নয়। হজযাত্রী না হয়ে সঙ্গতিবান হলেই কোরবানি দিতে হবে, এমন নয়। অথচ বর্তমান বিশ্বে হজযাত্রী নয়, কিন্তু সঙ্গতিবান, এমন প্রায় সব মুসলিমই কোরবানি দেয়। আবার অনেক বছর ধ’রে কোরবানি আমাদের সমাজে যতোটা না ধর্মীয়, তার চেয়ে ঢের বেশি সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন : আমরা সেবার কোরবানি দিতে পারি নি ব’লে শিশু-সমাজে পর্যন্ত আমাকে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়েছিল। আমার পিতামাতাও নিশ্চয় এজন্য বড়দের সমাজে লজ্জিত হয়েছিলেন।

অনেককে আমি দেখেছি, আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যেও ঋণ ক’রে কোরবানি করতে। কারণ কোরবানি না করতে পারলে সমাজে মানসম্মান থাকবে না। আবার বেয়াইবাড়িতে কোরবানির সময় আস্ত গরু ছাগল বা নিদেনপক্ষে গরুর ঊরু উপঢৌকন পাঠানো আমাদের বাঙালি মুসলমানদের বিশেষ সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। বিত্তবানেরা এখন অতি মূল্যবান পশু কোরবানি দেওয়ার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের বিত্ত-বৈভবের ঝলক দেখাতে পছন্দ করেন। রাজনৈতিকেরাও, তারা প্রত্যেকে কতবড় জনহিতৈষী তার অনেকখানি বেচারা এক মূল্যবান পশুকে জবাই করে প্রমাণ করতে চান।

বিবাহের আগে আমার নামে কোনোদিন কোরবানি হয় নি। বিবাহের পরে আমার প্রাক্তন বর ভদ্রলোক আমার পড়ালেখা বন্ধ ক’রে দিলেও আমার নামে দু’একবার কোরবানি দিয়েছিলেন। সে-বয়েসে তাতে আমার মনে হয়েছিল, বাঃ, ভদ্রলোকটি তো বড় মহান! উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে পারলে আমার যা প্রাপ্তি বা লাভ হতো, আমার পড়া বন্ধ করে দিয়ে দু’বার আমার নামে কোরবানি দেওয়াতে কি তার কিছুই হয়েছে? মানবজীবনে উচ্চশিক্ষার গুরুত্ব বেশি, নাকি কোরবানির? অমর্ত্য সেন বা আইনস্টাইনের নামে কি কখনো কোরবানি হয়েছিল?

আমার নিজের সঙ্গতি হবার পর থেকে আমি কোনোদিন কোরবানি দিই নি। কোরবানিতে নাকি অনেক পুণ্য। ঈশ্বর নাকি এতে খুব খুশি হন। কোরবানিতে পুণ্য যদি হয়েও থাকে, একটি অবলা অসহায় প্রাণীকে হত্যার মাধ্যমে অর্জিত পুণ্য দিয়ে আমি কী করবো? শিশুকালে আমার পিতা একবার সঙ্গতির অভাবে কোরবানি দিতে পারেন নি ব’লে আমি লজ্জিত বোধ করেছিলাম, আজ আমার সঙ্গতি থাকার পরেও আমি কোরবানি দিই না ব’লে আমি আনন্দিত বোধ করি।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!