পথের গল্প : ১

তামান্না ঝুমু
তামান্না ঝুমু - উন্নয়ন পরামর্শক
6 মিনিটে পড়ুন
সাময়িকী আর্কাইভ

এবারের গ্রীষ্মের ছুটি চলাকালীন একদিন আমার পার্শ্ববর্তী শহরে একটি নদীর পাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আকাশে গনগনে রোদ ছিল সেদিন। তাপমাত্রা বেশ গরম। দুপুরের দিকে, আমি রেল স্টেশন থেকে বের হয়ে আমার গন্তব্যের অভিমুখে হাঁটতে শুরু করলাম। সামনে খুব ব্যস্ত আর চওড়া একটি রাস্তা আমাকে পার হতে হবে। তার পরেই সেই মনোরম নদীর ধার। রাস্তা পার হবার সঙ্কেত পড়লে, আমি রাস্তা পার হতে শুরু করলাম। পার হবার সময় দেখলাম, ছোট্ট একট মেয়ে তার মায়ের সঙ্গে, ট্রাফিক সঙ্কেতে দাঁড়ানো গাড়িগুলোর কাছে গিয়ে গিয়ে এবং একই সঙ্গে পথচারীদের মধ্যে কিছু ফল বিক্রি করার চেষ্টা করছে। ফল নেবে? ফল? আম? তরমুজ? সতেজ ও স্নিগ্ধ শীতল ফল? আমি ওপারে গিয়ে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে ট্রাফিক সঙ্কেত পরিবর্তিত হয়ে গেছে। ওরা ওদের ফল বিক্রির চেষ্টা শেষে ফিরে এসেছে রাস্তার পাশে, এবং এবার শুধু পথচারীদের মধ্যেই বিক্রির চেষ্টা করছে ; ফল নেবে তোমরা? ফল? সতেজ ও স্নিগ্ধ শীতল ফল? দেখলাম, ওদের কাছে সুন্দর ক’রে কাটা পাকা আম ও তরমুজ রয়েছে। বরফ-দেওয়া একটি ডালাতে ফলগুলো ওরা রেখেছে, যাতে তা প্রচণ্ড গরমের মধ্যে সুন্দর ও ঠাণ্ডা থাকে।

দু’একজনা পথিক বা গাড়িচালক কিনছে ওদের ফল। বেশিরভাগই ওদের ফল বেচাকেনার আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পাশ কাটিয়ে অন্যদিকে নিজেদের পথে চ’লে যাচ্ছে। ছোট্ট মেয়েটিকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, খুকি, তোমার নাম কী? ও খুব সুন্দর একটি নাম বললো। আমি খুব লজ্জিত যে ওর সুন্দর নামটি আমি এখন কিছুতেই মনে করতে পারছি না। জিজ্ঞেস করলাম, তোমার বয়েস কতো? কোন ক্লাসে পড় তুমি? ও বললো, বয়েস সাত বছর, এবং ও সপ্তম শ্রেণীতে উঠেছে।

  • এখানে কখন এসেছে?
  • ভোরবেলায় এসেছি, মায়ের সঙ্গে।
  • তোমরা এ-শহরেই থাকো, নাকি অন্য কোথাও?
  • আরেকটি শহরে থাকি। ফল বেচতে এখানে আসি। অনেক ভোরে আমাদের বিক্রি করার ফলমূল সব বরফের ডালায় ভ’রে পাতাল রেলে চেপে এখানে চ’লে আসি। কারণ আমাদের এলাকার চেয়ে এখানে বিক্রিবাট্টা একটু ভাল হয়।

আমাদের কথোপকথনকালে বারবার ট্রাফিক সঙ্কেত পরিবর্তিত হতে থাকে। আর বাচ্চা মেয়েটি বারবার রাস্তায় ক্ষণিকের তরে থামা গাড়িগুলোর দিকে দৌড়ে যায় অনেক আশা নিয়ে, আর তাদের জনেজনে জিজ্ঞেস করতে থাকে, তোমরা ফল নেবে? ফল? আম? তরমুজ? ঠাণ্ডা ফল? কথাগুলো বাচ্চাটির মা নয়, ও-ই বলছে। কারণ ওর মা ইংরেজি বলতে পারে না। ওরা স্প্যানিশ-ভাষী। ওদের আশপাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া সমস্ত পথিকদেরও বলে চলেছে একই কথা। ক্রেতাদের নানা প্রশ্নের উত্তর ও ব্যসসা-সঙ্ক্রান্ত সব কথাবার্তা বাচ্চাটিই বলছে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কি এখানে প্রতিদিনই আসো? ও বললো, এখানেই বেশি আসি। মাঝেমাঝে অন্যান্য এলাকায়ও যাই।

  • ফলগুলো কেটেকুটে আগের দিন রাতেই তৈরি করে রাখো বুঝি?
  • হ্যাঁ। মা ফল কেটেকুটে নেয়। আমি মাকে সাহায্য করি। ভোরে উঠে বিক্রি করতে চলে আসি।

ওর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে আমি নদীর ধারে চলে আসি। আমি কিছু কিনি নি ওদের কাছ থেকে। কারণ আমি বাসা থেকে সারাদিনের জন্য টুকটাক খাবার ও জল ব্যাকপ্যাকে করে নিয়ে এসেছিলাম। আরও কিছু কিনে ব্যাগে ভরে নিলে ব্যাগটি ভারি হয়ে যাবে এবং আমার হাঁটতে কষ্ট হবে বলে কিছু কিনলাম না। আমি নদীর ধারে আনমনে হাঁটতে লাগলাম। জায়গাটা খুব সুন্দর। ফুলের বাগান, একটু পরে পরেই চমৎকার বসবার জায়গা, পার্ক। নদীতে নানা রকমের নৌকার ছুটোছুটি। অতি সুন্দর শান বাঁধানো নদীর পাড়ে ভ্রমণার্থীদের ভীড়। কেউ হাঁটছে, কেউ সাইকেল চালাচ্ছে, কেউ পিকনিক করছে। চারিদিক উৎসবমুখর। এক সময় এক জায়গায় ব’সে আমি বাসা থেকে নিয়ে আসা দুপুরের খাবারটি খেলাম। তারপর আবার ইতিউতি হাঁটতে থাকলাম। চারিদিকের এতসব সুন্দর দৃশ্যাবলী আমার চোখে ঝাপসা হয়ে বারেবারে সেই বাচ্চাটির আরো সুন্দর মখখানির স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠতে থাকলো। স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি চলছে। এখন ওই বয়েসের একটি বাচ্চার একটু আরাম ক’রে ঘুমিয়ে দেরিতে ঘুম থেকে উঠবার কথা, কোথাও বেড়াতে যাবার কথা, বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা ক’রে আনন্দে সময় কাটাবার কথা। কিন্তু এসব কিছুই না ক’রে ও মায়ের সঙ্গে এই তপ্ত রোদে সারাদিন ফল বিক্রি করছে, ওর নিজের এবং পরিবারের অন্নের ব্যবস্থা করতে মাকে একনিষ্ঠভাবে সাহায্য করছে। আমার কন্যাদ্বয় এই বয়েসটি পার হয়ে এসেছে।

দিনান্তে সন্ধ্যা নামে মন্দ মন্থরে। অতি সুন্দর জায়গাটি আরো আতীব সুন্দর হয়ে ওঠে। নিয়নের আলো জ্বলে চারিদিকে, আকাশেও জ্বলে নক্ষত্রের আগণন বাতি, বাতাস আরো রোমান্টিক হয়, নদীর শরীর আরো আকর্ষণীয় আরো গভীর হয়, ঢেউগুলো আরো ঝিরিঝিরি বয়। পাখিরা ঘরে ফিরতে শুরু করে। আমারও ঘরে ফেরার সময় হয়। আমি আবার একই পথের দিকে অগ্রসর হই। মনে-মনে কামনা করি, যেন ওদের দেখা আবার পাই। আবার আগের জায়গাতেই আসি রাস্তা পার হবার জন্য। দেখি, ওরা এখনো ফল বিক্রি করে চলেছে। আমি ওদের কাছে আসি। বাচ্চাটির সুন্দর মুখখানিতে সারাদিনের কঠিন পরিশ্রম ও গরমে একটুও বিরক্তির ছায়া পড়ে নি। আমি ওকে বলি, খুকি, আমাকে কিছু আম দাও। ওদের সঙ্গে কিছু মসলাও আছে। কিছু শুকনো গুঁড়ো মসলা, আর কিছু তরলজাতীয়। কোনো খদ্দের চাইলে ওরা আমের সঙ্গে তা মিশিয়ে দেয়। ও আমাকে কিছু কাটা আম দিলো। আমি বললাম, এখানকার যে-মসলাটি তোমার সবচেয়ে প্রিয়, আমাকে সেটা থেকে একটু দাও। ও আমাকে তরল মসলাটি দেখিয়ে বললো, এটি আমার বেশি প্রিয়। এবং সেটি আমার আমের সঙ্গে মিশিয়ে দিলো। আম কিনে নিয়ে আমি বাড়ি ফেরার জন্য রেল স্টেশনের দিকে এগুতে লাগলাম। তখনো বাচ্চাটি ওর মায়ের সঙ্গে ফল বিক্রি করে চলেছে। একবার ছুটে যাচ্ছে রাস্তায়, আরেকবার ফুটপাতে; গাড়ি আর পথিকদের কাছে। জনেজনে সাধছে, ফল নেবে? আম? তরমুজ? ঠাণ্ডা সতেজ আর সুস্বাদু ফল?

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!