কবি নজরুল এবং দৌলতপুরের নার্গিস

ড. কাজী মোজাম্মেল হেসেন
ড. কাজী মোজাম্মেল হেসেন
22 মিনিটে পড়ুন

সৈয়দা খাতুনের জন্ম বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার দৌলতপুর গ্রামের মুনশি পরিবারে ২৮ ভাদ্র ১৩১১ (১৯০৪ খ্রি.) বঙ্গাব্দে। তবে এ তারিখ নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। মতানৈক্য রয়েছে তাঁর পারিবারিক নাম নিয়ে–কেউ লিখেছেন সৈয়দা খাতুন আবার কেউ লিখেছেন সৈয়দা আসার খাতুন । শেষ বয়সে সৈয়দা খাতুন পরিচিতি পান সৈয়দা নার্গিস আসার বেগম বিদ্যাবিনোদিনী নামে। সৈয়দা খাতুন যদি ৮১ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকেন এবং ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে মারা যান, তাহলে তাঁর জন্ম সাল নিশ্চিত করে বলা যায় ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দ।

ইংল্যাণ্ডের ম্যানচেস্টারে সৈয়দা খাতুনের সমাধিস্থ শ্বেতপাথরে জন্মতারিখ খোদিত রয়েছে ১ জানুয়ারি ১৯১৪। উত্তরকালে অনিয়মিত ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয়ার কারণেই তাঁকে হয়ত এ তারিখটি লিখতে হয়েছিল। তাঁর পিতা ছিলেন মুনশি আবদুল খালেক ওরফে আবু মুনশি এবং মাতা ছিলেন আসমতেননিসা। চার ভাই ও দুই বোনর মধ্যে পঞ্চম সন্তান ছিলেন তিনি। পিতা-মাতা ভাই বোন নিয়ে দৌলতপুরেই ছিল তাঁদের সুখের মধ্যবৃত্ত সংসার।

সৈয়দা খাতুন তাঁর পরিবারিক নাম হলেও ডাক নাম ছিল জুবরাজ, যুবী বা যুবরাজ। পরিণত বয়সে তিনি সৈয়দা নার্গিস আসার বেগম বিদ্যাবিনোদিনী নামে খ্যাত ছিলেন। সৈয়দা খাতুনের নাম পরিবর্তনের পেছনে মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম যে বর্ণনা দিয়েছেন তা এরকম:‘মেয়েটির গ্রামের স্কুলে অক্ষর পরিচয় হয়েছিল মাত্র, তাঁকে অল্প সময়ের মধ্যে নজরুলের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য আলি আকবর খান তাঁকে হাতে কলমে শিক্ষা দিতে লাগলেন, তাঁন নতুন নাম হল নার্গিস আসার খানম।’ (মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, ‘নজরুল-জীবনী’; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭২; পৃষ্ঠা-১৫৩)

ছোটবেলা থেকেই সৈয়দা খাতুন ছিলেন পরমা সুন্দরী। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে দৌলতপুরে আলি আকবর খানের (১৮৮৫-১৯৭৭) বাড়িতে নজরুল-নার্গিস মুখামুখির পরই–দু’টি ভিন্ন সত্ত্বা এক অভিন্ন স্বত্ত্বায় পরিণত হয়। দৌলতপুরে নজরুল সেদিন যে দৌলতের সন্ধান পেয়েছিলেন, তার নাম ছিল সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিস। পরবর্তী সময়ে এদের দু’টি নাম এক হয়ে যায়–শুধু ব্যতিক্রম দেখা যায় একটি অতিরোক্ত হাইফেন: ‘নজরুল-নার্গিস’।

সৈয়দা খাতুনের ‘নার্গিস’ নামটি ছিল নজরুলের দেয়া। ফরাসি ভাষায় ‘নার্গিস’ হচ্ছে একপ্রকার গুল্মের নাম, যার মধ্যে একপ্রকার অতি সুগন্ধযুক্ত সাদা ফুল ফোঁটে। ইরানের কবিদের এ গুল্ম ও ফুল অতি প্রিয় বস্তু। নজরুল এ সুগন্ধি ফুলের নামানুসারে সৈয়দা খাতুনের নাম রেখেছিলেন ‘নার্গিস’। নাম পাল্টিয়ে নজরুলের প্রেয়সীর নতুন নাম রাখার পেছনের ঘটনাটি ছিল এরকম:‘একদিন নজরুল নার্গিসকে বলেছিলেন, এমন ফুলের মতো যার সৌন্দর্য, তার এ নাম কে রেখেছে? আজ থেকে তোমার নাম নার্গিস।’( মুজাফ্ফর আহমদ, ‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা’, মুক্তধারা, দ্বিতীয় প্রকাশ ১৯৭৬; পৃষ্ঠা-১০৯)

মোহাম্মদ কুদ্দুসের মতে, নার্গিসের পারিবারিক নাম সৈয়দা খাতুন আর নজরুলের দেয়া নাম নার্গিস আসার খানম, সংক্ষেপে নার্গিস। (এম. এ. কুদ্দুস, ‘কুমিল্লায় নজরুল’; দ্বিতীয় প্রকাশ ১৩৯৯ বাং., পৃষ্ঠা ১০৩)

সেই থেকে বাংলার সাহিত্যাকাশে নার্গিস নামটা অমর হয়ে রইল–অমর হয়ে রইল নজরুলের অসংখ্য কবিতা-গানে। একইভাবে নজরুল নামটাও যুক্ত হয়ে রইল দৌলতপুরের প্রতিটি ধূলিকণায়। নার্গিস ছিলেন নজরুলের ‘চিরজনমের প্রিয়া’; ‘কবিরাণী’–যার কাছে একসময় নজরুল ‘এত বিব্রত আর অসাবধান হয়ে পড়েছিলেন, যা তিনি কেনো নারীর কাছে কখনো হননি’। (আবদুল কাদির, নজরুল জীবনের এক অধ্যায়, ‘নজরুল রচনাসম্ভার’; পাইওনিয়ার পাবলিশার্স, ঢাকা, ২৫ মে ১৯৬৯; পৃষ্ঠা-৪৩২-৩৩)

তবে এ-কথা সত্য যে, নজরুলের কারণেই নার্গিস আজ সাহিত্যকাশের ধ্রূবতারা। আবার নার্গিসের কারণেই নজরুল আজ ‘প্রেম-বিদ্রোহের কবি,’ ‘অগ্নি-বীণার কবি,’ ‘বিদ্রোহী কবি’। দৈলতপুর ইতিহাসখ্যাত হওয়ার পেছনেও রয়েছে নজরুলের দৌলতপুর অবস্থান।

শৈশবে মেধাবী ছাত্রী সৈয়দা খাতুন খাঁ-বাড়ি প্রতিষ্ঠিত অধুনালুপ্ত উচ্চ প্রাথমিক আদর্শ বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে চতুর্থ শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়ে নিজ গৃহে উচ্চতর বিদ্যাচর্চায় রত ছিলেন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি দৌলতপুর গ্রামে অবস্থান করে আলি আকবর খানের সহযোগিতায় ঢাকা এসে তিরিশের দশকে প্রাইভেট ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে নিয়মিত পরীক্ষায় আই. এ. পাশ করে স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন।

সৈয়দা খাতুনের উর্দ্ধতন পূর্বপুরুষরা ছিলেন ইরান থেকে আসা খ্যাতমান জমিদার মীর আশরাফ আলীর উর্দ্ধতন পুুরুষদের সৈয়দ বংশীয় সহোদর ভাই। যাঁর এক উর্দ্ধতন পূর্বপুরুষ ছিলেন মুর্শিদাবাদ নবাবের দেওয়ান। আর সে-কারণেই একসময় নার্গিসদের পৈত্রিক বাড়ি ‘দেওয়ান বাড়ি’ নামে পরিচিতি পেলেও বর্তমানে তা ‘মুনশি বাড়ি’ নামে খ্যাত।

কোলকাতা থেকে নজরুল প্রথম আলী আকবর খানের সঙ্গে দৌলতপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে কুৃমিল্লা পৌঁছান ৪ এপ্রিল ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের (বাংলা ২১ চৈত্র ১৩২৭ বঙ্গাব্দ) রাতে। রাতের বেলা দৌলতপুরের পথ নিরাপদ না হওয়ায় আলী আকবর খান নজরুলকে নিয়ে তার সহপাঠি বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের সঙ্গে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের কুমিল্লাা শহরের কান্দিরপাড়ের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেন এবং দুই দিন, মতান্তরে ৩/৪ দিন সেখানে অবস্থানের পর আলি আকবর খানের সঙ্গে দৌলতপুর গ্রামে পৌঁছেন। দৌলতপুরবাসী সে দিন নজরুলকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন।

দৌলতপুর কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার বাঙ্গরা ইউনিয়নের দৌলতপুর মৌজার কোম্পানীগঞ্জ-নবীনগর সি.এন্ড.বি সড়কের পাশে অবস্থিত একটি গ্রাম। ঢাকা থেকে সড়কপথে দৌলতপুর গ্রামের দূরত্ব আনুমানিক ৭০/ ৮০ কিলোমিটার। তবে ঢাকা থেকে সড়কপথে কুমিল্লার দূরত্ব ৯৭ কিলোমিটার এবং কুমিল্লা শহর থেকে দৌলতপুরের দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। গোমতি-তিতাস-আরশি-বুড়ি-মেঘনাবিধৌত ছায়া-সুনিবিড় এক প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ও সংস্কৃতি ঋদ্ধ গ্রাম দৌলতপুর।

নজরুল দৌলতপুরের খাঁ-বাড়িতে দুই মাস পনের দিন (৫ এপ্রিল থেকে ১৭ জুন ১৯২১ খ্রিস্টাব্দ/বাংলা ২৩ চৈত্র থেকে ৩ আষাঢ় ১৩২৮ বঙ্গাব্দ) পর্যন্ত খুবই আদর-যত্নে দিন কাটান। আলি আকবরের মেঝ বোন ইখতিয়ারুন্নিসা অপুত্রক থাকায় নজরুলকে তিনি আপন ছেলের মতো আদর-যত্ন করতে সামান্যতম ত্রূটি করেন নি। নজরুলও তাকে কৃতজ্ঞচিত্তে মা বলে সম্বোধন করতে ভুল করেননি। একসময় নজরুল তাঁর লেখা ‘র্পূবের হাওয়া’ কাব্যগ্রন্থটিও ইখতিয়ারুন্নিসার নামে উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

১৩২৮ বঙ্গাব্দের ২২ বৈশাখ দৌলতপুরে খাঁ-বাড়িতে আলি আকবরের বড় ভাই নেজাবত আলি খানের কন্যা আম্বিয়া খানম মানিকের বিয়ের অনুষ্ঠানে সৈয়দা খাতুন বরযাত্রী হয়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সে অনুষ্ঠানে সংগীতের ব্যবস্থা করা হয়েছিল এবং নজরুল নিজে সে অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন। একই অনুষ্ঠানে সৈয়দা খাতুনও হারমোনিয়াম বাজিয়ে সংগীত পরিবেশন করেন। সেখানেই নার্গিসের-নজরুল প্রথম চার চোখের মিলন ঘটে–ভালো লাগে সুন্দরী ষোড়শীকে নজরুলের–সৈয়দা খাতুনও ভালোবেসে ফেলেন মাথাভরা বাবড়ি দোলানো চুল, ভরাট গাল, টানাটানা চোখ, সুঠাম দেহের তরুণ নজরুলকে। সেখান থেকেই শুরু হয় নার্গিস-নজরুলের প্রেম-পরিণয় ও বিচেছদের করুণ কাহিনী। নার্গিস আসার খানমের সঙ্গে নজরুলের পরিচয়, প্রণয়, পরিণয় এবং বিচ্ছেদ খুবই সল্পসময়ের মধ্যে ঘটলেও–এ আনন্দ-বিরহের ঘটনা কেবলমাত্র নার্গিস-নজরুলের ব্যক্তিজীবনেই নয়–পরবর্তীতে তা নজরুল-সাহিত্য এবং নজরুল-গবেষণার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট প্রভাব ও অভিঘাত সৃষ্টি করেছে।

দৌলতপুরে আলি আকবর খানের বাড়িতে ১৭ জুন ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে (বাংলা ৩ আষাঢ় ১৩২৮ বঙ্গাব্দ) শুক্রবার রাতে নার্গিস-নজরুলের মতানুক্রমে বিয়ের দিন নির্ধারিত হয়েছিল। বিয়ের সাত দিন পূর্ব থেকেই খাঁ-বাড়িতে শুরু হয়েছিল বিয়ের আনন্দ-উৎসব। জানা যায়, নার্গিস-নজরুলের বিয়ে পড়িয়েছিলেন মুনশি আব্দুর জব্বার। নার্গিসের পক্ষে উকিল শ্বশুর হয়েছিলেন তারই বড় মামা আলতাফ আলি খান। তবে সে-সময় কোলকাতায় রেল ও স্টিমার ধর্মঘট থাকার কারণে বিয়েতে বরপক্ষের কেউ উপস্থিত থাকতে না পারায়–বরের পক্ষের সাক্ষী হয়েছিলেন সাদত আলি মাস্টার এবং কনে পক্ষের সাক্ষী হয়েছিলেন মুনসি সৈয়দ আলী মাস্টার। বিয়েতে নার্গিসের দেনমোহর নির্ধারিত হয়েছিল পঁচিশ হাজার টাকা (মতান্তরে ২০ হাজার টাকা)।
নার্গিস-নজরুলের বিয়ে হয়েছিল রাজকীয় শানশওকতে। বিয়েতে আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন কুমিল্লার ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত পরিবারের ১১জন সদস্য। নজরুলের কোলকাতার বন্ধুদের বিয়েতে আমন্ত্রণ জানানো হলেও সেদিন সেখানে কেঊই উপস্থিত হননি। স্থানীয় অতিথিদের মধ্যে সেদিন বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন বাঙ্গরার জমিদার রায়বাহাদুর রূপেন্দ্রলোচন মজুমদার, বাঙ্গরা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক অবনীমোহন মজুমদার (১৮৯১-১৯৪৩)। বিয়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগদান করেছিলেন সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, বংশিবাদক ওস্তাদ আফতাবউদ্দিন ফকির, আলিনেওয়াজ ওরফে তুফানিসহ ২০ জনের একটি দল–যারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আমন্ত্রিত হয়ে দৌলতপুরে এসেছিলেন। জানা যায় নার্গিসের-নজরুলের বিয়েতে সেদিন সর্বমোট খরচ হয়েছিল পনের হাজার টাকা।

দৌলতপুরে নার্গিসের-নজরুলের বিয়ের অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণপত্র এবং নানা জনের কটুক্তি–সেদিন যেমনি আলি আকবর খানকে উত্তেজিত করে তুলেছিল, তেমনি কাবিননামার শর্ত ও নানা পরিস্থিতি নজরুল-পৌরুষে অঘাত হানায় নজরুলও সেদিন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। একপর্যায়ে উভয়ের বাকবিতণ্ডায় বিয়ের অনুষ্ঠান প্রায় ভেঙে যাবার উপক্রম হয়ে পড়ে। তবে অভ্যাগত অতিথিবর্গের হস্তক্ষেপে পরিবেশ শান্ত হয় এবং নজরুল বিবাহউত্তর বাকি উৎসব যত শীঘ্র পারেন বন্দোবস্ত করবেন ঘোষণা দিয়ে শেষ রাতের দিকে বীরেন্দ্র সেনগুপ্তের সঙ্গে কুমিলল্লার কান্দিরপাড় চলে আসেন। মতান্তরে, পরের দিন ১৮ জুন বাংলা ৪ আষাঢ় সকালে নাস্তা সেরে বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের সঙ্গে দশ-এগার মাইল কর্দমাক্ত রাস্তা পায়ে হেঁটে কোম্পানীগঞ্জ হয়ে নজরুল কুমিল্লার পথে দৌলতপুর ত্যাগ করেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুলাই নজরুল কুমিল্লার কান্দিরপাড় থেকে আলি আকবর খানকে পত্র লিখে জানান, বাকী উৎসবের জন্য যত শিগগির পারি বন্দোবস্ত করবো। বাড়ির সকলকে দস্তুর মতো সালাম দোয়া জানাবেন। অন্যান্য যাদের কথা রাখতে পারিনি তাদের ক্ষমা করতে বলবেন। তাকেও ক্ষমা করতে বলবেন, যদি এ ক্ষমা চাওয়া ধৃষ্টতা না হয়।

নার্গিস আসার খানমকে আমরা নজরুলের মাধ্যমে জানলেও, ব্যক্তি নার্গিস সম্পর্কে অনেক তথ্য আজও আমাদের অজানা। ব্যক্তি নার্গিস ছিলেন অসাধারণ এক সুন্দরী মহিলা; ছিলেন অসাধারণ গুণী ও ব্যক্তিত্বধারী। তিনি ছিলেন সংস্কৃতিমনা এবং সুকণ্ঠের অধিকারী। ছোটবেলা ওস্তাদ রেখে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান শিখেছেন; ছিলেন একজন সুলেখক ও কবি। তাঁর লেখা ‘তাহমিনা’, ‘ধূমকেতু’, ‘পথের হাওয়া’ উপন্যাসসহ ডজনখানেক ধর্মীয় পাঠ্যপুস্তক ও কিছুসংখ্যক কবিতা-গান সুধীসমাজে সমাদৃত হয়েছে। পত্র-পত্রিকায় তাঁর বেশকিছু সাক্ষাতকারও মুদ্রিত হয়েছে–যেখানে তিনি নজরুলকে দেহের তীরে পেয়েও তাঁকে হারানোর অন্তহীন বেদনা প্রকাশ পেয়েছে। কবিতা আবৃত্তিতে নার্গিস পারদর্শি ছিলেন এবং বহু পুরস্কারও তিনি অর্জন করেছিলেন। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘যমুনা সাহিত্য গোষ্ঠি’র ‘বিদ্যাবিনোদিনী’ খেতাবে ভূষিত হন। মধ্যজীবনে তিনি কৃতিত্বের সংগে ঢাকায় গ্রন্থ ব্যবসা পরিচালনা করেছেন । সম্ভবত সে-সময় তিনিই ছিলেন ঢাকায় প্রথম মহিলা পুস্তক ব্যবসায়ী।

নার্গিস সম্পর্কে অধ্যাপক মিলন দত্ত লিখেছেন:‘ নার্গিসের এক ছোট বোন (cousin sister) এর বিয়ে হয়েছিলো কুমিল্লা জেলার চাঁদপুর মহাকুমার বর্তমান চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানাধীন রূপসা গ্রামের আবদুল লতিফের সঙ্গে। লতিফ সাহেব ‘ল’ পড়াকালে কারমাইকেল হোস্টেলে থাকতেন। আমিও তখন কারমাইকেল হোস্টেলে থাকতাম। নজরুলের সঙ্গে আমার একটু হৃদ্যতা আছে জেনে তিনি নার্গিস সম্পর্কে অনেক কথাই আমাকে বলেছিলেন। তিনি খান পরিবার এবং তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে যা জানতে পেরেছিলেন তা সংক্ষেপে এই যে নজরুল নার্গিসকে দেখে এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, বিয়ের পূর্বেই তাঁকে একান্ত সান্নিধ্যে পেতে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাতেন। আলী আকবর খান নার্গিসকে নজরুলের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্যে তাকে বোনের বাড়ি থেকে নিজ বাড়ি এনে শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলি ও অন্যান্য লেখকদের কিছু লেখা পড়াতেন ও বুঝাতেন এবং নজরুলের সঙ্গে মেশার সুযোগ না দেওয়ার ইচ্ছায় অধিকাংশ সময় নিজের কাছেই রাখতেন, বিয়ের পূর্বে তাঁদের মেলামেশা নিয়ে সমাজের নানা আলোচনা চলছিলো। মানুষের মুখও তো তাঁকে বাঁচিয়ে চলতে হবে। কিন্তু এ অবস্থা নজরুলের অসহনীয় ছিল–বিরোজাসুন্দরী দেবী দৌলতপুরে এ বিয়েতে গেলে এই বিষয়টাকে নজরুল তাঁর কাছে বর্ণিলভাবে প্রকাশ করেছিলেন। যার জন্য বিরোজা দেবী এ বিয়ে করতে নিষেধ করেছিলেন।’ (দিলদার সম্পাদিত, ‘নজরুল স্মৃতিকথা,’ অধ্যাপক মিলন দত্তের ‘প্রথম প্রেম ও নার্গিস বেগম’ প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য)

সুলতান মাহমুদের (১৯০৫-১৯৮৫) সঙ্গে নার্গিসের সাক্ষাৎকার আরও চমৎকার:‘আমি ছাত্রকালে কারমাইকেল হোস্টেলে থাকাকালে নার্গিস বেগম একবার কোলকাতা গিয়েছিলেন ১৯২৮ কিংবা ১৯২৯ ইং সনে। আমি লতিফ সাহেবের নিকট খবর শুনে নার্গিসের সঙ্গে আমার কি করে দেখা হতে পারে, কোনো (arrangement) করা যায় কি না, বললে তিনি নার্গিস বেগমকে একদিন ট্যাক্সি করে কারমাইকেল হোস্টেলের গেইট পর্যন্ত নিয়ে আসেন এবং আমাকে খবর দিলে আমি গেটে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করি।…. আমি নজরুল-নার্গিসের বিচ্ছেদের রহস্য জানার জন্য কথা প্রসঙ্গে নার্গিস বেগমকে জিজ্ঞাসা করলাম: আপনাদের বিয়ের সময় কাজী নজরুলকে খানে মাদাম করার কথা উঠেছিল? উত্তরে তিনি বললেন, ‘অমাকে সে নিয়ে যেতো কোথায়? খাওয়াতে পারতো কি? চুরুলিয়ার বাড়ির সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল না। থাকতো পরের আস্তানায়। তখনও লেখায় তেমন পয়সা পেতো না। একস্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে খরচ দিতে হতো অন্যের…। কুমিল্লা আসার সময় মামার অতিথি হিসাবে আমার মামাই খরচ দিয়েছিলেন। এই লোক বউ নিয়ে তুলতো কোথায়? খাওয়াতো কি… আমাদের সামাজিক মান সম্ভ্রম ও আমার মনের দিকটা একবারও কি সে ভেবে দেখেছে?…..ঘরছাড়া এক পথিক যুবাকে বর করে নিলাম। তাই আমি দোষী, আর সে বুক ফুলিয়ে সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে লিখছে কবিতা, আমি জ্বলছি দুঃখ দহনে। স্ত্রী পুত্র নিয়ে সে হাসে, আমি চোখের জলে ভাসি।’ (সুলতান মাহমুদ মজুমদার, ‘কবিপ্রিয়ার সান্নিধ্যে কিছুক্ষণ’; ‘সাপ্তাহিক আমোদ’: ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৮৭)

মোশাররফ উদ্দিন ভূঁইয়া (১৮৯৫-১৯৭৭) একজন নামজাদা প্রকাশক, ‘চলন্তিকা বইঘর’ ও ‘চলন্তিকা কম্পিউটারর্স’-এর স্বত্ত্বাধিকারী। তিনি নার্গিসকে খুবই কাছ থেকে দেখেছেন। তার লেখায় ব্যক্তি নার্গিস সম্পর্কে সুন্দর তথ্য ফুটে উঠেছে এভাবে, ‘নার্গিস, নজরুলপ্রিয়া নার্গিস বাংলা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-ইতিহাসের এক অমর নায়িকা, কিংবদন্তির রাজকুমারী। নার্গিস সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই অমার। এবং সেই যোগ্যতাও আমার নেই। তবে, আমার জীবনের মহত্তম সঞ্চয় হলো মহিয়সী কবিপ্রিয়া নার্গিসের অপত্য স্নেহ ও সান্নিধ্য লাভ। বলা যায়, ছাত্রজীবন থেকেই নার্গিস পরিবারের সাথে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা।….খাঁ বাড়ি ও মুনসি বাড়িতে প্রায়ই যেতাম। নজরুলসুহৃদ আলি আকবর খান ও কবিপ্রিয়াকে অনেকবার দৌলতপুরে দেখেছি। কিন্তু ঘনিষ্ঠতা হয় ঢাকায়, ১৯৫৫-এর দিকে। মনিরুল হকের সঙ্গে আমি পরম শ্রদ্ধেয়া নার্গিসের বাসায় যাই। তখন থেকেই নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে, লাভ করি তাঁর অপত্য স্নেহ।…..যখনই তাঁর সান্নিধ্যে যেতাম, তখনই আমার মনে হতো: আমি এক যন্ত্রণাদগ্ধ মহিয়সী নারী এবং ইতিহাসের কিংবদন্তির নায়িকার মুখোমুখি। নার্গিস যেভাবে এবং যে সকল বিষয়ে আলোচনা করতেন, আমি বিশ্বাস করি: সমকালে কোনো মুসলিম মহিলার সাথে তাঁর তুলনা হয় না। রূপের রাণী নার্গিস অতিথিপরায়ণা, রুচিশীল, পরিচ্ছন্নপ্রিয়তা, স্বল্পভাষিণী ছিলেন। তাঁর হাসি ছিলো মধুর, মুগ্ধ না হয়ে উপায় ছিল না।….নিজের হাতে রান্না করতেন, নামাজ পড়তেন এবং তিনি অবিশ্বাস্য রকম দায়িত্বশীল ছিলেন। স্বামীর প্রতি তিনি অত্যন্ত দায়িত্বশীল ছিলেন।…..দৌলতপুরে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাবার ইচ্ছা ছিল তাঁর।…..’৪৭ সালের আগে আমার বর্তমান দোকান ঘরটিই ছিলো কবিপ্রিয়ার বেডরুম। আর এই ঘরটির নিচ তলায়ই ছিলো আলি আকবর খানের ‘ভারতী লাইব্রেরী’।…..১৯৪০ সালে নজরুল এই ঘরেই তাঁর সাথে জীবনের শেষবারের মতো দেখা করতে এসেছিলেন।…..ব্রিটিশ যুগে ঢাকায় মাত্র ৩টি গাড়ি ছিলো, ১টি ছিলো নার্গিসের।….নার্গিস প্রায় নিয়মিত নজরুলসংগীত শুনতেন। বিশেষ করে, নজরুলের বিরহদীর্ণ প্রেমাশ্রয়ী সংগীতমালা শুনে তাঁকে আমি নিরবে কাঁদতেও দেখেছি। নিজে ছিলেন সুকণ্ঠি । শৈশবে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানও গাইতেন, সে কথা নিজেই বলেছেন আমাকে।’ (সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ: মোশাররফ হোসেন ভূইয়া. ‘কবিপ্রিয়া নার্গিস : তোমাকে যেমন দেখেছি’; অভিনন্দন, ১৯৯৬; পৃষ্ঠা ৭৭)

বাস্তবে নার্গিস ছিলেন নজরুলধ্যানী, নজরুলপ্রেমী। নজরুলের কাব্যপ্রতিভা বিকাশের পেছনেও নার্গিসের অবদান অপরিসীম। নজরুলকে নার্গিসও কম ভালোবাসেননি। নার্গিসকে হারিয়ে নজরুলজীবনে যেমনি ঝড় বয়ে গিয়েছিল–তেমনি প্রেম-বিরহ-ক্ষোভও সৃষ্টি হয়েছিল নার্গিসজীবনে। যার প্রতিকীরূপ প্রকাশ পেয়েছে নার্গিসের লেখা ‘তাহমিনা’ উপন্যাসে। যেখানে নায়ক বীর রুস্তম তার নববিবাহিত স্ত্রী তাহমিনাকে ফেলে যুদ্ধে চলে যাওয়ার কাহিনীর মধ্যে নজরুল-নার্গিসের জীবণকাহিনীর ছাপ স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। একইভাবে নার্গিসের ‘ধূমকেতু’ উপন্যাসেও রয়েছে ধূমকেতুর মতো নার্গিসজীবনে নজরুলের উদয় ও অস্তমিত হওয়ার এক করুণ কাহিনী। ‘পথের হাওয়া’ উপন্যাসে নার্গিস বর্ণনা করেছেন নজরুলের বহিমিয়ান জীবনের নানা খুঁটিনাটি দিকসমূহ।

নজরুল দৌলতপুর ত্যাগের পর দীর্ঘ সতের বছর অপেক্ষায় দিন গুনতে হয় নার্গিসের। অসংখ্য কবিতা, গান ও উপন্যাসের মাধ্যমে নার্গিস আপন বিরহ, মান-অভিমান, ক্ষোভ, অভিযোগ প্রকাশ করেও জানতে পারেননি নজরুলের মনের কোনো প্রতিক্রিয়া। অগত্যা ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে নার্গিসের পক্ষ থেকে তাঁর মামা আলতাফ আলি খানকে কোলকাতা পাঠিয়ে নজরুলের কাছ থেকে তালাকনামায় স্বাক্ষর করিয়ে নিয়ে আইনমোতাবেক নজরুল-নার্গিসের বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটানো হয়। জানা যায়, তালাকনামায় স্বাক্ষরের সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন মোহিতলাল মজুমদার; ডক্টর লুৎফর রহমানও নাকি সে দলিলে সাক্ষী হিসাবে স্বাক্ষর করেছিলেন’। (মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, ‘নজরুল-জীবনী”; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭২; পৃষ্ঠা ১৬৫)

সতের বছর অপেক্ষায় থাকা অবস্থায় নার্গিস নজরুলকে মোট চারখানা চিঠি লিখেছিলেন এবং তিনবার নিজে কোলকাতায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। আলি আকবর খান ও কাজী আবদুল লতিফ নজরুল-নার্গিস ট্রাজেডির মীমাংসার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু নজরুল, নার্গিসের চিঠি বা সুপারিশের গুরুত্ব না দিয়ে ১.৭.১৯৩৭ তারিখে ১০৬ কোলকাতা আপার চিৎপুর রোডের গ্রামোফোন কোম্পানীর রিয়ারসাল রুম থেকে নার্গিসকে প্রথম ও শেষ চিঠিটি পাঠান। যেখানে তিনি লেখেন:‘…..আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি–তা দিয়ে তোমায় কোনদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি ‘অগ্নি-বীণা’ বাজাতে পারতাম না–আমি ‘ধূমকেতু’র বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না।….আজ চলেছি জীবনের অস্তমান দিনের শেষে রশ্মি ধরে ভাটার স্রোতে, তোমার ক্ষমতা নেই সে পথ থেকে ফেরানোর। আর তার চেষ্টা করো না। তোমার লেখা এই আমার প্রথম ও শেষ চিঠি হোক। যেখানেই থাকি, বিশ্বাস করো, আমার অক্ষয় আর্শিবাদী কবচ তোমায় ঘিরে থাকবে। তুমি সুখী হও, শান্তি পাও–এই প্রার্থনা। আমায় যত মন্দ বলে বিশ্বাস কর, আমি তত মন্দ নই–এই আমার শেষ কৈফিয়ৎ।’
চিঠির সঙ্গে নার্গিসকে উদ্দেশ্য করে নজরুল ‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই/কেন রাখ তারে মনে’ গানটিও লিখে পাঠিয়েছিলেন। গানটির সুরকার ছিলেন নজরুল নিজে। গানটি এইচ.এম. ভি.-তে বাণীবদ্ধ করা হয় জুলাই ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে এবং বেতারে প্রচারিত হয় ৮ জুন ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে। গানে কণ্ঠদান করেছিলেন সন্তোষ সেনগুপ্ত–যার মধ্যে নার্গিস-নজরুলের প্রেম-বিরহের স্মৃতিচারণ সুস্পষ্ট।

নজরুলের ১.৭.৩৭ তারিখের লেখা চিঠি সম্পর্কে শৈলজানন্দের বর্ণনা:‘নজরুল তাকে নার্গিস বেগমের নিকট হতে পাওয়া পত্রটা পড়তে দেয়। পড়ার পর নজরুলকে পত্রের উত্তর দিতে বলায়, অল্পক্ষণের ভিতরে সে একটা গান লিখে শৈলজানন্দের হাতে দিয়ে বলল, এই তো পত্রোত্তর দেয়া হলো। পত্রের সঙ্গে এই গানটিও নার্গিস বেগমকে পাঠিয়ে দিলেন কি-না তা আমি জানি না।’ ( মুজাফ্ফর আহমদ, ‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা’, মুক্তধারা, দ্বিতীয় প্রকাশ ১৯৭৬; পৃষ্ঠা ১২৩)
‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী দেব খোঁপায় তারার ফুল’ গজলাঙ্গের এ গানটিও নজরুলের মানসপ্রিয়া নার্গিসকে উদ্দেশ্য করে লেখা। গানটি নজরুলের ‘বুলবুল’ কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। গানের সুরকার নজরুল নিজে। গানে কণ্ঠদান করেন সত্য চৌধুরী। গানটি প্রথম বেতারে প্রচারিত হয় ১৪ ডিসেম্বর ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে এবং এইচ. এম. ভি.-তে বাণীবদ্ধ হয় ডিসেম্বর ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে। বাণীবদ্ধ হওয়ার অতি অল্পসময়ের মধেই তা জনপ্রিয়তা অর্জন করে। গানটি সম্পর্কে এক মজার কাহিনী রয়েছে : কোলকাতার গ্রামোফোন কোম্পানীর স্টুডিওতে একদিন আড্ডা বসেছিল। আড্ডায় হঠাৎ একজন প্রস্তাব রাখেন–এবার লটারীতে এক লক্ষ টাকা পেলে কে কার প্রিয়াকে কীভাবে সাজাবেন। উত্তরে একেকজন একেক ভাবে আপন প্রিয়াকে অপরূপ করে সাজানোর বর্ণনা দিচ্ছিলেন। এমন সময় কবি নজরুল স্টুডিওর ভিতরে প্রবেশ করায়, তাঁর কাছেও জানতে চাওয়া হয়েছিল লটারীতে এক লক্ষ টাকা পেলে সে তাঁর প্রিয়াকে কীভাবে সাজাবেন। জবাবে নজরুল তাদের একটু অপেক্ষা করার অনুরোধ জানিয়ে কাগজ-কলম নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে লিখে ফেলেন ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী দেব খোঁপায় তাঁরার ফুল’ গানটি–যার মধ্যে রয়েছে কবিপ্রিয়াকে অপরূপ করে সাজিয়ে তোলার চিত্রকল্প।

সতেরো বছর পর ১৯৩৮ সালে ঢাকা জেলার রায়পুরা থানার অন্তর্গত হাসনাবাদ গ্রামের কবি আজিজুল হাকিমের (১৯০৮-১৯৬১) সঙ্গে নার্গিসের দ্বিতীয় বিবাহ সম্পন্ন হয়। অল্পবয়সে আজিজুল হাকিমের কবি-প্রতিভার বিকাশ ঘটলেও পরিণত-বয়সে তিনি অনেক কাব্যগ্রন্থ, গল্প-উপন্যাসের লেখকসহ অনুবাদক এবং পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

বিবাহিত জীবনে নার্গিস ছিলেন এক ছেলে ও এক মেয়ের জননী। ৮১ বছর বয়সে (২ জুন ১৯৮৫ খ্রি./১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৩৯২ ব.) সৈয়দা আসার খানম যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারে তাঁর একমাত্র পুত্র ডা. ফিরোজ (আজাদ)-এর নিজস্ব বাসভবনে দেহত্যাগ করেন। তাঁকে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারে সমাধিস্থত করা হয়। মৃত্যুর পর ২৬ জুন ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে নার্গিসের পৈত্রিক বাড়িতে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করে এক শোকসভা ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছিল।

বর্তমানে, নার্গিস-নজরুলের প্রেম-পরিণয়-বিরহের ৯৭ বছর কেটে গেলেও, নার্গিস-নজরুল-দৌলতপুরের অনেক রহস্য আমাদের আজও অজানা। ফলে পূর্ণাঙ্গ নজরুলকে জানতে হলে আমাদের নার্গিস-নজরুলকে নিয়ে আরও অনেক গবেষণার প্রয়োজন।

তথ্যসূত্র:

১. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, ‘নজরুল-জীবনী”; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭২; পৃষ্ঠা ১৫৩
২. মুজাফ্ফর আহমেদ, ‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা’, মুক্তধারা, দ্বিতীয় প্রকাশ ১৯৭৬; পৃষ্ঠা ১০৯
৩. এম. এ. কুদ্দুস, ‘কুমিল্লায় নজরুল’; দ্বিতীয় প্রকাশ ১৩৯৯ বাং., পৃষ্ঠা ১০ ৩
৪. আবদুল কাদির, নজরুর জীবনের এক অধ্যায়, ‘নজরুল রচনাসম্ভার’; পাইওনিয়ার পাবলিশার্স, ঢাকা,
২৫ মে ১৯৬৯; পৃষ্ঠা ৪৩২-৩৩
৫. এম. এ. কুদ্দুস, ‘কুমিল্লায় নজরুল’; দ্বিতীয় প্রকাশ ১৩৯৯ বাং., পৃষ্ঠা ১৯
৬. দিলদার সম্পাদিত, ‘নজরুল স্মৃতিকথা,’ অধ্যাপক মিলন দত্তের ‘প্রথম প্রেম ও নার্গিস বেগম’ প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য।
৭. সুলতান মাহমুদ মজুমদার, ‘কবিপ্রিয়ার সান্নিধ্যে কিছুক্ষণ’; ‘সাপ্তাহিক আমোদ’: ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৮৭
৮. সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ: মোশাররফ হোসেন ভূইয়া. ‘কবিপ্রিয়া নাগর্ড়স: তোমাকে যেমন দেখেছি”;
অভিনন্দন, ১৯৯৬; পৃষ্ঠা ৭৭
৯. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, ‘নজরুল-জীবনী”; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭২; পৃষ্ঠা ১৬৫
১০. মুজাফ্ফর আহমদ, প্রাগুক্ত; পৃষ্ঠা ১২৩

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
চিত্রকর, লেখক ও গবেষক।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!