কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের সিদ্ধান্ত বহাল রাখল ভারতের সুপ্রিম কোর্ট

সাময়িকী ডেস্ক
সাময়িকী ডেস্ক
15 মিনিটে পড়ুন

কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের সিদ্ধান্ত বহাল রাখল ভারতের সুপ্রিম কোর্ট

ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করার কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত বহাল রেখেছে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। ওই সিদ্ধান্ত ‘অসাংবিধানিক’ নয় বলে আদালত রায় দিয়েছে।

সেই সঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীরে দ্রুত রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়া এবং সামনের বছরের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের জন্য আদালত আদেশ দিয়েছে।

ভারতের সুপ্রিম কোর্টে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিল সংক্রান্ত মামলার রায় দান ছিল সোমবার।

সোমবার প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির ওই সাংবিধানিক বেঞ্চ বলেছে, সংবিধানের ৩৭০ ধারা মেনে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ‘অস্থায়ী’ ছিল। রাষ্ট্রপতি শাসনকালে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের বিষয়টিও নিয়ম বহির্ভূত নয়।

দ্রুত জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করার সময়সীমাও বেঁধে দিয়েছে ভারতের শীর্ষ আদালত।

২০১৯ সালের ৫ই অগাস্ট ভারতের মুসলিম প্রধান জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের সাংবিধানিক বিশেষ মর্যাদা সংক্রান্ত সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে কেন্দ্রীয় শাসন জারি করে নরেন্দ্র মোদী সরকার। ওই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীরের নিজেদের সংবিধান ও আলাদা পতাকার অধিকার দেয়া হয়েছিল।

পূর্বতন জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য পুরোপুরি মুছে ফেলে একে লাদাখ এবং জম্মু-কাশ্মীর নামে দুটি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রূপান্তরিত করা হয়েছিল।

এরপর সেখানে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে দীর্ঘদিন লকডাউন করে রাখা হয়েছিল।

সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। অন্যদিকে জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আব্দুল্লা হতাশা প্রকাশ করেছেন।

কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের সিদ্ধান্ত বহাল রাখল ভারতের সুপ্রিম কোর্ট
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট।

শীর্ষ আদালতের রায়

সোমবার ভারতের সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছে, সেখানে ৭টি বিষয়ে আদেশ দিয়েছে আদালত।

যার মধ্যে প্রধান ছিল, ‘৩৭০ অনুচ্ছেদ টি অস্থায়ী বা সংবিধানে স্থায়ী মর্যাদা অর্জন করেছে কিনা?’

সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ বলেছেন, অনুচ্ছেদ ৩৭০একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা। ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর জম্মু ও কাশ্মীরের অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব নেই।

‘রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত বৈধ’-এ কথাও জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ।

প্রধান বিচারপতি বলেন “যেহেতু বিধানের ৩৭০ ধারায় কাশ্মীরকে যে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করা হয়েছিল, তা অস্থায়ী, তাই রাষ্ট্রপতি তা বাতিল করার অধিকার রাখেন। জম্মু ও কাশ্মীরের গণপরিষদ বাতিল করার পরেও রাষ্ট্রপতি এটি করতে পারেন।”

এছাড়া, জম্মু ও কাশ্মীরকে পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা দিতে কেন্দ্রকে নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।

রাজ্যের মর্যাদা দিয়ে জম্মু ও কাশ্মীরে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিধানসভা নির্বাচনের আয়োজন করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বিচারপতি সঞ্জয় কৌল তাঁর রায় ঘোষণায় জানিয়েছেন, জম্মু ও কাশ্মীরের সংবিধানের উদ্দেশ্য ছিল রাজ্যে দৈনন্দিন শাসন নিশ্চিত করা এবং ৩৭০ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য ছিল রাজ্যটিকে ভারতের সাথে একীভূত করা।

তাঁর রায় প্রদানের শেষে একটি ‘সংবেদনশীল’ উপসংহার লিখেছেন বিচারপতি কৌল। তিনি বলেন, “কাশ্মীর উপত্যকা একটি ঐতিহাসিক ভার বহন করে এবং ‘আমরা জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণ এই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছি।’

তিনি আরও জানিয়েছেন, ‘ সেনাবাহিনীর কাজ শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করা, জন্য রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ নয়। সেনাবাহিনীর প্রবেশে রাজ্যে একটি নিজস্ব বাস্তবতা তৈরি হয়েছে … পুরুষ, নারী ও শিশুদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছে।’

৩৭০ অনুচ্ছেদটি জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ ধরনের স্বায়ত্বশাসন ভোগ করার অধিকার দিয়েছিল, যা রাজ্যটিকে নিজস্ব সংবিধান, আলাদা পতাকা এবং আইন তৈরি করার অনুমোদন দেয়। পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ বিষয়ক ব্যাপারের নিয়ন্ত্রণ থাকতো কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে।

ফলস্বরুপ জম্মু ও কাশ্মীর নাগরিকত্ব, সম্পদের মালিকানা এবং মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত আইন নিজেরা তৈরি করার ক্ষমতা রাখতো।

ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মানুষকে জম্মু ও কাশ্মীরে জমি কেনা এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করা থেকেও বিরত রাখতে পারতো ঐ অনুচ্ছেদের বদৌলতে।

এই ৩৭০ ধারা এবং ৩৫এ অনুচ্ছেদ যোগ হয়েছিল ভারত ও কাশ্মীরের নেতাদের দীর্ঘ আলোচনার ভিত্তিতে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি দীর্ঘসময় ধরে অনুচ্ছেদ ৩৭০ এর বিরোধিতা করে আসছে।

কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের সিদ্ধান্ত বহাল রাখল ভারতের সুপ্রিম কোর্ট
ওমর আব্দুল্লা।

প্রতিক্রিয়া

ভারতের শীর্ষ আদালতের এই রায়ের পর রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন মহল থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গিয়েছে।

সম্প্রতি লোকসভায় পাশ হয়েছে জম্মু-কাশ্মীর পুনর্গঠন ও জম্মু-কাশ্মীর সংরক্ষণ বিল। এই দুটি বিল লোকসভা নির্বাচনের আগে গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে। আজ এই বিলগুলি নিয়ে রাজ্যসভায় আলোচনা হওয়ার কথা।

সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে স্বাগত জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক্স-এ (সাবেক টুইটারে) একটি পোস্টে লিখেছেন, “আজকের রায় কেবল একটি আইনি রায় নয়; এটি আশার আলো, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি এবং একটি শক্তিশালী, আরও ঐক্যবদ্ধ ভারত গড়ে তোলার জন্য আমাদের সম্মিলিত সংকল্পের সাক্ষ্য।”

অন্যদিকে জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আব্দুল্লা সমাজ মাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটারে) রায় দানের বিষয়ে লিখেছেন- ‘হতাশ হয়েছি, কিন্তু হার মানিনি। লড়াই জারি থাকবে। এখানে পৌঁছতে বিজেপির কয়েক দশক লেগেছে। আমরাও দীর্ঘ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত।’

জম্মু কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং ‘ডেমক্রেটিক প্রগ্রেসিভ আজাদ পার্টির’ গুলাম নবী আজাদও তাঁর ‘হতাশা’ জানিয়েছেন। তাঁর কথায়, “ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা জম্মু-কাশ্মীরের মানুষদের কিছু বিশেষ সুবিধা দিত, যা তাদের জীবনধারণের এবং অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল।”

৩৭০ ধারা নিয়ে আদালতের সিদ্ধান্তের পর জম্মু ও কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিংয়ের ছেলে এবং কংগ্রেস নেতা করণ সিং এ এনআই-কে বলেন “আমি এই রায়কে স্বাগত জানাই। এখন এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে যা কিছু ঘটেছে তা সাংবিধানিকভাবে বৈধ…আমি প্রধানমন্ত্রী মোদীকে অনুরোধ করছি যেন শীঘ্রই রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে আনার জন্য…।”

সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন বিজেপির জেপি নাড্ডা। এ দিন রায় প্রকাশের পর তিনি সমাজমাধ্যম এক্স-এ লেখেন, ‘মাননীয় শীর্ষ আদালতে ৩৭০ ধারার বিষয়ে যে রায় দেওয়া হয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি তার স্বাগত জানায়। দেশের উচ্চতম আদালত ৩৭০ ধারা এবং ৩৫-এ কে প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত, তাঁর প্রতিক্রিয়া এবং উদ্দেশ্য কে সঠিক বলে জানিয়েছে।’

অন্যদিকে, রায়ের পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে থেকেই কড়া নিরাপত্তা বলয়ে ঘিরে রাখা হয়েছিল জম্মু-কাশ্মীরকে।

সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘোষণার আগেই পিডিপি সভাপতি মেহবুবা মুফতি এবং ওমর আব্দুল্লার বাড়ির দরজা সিল করে পুলিশ এবং তাকে বেআইনি ভাবে গৃহবন্দী করা হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

যদিও সেই অভিযোগ নস্যাৎ করেছেন লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহা। তিনি দাবি করেছেন যে জম্মু ও কাশ্মীরে রাজনৈতিক কারণে কাউকে গৃহবন্দী বা গ্রেপ্তার করা হয়নি।

কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের সিদ্ধান্ত বহাল রাখল ভারতের সুপ্রিম কোর্ট
২৩টি মামলা দায়ের করা মামলা একত্রীভূত করে সুপ্রিমকোর্ট গত জুলাই মাস থেকে শুনানি শুরু করে।

কী নিয়ে মামলা?

নাগরিকত্ব, সম্পত্তির মালিকানা বা মৌলিক অধিকারের প্রশ্নেও এই রাজ্যের বাসিন্দারা বাকি দেশের তুলনায় বাড়তি কিছু সুবিধা ভোগ করেন, আর ৩৭০ ধারাই তাদের সে অধিকার দিয়েছে।

দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদে অনুযায়ী, জম্মু-কাশ্মীরের যে বিশেষ মর্যাদা ছিল তা বাতিল করে। বিলুপ্ত হয় ৩৭০ এর অন্তর্গত ৩৫-এ। পূর্ণ অঙ্গরাজ্যের মর্যাদাপ্রাপ্ত জম্মু-কাশ্মীরকে ভাগ করা হয় কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখে

দ্বিতীয়বার ক্ষমতায আসার পর ২০১৯ সালের ৫ই অগাস্ট ভারতের সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করার ঘোষণা দেয় ভারতের সরকার।

৩৭০ অনুচ্ছেদের কারণে জম্মু ও কাশ্মীর অন্য যেকোন ভারতীয় রাজ্যের চেয়ে বেশি স্বায়ত্বশাসন ভোগ করতো।

অনুচ্ছেদ ৩৭০ ভারতীয় রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরকে নিজেদের সংবিধান ও একটি আলাদা পতাকার স্বাধীনতা দিয়েছিল। এছাড়া পররাষ্ট্র সম্পর্কিত বিষয়াদি, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ বাদে অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে স্বাধীনতার নিশ্চয়তাও দেয়।

৩৭০ অনুচ্ছেদের সুবাদে কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দারাই শুধুমাত্র সেখানে বৈধভাবে জমি কিনতে পারতেন, সরকারি চাকরি করার সুযোগ পেতেন এবং সেখানে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারেন।

ঐ অনুচ্ছেদ বিলোপ করার বিষয়টি বিজেপি’র পুরনো রাজনৈতিক এজেন্ডাগুলোর একটি ছিল।

পূর্বতন জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য পুরোপুরি মুছে ফেলে একে লাদাখ এবং জম্মু-কাশ্মীর নামে দুটি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রূপান্তরিত করা হয়েছিল।

ওই অনুচ্ছেদ বাতিলের পরে কেন্দ্রীয় সরকারের এই পদক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে একাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে।

সেই সমস্ত মামলাকে একত্র করে জুলাই মাস থেকে প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন সাংবিধানিক বেঞ্চে শুরু হয় এর ধারাবাহিক শুনানি।

গত চার বছরের বিভিন্ন সময়ে দায়ের করা এই মামলা গুলিতে সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ মেনে যে বিশেষ মর্যাদা ও সুবিধা দেওয়া হয়েছিল জম্মু-কাশ্মীরকে, তা রদ করার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে একাধিক প্রশ্ন তোলা হয়েছিল।

প্রশ্ন উঠেছিল, সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন আনা এবং জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা সংসদের আছে? নাকি কেবল মাত্র ‘কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি’ বা পূর্ববর্তী রাজ্যের গণপরিষদের সুপারিশের ভিত্তিতে করা যেতে পারে?

মামলা চলাকালীন, শীর্ষ আদালতের সাংবিধানিক বেঞ্চ জানিয়েছিল, যে প্রক্রিয়ায় জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা লোপ করা হয়েছিল তা খতিয়ে দেখা হবে।

মামলা চলাকালীন এ বছর আগস্ট মাসে, আবেদনকারী পক্ষে থেকে শুনানিতে অংশ নিয়েছিলেন আইনজীবী কপিল সিব্বল।

শুনানির শুরুতে তিনি বলেন, ‘‘জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের সিদ্ধান্ত আদৌ সাংবিধানিক পদক্ষেপ নয়। পুরোপুরি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।”

কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের সিদ্ধান্ত বহাল রাখল ভারতের সুপ্রিম কোর্ট
মিরওয়াইজ মোহাম্মদ উমর ফারুক।

আবেদনকারী কারা?

এই মামলায় মোট ২৩টি আবেদন করা হয়েছে। আবেদনকারীদের মধ্যে মুলত রয়েছেন, সুশীল সমাজ, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও অ্যাক্টিভিস্ট। রয়েছেন জম্মু ও কাশ্মীর পিপলস কনফারেন্স, পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ, ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা-সাংসদ মহম্মদ আকবর লোন এবং জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন মধ্যস্থতাকারী রাধা কুমার।

আবেদনকারীদের পক্ষে কপিল সিব্বল, গোপাল সুব্রহ্মণ্যমের মতো প্রবীণ আইনজীবীরা অনুচ্ছেদ ৩৭০-এর বিষয়ে নেওয়া কেন্দ্র সরকারের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে একাধিক প্রশ্ন তুলেছেন।

আবেদনকারী ও সরকার দু’পক্ষের বক্তব্য শোনার পরে, গত পাঁচই সেপ্টেম্বর এই মামলার রায় দান স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন সাংবিধানিক বেঞ্চ।

আবেদনকারীদের অভিযোগ

অনুচ্ছেদ ৩৭০-এর বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ২০১৯ সালে নেওয়া পদক্ষেপ এবং জম্মু-কাশ্মীরকে কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চলে ভাগ বিষয়ক পদক্ষেপকে রদ করার আবেদনই মূলত জানানো হয়েছে।

আবেদনকারীদের বক্তব্য, ভারতীর সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ একটি স্থায়ী বিধান ছিল। এর যে কোনও পরিবর্তনের ক্ষেত্রে রাজ্যের গণপরিষদের অনুমতি প্রয়োজন, যা ১৯৫৬ সালে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল।

আবেদনকারীরা আরও বলেছেন, ৩৭০ ধারা অপসারণের বিষয়টি ইন্সট্রুমেন্ট অফ অ্যাকসেশন-এর পরিপন্থী, যার মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের অংশ হয়ে যায়। তাঁদের বক্তব্য, এটি জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নেওয়া একটি ‘রাজনৈতিক পদক্ষেপ’।

গণপরিষদকে বিধানসভা দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা যায় না কারণ তাদের কাজ আলাদা। শুধু তাই নয়, রাজ্যে যখন রাষ্ট্রপতি শাসন ছিল তখন এই সংশোধন করা যেতে পারে না।

কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের সিদ্ধান্ত বহাল রাখল ভারতের সুপ্রিম কোর্ট
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ।

কেন্দ্রীয় সরকারের যুক্তি

শুনানির সময়ে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ জানতে চেয়েছিল, জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যের মর্যাদা ফেরানোর, এবং নির্বাচনের বিষয়ে সরকার কী করছে।

এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতার বক্তব্য ছিল, “ওই রাজ্যের সাম্প্রতিকতম তথা সর্বশেষ ভোটার তালিকা তৈরি হয়ে গিয়েছে। তাই পঞ্চায়েত ও পুর ভোটের পরে জম্মু ও কাশ্মীরে বিধানসভা ভোট হতে কোনও সমস্যা নেই। তবে বিধানসভা ভোট কবে হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেবে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন।”

প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের পাঁচই অগস্ট রাজ্যসভায় জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা দানকারী ৩৭০ নম্বর ধারা প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করার সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জানিয়েছিলেন, এ সংক্রান্ত নির্দেশনামায় সই করেছেন স্বয়ং রাষ্ট্রপতি।

কেন্দ্রীয় সরকারের এই পদক্ষেপের পিছনে যে যুক্তিগুলি ছিল তার মধ্যে প্রধান ছিল, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই জম্মু-কাশ্মীরে ভোট হবে এবং ফেরানো হবে রাজ্যের মর্যাদা। তাদের যুক্তি, ৩৭০ অনুচ্ছেদ একটি অস্থায়ী বিধান ছিল। যেহেতু গণপরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, তাই পরিষদকে সেই পদটি গ্রহণ করতে হয়েছিল। তা না হলে, এই বিধানটি কখনই সংশোধন করা যেত না।

একই সঙ্গে দাবি করা হয়েছিল, অনুচ্ছেদ ৩৭০ প্রত্যাহার করার বিষয়টি সরকার ‘সংবিধান’ মেনে করেছে এবং এই পদক্ষেপ প্রয়োজনীয় ছিল, জম্মু-কাশ্মীরের আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে, সেখানে পর্যটন-সহ অন্যান্য বাণিজ্যের লাভের কথা মাথায় রেখে।

কিন্তু তারপর এতদিন কেটে যাওয়ার পরেও কেন, জম্মু-কাশ্মীরকে রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া হল না এবং নির্বাচন কবে হবে তা জানতে চেয়েছিল শীর্ষ আদালত।

সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলাকালীন সরকারের তরফে তুষার মেহতা বলেছিলেন, “কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করার ওই সিদ্ধান্ত ছিল সাময়িক।” তবে, কবে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের মর্যাদা কবে ফিরে পেতে পারে, সে বিষয়ে কিছু স্পষ্ট করে জানাতে পারেননি তিনি।

অনুচ্ছেদ ৩৭০ রদ করার পেছনে সরকারের যুক্তি ছিল, এই পরিবর্তনের ফলে জম্মু ও কাশ্মীরকে সম্পূর্ণভাবে ভারতের সাথে একীভূত করেছে। সরকার যুক্তি দিয়েছিল যে রাজ্যের বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য ছিল কারণ সেখানে ভারতীয় সংবিধান পুরোপুরি প্রয়োগ করা হয়নি।

সরকার আরও বলেছিল যে রাষ্ট্রপতি শাসনের অধীনে, রাজ্যপাল কর্তৃক জারি করা আদেশগুলি রাজ্য আইনসভা কর্তৃক পাস করা আদেশের সমতুল্য। অতএব, রাষ্ট্রপতি শাসনের অধীনে স্থিতাবস্থা পরিবর্তন এই কাজটিকে অবৈধ করে তুলবে না।

কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের সিদ্ধান্ত বহাল রাখল ভারতের সুপ্রিম কোর্ট
অমিত শাহ।

ঘটনার পরম্পরা

সত্য পাল মালিক, জম্মু-কাশ্মীরের তৎকালীন রাজ্যপা্‌ল, ২০১৮ এর নভেম্বর মাসে, বিধানসভা ভেঙে দেন। এক মাস পরে জারি করা হয় রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা হয়। সংসদে রাষ্ট্রপতির শাসন অনুমোদন করা হয় পরের বছর অর্থাৎ ২০১৯-এর জানুয়ারি মাসে যা পরে আবারও ছয় মাসের জন্য বাড়ানোও হয়।

ওই বছরেই (২০১৯ সাল) এর পাঁচই আগস্ট রাষ্ট্রপতি জম্মু-কাশ্মীর সংক্রান্ত নির্দেশ জারি করেন, যোগ করা হয় সংবিধানের ৩৬৭(৪) নম্বর অনুচ্ছেদ আর সংবিধানের ৩৭০(৩) নম্বর ধারায় ‘রাজ্যের সংবিধান সভা-র বদলে হয়ে যায় ‘রাজ্যের বিধানসভা’।

ওই একই দিনে, সংসদে একটি বিশেষ বিল পাশ করা হয়, যার ফলে ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ জম্মু-কাশ্মীরে কার্যকর হওয়া বন্ধ হয়। একই সঙ্গে পূর্ববর্তী জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যকে দুই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখে ভাগ করা হয়।

মোদী সরকারের এই পদক্ষেপ মিশ্র প্রতিক্রিয়া পেয়েছিল। বিরোধীদের অনেকেই একে ‘সংবিধান বিরোধী’ এবং ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত পদক্ষেপ’ বলেও মন্তব্য করেন।

কেন্দ্র সরকার সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে ব্যবহার করে এই বিল পাশ করিয়ে জম্মু-কাশ্মীরের মতো অঙ্গরাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নিয়েছে যা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপরে আঘাত হানা- ই অভিযোগও তোলা হয়েছিল।

এই পরিস্থিতিতে আজ সুপ্রিম কোর্টের এই রায়দান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এমনটা মনে করেন রাজনৈতিক মহল এবং বিশ্লেষকেরা।

যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের ২০১৯ এর পাঁচই আগস্ট ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের পদক্ষেপ বজায় রেখেছে শীর্ষ আদালত, একই সঙ্গে জম্মু-কাশ্মীরকে রাজ্যের মর্যাদা প্রধানের বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ এবং নির্বাচনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার ঘটনা তাৎপর্যপূর্ণ এমনটাও মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

বিষয়:
এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!