প্রাচীন ভারতের গণসমাধি ঘিরে যেসব রহস্য

সাময়িকী ডেস্ক
সাময়িকী ডেস্ক
8 মিনিটে পড়ুন
গুজরাটে খুঁজে পাওয়া গেছে যে প্রাচীন ভারতের সমাধিস্থল

প্রাচীন ভারতের গণসমাধি ঘিরে যেসব রহস্য

বিশ্বের প্রাচীনতম নগর সভ্যতার সময়কালের একটি বিশাল সমাধিস্থল ভারতে আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা বলছেন প্রাচীন ভারতের মানুষের জীবন এবং মৃত্যুর নিয়ে অনেক তথ্য পাওয়া যেতে পারে এই প্রাচীন সমাধিস্থল ধেকে।

ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য গুজরাটে পাকিস্তান সীমান্ত থেকে অল্পই দূরে জনবিরল কচ্ছ অঞ্চলের একটি প্রত্যন্ত গ্রামের কাছে বালি আর মাটির স্তূপ খনন শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালে। সেখানে যে কী লুকিয়ে আছে, তার কোনও ধারণাই ছিল না প্রত্নতাত্ত্বিকদের।

“আমরা যখন খনন কাজ শুরু করি, তখন আমরা ভেবেছিলাম এটি একটি প্রাচীন বসতি। এক সপ্তাহের মধ্যে আমরা বুঝতে পারি যে এটি একটি সমাধিস্থল,” বলছিলেন কেরালা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক রাজেশ এসভি, যিনি এই খননকার্যের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

তিনটি পর্যায়ে, ৪০ একর জায়গা জুড়ে ১৫০ জনেরও বেশি ভারতীয় ও বিদেশী প্রত্নতাত্ত্বিকের পরিচালনায় এই খনন কাজ হয়েছে।

বিশ্বের সবথেকে প্রাচীন নগর সভ্যতার অন্যতম, সিন্ধু-সভ্যতার আমলের অন্তত পাঁচশোটি কবরের অস্তিত্ব রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় দুশোটি কবর খনন করা হয়েছে।

প্রাচীন ভারতের গণসমাধি ঘিরে যেসব রহস্য
অন্তত পাঁচশো বছর ধরে ব্যবহৃত হত এই সমাধিস্থল

পাঁচশো বছর ধরে ব্যবহৃত সমাধিস্থল

ওই সময়কার প্রথম শহরের নাম অনুযায়ী ওই সভ্যতাকে হরপ্পা-সভ্যতাও বলা হয়ে থাকে।

সেই সমাজের মানুষরা কৃষক এবং বণিক ছিলেন। প্রাচীরে ঘেরা তাদের শহরগুলোতে পোড়া ইঁট দিয়ে বাড়ি তৈরি হত।

প্রায় ৫,৩০০ বছর আগে বর্তমান উত্তর-পশ্চিম ভারত এবং পাকিস্তানে বিস্তৃত ছিল ওই সভ্যতা।

সভ্যতাটির প্রাথমিক আবিষ্কারের পরে গত এক শতাব্দীতে গবেষকরা ভারত ও পাকিস্তানে আরও প্রায় দুই হাজারটি স্থাপনা আবিষ্কার করেছেন যেগুলি সিন্ধু সভ্যতার আমলের।

প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করছেন, গুজরাটের খাতিয়া গ্রামের কাছে বিস্তৃত সমাধিস্থলটি সম্ভবত এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত সিন্ধু সভ্যতার আমলের বৃহত্তম ‘নগর পূর্ববতী’ সমাধিস্থল।

তারা মনে করেন খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ থেকে ২৬০০ পর্যন্ত প্রায় পাঁচশো বছর ধরে ব্যবহৃত হয়েছিল এই সমাধিস্থল। এখানে আবিষ্কৃত প্রাচীনতম সমাধিগুলি প্রায় চার হাজার ছয়শো বছরের পুরনো।

প্রাচীন ভারতের গণসমাধি ঘিরে যেসব রহস্য
একটি অক্ষত পুরুষ কঙ্কাল পাওয়া গেছে সমাধিস্থলে

পাওয়া গেছে একটি অক্ষত পুরুষ কঙ্কাল

এখনও পর্যন্ত খননকার্যে একটি অক্ষত পুরুষ মানব কঙ্কাল পাওয়া গেছে এবং কঙ্কালের অংশ, খুলির টুকরো, হাড় এবং দাঁতও পাওয়া গেছে।

কবর দেওয়ার বেশ কিছু উপকরণ, যেমন একশোরও বেশি চুড়ি আর ২৭টি শাঁখের তৈরি পুঁতির মালাও পাওয়া গেছে এখান থেকে। এছাড়া চীনামাটির বড় গামলা, বাটি, থালা, ছোট কাপ, ছোট কলসি, বোতল ইত্যাদিও আবিষ্কৃত হয়েছে।

গাঢ় নীল রংয়ের পাথর লাপিস লাজুলি দিয়ে তৈরি মালার মতো কিছু মূল্যবান সম্পদও পাওয়া গেছে।

কবরগুলির বেশ কিছু অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

যেমন বেলেপাথরের বেড় দেওয়া কবরগুলো বিভিন্ন দিকে মুখ করে কাটা হয়েছিল। কিছু রয়েছে ডিম্বাকৃতির আবার অন্যগুলি আয়তাকার। ছোট ছোট কবর আছে যেখানে শিশুদের কবর দেওয়া হয়েছে। দেহগুলি চিৎ করে শোয়ানো হয়েছিল, কিন্তু মাটির অম্লত্বের কারণে বেশিরভাগ হাড়ই মিশে গেছে মাটিতে।

‘অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ আবিষ্কার’

প্রাচীন ভারতের গণসমাধি ঘিরে যেসব রহস্য
উত্তরপ্রদেশের বাগপতের সানৌলিতে মাটি খুঁড়ে আবিষ্কৃত হয়েছিল সিন্ধু-সভ্যতার আটটি কবর

মিশিগানের অ্যালবিয়ন কলেজের নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক ব্র্যাড চেজ বলেন, “এটি একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ আবিষ্কার।

“গুজরাটে বেশ কয়েকটি ‘নগর-পূর্ববর্তী’ সমাধিস্থল আবিষ্কৃত হয়েছে, তবে এটি এখন পর্যন্ত বৃহত্তম, তাই কবরের আরও বৈচিত্র্য সামনে আসবে, যার থেকে প্রত্নতাত্ত্বিকরা এই অঞ্চলের নগর-পূর্ববর্তী সমাজকে আরও ভালভাবে বুঝতে পারবেন। আগে আবিষ্কৃত কবরগুলির প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করাও সহজতর হবে”, বলছিলেন প্রফেসর চেজ।

এর আগে বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব অঞ্চলে সিন্ধু সভ্যতার স্থাপনাগুলিতে খননকাজ চালিয়ে ওই আমলের কবর দেওয়ার রীতিনীতি সম্বন্ধে কিছু ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল।

প্রাচীন ভারতের গণসমাধি ঘিরে যেসব রহস্য
খাতিয়ার সমাধিস্থলে মৃতদেহের সঙ্গে আর যেসব মাটির পাত্র পাওয়া গেছে

জাঁকজমকহীন সমাধি

মিশর এবং মেসোপটেমিয়ার অভিজাতদের মতো এখানকার শেষকৃত্যগুলি ছিল জাঁকজমকহীন। মৃতদের সঙ্গে কোনও গয়না বা অস্ত্র দেওয়া হত না।

বেশিরভাগ মৃতদেহ কাপড়ে মুড়ে আয়তাকার কাঠের কফিনে রাখা হত।

সিন্ধু সভ্যতা বিষয়ে পণ্ডিত, উইসকনসিন-ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়ের জোনাথন মার্ক কেনোয়ারের মতে, কফিনটি নামানোর আগে কবরের গর্তটি মাটির পাত্র দিয়ে ভরা হত।

কিছু মানুষকে ব্যক্তিগত অলঙ্কার সহ কবর দেওয়া হত যেমন চুড়ি, মালা, বাজুবন্ধ – এমন অলঙ্কার, যা অন্য কেউ আর ব্যবহার করতে পারবে না।

কয়েকজন নারীকে তামার তৈরি আয়না সহ কবর দেওয়া হয়েছিল।

প্রাপ্তবয়স্কদের মৃতদেহগুলির সঙ্গে খাবার খাওয়ার আর জমিয়ে রাখার জন্য নানা ধরনের পাত্র থাকত আর কিছু কবরে প্রাপ্তবয়স্ক নারীরা বাঁহাতে যেরকম বাজুবন্ধ পরেন, শাঁখের তৈরি সেরকম গয়না সহ কবর দেওয়া হত।

শিশুদের সাধারণত কোনও মাটির পাত্র ছাড়াই কবর দেওয়া হত।

কবরগুলি থেকে বিশেষ কোনও ধনসম্পদের নিদর্শন পাওয়া যায় নি এবং স্বাস্থ্য দেখে মনে হয় বেশিরভাগই ভাল খাওয়া দাওয়া করতেন, স্বাস্থ্যও ভাল ছিল যদিও কয়েকজনের শরীরে বাত এবং শারীরিক কষ্ট পাওয়ার লক্ষণ দেখা গেছে।“

তবে গুজরাটের বিশাল সমাধিস্থলের পুরো রহস্য এখনও উদঘাটন করা যায়নি।

প্রাচীন ভারতের গণসমাধি ঘিরে যেসব রহস্য
এই ধোলাভিরা শহর সহ সিন্ধু-সভ্যতার আমলের আটশোটি স্থাপনা খুঁজে পাওয়া গেছে গুজরাতে

যেভাবে হঠাৎ খুঁজে পাওয়া গেল সমাধিস্থল

এই আবিষ্কারটি ভাগ্যক্রমে পেয়ে যান প্রত্নতাত্ত্বিকরা।

কেরালা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ছাত্রদের একটি দলকে নিয়ে ২০১৬ সালে ওই অঞ্চলে ঘোরাঘুরি করছিলেন একজন গ্রাম প্রধান, যিনি আবার গাড়ির চালকও ছিলেন। তিনিই ছাত্রদের জায়গাটি দেখান।

জায়গাটি খাতিয়া থেকে মাত্র ৩০০ মিটার দূরে ছিল। মাত্র ৪০০ জন লোকের বাস ওই ছোট্ট গ্রামে।

বৃষ্টি-নির্ভর জমিতে চিনাবাদাম, তুলা এবং রেড়ি চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন এরা।

তাদের কিছু চাষ-জমি কবরস্থানটির মধ্যেও ছিল।

“বৃষ্টির পরে আমরা দেখতে পেতাম মাটির জিনিসপত্র ওপরে উঠে আসছে। কেউ কেউ বলতেন, এখানে ভূত আছে। কিন্তু আমাদের কোনও ধারণাই ছিল না যে আমরা এত বড় সমাধিস্থলের পাশে বাস করছি,” প্রাক্তন প্রধান নারায়ণ ভাই জাজানি বলছিলেন।

তার কথায়, “এখন প্রতি বছর সারা বিশ্বের প্রত্নতাত্ত্বিকরা আমাদের গ্রামে আসেন এবং এখানে কবর দেওয়া মানুষদের সম্পর্কে আরও জানার চেষ্টা করেন।“

প্রাচীন ভারতের গণসমাধি ঘিরে যেসব রহস্য
বর্তমান পাকিস্তানে মহেঞ্জোদারোর একটি স্তূপ

গণকবরের রহস্য কী?

এক জায়গায় এত সংখ্যক কবরের উপস্থিতিই এই সমাধিস্থলটির তাৎপর্য সম্পর্কে নানা প্রশ্ন জাগায়।

এটি কি কাছাকাছি বসতিগুলির জন্য একটি গণ-কবরস্থান নাকি এখানে কোনও বৃহত্তর বসতি ছিল?

এমনটাও কি হতে পারে যে যাযাবর পর্যটকদের জন্য একটা পবিত্র কবরস্থান হিসাবে এটি ব্যবহৃত হত, কারণ এখানে পাওয়া লাপিজ লাজুলি পাথর সবথেকে কাছের যে অঞ্চলে পাওয়া যায়, তা হল আফগানিস্তান

নাকি এটা একটা অ-প্রধান কবরস্থান হিসাবে কাজ করত, যেখানে মৃত ব্যক্তির হাড়গুলিই পৃথকভাবে কবর দেওয়া হত?

“আমরা এখনো জানি না। আমরা এখনও আশেপাশে কোনও বসতি খুঁজে পাইনি। এখনও খনন কাজ চালিয়ে যাচ্ছি,” বলছিলেন কেরালা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক অভয়ন জিএস।

মি. কেনোয়ার আবার বিশ্বাস করেন যে “কবরস্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু বসতি অবশ্যই রয়েছে, তবে সেগুলি হয় আধুনিক বসতিগুলির নীচে চাপা পড়ে রয়েছে অথবা এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি”।

প্রাচীন ভারতের গণসমাধি ঘিরে যেসব রহস্য
আবিষ্কারের ১০০ বছর পরেও সিন্ধু সভ্যতার এই শিলালিপির পাঠোদ্ধার করা যায় নি

সিন্ধু সভ্যতা নিয়েও রহস্য রয়ে গেছে

কবরগুলি সুচিহ্নিত পাথরের দেয়াল দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল যা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে সেই মানুষরা পাথর দিয়ে নির্মাণ-কাজ জানতেন এবং কবরস্থানটি থেকে ১৯ থেকে ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে এধরনের পাথরের স্থাপনা এবং প্রাচীর ঘেরা বসতি পাওয়া যায়।

আরও রাসায়নিক বিশ্লেষণ এবং মানব দেহাবশেষের ডিএনএ পরীক্ষা করলেই ভারতের প্রাচীনতম মানুষদের যে অংশটা এখানে ছিল, তাদের জীবন আর মৃত্যু সম্বন্ধে আরও তথ্য আমরা জানতে পারব।

সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে কিছু রহস্য এখনও রয়েই গেছে, যেমন শিলালিপি এখনও পড়া যায় নি।

এই শীতকালে প্রত্নতাত্ত্বিকরা খাতিয়া সমাধিক্ষেত্র থেকে উত্তরে আবারও খননকাজ চালাবেন। সেখানে একটা প্রাচীন বসতি পাওয়া গেলেও যেতে পারে বলে তারা মনে করছেন।

যদি তারা সেটি খুঁজে পান তবে রহস্যের একটি অংশ উন্মোচিত হবে। আর যদি কিছু খুঁজে না পাওয়া যায়, তাহলে খননকার্য চালিয়ে যেতেই থাকবেন তারা।

মি. রাজেশের কথায়, “আমরা আশা করি যে কিছু প্রশ্নের উত্তর হয়তো আমরা খুঁজে পাবো, হয় আজ না হলে কাল।“

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!