ভারতের হরিয়ানার দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকার মেও মুসলমান কারা?

সাময়িকী ডেস্ক
সাময়িকী ডেস্ক
9 মিনিটে পড়ুন
মেওয়াট অঞ্চলের মুসলমানরা ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন, কিন্তু এখনও হিন্দু ধর্মের অনেক রীতি মেনে চলেন তারা

ভারতের হরিয়ানার দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকার মেও মুসলমান কারা?

ভারতের হরিয়ানার যে অঞ্চলগুলিতে এই সপ্তাহের গোড়ার দিক থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে, সেখানকার বাসিন্দা মুসলমানদের বলা হয় মেওয়াটি বা মেও মুসলমান। হরিয়ানার নূহ্ জেলা, যেখান থেকে এই দাঙ্গা শুরু হয়, সেখানকার ৭৯ % বাসিন্দাই মুসলমান, তবে তারা এখনও হিন্দু ধর্মের বহু রীতি-রেওয়াজ মেনে চলেন।

নূহ্ জেলার নাম কয়েক বছর আগে পর্যন্তও ছিল মেওয়াট। নূহ্ থেকে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল পার্শ্ববর্তী গুরগাঁওতেও। হিন্দু আর মুসলমান, উভয় সম্প্রদায়ের ছয় জন এই দাঙ্গায় নিহত হয়েছেন, আহত ৫০-এরও বেশি।

তবে মেওয়াট শুধু হরিয়ানাতেই যে ছিল তা নয়, এর বিস্তার পূর্বদিকে মথুরার শেষপ্রান্ত থেকে শুরু হয়ে হরিয়ানার মেওয়াট জেলা আর রাজস্থানের ভরতপুর আর আলোয়ার জেলা পর্যন্ত। এই পুরো অঞ্চলের আদিবাসীদেরই মেওয়াটি বলা হয়, তা থেকেই মেওয়াটি বা মেও মুসলমান নামটি এসেছে বলে ইতিহাসবিদরা জানাচ্ছেন।

হরিয়ানার এই মেওয়াট জেলা, বর্তমানে যার নাম নূহ্, দেশের সবথেকে পিছিয়ে থাকা জেলা বলে কেন্দ্রীয় নীতি আয়োগ ২০১৮ সালে একটি রিপোর্টে উল্লেখ করেছিল।

ধর্মান্তরিত হয়ে মেও মুসলমান

মেও মুসলমানরা প্রাচীন যুগ থেকেই আরাবল্লী পর্বত এলাকায় বসবাস করা আদিবাসী সমাজের মানুষ। এঁদের সঙ্গে দ্বাদশ শতাব্দীতে কোনভাবে যোগাযোগ হয় ইসলামি সুফি সন্তদের। তাদের মাধ্যমেই এদের ইসলামের প্রতি আনুগত্য এবং ধর্মান্তরণ।

জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও ইসলামিক পণ্ডিত জাফরুল ইসলাম খান বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, “মেওরা মূলত রাজপুত যারা দ্বাদশ শতাব্দী থেকে ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে।”

“মুহম্মদ বিন তুঘলকের আমলে ১৩৭২ সাল থেকে ১৫২৭ সাল পর্যন্ত খানজাদা রাজপুতরা এই অঞ্চল শাসন করতেন। তবে ১৫২৭ সালে বাবরের সঙ্গে খানওয়ার যুদ্ধে নিহত হন মেওয়াটের তৎকালীন রাজা হাসান খান মেওয়াটি”, বলছিলেন অধ্যাপক খান।

Untitled 2 18 ভারতের হরিয়ানার দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকার মেও মুসলমান কারা?
হরিয়ানার যে জেলায় দাঙ্গা শুরু হয়, সেই নূহ্ প্রাচীন মেওয়াটেরই একটি অংশ

মেওয়াটি মুসলমান এবং অ্যাক্টিভিস্ট রামজান চৌধুরী বলছিলেন, “বাবর অনেক চেষ্টা করেছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষদের, বিশেষ করে রাজা হাসান খান মেওয়াটির সঙ্গে ধর্মের ভিত্তিতে বন্ধুত্ব পাতাতে। বিনিময়ে আলোয়ার অঞ্চলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের শাসনভার তাকে দেওয়ার কথা বলেছিলেন বাবর। কিন্তু রাজা হাসান রাজী হন নি। এর ফল স্বরূপ ১৫ মার্চ, ১৫২৭ সালে বর্তমান রাজস্থান রাজ্যের ভরতপুরের অন্তর্গত খানওয়ার যুদ্ধে বাবরের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন রাজা হাসান খান মেওয়াটি। তবে ১২ হাজার ঘোড়সওয়ার সৈন্যের সঙ্গে তিনি নিজেও নিহত হন যুদ্ধক্ষেত্রেই, তবুও বিদেশী আক্রমণকারীর সঙ্গে যোগ দেন নি।“

যেসব হিন্দু রীতি মানেন মেও মুসলমানরা

মেওয়াট অঞ্চলেরই বাসিন্দা, হিন্দির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক জীবন সিং মানভির কথায়, “এই মুসলমানদের কিন্তু জোর করে ধর্মান্তরণ হয়নি। এদের সমাজের কেউ কেউ দিল্লি অঞ্চলে গিয়ে সুফি সন্তদের সংস্পর্শে আসেন, সেখান থেকেই এদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ। তবে ইসলাম গ্রহণ করলেও পুরণো হিন্দু ধর্মের রীতি রেওয়াজ, বেশভূষা, খাদ্যাভ্যাস থেকে সরে আসেন নি তারা। সামাজিক অভ্যাসও বদলায়নি তারা, এর একটা উদাহরণ স্বগোত্রে বিয়ে না দেওয়া।”

অন্যান্য মুসলমানদের মধ্যে স্বগোত্রে বিয়ের চল থাকলেও মেও মুসলমানরা এখনও হিন্দু রীতি অনুযায়ী নিজেদের গোত্র, এমনকি এক গ্রামের মধ্যেও বিয়ে দেয় না,” বলছিলেন অধ্যাপক মানভি।

স্বগোত্রে বিয়ে না দেওয়া ছাড়াও বিয়ের আগে ‘ভাত ভরণ’ বা সন্তান জন্মের পরে তার মঙ্গলকামনায় ‘কুয়া পূজন’ ইত্যাদি হিন্দু রীতি রেওয়াজ এখনও চলে মেও মুসলমানদের মধ্যে।

Untitled 3 13 ভারতের হরিয়ানার দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকার মেও মুসলমান কারা?
মেও মুসলমানদের অনেকেরই বেশভূষা, খাদ্যাভ্যাস বা রীতি রেওয়াজ হিন্দুদের মতোই

অধ্যাপক মানভির কথায়, এই রীতি রেওয়াজগুলো মেওয়াটের হিন্দু আর মুসলমান, উভয় সম্প্রদায়তেই প্রাচীন কাল থেকে এখনও পর্যন্ত চলে আসছে। আবার অ্যাক্টিভিস্ট রামজান চৌধুরী বলছেন, তাদের সমাজে বহু মানুষেরই নাম হিন্দুদের মতোই।

আবার মেওয়াট অঞ্চলের একদিকে যেহেতু মথুরা বা ব্রজ, যেখানে হিন্দুদের বিশ্বাসমতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল, তাই মেওয়াটিদের ওপরে শ্রী কৃষ্ণেরও প্রভাব থেকে গেছে ঐতিহাসিকভাবেই।

“তবে স্বাধীনতার বেশ কিছু পর থেকে এই অঞ্চলে মুৃসলিম ধর্ম প্রচারকরা আসতে শুরু করেন, মেও মুসলমানদের তারা বোঝাতে থাকেন যে কোনটা সঠিক ইসলামী রীতি নীতি। তার আগে তো এখানকার মুসলমানরা নামাজও ঠিক মতো পড়তেন না। তার পর থেকেই কুর্তা-পাজামা পরা, টুপি পরা বা দাড়ি রাখার চল শুরু হয়। আমার দাদীকে তো দেখেছি একদম হিন্দু নারীদের মতোই পোষাক পরতেন,” বলছিলেন রামজান চৌধুরী।

“আবার এই মেওয়াটি মুসলমানরাই স্বঘোষিত হিন্দুত্ববাদী গোরক্ষকদের হামলার শিকার হয়েছেন বড় সংখ্যায়, এটাও মনে রাখতে হবে,” বলছিলেন অধ্যাপক জাফরুল ইসলাম খান।

তার কথায়, “গোমাংস বহন বা গরু জবাই করার অভিযোগে ২০১৪ সালের পর থেকে যত মুসলমানকে গোরক্ষকদের হাতে নিহত হয়েছেন, তার মধ্যে অনেকেই মেও মুসলমান। সর্বশেষ যে গণধোলাই দিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা হয়েছে এবছরের ফেব্রুয়ারি মাসে, যেখানে নাসির আর জুনেইদ নামে রাজস্থানের মেওয়াট অঞ্চলের দুই মুসলমানকে পুড়িয়ে মারা অভিযোগ আছে যার বিরুদ্ধে, সেই মনু মানেসর আবার সাম্প্রতিক দাঙ্গা ছড়ানোর পিছনেও ছিল বলে অভিযোগ উঠছে।“

১৯৪৭, গান্ধী এবং মেও মুসলমান

মেওয়াট অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত রাজস্থানের আলোয়ার এবং ভরতপুরে শাসন করতেন দুই রাজা আর বর্তমান হরিয়ানার অংশটিতে ব্রিটিশ শাসন কায়েম হয়।

ব্রিটিশদের এলাকায় যাওয়ার সময়ে মেওয়াটের অন্য অঞ্চলের বাসিন্দারা বলতেন, যে “ইংরেজিতে যাচ্ছি”। গবেষকরা বলছেন, কোনও সময়েই মেওয়াটি মুসলমানদের সঙ্গে শাসকদের বিরোধ ছিল না, তবে ১৯৩০-এর পর থেকে আলোয়ারের শাসনব্যবস্থায় নিজেদের সংখ্যাধিক্যের জেরে তারা আরও বেশি ক্ষমতায়ন চাইছিলেন।

Untitled 4 11 ভারতের হরিয়ানার দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকার মেও মুসলমান কারা?
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (মাঝে, খালি গায়ে, কাঁদে চাদর নিয়ে) দেশভাগের পর মেও মুসলমানদের পাকিস্তান না গিয়ে ভারতে থেকে যেতে রাজী করিয়েছিলেন – ফাইল ছবি

ভারতের জাতীয় সংহতি পরিষদ বা ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন কাউন্সিলের প্রাক্তন সদস্য ও ইসলামিক পণ্ডিত নাভেদ হামিদ বলছিলেন, “মেওয়াটি মুসলমানদের সঙ্গে আলোয়ারের রাজার বিরোধ বাঁধে। তার পিছনে কিছুটা ইন্ধন জুগিয়েছিল মুসলিম লিগ

“এর ফল হয়েছিল আলোয়ারের শেষ রাজা তেজ সিং প্রভাকরের সেনাবাহিনী অন্তত ৩০ হাজার মেওয়াটি মুসলমানকে হত্যা করে স্বাধীনতার ঠিক আগে। এই ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে অনেক মেওয়াটি মুসলমান পাকিস্তান চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। তখনই এ খবর পৌঁছয় মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর কানে। তিনি এসেওছিলেন মেওয়াটের মুসলমানদের বুঝিয়ে শুনিয়ে ভারতেই থেকে যেতে রাজি করাতে”, বলছিলেন মি. নাভেদ হামিদ।

মি. গান্ধীর সেই মেওয়াট যাত্রা নিয়ে গবেষক ও লেখক, বিবেক শুক্লা বিবিসিকে জানিয়েছেন, “দিল্লির বিড়লা হাউসে সেই সময়ে থাকতেন মি. গান্ধী। মেওয়াটি মুসলমানদের এক নেতা চৌধুরী ইয়াসিন খান মি. গান্ধীর প্রার্থনা সভায় হাজির হন ১৯৪৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। তিনিই মি. গান্ধীকে জানান যে হাজার হাজার মেওয়াটি মুসলমান পাকিস্তানে যেতে মুখিয়ে আছে। তখনই মি. গান্ধী সিদ্ধান্ত নেন যে নিজে মেওয়াট গিয়ে মুসলমানদের বোঝাবেন যাতে তারা পাকিস্তান না যান।“

কয়েক সপ্তাহ পরেই মেওয়াটের ঘাসেড়া গ্রামে গিয়েছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। আলোয়ার আর ভরতপুরের কয়েক হাজার মুসলমান ঘাসেড়া গ্রামের আশ্রয় শিবিরে ছিলেন তখন।

বিবেক শুক্লার কথায়, “মি. গান্ধী ঘাসেড়া গ্রামে পৌঁছিয়ে কিছুটা আদেশের সুরেই বলেন যে তাদের পাকিস্তান যাওয়ার কোনও দরকার নেই। ভারত তাদের এবং তারা ভারতের। এটা শুনেই মুসলমানরা পাকিস্তান যাওয়ার সিদ্ধান্ত বদলিয়ে ফেলেন।“

Untitled 5 3 ভারতের হরিয়ানার দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকার মেও মুসলমান কারা?
কজন মেওয়াটি মুসলমান

‘এখানকার সংস্কৃতিটাই অন্যরকম’

ওই ঘাসেড়া গ্রামে ২০১৪ সালে গিয়েছিলেন বিবিসি সংবাদদাতা সলমান রভি। গ্রামটির সবথেকে বয়স্ক মানুষ সর্দার খান বিবিসি সংবাদদাতাকে তখন বলেছিলেন, “আমার বয়স তখন দশ বছর। কিন্তু তার প্রত্যেকটা কথা আমার মনে আছে। তার (মি. গান্ধির) আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমরা এখানেই থেকে গিয়েছিলাম।“

মি. খান বিবিসিকে আরও বলেছিলেন, “এমনিতেই মেওয়াটের মুসলমানরা দেশভাগের বিপক্ষে ছিলেন। কিন্তু তখন দাঙ্গা হচ্ছে, পরিস্থিতি খারাপ। চারদিকে আতঙ্কের পরিবেশ। কিন্তু আমাদের বাপ-দাদারা এখানেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।“

মেওয়াটি মুসলমান রামজান চৌধুরী বলছিলেন, “এখানকার সংস্কৃতিটাই অন্যরকম। হিন্দুদের যে যাত্রা থেকে দাঙ্গা শুরু, সেই যাত্রীদের জন্য এখানকার মুসলমানদের বাড়িঘরে অবারিত দ্বার। এমনকি আমার নিজের বাড়িতেও বহু হিন্দু তীর্থযাত্রী গত দশদিন ধরে থাকছেন, খাচ্ছেন, আমরা তাদের জল খাওয়ানোর জন্য তাঁবু খাটাই। আবার কিছুদিন আগে একটা জলসা হয়েছিল, মেলা বসেছিল। সেখানে বহু হিন্দু এসেছিলেন।“

“যে দাঙ্গাটা হয়েছে, সেটা হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে বললে ভুল হবে। হিন্দু সমাজের কিছু গুণ্ডা আর মুসলমান সমাজের কিছু গুণ্ডার মধ্যে সংঘর্ষটা হয়েছে,” বলছিলেন মি. চৌধুরী।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!