উইঘুর নির্যাতন : চীনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে যায়নি মুসলিম দেশগুলোও

সাময়িকী ডেস্ক
সাময়িকী ডেস্ক
8 মিনিটে পড়ুন

জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে অর্থাৎ ইউএনএইচআরসিতে চীনের বিরুদ্ধে আনা একটি প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত গৃহীত হয়নি। উইঘুর মুসলিম ইস্যুতে তোলা প্রস্তাবটি কেন পাস হলো না তা নিয়ে অনেক মুসলিম দেশেই প্রশ্ন উঠছে।

চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিম জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে বৃহস্পতিবার ইউএনএইচআরসিতে প্রস্তাবটি উপস্থাপন করা হয়েছিল।

প্রস্তাবটি পাস হলে মার্চে পরবর্তী অধিবেশনে উইঘুর মুসলমানদের মানবাধিকার লঙ্ঘন ইস্যুতে আলোচনা হতো, কিন্তু ৪৭ সদস্যের কাউন্সিলে ১৭টি দেশ এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় এবং ১৯টি দেশ এর বিপক্ষে ভোট দেয়।

যে ১৯টি দেশ এই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে, তারা চীনকে সমর্থন করেছে, যাদের বেশিরভাগই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো এই প্রস্তাবের সমর্থনে ইউএনএইচআরসিতে ভোট দিয়েছিল।

তবে ভারত, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো এবং ইউক্রেনের মতো দেশ এই প্রস্তাবের উপর ভোটাভুটির সময় হাউসে উপস্থিত ছিল না।

এই প্রস্তাব ভেস্তে যাওয়ার পর বিবৃতি জারি করেছে চীন। এতে তারা বলছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ‘পরিষ্কারভাবে সচেতন’ যে যুক্তরাষ্ট্র ও কিছু পশ্চিমা দেশ জিনজিয়াংয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগটিকে চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করতে চায়।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য কিছু পশ্চিমা দেশ জিনজিয়াং সম্পর্কে মানুষের মধ্যে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিতে চায় যাতে চীনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় এবং এর উন্নয়ন সীমিত করা যায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করা যাবে না।

ইন্দোনেশিয়া ব্যাখ্যা দিয়েছে
যে ১৯টি দেশ চীনের বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে, তার মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ ইন্দোনেশিয়া, আরব বিশ্বের কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো মুসলিম দেশ রয়েছে। একই সঙ্গে পাকিস্তান, কাজাখস্তান, উজবেকিস্তানের মতো মুসলিম প্রধান দেশগুলোও চীনকে সমর্থন করেছে।

কেন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে ইন্দোনেশিয়া তার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে দেশটি। শুক্রবার দেওয়া এক বিবৃতিতে ইন্দোনেশিয়া বলেছে, জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থাকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য ব্যবহার করা উচিত নয়।

ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানবাধিকার ও মানবিক বিষয়ক পরিচালক আচসানুল হাবিব এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, কাউন্সিলকে এমন একটি প্লাটফর্ম হতে হবে যেখানে সব দেশ নির্দিষ্ট কোনো পক্ষ নয়, বরং নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে কথা বলতে পারে।

তিনি বলেন, আমরা এই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছি কারণ আমরা চাই না যে মানবাধিকার কাউন্সিলের রাজনীতিকরণ হোক এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হোক।

একই সঙ্গে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে ইন্দোনেশিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধিও সাফাই দিয়েছেন।

ফাবারিয়ান রুডইয়ার্ড বলেন, মানবাধিকার কাউন্সিলের উচিত এমন একটি পরিবেশ তৈরির দিকে মনোনিবেশ করা যা সব দেশকে তাদের মানবাধিকারের দায়িত্ব পালনে অনুপ্রাণিত করবে।

কাউন্সিলের সদস্যদের তিনি বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ এবং প্রাণবন্ত গণতন্ত্র হিসেবে আমরা আমাদের মুসলিম ভাই-বোনদের দুর্দশার কথা জেনে চোখ বন্ধ রাখতে পারি না। আমরা বিশ্বাস করি যে কাউন্সিল আজ যে পদ্ধতি গ্রহণ করেছে তা অর্থপূর্ণ অগ্রগতি দেখতে পাবে না কারণ এতে সংশ্লিষ্ট দেশের সম্মতি এবং সমর্থন নেই।

বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ হওয়া সত্ত্বেও, চীনকে ইন্দোনেশিয়ার সমর্থন দেখে অনেকেই খুব অবাক হয়েছেন।

আমেরিকান থিঙ্ক ট্যাঙ্ক আর অ্যান্ড ডি কর্পোরেশনের জাতীয় নিরাপত্তা এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের বিশ্লেষক ডেরিক জে গ্রসম্যান টুইট করেছেন এবং ইন্দোনেশিয়ার সিদ্ধান্তে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ইস্ট তুর্কিস্তান ন্যাশনাল অ্যাওয়েকেটিং মুভমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা সালেহ হুদাইয়ার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেওয়াকে ‘নির্লজ্জ প্রতারণা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

ওয়ার্ল্ড ওয়েইগার কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট ডলকান ইসা বলেছেন, কাউন্সিলের সদস্যরা চীনকে অন্যান্য দেশের মতো একই কাতারে রাখার একটি সুযোগ হারিয়েছে।

উইঘুর হিউম্যান রাইটস প্রজেক্ট বলছে, এই প্রস্তাবকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে সদস্য দেশগুলোর ব্যর্থতা চরম অবজ্ঞা।

মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাবেক নির্বাহী পরিচালক কেনেথ রথ টুইট করেছেন যে এটি জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের সদস্যদের জন্য একটি লজ্জাজনক মুহূর্ত।

পৃথক আরেকটি টুইটে তিনি লিখেছেন, কোথা থেকে দোষারোপ করা শুরু করা যায় তা খুঁজে বের করা কঠিন। লাতিন আমেরিকার গণতন্ত্র, চীনের ব্ল্যাকমেইলের কাছে মাথা নত করে, ভোটদানে বিরত থাকে। জিনজিয়াংয়ের মুসলিমদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল ইন্দোনেশিয়া। ভারত এই বিতর্ককে সমর্থন করতে অস্বীকৃতি জানায়। ইউক্রেন ভোটদানে বিরত ছিল, যখন তারা রাশিয়ার যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে সাহায্য চাইছে।

ভারত কেন ভোট দিল না
চীনের বিরুদ্ধে এই প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটির সময় মোট ১১টি দেশ ভোটদানে বিরত ছিল। এর মধ্যে রয়েছে ভারত, লিবিয়া, গাম্বিয়া, মালয়েশিয়া ও মেক্সিকোর মতো দেশ।

ভারত কেন ভোটদানে বিরত ছিল? এই প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছে দেশটি। শুক্রবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী বলেন, অঞ্চলের মানুষের অধিকারকে সম্মান করা উচিত।

জিনজিয়াংয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত প্রস্তাবে ভারত কেন ভোট না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ভারত যে নীতি অনুসরণ করছে তার কারণে তারা এ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়নি।

তিনি বলেন, ভারত মানবাধিকারকে সম্মান করে। এই বিষয়ে ভারত যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা দীর্ঘ-গৃহীত নীতি অনুসারে। এ ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য ভারত দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনার পক্ষে।

জিনজিয়াংয়ের উইঘুর মুসলিম সম্পর্কিত বিষয়ে এই প্রথম প্রকাশ্যে মুখ খুলল ভারত সরকার।

ভারতের সিদ্ধান্ত নিয়ে যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

গত বছরের শুরুর দিকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এ ইস্যুতে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। সেই ঘটনার উল্লেখ করে দ্য হিন্দু পত্রিকার সংবাদদাতা অনন্ত কৃষ্ণণ টুইট করেছেন।

ইউএনএইচআরসি-তে জিনজিয়াং-এর ওপর ভোটাভুটিতে ভারতের অনুপস্থিতি অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়। গত বছর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর প্রকাশ্যেই জানিয়েছিলেন, চীনের আরও বহু প্রসঙ্গ আছে, তিনি সেদিকেই নজর দিতে চান।

ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব কানওয়াল সিবাল টুইট করেছেন, ভারতের অবস্থান হলো- মানবাধিকার ইস্যুর রাজনীতিকরণ উচিৎ নয়; যদিও ইউএইচএনসিআরে সেটা অহরহ হয়। কোনো দেশের বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাবের ক্ষেত্রে, ভারতের এটি থেকে দূরে থাকার নীতি রয়েছে। ২০২১ সালে শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রেও একই কাজ করা হয়েছিল। কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়ার মতো ইসলামি দেশগুলোও উইঘুর প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে, কেউ কেউ আবার ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল।

তিনি আরও লিখেছেন, ইন্দোনেশিয়া, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, মৌরিতানিয়া চীনের পক্ষে ভোট দিয়েছে। এসব দেশ, কাতার এবং পাকিস্তানের মতো দেশগুলো দ্বৈত কূটনীতি দেখিয়ে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে, এ দেশগুলো জাতীয় স্বার্থকে প্রয়োজনের সময় ধর্মের ঊর্ধ্বে রাখে। ইউএনএইচআরসি ভারতকে টার্গেট করেছে। ভোট এড়িয়ে ঠিক কাজটিই করেছে ভারত।

সমালোচনা হচ্ছে ভারতেই

ভারতের অন্যতম মুসলিম রাজনীতিবিদ নিখিল ভারত মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের (এআইএমআইএম) প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়াইসি টুইট করেছেন এবং এই প্রস্তাবের ওপর ভোটদানে ভারতের বিরত থাকার নিন্দা করেছেন।

টুইটে তিনি লিখেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি কি আমাদের বলবেন যে ভারত ইউএনএইচআরসি-তে উইঘুর ইস্যুতে একটি বিশেষ ভোট দেওয়া থেকে কেন বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে চীনকে সহায়তা করছে? তিনি কি শি জিনপিংকের বিপক্ষে দাঁড়াতে ভয় পান? ভারত কি ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে পারে না?

কংগ্রেস মুখপাত্র শামা মোহাম্মদ টুইটারে লিখেছেন, আমাদের জমি কেড়ে নেওয়ার জন্য চীনকে দায়ী করা তো অনেক দূরের কথা, প্রধানমন্ত্রী মোদি মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্যও চীনের নিন্দা করতে পারেন না। নরেন্দ্র মোদি কেন চিনকে এত ভয় পাচ্ছেন?

চীনের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ রয়েছে?

জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে চীনকে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জিনজিয়াং প্রদেশে ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে। তবে বহু প্রতীক্ষিত এই প্রতিবেদন প্রকাশ না করার আবেদন জানিয়েছিল চীন। চীন বলছে, এটা পশ্চিমা দেশগুলোর এক ধরনের জালিয়াতি।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে সংখ্যালঘু মুসলিম ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়নের অভিযোগের তদন্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

চীন দমন-পীড়নের এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। তবে যারা এসব অভিযোগের তদন্ত করেছেন তারা বলছেন,এসব সম্প্রদায়ের মানুষকে হয়রানির জোরালো প্রমাণ পেয়েছেন তারা।

জিনজিয়াংয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।

উইঘুর সম্প্রদায়ের ১০ লাখ লোককে পুনর্শিক্ষা শিবিরে প্রশিক্ষণের অজুহাতে এখানে আটক করা হয়েছে।

( সূত্র ঢাকা পোষ্ট)

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!