মহিষাসুর এক অনার্য বীর

সাময়িকী ডেস্ক
সাময়িকী ডেস্ক
7 মিনিটে পড়ুন

মহিষাসুর কোনও অশুভ শক্তির প্রতীক নন। তিনি শহিদ। আর্য সভ্যতার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে গিয়ে ‘খুন’ হন হুদুড় দুর্গা নামে অনার্য বীর।

প্রাচীন কালে এই জনপদের নাম ছিল “বোঙ্গাদিশম” এবং যার মহান সম্রাট ছিলেন এই বোঙ্গাসুর বা মহিষাসুর। হুদুড় (বজ্রের ধ্বনিকে হুদুড় বলা হয়) বা বজ্রের মত ছিল তাঁর প্রভাব ও প্রতাপ। তাই তাঁর আর এক নাম হুদুড় দুর্গা। আনন্দস্রোতের বিপরীতে এ এক আশ্চর্য শোকগাথা৷ আকাশে-বাতাসে যখন শারদীয়ার আনন্দ, তখন এই ভারতীয় মানচিত্রেরই আর এক দিকে পালিত হয় দাসাই, যা আসলে শোক-উৎসব৷ মহিষাসুরকে অন্যায় ভাবে খুন করা হয়েছিল, এমনটাই দৃঢ় বিশ্বাস উপজাতির মানুষদের। তাই দুর্গাপুজোর দিনগুলিতে একাংশ উপজাতির ঘরে আলোও জ্বলে না৷

পুরুলিয়ার ভালাগোড়া গ্রামে বহু বছর ধরে হুদুড় দুর্গার পুজোর প্রচলন৷ ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের তৎকালীন সম্পাদক জিতেন্দ্র যাদব ছবি এঁকে সমর্থন জানিয়েছিলেন এই পুজোয়।

মুখে মুখে প্রচলিত উপজাতিদের গানে বারবার ফিরে আসে জনগোষ্ঠীর পুরোনো ইতিহাস৷ চাঁইচম্পা বা চম্পা ছিল তাদের বাসভূমি৷ সেই আদিম জীবনে মেঘ ঘনায় আর্যদের দখলদারি শুরু হলে৷ প্রচলিত বিশ্বাস, হুদুড় দুর্গার সঙ্গে বাহুবলে এঁটে উঠতে না পেরে অন্য কৌশল নেয় দখলদারেরা৷ রমণীর সঙ্গে লড়াইয়ে নীতিগত আপত্তি ছিল হুদুড় দুর্গার৷

তাই ছলনা করে এক আর্য নারীর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয় তাঁর৷ সেই নারীর হাতেই শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হয় এই অসীম বলশালী উপজাতি নেতার৷ হুদুড় দুর্গা বধ হওয়ার পর খেরোয়ালদের (উপজাতি) নেতৃত্ব দেওয়ার আর কেউ ছিল না৷ ধর্মগুরুদের পরামর্শে তারা সরস্বতী নদীতে স্নান করে মহিলাদের পোশাক পরে নাচতে নাচতে পূর্ব দিকে পালাতে থাকে৷ এই নাচই ‘দাসাই’ নাচ নামে প্রচলিত৷ আশ্বিন মাসও উপজাতিদের কাছে এক অর্থে দাসাই৷ দাসাইয়ের অর্থ অসহায়৷ নেতাহীন খেরোয়ালরা সেসময় যথার্থই অসহায় হয়ে পড়েছিল৷ দাসাই নাচের গানেও সেই হা -হুতাশ আছে৷ তাতে বলা হয়, ‘দুর্গা অন্যায় সমরে মহিষাসুরকে বধ করেছেন৷ হে বীর, তোমার পরিণামে আমরা দুঃখিত৷ তুমি আমাদের পূর্বপুরুষ৷ আমাদের প্রণাম নাও…’

নবমীর দিন রঙিন পোশাক পরে, মাথায় ময়ূরের পালক গুঁজে, বাজনার তালে তালে নাচ -গান করেন সাঁওতালরা৷ সেদিন স্মৃতিতর্পণের পর হুদুড় দুর্গা তথা মহিষাসুরের উদ্দেশ্যে ছাতা উত্তোলনের অনুষ্ঠান চলে৷ যা পরিচিত ‘ছাতা ধরা’ উৎসব নামে৷ বীর বন্দনার এই পালা ক্রমে জনপ্রিয় হচ্ছে আদিবাসী সমাজে৷ এই পুজোর প্রসারও ঘটছে ক্রমশ৷ দেশে এখন প্রায় ১৫০টি এলাকায় হুদুড় দুর্গার পুজো প্রচলিত আছে৷ হুদুড় দুর্গা পূজাকে নিজেদের সমগ্র জাতি চেতনার অহংকার হিসেবে দেখেন সাঁওতাল জনজাতির অনেকেই। এ যেন অনেকটা সরাসরি হিন্দু দেবতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে প্রান্তমানুষের বীরগাথা, শোষিতের জয়গান।

ইতিহাসবিদরা এমনও বলেন, গ্রামীণ কৃষিপ্রধান সভ্যতার বাহক অনার্য জাতির কাছে মহিষরূপী মহিষাসুর চিরকালই খুব আপন। আজও ষষ্ঠী থেকে দশমীর দিন পর্যন্ত উপজাতির (মূলত সাঁওতাল, মুন্ডা প্রভৃতি জাতি) পুরুষেরা সেরেঞ বা ভুয়াং হাতে ‘দাসাই নাচ’-এর ‍মাধ্যমে নিজেদের আত্মরক্ষার একটা প্রয়াস করেন। মহিষাসুরের শোকগাথা মাধ্যমেই তাঁরা প্রমাণ করতে চান মানুষ হিসেবে তাঁরা আজও কতটা বঞ্চনা আর অবহেলার শিকার। দুর্গাপূজার পনেরো দিন পরেই আদিম আদিবাসীদের দ্বারা পালিত বাঁদনা পরবে গৃহপালিত পশু হিসেবে মহিষের পুজো করা হয়।

রাঁচি থেকে ৯০ কিলোমিটার এগুলে গুমলা শহর। তারই কিছু দূরে পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা ঝাড়খণ্ডের ঘাগরা, চৈনপুর, বিষণপুর। দুর্গাপুজো এলেই ঝাড়খণ্ডের অসুর জাতি অধ্যুষিত এই তিন গ্রাম ডুবে যায় শ্মশানের নৈঃশব্দে। ঘরে ঘরে জানলা-দরজা বন্ধ থাকে পুজোর চার দিন। যাতে আলোর রোশনাই তো দূর, ঢাকের আওয়াজটুকুও যেন ভুল করে ঢুকে না পড়ে! ‘পূর্বপুরুষ মহিষাসুরের হত্যার উৎসবে কেন সামিল হব আমরা,’ বেশ ঝাঁঝিয়েই উত্তর আসে প্রান্তজনদের কাছ থেকে। আগে তো নবরাত্রি উৎসবের টানা ন’দিনই গ্রামগুলিতে শোকপালন হত। সাদা থান পরে থাকতেন সকলে। মেয়েরা সাদা শাড়ি পরতেন। এখন সময় পাল্টেছে। সাদা কাপড় পরা বা শোকগাথা পাঠ হয় না। তবে দুর্গাপুজোর সঙ্গে এখনও সম্পর্কহীন এই প্রান্তজনেরা।

শুধু মহিষাসুর বধ নয়, পুজোর পরে ঝাড়খণ্ডের বিষণপুরের অসুর সম্প্রদায় দশেরায় রাবণ বধও মেনে নিতে পারেন না। রামলীলা উৎসবে গিয়ে রাবণের মূর্তি জ্বালানোর বিরোধিতা করেন আপামর সবাই। মহিষাসুর এবং রাবণই এই এলাকার অধিবাসীদের আত্মার আত্মীয়। আরাধ্য দেবতা। দুর্গাপুজোকে তারা কার্যত ‘গণ-বয়কট’ করেছে। পুরাণ ঘেঁটে অসুর জনজাতির আসল রহস্য, আর্য-অনার্য তত্ত্বের হাল-হকিকত বোঝার চেষ্টা করে চলেছেন ইতিহাসবিদ, গবেষকরা। বাংলা ও ঝাড়খণ্ড জুড়ে অসুর জাতি অধ্যুষিত-গ্রামগুলির এই সংস্কারের আসল কারণ কিন্তু আজও রহস্যে ঘেরা। বছর বছর আশ্বিনের শারদপ্রাতে বিষাদের মেঘ জমে অসুরদের ঘরে ঘরে।

আদিবাসীদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস বা নষ্ট করার প্রচেষ্টা উচ্চবর্ণকুল চালিয়ে আসছে সেই প্রাচীন কাল থেকে। তবু কোনও ধর্মবিরোধী তীব্র লড়াই ছিল না এতদিন। অন্যায় শোষণের বিরুদ্ধে আদিবাসীরা বহুবার গর্জে উঠলেও হিন্দু ধর্মকে আঘাত করেনি কখনও। বরং উপজাতিকুল হিন্দু ধর্মকে সবসময় মর্যাদা দিয়ে এসেছে। পুরুলিয়ার ছৌ-নাচে দীর্ঘদিন ধরে দুর্গার কাহিনী পরিবেশিত হয়।

আদিবাসীদের আদি পুরুষ হুদুড়দুর্গা তথা মহান রাজা মহিষাসুর বিদেশি আর্য রমণীর দ্বারা অন্যায়ভাবে নিধনের ফলে ভারতের আদিবাসী খেরওয়ালগণ দেশের শাসন ক্ষমতা হারিয়েছিল। সারা দেশে গ্রাস করেছিল বৈদিক সংস্কৃতি। বৈদিক সংস্কৃতির সেই প্রবলতার সামনে সারা ভারতের মূলনিবাসীরা দলিত -অন্ত্যজ- নীচ ইত্যাদি আখ্যা যে লাভ করেছিল তার প্রমাণ আজও মেলে।

বাংলা, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, ছত্তীসগড় অন্ধ্রপ্রদেশের যেসব অঞ্চলে ভারতের খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার, সেই সব অঞ্চলের জঙ্গল ও পাহাড়ে লক্ষ লক্ষ আদিবাসী হাজার হাজার বছর ধরে পুরুষানুক্রমে বসবাস করে আসছেন। সেসব অঞ্চলে এখন অনেক আইনি ও বেআইনি খনি। সংবিধানের পঞ্চম তফসিলকে মানা হয়নি। নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস করে জঙ্গল থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে তাঁর ভূমিসন্তানদের। বাধ্য করা হয়েছে মহাজনের কাছে জীবন বিকিয়ে দিতে। পাশাপাশি চলেছে জল- জঙ্গল- খনিজ সম্পদ লুঠতরাজ। নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন না থাকায় বাধ্য হয়েই তাঁরা উগ্র-বামপন্থী মাওবাদী রাজনীতির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। অতএব আখ্যা মিলেছে রাষ্ট্রদ্রোহীর!

দেশের অগ্রগতির নামে মৌ চুক্তিতে আদিবাসীদের দেবতা পাহাড়গুলিকে বেচে দেওয়া হল কর্পোরেট সংস্থার কাছে। কারণ এই পাহাড়গুলি থেকে বক্সাইট পাওয়া যায়। ডিনামাইট ফাটিয়ে আসলে তখন আর খনিজ উত্তোলন হচ্ছে না, বামিয়ান বুদ্ধের মতই ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে হাজার হাজার বছরের অস্ট্রিক দেবতাকে। তাঁদের আরাধ্য মারাংবুরুকে চোখের সামনে টুকরো টুকরো হতে দেখছেন আদিবাসীরা। আজ হুদুড় দুর্গার মতই অসহায় মূলবাসীরা। কর্পোরেট সংস্থার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে গিয়ে আগামীতেও হয়ত শহিদ হবেন অনার্য বীরেরা। রচিত হবে নতুন পুরাণ।

লেখক: অভিমন্যু মাহাত

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!