গল্প: শহরের আবছা রঙ

সুদাম কৃষ্ণ মন্ডল
সুদাম কৃষ্ণ মন্ডল
7 মিনিটে পড়ুন

সে যেতে বাধ্য হল। অস্ত্রধারী পুলিশসহ তার ছোটবোন পিছু পিছু এসে তাকে টানাটানি করছে। ট্রেন ছাড়বে সময় সমাগত। সেতো নাছোড়, পরণে জীর্ণ শাড়ি ব্লাউজ। পুরানো বস্ত্র বিপণীর ব্যাগে গচ্ছিত তার মূল্যবান সামগ্রী। দু’টো ব্যাগ আগলে ধাঁ করে এসে ট্রেনের সামনের বগিতে পেছনের সীটে বসে পড়ল। ছোট বোনটা হাঁপাচ্ছে। দৌড়াতে দৌড়াতে এসেছে। পিছনে মা প্লাটফর্মের আলো-আঁধারি ছায়ায় দন্ডায়মান।
অ্যায় দি চল, চল বলছি। দাওনা, ওকে একটু ধরে নামিয়ে দিই। সকাতর আবেদন ছোট বোনটির। যাত্রীরা বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। তারও জীর্ণ ময়লা আধুনিক স্বল্পদৈর্ঘ্যের চুড়িদার-গেঞ্জি-স্যুট নিম্নাঙ্গে। শ্যেন দৃষ্টি দিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখছে লোলুপ দু’তিন জন যুবক। সিটে বসা মেয়েগুলিও অবাক হয়ে শুনছে। কেউ তার বোনের কথা শুনে এগিয়ে আসতে চাইলে দু’টো ব্যাগ বুকে আগলে সজোরে প্রতিরোধ করছে।
আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়লাম। আমার পাশে বসা ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার ডিগ্রীধারী তন্বী মেয়েটি বিনীত ও নম্র সুরে মোবাইলে লেখাটি পড়ে বলল মাফ চাইছি। আপনার অজান্তে লেখাটা পড়ছিলাম।
কেন? কৌতূক করে বললাম।
আপনার অজান্তে মোবাইলে লেখাটি পড়ছিলাম। সত্যি বলছি আর কিছু না।ওহ! তাই! দু’দিন পরেও তো পড়তে পারো।
কিভাবে?
এটা একটা পত্রিকার জন্য লেখা। প্রকাশিত হবে। বিষয়: স্বাধীনতার ৭৫ বছর ও আমরা।
লেখাটা বাস্তবিক সুন্দর লেখনী।
বাহ শুনে ধন্য হলাম।
ওই যে ওই অংশটা: মেয়েরা কতভাবে নির্যাতিত আর শিশুশিক্ষা কাল ইত্যাদি ইত্যাদি।
সে তো বুঝলো না তার বোন তাকে টানাটানি করছে।
জানো ওর পাগলামি, ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ও সুস্থ নয়। ও লুকিয়ে বরঘর থেকে পালিয়ে…
নাহ, আমি ওখানে যাব না।
যাবি, না যাবি আগে নেমে আয়। সে যেন ধমক দিল।
আমি যাবো না।
সে মুখে আঙ্গুল দিয়ে পুলিশকে কোনও বলতে “না “বললো । মুখে হাসি লেগে আছে। আহা-মরি সুন্দরী সে নয়। মুখমন্ডলে কালচে দাগ। মাথায় কেশও তত নেই। নেউলের লেজের মতো হলুদাভ একগোছা চুল। অযত্নে অকথ্য অত্যাচারের বার্তা বহন করছে। অভাবের ছায়ায় বিকৃতমনা, খামখেয়ালিও নয়। তখনও সমানে চেষ্টা চলছে তাকে নামানোর জন্য।
আমার চিনতে ভুল হয়নি। ও হেনার মেয়ে পিয়ালী। গ্রামের মেয়ে। কাকি- পাড়াতুতো দিদিদের হাত ধরে শহরের ব্যস্ত মুখ দেখেছিল হেনা। প্রত্যহ বাবুর বাড়িতে আসত লোকাল ট্রেন ধরে। প্রত্যহ অজস্র মুখের ভিড়ে হেনার মুখটাও লাবণ্য- সৌন্দর্য্যে উদ্ভাসিত হয়েছিল। সে একটা সময়। পোয়া বারো হেনাকে ধরে রাখা দায়। রূপ-যৌবন টসটসে পেয়ারার মতো। জিভে জল আসত… চোখের পলক পড়ত অনেকের! অনেকে মনে মনে চাইত দই খেয়ে ভাঁড় ফেলে দিই। পাত্তা দিতনা। যাত্রীকে শুনিয়ে শুনিয়ে বুলেট লংকার মতো ঝাঁঝিয়ে উঠত। নীলেশ বাজ পাখির মতো একদিন ছোঁ মেরে কব্জা করে। ওই যে পাশে বিকির দোকান, ওখানে দাঁড়িয়ে প্রস্তাব দিয়েছিল, হ্যাঁ রে… থাকিস কোথায়?
আপনি ট্রেনে কাজ করেন না?
আর আপনি আপনি করিস নি। ধর, এই পেয়ারাটা খা, আমাকে একটু নিষ্কৃতি দে দেখিনি।
না না খাবুনি। দিদিরা খেতে না বলেছে। ঘুমপাড়ানি ওষুধ থাকে।
থুর… তোর তো পেটে খিদে; মুখে লজ্জা করলে হবে? আবার তুই তো জানিস আমি ট্রেনে কাজ করি। তাহলে তো সমস্যা মিটে গেল। আমি তোকে ঠকাতে পারবো না। নে ধর, ফিরবি ক’টার ট্রেনে?
সাড়ে পাঁচটার টেরনে।
ওহো… তাহলে আমি এখানে থাকবো। লোকের বাড়ি কাজ করিস নাকি? বাবা মা নেই মনে হয়?
হুমম; বাবা-মা আছে।
দেখো দেখি! এমন সোমত্ত সুন্দরী মেয়েকে কেউ ঘর থেকে ছাড়ে? সুযোগ পেলি শেয়াল-কুকুরে খাবে যে? শালা কি পাষণ্ড! জন্মের পর দায়িত্ব শেষ?
তুমি আছ না? টেরনে তো পুলিশ থাকে।
বাপরে বাপ তাই! বেশ শোন, রাস্তায় লক্ষ্য নজর করে চলিস বুঝলি? চারিদিকে যা শুনছি! এখানে আমি দাঁড়াবো, কিছু কিনে দেব তা নিয়ে যাবি।
কোনও ধান্দা নয়তো। এত ফিকিরি-উদার-ব্যয়পিপাসু-পরোপকারী ও অপরিচিত অথচ উপযাচক হয়ে পেয়ারা খেতে দেয় কেন? এই কথা বারবার হেনার বুকে ঘন্টা পেটা ঘড়ির মত বেজেছিল। একে তো ফাগুন মাস ফুলে রসাল মধু পূর্ণ… যৌবন সলিলে অবারিত ঢেউ তরঙ আছড়ে পড়ে, সুযোগ পেলে পরখ করা যেতেও পারে।
নীলেশ নাইটগার্ডের কাজে এখন আপাতত শিয়ালদা স্টেশনে। প্রত্যহ দেখা করার ফুরসৎ তার জুটে যায়। ফুচকা, ডিমভাজা, ডালবড়ি, এগরোল, লস্যি, লুচি, রুটি ও তড়কা খাওয়াতে খাওয়াতে নীলেশ আপন বৈভবের মত তার হৃদয়ে গেঁথে গেছে।
চার নম্বরের ভবানীবাবু সিগনাল দিয়ে বলে, মাল তো পটে গেছে নীলেশ। ছিপে আধার দাও কাঁটায় ধরা পড়ুক।
কি করি বলুন তো? বাড়িতে যে বউ বাচ্চা আছে?
তাহলে ছিপ ফেলতে গেলে কেন? ওকে বলেছ তো তোমার পরিবার আছে?
যা হবে হবে। ফেলছি যখন শাঁস খুবলে খাই আগে। পরেরটা পরে ভাববো।
একা খেয়ে বদ হজমে পড়োনা। এক আধ বেলা দিও চেখে দেখতে পারি। খিদে তো সবার আছে না কী? ঝানু মালটা…
আচ্ছা দেখব খন।
নীলেশ তিন বছরে চাকুর চুকুর খেয়ে খাইয়ে পগার পেরিয়ে সে এখন গাঁয়ের বউর আঁচলায় বাঁধা। মেয়ে-ছেলে নিয়ে পটাশপুরে সুখে থাকে। কাছাকাছি ডিউটি করে। সে আর আসে না। হেনা স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন।
কারণ মেয়ে দু’টোর সামনে নাইট ডিউটির নিদ্রাহীন মেষপালকেরা শরীরের গভীরতা মাপে। দিনের আলোয় সাওয়ারের জলে পালকেরা ধোয়া তুলসীপাতা হলেও হেনা ট্যাপে ধরা বোতলের জলে স্নানে সেই কীট হয়ে থেকে গেছে। শহর কলকাতার পীচ ঢালাই রাস্তায় প্রবল বৃষ্টিতে কত জল জমা হয়ে কতবার ম্যানহোলে গেছে তা যেন অতীত হেনার কাছে। কয়লার মতো পরিষ্কার করা যায় না। পিয়ালী পালিয়ে বিয়ে করেছিল ভূপিন্দরকে। কালীঘাটে বিয়ে। প্রথম ক’দিন তো মাঠে নামলেই শুধু ছক্কা মেরে দিত। তখন অবশ্য গুটখা-তেরাঙা মদ্যপান করত না। সন্ধ্যা নামলেই কাজকাম সাফসুফ করে দুপুরের ভাত তরকারি তোলা থাকত তাই দু-চার গাল খেয়ে ঘুমের মাঝে মাঝে সুন্দরবনের বন মধু চেটেপুটে খেত। সে বলত, আহা! কি টেস্টি মাইরি!! আগুনে পুড়ে যেত তাদের শরীর।
চোদ্দ বছরের পিয়ালির শরীর ঝাঁঝরা হয়ে গেল অথচ রাজধানী কলকাতার এত্তো আইনজ্ঞ পুলিশ প্রশাসন কর্তারা কেউই জানলো না। বিয়ের সময়ও তো কেউ বাধ সাধেনি। ওদের স্বেচ্ছাচারিতায় এবং হেনার অজ্ঞতা ও হেয়তার কারণে ফুটপাত জীবন স্বরলিপিতে গড্ডালিকায় গা ভাসিয়েছে।
সারারাত কঁকিয়ে কাঁদে। নেকড়ে বাঘের মতো শিকার ধরে শরীর কুচি কুচি করে খায়। নখ দাঁতের তীক্ষ্ণতায় শরীরমন ক্ষত বিক্ষত ও বিদীর্ণ, সে একা কিন্তু নিরুপায় হৃদয়হীন ভুপিন্দরের কাছে।
সে এখন মদ্যপান করে। সাথে আনে সহকর্মী নেপাল আর মাজেৎকে। নেপাল আকন্ঠ্য মদ্যপান করে ইশারা করে, একটু যাবো?
ভুপিন্দর বলেছিল, যা শালা রেখে খাবি। নেপাল হামাগুড়ি দিয়ে মাদুরে শুয়ে থাকা পিয়ালীর কাছে যায়। হাতের স্পর্শতায় সে বুঝেছিল যে ভূপিন্দর নয়। তৎক্ষণাৎ দৌড়ে ফুটপাত বরাবর মায়ের ঘুপচি আস্তানায় আত্মরক্ষা করে। মা বলল, সে কি!! তুই এখানে? এখানে কি? যা… আগে। ভাগ, ভাগিয়ে দেতো শেফালী।
ওমা দিদি কাঁদছে।
কাঁদুক। ভাগিয়ে দে। একটু পরে লালজীর ডাইভার আসার কথা আছে। সে নিরুপায় হয়ে দৌড়ে উঠেছিল ট্রেনে। ভুপিন্দার টলমল পায়ে হেঁটে এসে হেনাকে বলেছিল, সেই ধুমসি মাগীটা কোথায়? কোথায় গেল? শেফালী… আমার বউয়ের সিঁথিতে সিঁদুর আ-মি তুলে দিয়েছি। ঠিক কিনা?
সে আবার ভাগিয়েছে? শেফালি বলল।
যাতো শেফালি দৌড়ে যা এক্ষুনি বেরিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তার মা বলল।
অবশেষে সে ট্রেন ছাড়ার পূর্বমুহূর্তে অত্যন্ত অসহায়ভাবে স্টেশনে নেমে গেল। শেফালী তার ডানা ধরে আছে। খাঁকিওলা মহিলা বগিতে উঠে পড়ল।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!