শরীয়া আইন, নগদ নারায়ণ, ব্যাপক উত্তেজনা, স্বল্পমাত্রার গল্প…

অপূর্ব দাস
অপূর্ব দাস
8 মিনিটে পড়ুন

দেশে যখন কোন ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর, তাঁদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সাম্প্রদায়িক হামলা, ভাংচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে, প্রায় প্রত্যেকটি ঘটনায় একটা সাধারণ গল্প হল সেই ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনো এক তরুণের ফেসবুক পোস্টে দেশের কথিত ধর্মীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ধর্ম কিংবা ধর্মীয় নেতা সম্পর্কে কটাক্ষ করা হয়েছে! তারপর সেই পোস্টকে কেন্দ্র করে সেই এলাকার একদল মানুষ উত্তেজিত হয়ে পোস্টদাতার বাড়িঘর তো বটেই, তার পাড়া-প্রতিবেশির বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এমনকি ধর্মীয় উপাসনালয়েও হামলা করেন, ভাংচুর করেন, অগ্নিসংযোগ করেন, মালামাল লুটপাট করেন! সম্প্রতি নড়াইলের দিঘলিয়া ইউনিয়নের সাহাপাড়াতে হামলায় একটা নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে, বাড়িতে হামলা করবার আগে নগদ টাকা চাওয়া হয়েছে! আহারে অনুভুতি, নগদ নারায়ণে নমস্কার! যারা টাকা দিয়েছেন, তাদের বাড়িতে হামলা হয় নাই, যারা দেন নাই, দিতে চান নাই, তাদের বাড়িতেই হামলা, ভাংচুর বেশি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে! এখানে আরো একটা বিষয় খেয়াল করবার মত, সেটা হল, সাহাপাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন জ্যৈষ্ঠ ব্যক্তি যার কাছে উত্তেজিত লোকেরা প্রথম আসেন এবং তাকে বলেন, কাকা আকাশ নামে আপনাদের পাড়ার একটা ছেলে আমাদের নবীজিকে কটাক্ষ করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছে, আপনি এর বিচার করবেন! সেই ব্যক্তির উত্তর ছিল এরকম, ঠিক আছে সত্য প্রমাণ হলে, শরীয়া আইন মোতাবেকই তার বিচার করা হবে! এই দুইটি ঘটনার কথা আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করলাম- এই কারণে এগুলি আমাদের কথিত মুলধারার পত্র-পত্রিকাতে আসে নাই! কিন্ত আসা দরকার ছিল, বিশেষ করে একজন ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একেবারে স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি যখন বলেন, যে সত্য প্রমাণিত হলে শরীয়া আইন মোতাবেক বিচার করা হবে এই বক্তব্য কিন্তু শুধুমাত্র এ রকম নয়, যে পরিস্থিতি সামাল দিতে একটা কৌশল যে দেবতা যাতে তুষ্ট! এর মধ্যে আমাদের রাষ্ট্রপ্রধানের মদিনা সনদ অনুসারে দেশ পরিচালনার প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়! এই বক্তব্য থেকে আগামী দিনের বাংলাদেশের চিত্র দেখতে পাওয়া যায়! এগুলি আমলে না নিয়ে, আওয়ামলীগ, চৌদ্দদল, বিএনপি, সিপিবি কংবা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ নেতারা যতই আক্রান্ত এলাকা পরিদর্শন করেন, আক্রান্তদেরকে আশ্বাস দেন, মনোবল যোগান, ঘটনা বিশ্লেষণ করেন, এটা বধহয় নিশ্চিত করে বলা যায়, প্রস্তুত থাকুন শীঘই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি পরিদর্শনে আপনাদেরকে যেতে হবে অন্য কোন এলাকায়! বিষয় দুটিকে নিয়ে বিস্তারিত আলাপের আগে কথিত গণমাধ্যমের একটা বাক্য নিয়ে একটু আলাপে যেতে চাই!

এই ধরনের ঘটনার শিরোনাম যাই থাকুক না কেন, মুল সংবাদের একটা জায়গা থাকে এ রকম, বিষয়টা নিয়ে এলাকায় ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দেয়! কোন ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের উপর হামলা হয়ে যাবার পর, পরিস্থিতি বর্ণনায় এ ধরনের বাক্য আক্রমণকে জায়েজ করবার জন্য সহায়ক বলে আমি মনে করি! কারণ, আমরা একটু চোখ, কান খোলা রেখে হিসাব করলে দেখতে পাব, ওই এলাকায় বসবাসরত মোট মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা এবং হামলাকারীর সংখ্যার মধ্যে দারুণ ফারাক রয়েছে! যখন আপনারা বলেন, এলাকায় ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে! তার মানে এলাকার সকল মানুষ সমভাবে উত্তেজিত! আসলে কি তাই? একটা ধর্মে বিশ্বাসী মানুষ তার ধর্মের অবমাননা হলে অনুস্মরণীয় ব্যক্তির অবমাননা হলে, তিনি ব্যথিত হবেন সেটাই স্বাভাবিক! কিন্তু এই ব্যথা কিভাবে উত্তেজনায় রূপ নেয়, সেটা নিয়ে আলাপ হওয়াও জরুরী! সেই আলাপে আজ যেতে চাই না! কোনো কিছুর সমালোচনা করলে, সঠিকটাও বলা জরুরী! আমার মনে হয়, সংবাদপত্রগুলোর ভাষ্য এরকম হতে পারত, বিষয়টা নিয়ে এলাকার মুসলিম সম্প্রদায়ের একাংশ ক্ষুব্ধ হন কিংবা বলা যায়, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে, এলাকার একদল মানুষ অন্যদেরকে উত্তেজিত করেন কিংবা উত্তেজনা ছড়াতে চেষ্টা করেন! আসলেও তো ঘটনা তাই ই, ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গতে যেমন সব হিন্দু যান নাই, তেমনি এদেশে সেই সংবাদ শুনে সব মুসলিম, হিন্দুদের মন্দির ভাঙতেও যান নাই! এমনকি, বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রতিক্রিয়া ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সেভাবে বুঝতেই পারেন নাই! নড়াইলের ঘটনায় পত্রিকাগুলোর ভাষ্য অনুযায়ী, পুলিশ, প্রশাসন এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করায় ঘটনা ব্যাপকতা লাভ করতে পারে নাই! যদিও এই ভাষ্য সরাসরি পত্রিকার না, পত্রিকা পুলিশ, প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বক্তব্যকে কোট করেছেন! এখানেও গণমাধ্যমের দায় থাকে, এগুলি তারা করেছেন এলাকা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিককের ব্রিফিং এর সময়, মতবিনিময় সভায়! তাহলে কেন, সাংবাদিকেরা এই প্রশ্ন করলেন না যে এই ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ব্যাপকতা দিয়ে পরিমাপ করা যায় কিনা! দেশের নাগরিক হিসাবে একজন মানুষেরও যদি নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, তাহলেও সেটা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা! এখানে সংবাদভাষ্য এ রকম হতে পারত যে, স্থানীয় পুলিশ, প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ব্যর্থতার দায় স্বীকার করতে নারাজ, কিংবা হামলার ঘটনা যে ব্যাপকতা লাভ করে নাই, তাতেই তারা আত্মশ্লাঘায় ভুগছেন!

আবার ফিরে আসি, নগদ নারায়ণে! কথিত ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাতের অভিযোগে দল বেঁধে নির্দোষ নাগিরকের বাড়িতে গিয়ে টাকা দাবী করা তো চাঁদাবাজি, রাতের বেলা অনাধিকার গৃহপ্রবেশ, ডাকাতির সামিল! এইটা আমলে না নিলে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যে ওই এলাকাতেই আবারো হবে, সেটা নিশ্চিত করে বলা যায়! আমলে নেওয়া মানে আক্ষরিক অর্থেই আমলে নিয়ে যথাযথভাবে বিচার নিশ্চিত করা! এতে এলাকার মানুষের কাছে এই বার্তা যাবে যে, উত্তেজিত জনতার একাংশের আসল উদ্দেশ্য কি ছিল!

শরীয়া আইনের প্রসঙ্গের আলোচনাটা এই কারণে গুরুত্বপূর্ণ কারণ, আমাদের সমাজকে, দেশটাকে যারা পেছনের দিনে টেনে নিয়ে যেতে চাই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মুলমন্ত্র থেকে বিচ্যুত করতে চায়, এটা তাদের জয়ের পথে আরো একধাপ এগিয়ে যাওয়া! কারণ, এটা তাদের ভাষ্যমতে একজন কথিত বিধর্মীও শরীয়া আইনে বিচার করতে চান! আর উল্টোকথা হল, একজন কথিত ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতা জানেন, এদেরকে আইনের কথা বলে কাজ হবে না। বলতে হবে ওদের যেটার উপর আস্থা রয়েছে, সেই আইনের কথা! উভয় ভাবনায় একটা স্বাধীন, সার্বভৌম দেশের জন্য অশনিসংকেত! এই পেছনে হাঁটবার রাস্তা আমাদের নানাভাবে প্রসারিত হচ্ছে! ২০১৪ সালে হেফাজত এ ইসলাম ঢাকার রাস্তা দখলের ঘটনার পর, আমরা মিডিয়াতে শুনতে আরম্ভ করলাম ৯০ শতাংশ মুসলিমের দেশ, কেউ আরো একধাপ এগিয়ে বলা শুরু করলেন, ৯৫ শতাংশ মুসলিমের দেশ! এই শব্দ, বাক্যের প্রকাশের মধ্য দিয়ে শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট বিশ্বাসের অনুসারীদের দেশ বলে তারা প্রচার করে! যেখানে বলা যেত দেশের এত শতাংশ মানুষ একটা বিশেষ ধর্মের অনুসারী! কিন্তু যেটা বলা হল, তাতে ভুল মেসেজ যায়, যে দেশটা তো মুসলমানদেরই! যারা এই মেসেজ দিয়েছেন, তাদের উদ্দেশ্য নিশ্চয় সেটাই ছিল, তাই তো আজকের বাংলাদেশে একজন অন্য ধর্মের অনুসারীকেও বলতে হয়, শরীয়া আইন অনুসারে বিচার হবে!

সবশেষে বলতে চাই, দেশে বিগত বছরগুলোতে ঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলার একটি ঘটনারও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয় নাই! আক্রান্তদের বাড়িঘর নতুন করে নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে, আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়েছে, উপাসনালয়, আরাধ্য দেবতার মূর্তি পুণঃনির্মাণ করা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাদের মনে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়ে আছে- তা সারাবার কথা দায়িত্বশীলরা ভাবনায় এনেছেন কি? একটা পত্রিকা মারফত জানতে পারলাম, সেখানে ২০০ শত গাভী বিতরণের সিদ্ধান্ত হয়েছে! আমাদের নীতি-নির্ধারকেরা হয়ত জানেন না, এই সিদ্ধান্ত এবং ঘোষণা দিয়ে সেটা জানানোর ফলাফল কি হতে পারে! রাস্তাঘাটে, বাজারে এখন আলোচনা হবে ঘর পুড়ে কার কেমন লাভ হল, কে কয়টা গাভী পেল! এগুলিও হয়ত দরকার কিন্তু সেটা কোন প্রক্রিয়ায় হবে তা নিয়ে আলাপ জরুরী! আক্রান্ত নড়াইল থেকে শুরু হোক, মানুষের ক্ষত সেরে তুলবার উদ্যোগ! ঘোষণা দিয়ে গাভী বিতরণ, আক্রান্তদের ক্ষত আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে! আক্রান্তদের ক্ষত সারিয়ে তুলবার পাশাপাশি মননশীল মানুষ গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে এবং সেই প্রচেষ্টা শুরু করতে হবে এখনই!

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
তিনি একজন মানবাধিকার কর্মী। জন্ম এবং বেড়ে ওঠা যশোর জেলায়। লেখাপড়া সম্পন্ন করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মানবাধিকার, নারীর মানবাধিকার, জেন্ডার এবং নারীর ভূমির অধিকার নিয়ে তিনি কাজ করেছেন একাধিক জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনে। এছাড়াও যুক্ত আছেন লেখালেখি এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথেও। কর্মসূত্রে বর্তমানে বসবাস করছেন ঢাকাতে!
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!