অদ্ভুত আঁধার

ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী
ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী
16 মিনিটে পড়ুন
সাময়িকী আর্কাইভ

অন্ধকার ফিকে হয়েছে। সামনের আকাশ লাল। অঘ্রাণের হাল্কা ঠাণ্ডায় আড়মোড়া ভাঙছেন সূর্যদেব। পূর্ব মুখো মোরাম ঢালা রাস্তায় বাঁ-কাঁধে লাঙল নিয়ে ধীর পায়ে হাঁটছেন সদাশিব। সঙ্গে নাতি শিবু, শিবেন গোপ।
শিবুর ডান হাতে জোড়া বলদের দড়ি, বাঁ-হাতে লাঠি। বলদের গলার দড়ি ধরে ধুপ ধাপ হাঁটছে শিবু। মাঝে মাঝে অনেকটা পিছিয়ে পড়ে হাঁক মারছে সদাশিব – শিবু, মোর লজরটা খাটো আচে, হনহনিয়ে হাঁটিস না। ক্ষ্যাপাটারে একটুক জিরান দে।
বলদের গলার দড়িতে টান মেরে দাঁড়িয়ে যায় শিবু – ওঃ এই এক সোহাগের ক্ষ্যাপা তোমার, শালা চারপায়া বুড্ডা জানোয়ার। হ্যাট হ্যাট করে জোর কদমে একটু হাঁটাবো কি বুড়া মালিকের বুক টাটাবে!
নাতির কথায় মনে মনে হাসল সদা। এগিয়ে এসে জোড়া বলদের বড়টার গায়ে একটু হাত বুলাল।
আজকাল বলদের কদর নাই। গাঁয়ে সবাই যন্তর দিয়ে চাষ দেয়। কিন্তু বলদ দু’টো এখনও বেচে দেয়নি সদা। নিজের হাল-বলদ নিয়ে চার কুড়ি বয়সে এখনো লাঙল মারা, রোপা-নিরানি-সেচ সব কাজ সামাল দেয় সদাশিব। বলদটা বুড়ো হলেও সদাশিবের মতই খাটিয়া। সব কাজই করে, তবে ঢিমে তেতালে। সেই কবে, বছর এগারো–বারো হল। বড় ছেলে রতন কিনে এনেছিল সস্তার চোরাই বলদ, মালদার কালিয়াচক থেকে।
ছোট ছেলে পঞ্চু তখন নোতুন দীঘির পারে সদ্য গালা-মালের দোকান দিয়েছে। এক নম্বর অলস ছিল পঞ্চু। মায়ের আদরে একদম থপথপা। পড়াশুনা-চাষবাস মন নাই কোনটাতেই। কেবল বলে, মুদির দোকান খুলবে। বাপের কাঁধে ধার-কজ্জের জোয়াল চাপিয়ে দোকানটা খুললো। বুড়োবুড়ি তলায় চার বিঘা জমি নিজের নামে সেটেলমেন্টের বর্গা রেকর্ড লিখিয়ে হাঁড়ি ভেন্ন করল। এখন দু-মেয়ের বাপ। মুদির দোকান আর পারুলের দু’বিঘা জমিতে জন খাটিয়ে চাষ-আবাদ করে কোন মতে নিজের সংসারটা টানে পঞ্চু।
রতনটা ছিল চটপটে, সব কাজে ওস্তাদ। যেমন চাষ-বাসে মন, তেমন ছিল পড়াশুনাতেও। বিদ্যাপতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে দীনবন্ধু বিদ্যাপীঠ থেকে বিনা মাস্টারে মাধ্যমিকটা পাশ দিল। তারপরেও গতর খাটিয়ে চাষ করছিল রতন। তখন বাপ-ব্যাটা মিলে হাল মারত চৌধুরীদের আট বিঘা মাঠটায়। জমির মালিকানা রমাপ্রসাদ চৌধুরীর আর বর্গাদার সদাশিব গোপ। মৃত্যুর পরও দলিল, পর্চা, আরএস খতিয়ান, খাজনার রসিদ মোতাবেক রমাপ্রসাদই মালিক। মালিক যেই হোক, সদাশিব আর রতন, বাপ-বেটা মিলে নিজের হালে ভালই চাষবাস করছিল।
হঠাৎ একা হয়ে গেল সদা। সরকার কৃত্রিম ভেড়া প্রজনন কেন্দ্র খুললো মন্দির তলায়। আর বছর ঘুরতেই পিয়োনের কাজ পেয়ে গেল রতন। অবশ্য কাজটা প্রথমে পেয়েছিল যুধিষ্ঠির, গ্রাম-প্রধানের ছেলে। ও রাজনীতি করবে, আর বাপের মত গাঁয়ের মাথায় বসে কত্তামো ফলাবে। তাই একমাস পরে পঞ্চায়েত ভোটের মুখে উপরআলার ফরমাইস খাটার বেমানান চাকরিটা ছেড়েই দিল। তারপরই দুঃখ-আনন্দ মেশানো খবর। কোন রকম ধর-পাকর ছাড়াই শুধু মৌখিক পরীক্ষার জোরে রতনের সরকারি একটা চাকরি জুটে গেল। মাস পয়লা মোটা মাইনা। বাপের অনুমতি নিয়ে রক্ষা কালীতলায় ঢাক ঢোল পিটিয়ে পূজা দিল। তারপর নোতুন জামা-জুতো চাপিয়ে বাবুদের মত গট মট করে আফিস গেল রতন। দেখেও আনন্দ লাগে। কিন্তু রতন বিনা একা হাল মারতে সদাশিবের মন লাগে না, এটা দুঃখের।
যা’হোক রতনটা উন্নতি করেছে, এখন অফিসেও বড় নামডাক। মেয়ের বিয়ে দিয়েছে নবগ্রামে। শিবুটা ছোট। চাষের ধারে কাছে যায়নি শিবু। মাঠের কাদায় গোঁফ ওঠা ইস্তক কোনোদিন পা পড়েনি। কিন্তু লায়েক হতেই ওর কামাই বড় লোকের লাতির মত। ট্যাঁকে সব সময় পাঁচশো হাজারের কিসসা। বাপের মত বাড়ির কাছে সরকারি চাকরি লটকাতে পারেনি বটে কিন্তু কাজ জুটিয়েছে ঝকমকা শহর মুম্বাইতে। গুজরাতি ঠিকাদার কোম্পানির হেড পাহারাদার। মাইনা ভাল আর দু-হাতে উপরি। বছরে মাত্র একবার পূজার টাইমে চার-পাঁচ দিনের ছুটিতে আসতো।
তিন-চার দিন আগে বলা–কওয়া নেই, শিবু হাজির। বুক ঠুকে যাত্রা দলের নায়কের মত বলে, গাঁয়ে ফিরলাম গো, চাষ করবো। ভরা ক্ষেতে পাকা ধানের সুবাস আর আর কুল কুল অজয় নদ, প্রাণটা খালি আঁকু বাকু করে। তারপর ছোট বেলায় বাপের কাছে শেখা কবিতা একটা ঝাড়ল। বলে মাইকেলের কবিতা। ‘সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে-/ বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ দলে, / কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?/ দুগ্ধ স্রোতরুপী তুমি জন্মভূমি- স্তনে!’
এসব যাই বলুক সদার মনে ধন্দ। বড় শহরের চাকরি ছেড়ে চাষার কাজ! নবাবী ভুলে নিত্যি দিন খালি গায়ে রোদ-জল-ঠাণ্ডা-শুখায় হাল মারবে শিবু? সদার কপাল সেই যে ধসা রোগ লাগা পাতার মত কুঁচকে গেল, দু’দিনেও সোজা হ’ল না। বউ অনেক বোঝালো–মনের মতিগতি বুঝবে কে গো! চল্লিশ বছর বয়সে কি বাই উঠলো বল, কলকাতার পাট চুকিয়ে আধবুড়ো গঙ্গাধর গাঁয়ে ফিরে গান ধরলো? এসব শুনতে শুনতে তিন দিনের মাথায় সদার কপাল অনেকটা সোজা হ’ল।
হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল সদা। মনের মতিগতি আর আকাশের খেয়াল—ঝড়-বৃষ্টি সুখা-বন্না, ঠাওর করা বড় দায়। বড় দায় শিবুর মন মর্জির নাগাল পাওয়া। কোন গতিকে যে গাঁয়ে ফিরলো শিবু? ভাবনার তল না পেয়ে শেষে বউ-এর কথা অবিকল মেনে নিল সদা। কারণ যা’হোক, যুবক নাতি ঘরে থাকলে বুকে একটা জোর তো আসে।
গাঁট্টা-গোট্টা জোয়ান নাতিকে সঙ্গে পেয়ে শরীরে আজ জোশ লাগছিল খুব। শিবুর পরনে হাফ প্যান্ট, ডোরা কাটা গেঞ্জি। হাতের গুলি ফুলানো টান টান শিবু পাখি ডাকা শান্ত সকালে গটগটিয়ে হাঁটছে। লজরটা খাটো, কিন্তু পেছন থেকে পষ্ট দেখতে দেখতে ভিতরের টগবগানি টের পাচ্ছে সদাশিব।
হঠাৎ চিৎকার, হ্যাট-হ্যাট বাঁয়ে-বাঁয়ে। তারপরই ক্ষ্যাপার পিঠে ঠকাস ঠকাস লাঠি কশালো শিবু।
-মারিস না, মারিস না। সদাশিব ছুটে এসে লাঠিটা নিজের হাতে নিয়ে ক্ষ্যাপার ডান পায়ে পাছার কাছে মৃদু ঘা দিল। মুখে হুরর, হুরর, বাঁয়ে বাঁয়ে। বাঁদিকে বাঁক নিয়ে ক্যানালের উপর কালভার্ট পেরোতেই নতুন রাস্তা। ডানদিকে পা রাখতেই শিবুর নজরে এল শশী মাষ্টারের চকচকে টাক। ডানদিকে সূর্যের নরম আলো, মাষ্টারের হাসি মুখে লাল ছটা।
-ওটি কে বটে?
-শশী দাদু গো। তোমার ওস্তাদ, তোমার গুরু।
-ওঃ, ভোর হল কি না হোল, ট্যাং ট্যাং হাঁটছে মাষ্টার। এনটিপিসি মাঠে আধা-চক্কর মেরে ফেরেস হাওয়া খেয়ে এখন ঘরে যাচ্চেন কত্তা।
-দাদু, পেন্নাম করতে হবে?
-কত্তেই হবে। কদ্দিন পর দেকা, গড় করবি না? কাল আমারে কইচিল, শিবুটা বড় শহর ছেড়ে গাঁয়ে ফিরল যে বড়! মতলবটা কি?
-তুমি কি কোয়েচো?
-হক কতা কয়েচি। ছেলে ছোকড়ার মনের তল পাওয়া কি সহজ কম্ম?
-ব্যাস, এটাই বলবে দাদু। বেশী কথা কয়ো না। শশী চক্কোত্তি বুদ্ধির জাহাজ। কার কানে কি মন্তর দেয় বুড়া!
এগিয়ে এসেছেন শশী মাষ্টার। বলদের দড়ি সদাশিবের হাতে ধরিয়ে দু’পা ছুঁয়ে প্রণাম করলো শিবু।
-বেঁচে থাকো বাবা। চাষ-বাসে মন হোয়েছে দেখে প্রাণটা জুড়াল। সদা, তোমার তাইলে সঙ্গী জুটল। শক্ত-পোক্ত করিৎকর্মা জোয়ান চাষি। গায়ের জোর, চোখের নজর, মাথার বুদ্ধি সবেতেই ওস্তাদ। এবার জমবে খেলা। চলি গো সদা। বাড়ি অনেকটা পথ ।
দু-তিন মিনিট আরেকটু হেঁটে ক্যানালের উপর কালভার্টে দাড়িয়ে পিছন ফিরল শিবু। দাদু, শশী মাষ্টার কি বললো? ‘এবার জমবে খেলা’ এর মানে কি?
-আমি মুখ্যু-সুখ্যু মানুষ, মাষ্টারের সব কথার খেই পাই নাকো। দু-চার দিন পর গিয়ে শুধাবো বটে। আজ আরেকবার হাল মারবো, পরশু বাদল ঘোষের পাম্প পঞ্চাশ টাকা কড়ারে চার ঘণ্টার লগে ভাড়া নিয়ে ক্যানালের জল ঢুকাবো। তার পরদিন হাল্কা আবাদ, সন্ধ্যা বেলা যাবো মাষ্টারের বাড়ি। তখন সব শুধাবো।
গম্ভীর মুখ শিবুর। জমিতে পা রেখে চকড়া বকড়া গেঞ্জিটা খুলতে খুলতে বলল, দাদু মাষ্টারকে নজরে রাখো। জমি দখলের নোটিশ লাগতেই গেরামে ভন ভন করছে মাছি। চৌধুরীদের গণেশদা নাকি গেরামে আসছে? মাষ্টার আবার কী বুদ্ধি ঢুকাবে কে জানে?
–গণেশকে আমি তো গেরামে দেখি নাই বটে। তোর কথায় তো ভয় ধরে গেল। আমার এই বর্গার জমিটা কি দখল নিয়ে নিল?।
-গত মাসে আরও তিনশো বিঘা দখলের নোটিশ লটকেছে শালার এনটিপিসি। আঠারো দাগের সব জমি ওদের গর্ভে ঢুকবে। আমাদের বর্গার জমি আরএস দাগ নম্বর আঠারো। পর্চা একশ সতের, মৌজা পাচুরিয়া। কিছু খবর রাখো? তোমার নহে কান খাটো লজর খাটো কিন্তু তোমার আদরের বেটা? আপিস, বড়বাবু আর ভেড়া ভিন্ন কিছু জানে?
-আমার তাইলে হাল মারা বন্ধ? বলদ দু’টোকে খাইয়ে ঘরে বসে খালি কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে করবো?
-তুমি যা খুশি কর। আমি কিন্তু ছাড়বো না দাদু। তিন কুড়ি বছর তুমি হাল মারছো। বাবা মেরেছে আমি মারছি। তিন পুরুষের চাষবাস। এমনি জমির দখল নেবে? দখল নিলে টাকা দিবে না?
-তুই গাঁয়ে এলি কেন বটে? থাকবার মতি নাই, শালা টাকার ভাগ নিয়ে আবার পগার পার?
-ভাগ পেলে তো নিবো?
-কি মতলব তোর পষ্ট করে ক’দেকি নি!
-নিজের গাঁয়ে থাকতে মন করে না আমার? সারা জীবন মুখে শুধু খটর-মটর ইংলিশ মারাঠি বুলি ফুটাবো?
-আরও কিচু কতা লুকাইচিস বটে শিবু। শহরের মেয়ের সাথে তোর পিরিত আচে। শুনছিলাম তোর মা’র মুকে। তো গাঁয়ে করবিটা কি? চাষ তো উটে গেল।
-ব্যবসা করব দাদু। ষ্টেশনের বাইরে জগন্নাথ তলায় সুবল সাহার চালু হোটেলটা বিক্রি আছে।
-যা মন চায় কর। নে এবার ঠাণ্ডা দেমাকে কামে লাগ। খ্যাপা আর দামড়া বলদ কাউকে মারবি না কিন্তু।

।।দুই।।

চাদরে কান মাথা মুড়ে বৈঠক খানায় বসে সবার কথা শুনছিলেন শশী চক্রবর্তী। বেঞ্চিতে বসে গলার শিরা ফুলিয়ে দুলাল বাগদি বলছিল, চাষের জমি সরকার কিনে বিদ্যুৎ কেন্দ্র না এনটিপিসি করবে, করুক। আমরা তো বাধা দিবো না। কিন্তু ক্ষতি পুরনের টাকা শুধু মালিক পাবে? বর্গাদার আঙুল চুষবে!
বিনয় মোক্তার চায়ে বড় চুমুক মেড়ে বলল, আর কি করবে তুমি? এটাই তো সরকারি আইন।
ঘোষ পাড়ার কানু বলল, তাইলে সরকার বর্গা রেকর্ড করিয়ে আমাদের কি ভালোটা করলো বটে?
বিনয় মোক্তার – আইন মাথায় ঢুকবে তোমাদের? মালিক জমি বিক্রি করলে বর্গাদার ভাগ পাবে। কিন্তু সরকার উন্নয়ন প্রকল্পে জমি নিলে তোমাদের সব ফক্কা। মালিকের নামে ব্যাঙ্কের চেক লিখবে সরকার?
-কেমন ধারা আইন এটা মাষ্টার মশায়? ধান রোপায় ওস্তাদ কানুর বউ নরম গলায় বলল।
আলোচনায় তাপ বাড়তে দেখে শশী মাষ্টার মুখ খুললেন, আমার পারুল ডাঙার জমিটা গত বছর অধিগ্রহন করে আমাকে দু-লাখ টাকা দিল। ক-দিন পর অর্ধেক টাকা পুজামণ্ডপে বসে সবার সমক্ষে আমি বর্গাদার কালো মণ্ডলের হাতে তুলে দিয়েছিলাম।
-তাইলে অর্ধেকটা আমি পাব বটে। চাদরটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে সদাশিব বললেন ।
বিনয় মোক্তার গলা চড়ালেন, না দিলে আইন মোতাবেক তুমি কিছু করতে পারবে?
হঠাত উত্তেজিত ভাবে দাঁড়িয়ে উঠলো শিবু — টাকার অর্ধেক না দিলে একটু চমকে দিব কাকা।
কথাটা বলেই গট গট করে বেড়িয়ে গেল শিবু। শশী মাষ্টার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন তখনই নাতি মারফত ভিতর বাড়িতে ডাক পাঠালেন স্ত্রী মালতি।
-তুলসি তলায় শাঁখ বাজাতে বজাতে বাঁশ ঝাড়ের মাথার উপর দিয়ে কী দেখলাম জানো?
ব্যাজার গলা শশী মাষ্টারের, কী দেখলে? ভুত না পেত্নী?
-ওসব না গো? একদম সত্যি। জমিদার বাড়িতে আলো জলছে। আমি তো আলেয়া ভেবে সিটিয়ে ছিলাম। শেষমেশ গয়লাদিকে ডেকে দ্যাখালাম। ও ঘুরে এসে বলল, গনেশ বাবাজীর ভারি গলা শুনলাম। কতকাল দেকিনি ওদের! ওকে ঘিরে নাকি ফটকের ওপারে শাসাচ্ছে ক-জন। কি ব্যাপার গো? যদু ঠাকুরপোর ছেলেদের শাসানি?
-হু, কি আর বলবো। অর্থই অনর্থ।
ভিতর বারান্দা থেকে অন্ধকার বাঁশঝাড়ের দিকে তাকিয়ে বড় একটা শ্বাস ফেললেন শশী মাস্টার। ওনার বাড়ির পিছনে হরিহরতলা পুজা মণ্ডপ। পাশে পূজারী বামুনের বড় বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড় পেরোলেই জমিদারদের চক মিলানো ভিটা। সংস্কারের অভাবে জীর্ণ কিন্তু উত্তর দিকটা এখনো বাসযোগ্য। পরেশনাথ দশ বছর আগে একবার জঙ্গল সাফসুত্র করে প্লাস্টার চুনকাম মাখিয়ে নিজের অংশটার হাল ফিরিয়ে ছিলেন। নতুন পুকুরটা পূজারীর নামে লিখিয়ে পাকা করে দিয়েছিলেন নিত্যপূজার বন্দোবস্ত। মানুষটা ছিলেন বড় উদার মনের। ভিটের প্রতি টান ছিল খুব। জমিদারির আদ্যোপান্ত ইতিহাসও উনি জানতেন।
সবটা না জানলেও শশী মাষ্টারের মাথায় চার-পুরুষের ইতিহাস ধরা আছে। বর্তমান প্রজন্মে হারু, গণেশ, লাটু। বড় তরফ পরেশনাথের ছেলে লাটু বরাবরের হাঁপানির রুগী। কাজকম্ম কিছু পারে না। বাপের রেখে যাওয়া অর্থ আর কলকাতায় বাড়ি ভাড়ার টাকায় ওর চলে। মদের নেশা ছিল পরেশনাথের কিন্তু মনটা ছিল উদার। লিভারের রোগে মরে গেল। বেশি বয়সের সন্তান লাটু তখন স্কুলে পড়ে। ওর মা উচ্চ শিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী। অসুস্থ্য ছেলেটাকে আদর যত্নে বড় করলেন। ছেলেটা সাধু প্রকৃতির, বিয়ে-থা করেনি। হরিনাম জপ করে খুব। বিষয়-আশয়ে মন নাই। ছোট তরফ যদুনাথের ছেলে হারু আর গণেশ।
গণেশ এল নাকি? ভাবছিলেন শশী চক্রবর্তী। গত পাঁচ বছরে দু’ভায়ের কেউ গ্রাম-মুখো হয়নি। সম্পন্ন অবস্থা। সল্টলেকে দু’জনের আলাদা বাড়ি। দু’জনেই ব্যাবসার কাজে ডুবে থাকে। ইতিহাস এলোমেলো ভাবে মাথায় ঘুরছিল শশী চক্রবর্তীর। যদুনাথ–পরেশনাথের বাবা রমাপ্রসন্ন। তাদের বাবা দোর্দণ্ড প্রতাপ জমিদার দুর্গাকিঙ্কর চৌধুরী। তাঁর তিন মেয়ে। আর ছেলে বলতে রমাপ্রসন্ন, কলকাতা হাইকোর্টের ডাকসাইটে উকিল। অত বড় উকিল কিন্তু গাঁয়ের দুর্গা পুজায় প্রতি বছর আসা চাই। খালি গায়ে ঘুরতেন, গাঁয়ে সবার সাথে মিশতেন। আর ছিল ছিপ ফেলে মাছ ধরার নেশা। তার ছোট ছেলে যদুনাথ ছিল ঘোর বিষয়ী। কলকাতায় প্রমোটারি আর আরামবাগে কোল্ড স্টোরেজের কামাই। গ্রামে বড় একটা আসতো না। লোক পাঠিয়ে আধিদারদের তাগাদা মেরে নিজের ফসলের অংশ কড়ায় গণ্ডায় উসুল করতো। বছর ছয়েক আগে দুর্ঘটনায় ওর মৃত্যুর পর হারু–গনেশ গাঁয়ে একবার এসেছিল। তখন ওরা সোমত্থ যুবক, বয়স ছাব্বিশ–সাতাশ।
-কি ভাবচো গো এত? জমিদার বংশের জোয়ান ছেলে গাঁয়ে ফিরলো, এ-তো খুশির কতা!
গভীর একটা শ্বাস ফেললেন শশী মাষ্টার, -খুশি কি অখুশি পরে বুঝবে? যা ভাবছিলাম তাই ঘটবে হয়ত।
-রহস্য রেকে আসল কতাটা কও তো!
-চারদিকে থিক থিক করছে লোক। ধনি গরীব চাষা মালিক দালাল পুলিশ। গাঁয়ে মধুর গন্ধ গো! মধুর লোভে মৌমাছি ভরপেট খেয়ে আবার চাকে ফিরে আসে। আর মানুষ? ডাল-ভাতে মন নাই। কেবলি বান্ডিল বান্ডিল নোট চায়, গোছা গোছা টাকা। নোট বেশী হলে মানুষের কী হয়? অস্থির হয়ে যায়। বে-লাগাম। তখন এক আগুন থেকে অন্য আগুনে ঝাঁপ মারে।
-তোমার কতা বোধগম্মি হচ্ছে না গো।
-পরে বলবো সব। আমিও চিন্তায় আছি। সদাশিবের নাতিটা কি এমনি এমনি ছাড়বে? মুম্বাই থেকে হাল মারতে আসেনি ছেলেটা। ওর পকেটে টাকার খামচানি আছে। পঞ্চায়েত প্রধানের ছেলে ষষ্ঠীর বন্ধু। ষষ্ঠীর দল ওর সাথে। যা শুনছি, অর্ধেক টাকা ওরা চাইবে। আর গণেশরাও কঞ্জুস, পাওনা টাকার কানাকড়ি ছাড়বে না। মারদাঙ্গা লাগবে। জমির দাম বাবদ চল্লিশ লক্ষ টাকার চেক নিয়ে গনেশ কলকাতা ফিরতে পারলে হয়! অবশ্যি ব্যবসায়ী মানুষ ওরা, গুন্ডা মস্তান ওদেরও কেনা আছে।
-আমার খুব ভয় করছে গো? গ্রামে খুনোখুনি হবে নাকি? সবাই তো নিজের লোক। তুমি একটু বুঝাও?
– কাকে বোঝাবো? শিবু গাঁয়ে থাকবার বাসনায় হোটেল ব্যাবসা করতে চায়। অগ্রিম টাকাও দিয়ে এসেছে। ওর দরকার দশ লাখ। আর গণেশের কোল্ড স্টোরেজের ব্যাবসা নিভু নিভু। বিদ্যুতের পুরানো লাইন আগা পাস্তালা পাল্টে নতুন ঠাণ্ডা মেশিন বসাতে হবে। পঞ্চান্ন লক্ষ নাকি লাগবেই।
-তাহলে? কিছু একটা উপায় কর। গাঁয়ের প্রধানও তোমাকে মান্যি করে।
-উপায় আমি কি বাতলাবো? উভয় সংকট। আইন মানলে লাভ জমিদারের আর ক্ষতি চাষির। তুমি বে-আইনি কাজ করবে, না জমিদারের পক্ষ নেবে?
-কোন একটা রফা হয় না?
– আলবাত হয়। কিন্তু আমার কথা শুনবে কেন? ক্ষমতাহীন দুর্বল মানুষ আমি। দু-একটা বুড়া-হাবড়ার সাথে আড্ডা মারি।
চিন্তিত মুখে বৈঠক খানায় ফিরে এলেন শশী চক্রবর্তী। অসম্পূর্ণ আলোচনায় ইতি টেনে একে একে বিদায় নিল সবাই। নির্জন ঘর, বাইরে হিম মাখা নিস্তব্ধ রাত। চাঁদ ঢাকা হাল্কা মেঘ আকাশে। অসময়ের মেঘ। বৃষ্টি নামবে নাকি? ভাবছিলেন শশী মাস্টার।
হঠাৎ বাঁশঝাড়ের ওপারে বিকট শব্দ। দুম দাম বোমা ফাটলো। শশী মাষ্টারের বুকে প্রবল কাঁপুনি ধরিয়ে মুহুর্মুহ বিস্ফোরণ। গ্রামবাসী আতঙ্কে নির্বাক। পুজা মণ্ডপের মাথার উপর কয়েকটা ভয়ার্ত পেঁচাড় অসহায় আর্তনাদ। ঘুট ঘুটে অন্ধকারে ডুবে গেল বসতি ধানক্ষেত নদী পুজামণ্ডপ। ‘দুগ্ধ স্রোতরুপী জন্মভূমি-স্তনে’ কেবলই অদ্ভুত আঁধার।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
ড.সৌমিত্র কুমার চৌধুরী, ভূতপূর্ব বিভাগীয় প্রধান ও এমেরিটাস মেডিক্যাল স্যায়েন্টিস্ট, চিত্তরঞ্জন জাতীয় কর্কট রোগ গবেষণা সংস্থাণ, কলকাতা-700 026. প্রকাশিত গ্রন্থ- বিজ্ঞানের জানা অজানা (কিশোর উপযোগী বিজ্ঞান), আমার বাগান (গল্পগ্রন্থ), এবং বিদেশী সংস্থায় গবেষণা গ্রন্থ: Anticancer Drugs-Nature synthesis and cell (Intech)। পুরষ্কার সমূহ: ‘যোগমায়া স্মৃতি পুরস্কার’ (২০১৫), জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকায় বছরের শ্রেষ্ঠ রচনার জন্য। ‘চৌরঙ্গী নাথ’ পুরস্কার (২০১৮), শৈব ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত উপন্যাসের জন্য। গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরষ্কার (2019), পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও জৈবপ্রযুক্তি দফতর থেকে), পঁচিশ বছরের অধিক কাল বাংলা ভাষায় জনপ্রিয় বিজ্ঞান রচনার জন্য)।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!