আলো অন্ধকারে যাই (পর্ব ৯)

গৌতম রায়
গৌতম রায়
9 মিনিটে পড়ুন
ছবি প্রতীকী

শিক্ষাঃ বন্ধু ও শিক্ষক

ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় বেশ কিছু নতুন বন্ধু জুটে যায় আমার যারা অন্য বিদ্যালয় থেকে এসেছিলো। এদের ভিতরে ছোট দিলীপ, বড় দিলীপ, সমীরণ, আব্দুল বার (আম্মু), সাখাওয়াত, খোকন, বুলু, হর প্রসাদ (হারু), মনিরুল, আখতারসহ আরো অনেকে। দুই সেকশন মিলে প্রায় পঞ্চাশ/ষাট জনের উপরে ছাত্র। সবার নাম মনে করা দুষ্কর। অনেকের সাথে পরিচয়ও ছিল না তখন। শুধু তাদের সাথেই কথা হতো যারা আমার সেকশনে পড়তো।  

ছোট দিলীপের সাথে আমার খুব বন্ধুত্ব হয়ে যায়। একেবারে দোস্তি যাকে বলে। যে বিদ্যালয়ে সে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছিলো সেখানে আমার মেজদি (মীরা রায়) শিক্ষক ছিলেন আর দিলীপকে তিনি খুবই স্নেহ করতেন। দিলীপ ভালো ছাত্রও ছিল। এজন্যে আমাদের বাড়িতে দিলীপের আলাদা খাতির ছিল। সে ছিল একেবারেই আমাদের বাড়ির সন্তান। মাগুরা বাজারের পাশে সিকদার স্টোর নামে দিলীপদের একটি পাইকারী মালামালের দোকান ছিলো। সেখানে আমি যে কত অত্যাচার করেছি! সেই সময়ে নাবিস্কো সুপার নামে এক ধরনের ছোট ছোট বিস্কিট পাওয়া যেতো। বিস্কিটগুলি খুব মচমচে ছিল আর স্বাদেও চমৎকার ছিল সেগুলি। দিলীপদের দোকানে সেটি টিন ভর্তি পাওয়া যেতো। সেখান থেকে কিছু খেয়ে, কিছু পকেট ভর্তি না করে খুব কম দিনই আমি ফিরেছি। ওর কাকারা সেগুলি যথেষ্ট ধৈর্য নিয়েই সামলাতেন কারণ আমি তো তাদের ভাতিজার বন্ধু!

এই বন্ধুটির সাথে আমার বন্ধুত্বের পাশাপাশি এক ধরণের সুস্থ প্রতিযোগিতাও ছিল। দিলীপ খুব ভাল গীতা পাঠ করতে পারতো। এক কথায় তার গীতা পাঠ ছিল অসাধারণ। এসেম্বলিতে আমাদের শ্রেণী থেকে গীতা পাঠ করার জন্যে দিলীপ ছিল অবধারিত পছন্দ। সে বেশ নাটকীয় কায়দায় কবিতা আবৃত্তি করতেও পারতো। ষষ্ঠ শ্রেণীতে তার সাথে আমার ‘কাঠবিড়ালী, কাঠবিড়ালি পেয়ারা তুমি খাও’ ও সপ্তম শ্রেণীতে ‘তুমি যাবে ভাই, যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়’ – নিয়ে তুমুল প্রতিযোগিতা হয়েছিল। ছোট্টোখাট্টো, শক্তপোক্ত গড়নের দিলীপ ও আমি খুব দ্রুত হরিহর আত্মা হয়ে যাই। তবে দিলীপ একবার আমার আচরণে কষ্ট পেয়েছিলো। সেদিন এসেম্বলিতে গীতা পাঠের জন্যে নির্ধারিত আমাদের শ্রেণী। দিলীপ প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলো। গীতা পাঠের জন্যে ডাক আসতেই দিলীপ পা বাড়ায় যাবার জন্যে। কিন্তু কেন যেনো সেদিন আমার এই কৃতিত্বটুকু পাবার ইচ্ছে মাথাচাঁড়া দিয়ে ওঠে। আমিও পা বাড়াই। আর দিলীপকে অতিক্রম করেই স্যারদের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। গীতা পাঠ শেষ করে ফিরে এসে দিলীপের শুকনো মুখটা আমাকে মর্মাহত করে। তবে এ নিয়ে ও কখনো কোনো রূঢ় আচরণ করেনি, আমাকে দূরে সরিয়েও দেয়নি। শুধু বলেছিলো – তুই গীতা পাঠ করবি সেটি আমাকে আগে থেকে বললেই তো হতো! আমি খুব লজ্জা পেয়েছিলাম। এটি আমার জন্যে একটি বড় শিক্ষাও ছিল। আমার গীতা পাঠের ইতিহাস এমনিতেই এক বা দু’দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সেদিন যদি না করতাম কি আর এমন হতো! 

এই সময়ের কয়েকটি বিষয় মনে পড়লে খুব হাসি পায় এখন। বিশ জুলাই (চার শ্রাবণ) আমার জন্মদিন। আজ থেকে অনেক আগে সেই ছোট মফস্বল শহরে তখন জন্মদিন ঘটা করে পালনের রীতি ছিল না। অন্তত এখন যেমনটি হয় – কেক কাটা, হ্যাপি বার্থডে বলা – এসব খুব একটা ছিল না। যাহোক, জন্মদিন আসার দু’একদিন আগে আমি নিজেই খাতার পাতা কেটে বা আর্ট পেপারে নিজ হাতে আমন্ত্রণপত্র বানাতাম। তারপর সেটি খামের মধ্যে ঢুকিয়ে আমার কয়েকজন বন্ধুকে আমার বাসায় দুপুরে একসাথে খাবার জন্যে নিমন্ত্রণ জানতাম। বন্ধুরা আসতো ছোটোখাটো উপহার নিয়ে। কয়েক ঘন্টা তাদের সাথে কেটে যেত। এখন ভাবলে খুব লজ্জা লাগে। কী ছেলেমানুষই না ছিলাম! এসব অনুষ্ঠানে দুই দিলীপ, লিটু, আলোক, সমীরণ ছিল অবধারিত অংশগ্রহণকারী। তবে পঞ্চম থেকে সপ্তম শ্রেণীর পরে এটি আমি আর করিনি। হয়তো ততদিনে একটু-আধটু বুদ্ধি-শুদ্ধি হয়েছিল আমার। 

ষষ্ঠ/সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকেই বুঝতে পারছিলাম স্কুলে পরিবর্তনের হাওয়া। অলোক ক্লাসের খুব ভাল ছাত্রদের একজন ছিল। কিন্তু তাকে প্রায়ই একজন বিজ্ঞানের শিক্ষক নানা উছিলায় অপদস্থ করতো। অপদস্থ করার বিষয়গুলি ছিল এমন – ওর বাবা কেন একটি রাজনৈতিক দল করতো, ওর বাবা কেন তৎকালীন মাগুরার মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে এক রিক্সায় নির্বাচন উত্তর ৱ্যালিতে অংশ নিয়েছিল যেখানে বাংলাদেশের অধিকাংশ হিন্দু দেশে খেয়ে ভারতে বাড়ি-গাড়ি বানায়, কেন এদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের চামড়ার স্যান্ডেলটি, কাঠ পেন্সিলটি পর্যন্ত ভারতের ব্যবহার করে ইত্যাদি। অলোকের বাবা বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি কোন রাজনৈতিক দল করলেও তাদের ভারতে কোনো বাড়ি গাড়ি আছে এমনটি আমার আজ পর্যন্ত জানা নেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই কথাগুলি যে শিক্ষক বলতেন তিনি নিজে ঘোরতর মুসলিম লীগের সমর্থক ছিলেন এবং সেই সূত্রে তিনি বিএনপি-জামাত ঘরানার কট্টর সমর্থকই ছিলেন; বছর দুই আগে প্রয়াত হয়েছেন। ক্লাসে তিনি যতটা সময় পড়াতেন তার থেকে বেশি সময় ব্যয় করতেন এমনতরো হাজারটা অকাজ করতে, এমনকি শহরের অন্যান্য ব্যবসায়ী যারা মুসলিম ছিলেন না বা যাদের ছেলেমেয়েরা সেই সময় ওই স্কুলে পড়তোও না তাঁদের চরিত্র নিয়েও তিনি নেতিবাচক বিশ্লেষণ করতে ছাড়তেন না।     

অলোকের বাবার কোন রাজনৈতিক দল করার জন্যে ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণীতে পড়ুয়া অলোকের কী করণীয় ছিল? কিংবা মাগুরার অন্য কোনো হিন্দু ব্যবসায়ী যদি ভারতে বাড়ি বানিয়েও থাকে সেটি আমাদের বলে কী লাভ হতো আমি বা আমরা বুঝতাম না তবে কষ্ট পেতাম। এখন বুঝি এই বিভাজন ও ছোট করার মাঝ দিয়ে, এই মানসিক পীড়নের মাঝে এক খুদে শিক্ষার্থীকে ফেলে দিয়ে তিনি এক ধরণের ধর্ষকাম-অনুভূতি পেতেন। এই কথাগুলি বলে উনি খুব মজা পেতেন কিন্তু একটিবারের জন্যেও বুঝতে পারতেন না (নাকি বুঝেই বলতেন জানিনা) যে এর মাঝ দিয়ে তিনি তারই শিক্ষার্থীদের সাথে সাম্প্রদায়িক আচরণ করছেন। অন্যদের কাছে একজন শিক্ষার্থীকে ছোট করছেন, তাকে লজ্জায় ফেলছেন। অলোকের মুখ লাল হয়ে যেতো তবু ও কোনো প্রতিবাদ করতে পারত না। ওই শিক্ষক কৃষি বিজ্ঞান না জীব বিজ্ঞান ভালো পড়াতেন। কিন্তু নিজের এই মৌল কাজটি তার কাছে ছিল গৌণ। আর উল্লেখিত ধরণের অকাজ, প্রধান শিক্ষকের তোষামোদি, বিদ্যালয় ভিত্তিক রাজনীতি এসবের পিছনেই তার সময় যেতো বেশি। 

সরকারি চাকুরীতে অভ্যাসগত ঋণগ্রস্থতা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও তিনি সেই সময় এসবের বেড়াজালেই থাকতেন। তাঁর কাছ থেকেই শোনা – এক ধনাঢ্য ব্যাক্তির ছেলেকে পড়াতেন উনি যাদের একটি ফিনিক্স (সবাই বলে ফনিক্স) সাইকেলের দোকান ছিল। সেখান থেকে একটি সাইকেল নিয়ে সেটির মূল্য পরিশোধের কথা তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। আমাদের একটি ষ্টুডিও ছিল। সেখান থেকে  কিছু ছবি তুলে টাকা পরে দেবেন বলে সেটি দেবার কথা আর উনি মনে করতে পারেননি। সাইকেলের তুলনায় সেটির মূল্য কম হলেও কমোডিটির মূল্য হিসেবে পাওনার পরিমাণ একদম কম ছিল না। আর সেটি তাঁকে মনে করিয়ে দেবার জন্যে উনি এতটাই রুষ্ট হয়েছিলেন যে আমি ছিলাম তার দুই চোখের বালি। আর এর খেসারত আমাকে দিতে হয়েছিলো ভয়ংকরভাবে। একেতো ছাই, তার ওপরে আবার বাতাস। 

শিক্ষককে আমরা বলি শিক্ষার্থীর রোল মডেল। একজন শিক্ষার্থী তার পরিবারের অভিভাবকদের কথা থেকেও শিক্ষকের কথাকে অনেক বেশি মূল্য দেয়। শিক্ষক শুধুমাত্রই একজন শিক্ষার্থীকে জ্ঞান বিতরণ করেন না, তিনি  শিক্ষার্থীকে ভাষা দেন, দৃস্টিভঙ্গি দেন, মূল্যবোধ দেন, শিক্ষার্থীর বিশ্বাস তৈরী করেন। একজন শিক্ষক কীভাবে কথা বলেন, কোন উচ্চারণে কথা বলেন, কীভাবে তিনি দাঁড়ান, কতটা দুরত্বে দাঁড়ান, কেমনভাবে কলমটি ধরেন, শিক্ষার্থীদের কতটা আদর করেন বা কতটা দুর্ব্যবহার করেন তার প্রতিটি বিষয় শিক্ষার্থীর মনে দাগ কেটে যায়। আর সে জন্যেই শিক্ষককে বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। শুনতে শুনতে হয়তো এটি ক্লিশে হয়ে গিয়েছে কিন্তু কথাটি তো সত্য। আমরা আমাদের বাচ্চাদেরকে তো আমাদের শিক্ষকদের কাছেই পাঠাই। শিক্ষক যা দিতে পারেন, সেটি তো কোনো মুদি দোকান থেকে কিনতে পাওয়া যায়না বা পোস্ট অফিসে বা অন্য কোথাও।   

এত আশা ভরসা নিয়ে এতো স্বপ্ন বুকে নিয়ে যাদের কাছে সন্তানকে পাঠানো হয়, এই যদি হয় তাদের অর্জন, ভাষা, মানসিকতা, বা উন্মত্ততা তাহলে শিক্ষার্থী আলোকিত মানুষ হবে কী করে! হ্যাঁ, এরকম শিক্ষকের কাছে পড়ে বা না পড়েও হয়তো একখানা সনদ পাওয়া যায় কিন্তু শুধু সনদই পাওয়া যায় আর কিছু না। এভাবে এই শিক্ষকেরাও হয়তো গাড়িবাড়ি, টাকা-পয়সার মালিক হন, কিন্তু শিক্ষার্থী যে তার অন্তরের শ্রদ্ধা ভাব শিক্ষকের জন্যে হারিয়ে ফেলেছে সেটি হয়ত তিনি বোঝেন না। আর যদি বুঝেও এটি করে থাকেন, তাহেল সেটি একটি অপরাধ নয় কেন?  

অনেক শিক্ষক মহোদয় প্রায়ই বলে থাকেন, এখন আর আগের মতো সম্মান নেই শিক্ষকতা পেশায়। আমার প্রশ্ন, সেই সম্মানটা কি আমরা নিজেরাই নষ্ট করিনি? না, সমাজ জোর করে নষ্ট করে দিয়েছে? উপরোক্ত উদাহরণের থেকে আরো ভয়ঙ্কর উদাহরণ হয়তো আমাদের অনেকের জীবনেই আছে। শিক্ষকতা একটি মহান পেশা না এক ধরণের অর্থগৃধ্নুতা সেটি মাঝে মাঝে আমার কাছে খুব বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় ইদানিং। এটিও জানি না জীবনে মোটামুটি ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্যে কত টাকার প্রয়োজন হয়।   

(চলবে) 

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
লেখক: গৌতম রায়
গৌতম রায় ইংরেজির অধ্যাপক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজীতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেবার পর বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বেশ তরুণ বয়সেই শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। পড়িয়েছেন দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষার প্রতি ভালোবাসা থেকেই পরবর্তীতে ছাত্র হয়েছেন ইংল্যান্ডের এক্সিটার ইউনিভার্সিটির।‌ যুক্তরাষ্ট্রের অরেগন ইউনিভার্সিটি, ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি ও ওয়ার্ল্ড লার্নিং থেকে নিয়েছেন পেশাগত প্রশিক্ষণ। এখন কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশের জাতীয় ‌শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে। শিক্ষা বিষয়ক বর্ণিল কাজে নিজেকে ‌সম্পৃক্ত রাখার জন্যই বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যাবস্থাকে তিনি দেখেছেন খুব কাছে থেকে। শিক্ষা ক্ষেত্রে গৌতম রায়ের পছন্দের আঙ্গিনা শিক্ষকের অনিঃশেষ পেশাগত দক্ষতা, ইন্টারেক্টিভ মেটিরিয়ালস ডিভ্যালপমেন্ট, ও লার্নিং এসেসমেন্ট।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!