সমুদ্র দর্শনে আরও একবার (পর্ব ২)

কামরুল হাসান
কামরুল হাসান
7 মিনিটে পড়ুন
মহেশখালী দ্বীপে যাওয়ার ৬ নং ঘাট

তন্দ্রা মতো জড়িয়ে এসেছিল, টের পেলাম বাস নড়ছে না। বাসের গতির সাথে যাত্রীর তন্দ্রাচ্ছন্নতার সংযোগটি কেটে গেলে জেগে উঠি। পর্দা সরিয়ে দেখি ডিজেল নিচ্ছে ডাবল ডেকার। পেট্রল পাম্পটির নাম ইউনাইটেড ফিলিং স্টেশন, তেলের মিটারে সবুজ বাতির স্ক্রল হচ্ছে, ওয়েলকাম টু আওয়ার ফিলিং স্টেশন। আমেরিকায় ওরা বলে গ্যাস স্টেশন, ইউরোপে ফিলিং স্টেশন, আমরা বলি পেট্রল পাম্প। নিচ্ছে কিন্তু ডিজেল। ওপাশে গ্রীণলাইন পরিবহনের আরেকটি বাস এসে দাঁড়ালে বুঝি এটাই ওদের ফিলিং স্টেশন। লাল থামের শক্তিতে দাঁড়ানো সবুজ ছাদে সাদা ও হলুদ বাতি জ্বলছে, ওপাশে একটি একতলা দালান নীল মরিচ বাতিতে মোড়ানো। সব মিলিয়ে বহুবর্ণের বাতিমালায় আলোকিত এই ফিলিং স্টেশন।

আমাদের এই দোতালায় দুটি বালক-বালিকাকে ভ্রমণের আনন্দ উপভোগ করতে দেখেছি। মা-বাবার সাথে যাচ্ছে ওরা। এক বিদেশি দম্পতি, মেয়েটি স্কার্ট ও ব্লাউজ নয়, সালোয়ার কামিজ পরেছে। তাকে বাঙালি মেয়েদের মতো লাগছে। সঙ্গে শিশু পুত্রটি ভারি শান্ত প্রকৃতির। পাহাড়ি এক দম্পতির সাথেও একটি শিশু পুত্র আছে, সে বিদ্রোহী প্রকৃতির। বাস ছাড়লে ফের ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, এবার গভীর তন্দ্রায়, কারণ সে তো ঘুমেরই সময়। ফের জেগে উঠি বাসের নিশ্চলতায়। আগে সে থেমেছিল নিজের উদর পূর্তির জন্য, এখন থেমেছে যাত্রীদের উদর পূর্তির জন্য। হাইওয়ে রেস্তোরাঁগুলো ঝাঁক বেঁধে আছে চৌদ্দগ্রামে, চৌদ্দটি তো হবেই। গ্রীণলাইন থেমেছে কুমিল্লার কাছাকাছি, কেননা তাদের ফুড হাব গ্রীনভিউ হোটেল এখানেই। দুটি, ঘোড়ারা যেভাবে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকে আস্তাবলে, গ্রীণলাইনের অভিজাত বাস দুটি সবুজ দৃশ্যের দিকে মুখ করে আছে। ঘুম জড়ানো চোখ নিয়ে নামি। এখন যাত্রী চলাচল কম বলে বিরাট রেস্তোরাঁটি ফাঁকাই বলা যায়। রাত দেড়টায় সবজি, পরোটা, পানি ও চা খেয়ে চাঙ্গা হই। গ্রীনভিউ হোটেলের ছাদে নামের স্বার্থকতা প্রমাণে সবুজ বাতি প্রজ্জ্বলিত। বসার চেয়ারগুলো লাল রেকসিনে মোড়ানো, ফলে গোটা রেস্তোরাঁয় লাল-সবুজ কম্বিনেশন তৈরি হয়েছে। ইদানীং আমরা বেশ দেশ প্রেমিক হয়ে উঠেছি। সুযোগ পেলেই লাল-সবুজ কম্বিনেশন তৈরি করি।

গ্রীনভিউ থেকে বেরিয়ে তবেই গ্রীনভিউ পাই। গাড়ির হেড লাইটে যা দেখলাম তা হলো সড়কের পূর্বপার্শ্বে মনোরম বৃক্ষসারি তাদের একহারা কাণ্ড আর ছায়াময় ডালপালা নিয়ে দণ্ডায়মান। এদের বয়স হয়েছে। সড়ক ডিভাইডারের গাছগুলো তুলনায় বেশ নবীন, শিশু বা বালক, লকলকিয়ে উঠেছে যে কয়টি তরুণ, তাদেরও বালক বলা যায় বৃক্ষের দীর্ঘ জীবনের বিচারে।

বৃষ্টি নামল রাত তিনটায়। ভেজা উইন্ড শিল্ডের ভেতর দিয়ে যা দেখলাম, মহাসড়কে, যাত্রীবাহী বাস তেমন নেই, বেশিরভাগ মালবাহী ট্রাক। ট্রাকগুলো অপেক্ষাকৃত মন্থর গতির, দ্রুতগামী বাসগুলো তাদের ওভারটেক করে করে যায়। বাসগুলোকে মনে হয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য ছুটছে। বিপরীতে ট্রাকগুলো সরকারি চরিত্রের, তাড়া নেই তেমন। গ্রীণলাইনের ডাবল ডেকার কখনো ডান কখনো বাম পাশের লেন ধরে ট্রাকগুলো ওভারটেক করে। কেবল কখনো দুটি ট্রাক দুটি লেনকেই দখল করলে পেছন থেকে বাসটি হাঁসের মতো প্যাকপ্যাক করে, ‘পথ ছাড়ো, পথ ছাড়ো’। তারা পথ ছেড়েও দেয়। জানে হাঁসের তাড়া আছে, ও গিয়ে সমুদ্র জলে নামবে। মুরগীর পাল ঢুকবে খোঁপে।

চট্টগ্রাম পার হলাম রাত চারটায়। ইচ্ছে ছিল কর্ণফুলি নদী দেখব, ঘুমের জন্য হলো না। ঘুম ভাঙল খুব ভোরে, সূর্য উঠি উঠি করছে। প্রদোষকালের সেই শান্ত সময়ের প্রকৃতি টিপটিপ বৃষ্টিতে ভিজছে। মাঝে মাঝেই সড়কের দুপাশে জড়ো হওয়া বাজারগুলো এসে পড়ে। তাদের মনে হয় ইসরাইলি বিমানে বিধ্বস্ত প্যালেস্টাইনি বাড়িঘরের মতো, ভাঙাচোরা বাক্স-পেটরা। কোথা দিয়ে যাচ্ছি বুঝতে পারি না, আবছা বৃষ্টি আর বাসের দ্রুত চলা মিলে একটি জায়গার নামও পড়তে পারি না। তখন মনে পড়লো, আরে আমার কাছে তো গুগল ম্যাপ আছে। গুগল আবার নদীর নাম না দেখিয়ে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নাম দেখাতে আগ্রহী, কারণ তারা টাকা দেয়, নদীর তো টাকা- পয়সা নেই। গুগল দেখায় বাস দোহাজারিতে, অবাক কাণ্ড বাইরে একটি সাইনবোর্ডেও তাই লেখা। গুগল দেখানোর পরে আমিও পড়তে পারলাম। এরপরেই সাঙ্গু নদী। বাণিজ্য ভুলে গুগল হয়ে উঠল ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক।

পর্ব ২ ছবি ৩ সমুদ্র দর্শনে আরও একবার (পর্ব ২)
কক্সবাজারে পিডিবি রেস্ট হাউজ

বাস চলে এলো কেরানিহাঁট। এখান থেকেই বান্দরবনের দিকে সড়ক চলে গেছে। পথটি কেমন মনে পড়ছে না, কেননা আমিও গিয়েছি, কিন্তু কেরানি হাঁটের সংযোগ মুখটি কেরানির মতোই নিষ্প্রভ। চল্লিশ বছর আগে যেমন দেখেছি, তেমনই আছে। মনে হলো এই চার লেনের সড়ক নিজ সন্তান, ওটি সতীন পুত্র। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক অবশ্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। লোহাগড়া থেকে চকরিয়া পর্যন্ত সড়কটি প্রকৃতির অনুদানে নৈসর্গিক। টিলা সারির উপরে গর্জন গাছের আকাশ ছোঁয়া সৌন্দর্য। পথ গেছে টিলা ও বনভূমির ভেতর দিয়ে। চল্লিশ বছর আগে টিলাগুলোতে যত গাছ দেখেছি, এখন তত দেখি না। কোনো কোনো টিলায় সব গাছ হারিয়ে একটি মাত্র গর্জন হারানো ভাইবোনের শোক নিয়ে প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এক মানব জীবনেই এই বৃক্ষ মৃত্যু বা বৃক্ষ হত্যা দেখলাম, কেননা গাছদের আয়ু তো অনেক বেশি। গাছ লোপাটকারীদের পাপ ঢাকতেই সরকার নতুন করে বনায়ন করেছে। তবে চকরিয়া থেকে ঈদগাঁ পর্যন্ত বনভূমি অংশে গর্জনের সংখ্যা বাড়তে লাগলো, গর্জন ও প্রতিবাদহীন গাছদের দীর্ঘজীবন কামনা করে প্রভাত সূর্যের দিকে তাকাই। এক অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীতে অকৃপণ আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে, ঈশ্বরের মতো পক্ষপাতহীন ও উদাসীন হয়ে। সেই বিদেশি দম্পতি চকরিয়ায় নেমে গেল।

পর্ব ২ ছবি ২ সমুদ্র দর্শনে আরও একবার (পর্ব ২)
বাঁকখালী নদীতে নোঙর করা সমুদ্রে মাছ ধরার ট্রলার

এই জায়গাগুলোকে কৈশোর থেকে চিনি। পুরনো টিনের চালগুলো আরও পুরনো হয়েছে, উঠেছে নতুন দালানকোঠা, বিপণি বিতান, সবই অপরিকল্পিত, সেই আল মাহমুদের ‘মানুষের সাধ্য মত ঘরবাড়ি’। এখানে হবে দোকানপাট। শ্রীহীন, উপরন্তু নোংরা জায়গাগুলো – বিভিন্নপ্রকার যানবাহন, কোনটি সচল, কোনটি বিকল – রেখে দুপাশের জায়গা দখল। পরিচ্ছন্নতা কোথাও নেই, পরিকল্পনা কোথাও নেই। সব মিলিয়ে খুকুর বাক্স থেকে নামানো বিবিধ সামগ্রী স্তূপ করে রাখা, সৌন্দর্যহীন, এলোমেলো ও দরিদ্র। লোহাগড়া থেকে হারবাঙ্গ যেতে চুনাতি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অভয়ারণ্য পড়ে, তবে তা সড়ক থেকে দূরে বলে দেখা যায় না, নাকি কিছুটা দেখা যায়? আমি কোনো বন্যপ্রাণী দেখিনি, বন মানুষ ছাড়া, যাদের ভয়ে সবপ্রাণীই ভয়ে থরো থরো। অভয়ারণ্য শব্দটি হতে পারে মানুষের আত্ম তৃপ্তির উদগার। লোহাগড়া থেকে হারবাঙ্গ আসতে ডালু নদী পেরিয়ে আসে বাস, আর হারবাঙ্গ থেকে চকরিয়া আসতে মাতামুহুরি নদী পেরুই। মাতামুহুরি অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত নদী, এর উপরে ট্রেন চলাচলের ব্রিজ তৈরি হচ্ছে মহা আয়োজনে।

ভেবেছিলাম বাস কোথাও থামবে প্রভাতের চা পানের ফুরসত দিবে। চালক একটানা টেনে গেল বাসটি। কক্সবাজার কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে এসে নামলাম সকাল সাতটায়। আমার গন্তব্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অতিথিশালা।

(চলবে)

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
কামরুল হাসানের জন্ম ২২ ডিসেম্বর, ১৯৬১ সালে বাংলাদেশের শরীয়তপুর জেলায়। তিনি আশির দশকের কবি। প্রথম কাব্য ‘সহস্র কোকিলের গ্রীবা’ প্রকাশিত হয় ১৯৯১ সালে। এরপরে আরও ১১টি কাব্য প্রকাশ করেন। ২০১২ সালে প্রকাশিত হয় ‘নির্বাচিত কবিতা’। কবিতার পাশাপাশি গল্প ও কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ লেখেন এবং বিদেশি সাহিত্য থেকে অনুবাদ করেন। ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয় একমাত্র গল্পগ্রন্থ ‘মধ্যবিত্ত বারান্দা ও অন্যান্য গল্প’। ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয় প্রবন্ধের বই ‘প্রহরের প্রস্তাবনা’। ভ্রমণপিপাসু এ কবি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সুপ্রচুর ভ্রমণকাহিনী লিখছেন। এপর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে চারটি ভ্রমণকাহিনী। ছাত্রাবস্থায় তার কবিতা সাপ্তাহিক ‘দেশ’ ও ত্রৈমাসিক ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তার অনুদিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই। ২০০৩ সালে সমীর রায়চৌধুরী ও তুষার গায়েনের সাথে সম্পাদনা করেন দুই বাংলার যৌথ সংকলন Post Modern Bangla Poetry 2003। তিনি বেশ কয়েকবার আমন্ত্রিত কবি হিসেবে দক্ষিণ এশীয় সাহিত্য উৎসবে যোগ দিয়েছেন। কবিতার জন্য পেয়েছেন ‘মৈনাক সন্মাননা স্মারক’ ও ‘কবিকুল, কক্সবাজার কবিতা সম্মাননা‘। ছাত্রজীবনে মেধাবী কামরুল হাসান ভারতের বিখ্যাত আইআইটি খড়গপুর থেকে প্রকৌশলবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তী পড়াশোনা ব্যবসায় প্রশাসনে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। পেশাগত জীবনে বহুবার চাকরি বদল করেছেন। করপোরেট জগৎ থেকে শিক্ষকতায় যোগ দেন। গত ১৫ বছর ধরে পড়াচ্ছেন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সটিতে। তিনি বিবাহিত ও চার সন্তানের জনক। সম্প্রতি তিনি মহেশখালির দক্ষিণে সোনাদিয়া দ্বীপে সেখানকার তরুণ কবিদের আমন্ত্রণে কবি হাফিজ রশিদ খানের জন্মদিন পালনে গিয়েছিলেন। সে ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা ‘সমুদ্রদর্শনে আরও একবার’।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!