সামনে ঝুঁকতেই কোমরে টান। আস্তে আস্তে শরীরটা বেঁকালাম। পরশুদিন রাস্তার কল থেকে জল আনতে গিয়ে একটা খিঁচ লেগেছিল। তখন ব্যথা বুঝিনি। এখন টের পেলাম। আশ্রমে ঢুকলে আগে বড় মোহান্তর পায়ে মাথা ঠেকাতে হয়। বড় ঘরের সিংহাসনে সামনে দু’পা মেলে বসেছিলেন। পায়ে কপাল ছোঁয়াবো বলে কোমর বেঁকিয়ে ধীরে ধীরে সামনে ঝুঁকছিলাম। তখনই কথার ছুরি, ‘তুই পোয়াতি হয়েছিস নাকি? কোমর বেঁকাতে কষ্ট?’
এ আবার কি কথা! ভিতরে ভিতরে জ্বলে উঠলাম। মুখ ফস্কে বেরিয়ে এল, ‘ওমা আমি কুমারী!’ এক দঙ্গল লোক খ্যা খ্যা করে হেসে উঠল। গাঁট্টাগোট্টা এক ভক্ত মাথা দুলিয়ে বলল, ‘হয় হয়। কুমারী সধবা বিধবা সব্বার হয়।’
ঘরে হাসির রোল। শব্দ ছড়িয়ে পড়ল বাইরে। সন্ধ্যার অন্ধকারে বাতাসে ভাসতে অনেক দূর। মেঝের শতরঞ্জির সাথে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে আমি পাথর। ভাবছি কী করতে বলবেন এবার। দোতলার সিঁড়ি মোছা কিংবা হাতপাখা দিয়ে বাতাস করা। মোহান্তর আদেশের অপেক্ষায় থাকতে হয়। সন্ধ্যায় বহু মানুষের জমায়েত পেল্লায় ঘরে। কাউকে গান করতে বললে গাইবে। নাচ করবার আদেশ পেলে কেউ এক লাফে উঠে তাথৈ তাথৈ শুরু করে দেবে।
হাসি থেমে এল। শান্ত ঘর। এখানে কেন যে আসি! ভাবছি। স্কুল পাশ। পেট ভরে খেতে পাই। মা পুরসভার সাফাই কর্মী। অভাব নেই তেমন। তবু এখানে না-এসে পারি না। সেই ছোটবেলা বাবা মারা যাবার পর ছেঁড়া ফ্রক পরে মায়ের হাত ধরে আসতাম। এখন শাড়ি পরি কিন্তু খালি পা। এখানকার সবাই খালি পায়ে আশ্রমে আসে। ঝড়ে বন্যায় সাহায্য বিলি করে আশ্রমের সাধু মহান্তরা। আমার মা আগের বড় মোহান্তর শিষ্যা। খুবই বড় সাধু ছিলেন। একশ এক বৃন্দাবন দাস মহারাজ। বিশাল বনস্পতি।
এখনকার মোহান্ত…একশ দুই নম্বর। হাবভাবে আগের মোহান্তির মতোই। কিন্তু কেমন যেন! যুবতী মেয়ে দেখলে খলবল করে ওঠে। ঘরের কোণে বসে মনে মনে বললাম, দু’নম্বর। মূর্খ একটা। আগাছা। দুব্বাঘাস।
ধর্মকথা শুরু করেছে একশ দুই নম্বর। কানে ঢুকছে না কিছু। রাগে জ্বলছে শরীর। উঠে দাঁড়ালাম। ঘরের দিকে হাঁটছি। কাঁচা পথ। খালি পায়ে দুব্বাঘাস মারিয়ে চলতে চলতে শরীরটা একটু ঠাণ্ডা হ’ল।
বড় মোহান্ত

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
ড.সৌমিত্র কুমার চৌধুরী, ভূতপূর্ব বিভাগীয় প্রধান ও এমেরিটাস মেডিক্যাল স্যায়েন্টিস্ট, চিত্তরঞ্জন জাতীয় কর্কট রোগ গবেষণা সংস্থাণ, কলকাতা-700 026.
প্রকাশিত গ্রন্থ- বিজ্ঞানের জানা অজানা (কিশোর উপযোগী বিজ্ঞান), আমার বাগান (গল্পগ্রন্থ), এবং বিদেশী সংস্থায় গবেষণা গ্রন্থ: Anticancer Drugs-Nature synthesis and cell (Intech)।
পুরষ্কার সমূহ: ‘যোগমায়া স্মৃতি পুরস্কার’ (২০১৫), জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকায় বছরের শ্রেষ্ঠ রচনার জন্য। ‘চৌরঙ্গী নাথ’ পুরস্কার (২০১৮), শৈব ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত উপন্যাসের জন্য। গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরষ্কার (2019), পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও জৈবপ্রযুক্তি দফতর থেকে), পঁচিশ বছরের অধিক কাল বাংলা ভাষায় জনপ্রিয় বিজ্ঞান রচনার জন্য)।
মন্তব্য নেই
মন্তব্য নেই