ভাওয়াইয়া একটি জনপ্রিয় ফোক সঙ্গীত শৈলী, যা মূলত বাংলাদেশের রংপুর বিভাগ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলা এবং আসামের গোলপাড়া জেলার উত্তরাঞ্চলে প্রচলিত। এই সঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য হলো এটি সাধারণত শ্রমজীবী মানুষদের, যেমন মহুত, মহিশাল (গরু চরানো), এবং গাড়িয়াল (গাড়ির চালক) জীবনযাত্রাকে কেন্দ্র করে লেখা হয়। ভাওয়াইয়া গানের কথা মূলত বিচ্ছেদ, একাকীত্ব এবং তাদের মহিলাদের জন্য মনোবেদনার সাথে সম্পর্কিত, যেখানে দীর্ঘস্বর ব্যবহার করে দুঃখ, আকুলতা এবং “গভীর অনুভূতি” প্রকাশ করা হয়। ভাওয়াইয়া সঙ্গীতের উৎপত্তি ১৬ শতকের দিকে, বিস্ব সিংহের শাসনামলে, এবং ১৯৫০ এর দশক থেকে এটি মঞ্চে পরিবেশনায় রূপান্তরিত হয়েছে।
ভাওয়াইয়া শব্দের উৎপত্তি
ভাওয়াইয়া শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মত আছে। একদিকে, ভাওয়া শব্দটি নিম্নভূমি বা ঝোপঝাড়ের মধ্যে জমিতে বাড়ানো শাকসবজি বোঝায়, যাকে “ভাওয়া” বলা হয়। কিছু গবেষক বলেন, ভাওয়াইয়া শব্দটি “বাও” (বাতাস) শব্দ থেকে এসেছে। অন্যদিকে, ভাওয়াইয়া শব্দটি ভাও (অনুভূতি) এবং ইয়া (সংগীত) শব্দের মিলিত রূপ, যা একটি অনুভূতির সঙ্গীত হিসেবে পরিচিত। কিংবদন্তী গায়ক আব্বাসউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ভাওয়াইয়া সঙ্গীত উত্তরবাংলার বাতাসের মতো, যা মানুষের হৃদয়ে গভীর অনুভূতি জাগায়।
এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের ফোক কালচার অ্যান্ড ট্রাইবাল কালচারাল সেন্টারের গবেষণা অনুসারে, ভাওয়াইয়া শব্দটি “ভাও” থেকে পরিবর্তিত হয়ে “ভব” রূপে এসেছে, যার মানে গভীর অনুভূতি। এসব গান মানুষের বিচ্ছেদ বা একাকীত্বের অনুভূতি প্রকাশ করে।
উৎপত্তি এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব
ভাওয়াইয়া সঙ্গীতের মূল উৎস রংপুর। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে নদী কম এবং গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল বেশি। গাড়ির চালকরা দীর্ঘ পথ চলার সময় একাকী থেকে মনোবেদনা ও অভ্যস্ত বিষাদ অনুভব করতেন, এবং সেই সময়ে তাদের গানগুলোতে অনুভূতি প্রকাশ পেত। বিশেষত, গাড়ির চাকার শব্দে সুরের “ভাঙা” বা “ভাঁজ” পড়ে, যা গানের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। এই সুরের ভাঁজগুলো সুরের গতির পরিবর্তন এবং মানুষের মনের উত্থান-পতনকে প্রতিফলিত করে।
ভাওয়াইয়া গানের সুরগুলি প্রায়শই অনুভূতির তীব্রতায় ভরা, যেমন প্রেমের বিচ্ছেদ, দীর্ঘশ্বাস এবং পরস্পরের অভাব অনুভবের দৃশ্য। ভাওয়াইয়া সঙ্গীতের এই গঠন ও সুরের রূপ তাদের পল্লী জীবন ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের একটি উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি।

ভাওয়াইয়া গানের থিম এবং কথাবার্তা
ভাওয়াইয়া গানের প্রধান থিম হল বিচ্ছেদ, একাকীত্ব এবং দীর্ঘশ্বাস। গানের কথায় সাধারণত শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট, তাদের দিনের পর দিন ঘামে ভেজা জীবন এবং তাদের পরিবারের প্রতি গভীর প্রেম এবং মমতা প্রকাশিত হয়। বহু গানে মহিলাদের দুঃখ, যাদের তাদের প্রিয়জনদের থেকে দীর্ঘ সময় বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়, সে বিষয়ে কথা বলা হয়।
একটি জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া গান:
“ওকি গাড়িয়াল ভাই,
কত রব আমি পন্থের দিকে চাঞা রে,
যেদিন গাড়িয়াল উজান যায়”
এই গানের মাধ্যমে গাড়ি চালকদের দীর্ঘ পথ চলার সময় অনুভূতি ও বিচ্ছেদের বিষয়টি ফুটে ওঠে। এই ধরনের গান গায়ক বা গায়িকাদের নিজস্ব ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং অনুরাগের গল্প বলার মাধ্যম হয়ে ওঠে।
মঞ্চে ভাওয়াইয়া গানের প্রবেশ
ভাওয়াইয়া গানের মঞ্চে পরিবেশন শুরু হয় ১৯৫০-এর দশকে, যখন এটি ফোক সঙ্গীতের অংশ হিসেবে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। তখন থেকে এটি শুধু গ্রামীণ অঞ্চলের সঙ্গীত হিসাবে নয়, বরং মূলধারার বাংলা সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। গায়ক আব্বাসউদ্দিন আহমদ, যাকে “ভাওয়াইয়া সম্রাট” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, তার কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে এই সঙ্গীত জাতীয় স্তরে পরিচিতি লাভ করে।
আরও একজন বিশিষ্ট শিল্পী, প্রতিমা বড়ুয়া পাণ্ডে, যিনি আসামে এবং ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য অংশে ভাওয়াইয়া সঙ্গীতের প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার অনন্য কণ্ঠস্বরে সঙ্গীতটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং মঞ্চের পারফরম্যান্সে এটির স্থান স্থির হয়ে যায়।
চলচ্চিত্রে ভাওয়াইয়া
ভাওয়াইয়া সঙ্গীতের গুরুত্ব আজও অমলিন। ২০১৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলাদেশের চলচ্চিত্র উত্তরের সুর (Northern Symphony) পরিচালক শাহনেওয়াজ কাকলীর একটি গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি, যেখানে ভাওয়াইয়া গায়কের জীবন এবং এই সঙ্গীতের ভবিষ্যত নিয়ে এক গল্প বলা হয়েছে। এই চলচ্চিত্রটি বাংলার উত্তরাঞ্চলের দারিদ্র্য ও ভাওয়াইয়া সঙ্গীতের ধীরে ধীরে অবলুপ্তির বিষয় তুলে ধরেছে। এটি কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়।
প্রধান ভাওয়াইয়া শিল্পী
ভাওয়াইয়া সঙ্গীতের ঐতিহ্য বহন করেছেন অনেক খ্যাতিমান শিল্পী। তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন:
- আব্বাসউদ্দিন আহমদ – যিনি ভাওয়াইয়া সঙ্গীতকে সর্বাধিক জনপ্রিয় করেছেন।
- প্রতিমা বড়ুয়া পাণ্ডে – আসামে এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ভাওয়াইয়া সঙ্গীতের প্রচারে তাঁর অবদান অপরিসীম।
- কল্পনা পাটোয়ারী – যিনি ভাওয়াইয়া সঙ্গীতকে আধুনিক সঙ্গীতের সাথে মিশিয়ে নতুন ধারায় উপস্থাপন করেছেন।
- জুবিন গাৰ্গ – আধুনিক সঙ্গীতে ভাওয়াইয়া গানের প্রবণতা এনেছেন।
ভাওয়াইয়া সঙ্গীত আজও উত্তরবাংলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি শুধুমাত্র শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামকেই প্রতিফলিত করে না, বরং মানবিক অনুভূতি, প্রেম, বিচ্ছেদ এবং একাকীত্বের গভীর প্রকাশ ঘটায়। সঙ্গীতের এই ঐতিহ্য একদিকে যেমন গ্রামীণ জীবনযাত্রার সঙ্গীত, তেমনি আধুনিক যুগে তা মঞ্চ, চলচ্চিত্র এবং পপ সঙ্গীতের মাধ্যমে আরও প্রসারিত হয়েছে। ভাওয়াইয়া সঙ্গীতের গভীর আবেগ এবং হৃদয়গ্রাহী সুরগুলি আমাদেরকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সম্পর্কে।