ভারতের হরিয়ানায় দাঙ্গার ঘটনায় বহু মুসলিম ও রোহিঙ্গা গ্রেপ্তার
ভারতের হরিয়ানাতে সাম্প্রতিক দাঙ্গা ও সহিংসতার পর বেছে বেছে শুধু একটি সম্প্রদায়ের লোকজনকেই আটক করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে।
রাজ্যের নূহ ও গুরগাঁওতে গত সোমবার থেকে শুরু হওয়া এই সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় এযাবত মোট ২০২জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং ৮০জনকে ‘প্রিভেনটিভ ডিটেনশনে’ আটক করা হয়েছে বলে হরিয়ানার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনিল ভিজ নিশ্চিত করেছেন।
যদিও এই ধৃতদের ধর্মীয় পরিচয় সরকার প্রকাশ করেনি, তবে এদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশই নূহ ও আশেপাশের এলাকার মুসলিম বাসিন্দা বলে বিবিসি বিভিন্ন সূত্র মারফত নিশ্চিত হতে পেরেছে।
ধৃতদের মধ্যে নূহ্-র কাছে তাউরুর একটি বস্তির বাসিন্দা দুই-তিন ডজন রোহিঙ্গা মুসলিমও রয়েছে। পুলিশ বলছে এই রোহিঙ্গারা দাঙ্গার দিন হিন্দুদের মিছিলে পাথর ছোঁড়ার ঘটনায় জড়িত ছিলেন।
এছাড়া নূহ ও মেওয়াট শহরের বিভিন্ন এলাকায় হানা দিয়ে পুলিশ শতাধিক মুসলিম যুবককে তুলে নিয়ে গেছে বলে জানা যাচ্ছে।
অন্যদিকে নূহ-র লাগোয়া অভিজাত গুরগাঁওতে একটি মসজিদে হামলার ঘটনায় এ পর্যন্ত মাত্র চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে গুরগাঁও পুলিশ নিশ্চিত করেছে।
গত সোমবার (৩১শে জুলাই) মধ্যরাতে এক বিশাল জনতা ওই মসজিদে হামলা চালায় এবং মসজিদের ভারপ্রাপ্ত ইমাম সেই ঘটনায় নিহত হন।
এই দাঙ্গায় জড়িত সন্দেহে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বজরং দলের একজন নেতা বিট্টু বজরঙ্গীকে হরিয়ানা পুলিশ ফরিদাবাদ থেকে গ্রেপ্তার করেছিল – কিন্তু তিনি মাত্র চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই জামিন পেয়ে গেছেন।
অন্য দিকে মোনু মানেসর নামে যে হিন্দুত্ববাদী নেতা ও ইউটিউবার-কে কেন্দ্র করে নূহ্-তে সহিংসতার সূত্রপাত হয়েছিল বলে অভিযোগ, পুলিশ এখনও তার বিরুদ্ধে কোনও এফআইআর-ই দায়ের করেনি।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার থেকে নূহ-তে বুলডোজার দিয়ে যে ‘অবৈধ স্থাপনা’ ভাঙার অভিযান শুরু হয়েছে তাতেও বেছে বেছে শুধু মুসলিম বাসিন্দাদেরই নিশানা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। হিন্দু-অধ্যুষিত অভিজাত গুরগাঁও কিন্তু সেই অভিযান থেকেও ছাড় পেয়েছে।
তবে আজ (সোমবার) পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্ট তাদের এক নির্দেশে এই বুলডোজার অভিযান স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
রোহিঙ্গাদের ধরপাকড়
নূহ্ জেলার সদ্য দায়িত্ব পাওয়া পুলিশ প্রধান নরেন্দর বিজরানিয়া জানিয়েছেন, তাউরু-তে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প থেকে তারা প্রায় ২৫-৩০জন রোহিঙ্গা মুসলিমকে আটক করেছেন।
তিনি জানান, এই রোহিঙ্গারা হরিয়ানা সরকারের নগরোন্নয়ন বিভাগের জমি দখল করে সেখানে অবৈধভাবে শিবির স্থাপন করে বসবাস করছিলেন।
তবে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ৩১শে জুলাই নূহ্-তে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মিছিলে পাথর ছোঁড়ার ঘটনাতেও যুক্ত ছিল – পুলিশ তার প্রমাণ পেয়েছে বলেও মি. বিজরানিয়া দাবি করেন।
নূহ ও তাউরুর বিভিন্ন বস্তিতে হাজার দুয়েকেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করেন – তাদের বেশির ভাগেরই জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার জারি করা ‘শরণার্থী কার্ড’ও রয়েছে।
এই গরিব খেটে-খাওয়া মানুষগুলো কিছুতেই দাঙ্গাতে জড়াতে পারেন না বলে দাবি করছে দিল্লিতে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সংগঠন।
ভারতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত আলি জোহর যেমন বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “নূহ্-তে এই রোহিঙ্গারা খেতেখামারে বা ছোট দোকানে দিনমজুরি করে দিনে বড়জোর দু-আড়াইশো টাকা রোজগার করেন।”
ভারতে যাদের অস্তিত্ত্ব ও বেঁচে থাকাটাই নড়বড়ে, তারা গিয়ে দাঙ্গাহাঙ্গামায় জড়াবেন বা হিন্দুদের ধর্মীয় শোভাযাত্রায় পাথর ছুঁড়বেন – সেই অভিযোগ কতটা বিশ্বাস্য, এই প্রশ্নও তুলছেন আলি জোহর।
নূহ-র শিবির থেকে দিল্লিতে পালিয়ে আসা এক রোহিঙ্গা যুবক মহম্মদ আবদুল্লাহও বিবিসিকে বলেছেন, শুধুমাত্র মুসলিম বলেই তাদের এভাবে পুলিশি হেনস্থা ও নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে।
তিনি বলছিলেন, “আমরা এদেশে শরণার্থী এখানকার হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্কই নেই – তবুও শুধু শুধু পুলিশ আমাদের হয়রানি করছে।”
মোনু মানেসর কোথায়?
নূহ্-তে গত সোমবার ভিএইপি-র ধর্মীয় শোভাযাত্রায় মোনু মানেসর নামে একজন বিতর্কিত হিন্দুত্ববাদী নেতা যোগ দেবেন, এই খবরকে ঘিরেই এলাকায় তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়েছিল।
মোনু মানেসর নিজেও সোশ্যাল মিডিয়াতে ভিডিও পোস্ট করে জানিয়েছিলেন, তিনি ওই মিছিলে থাকবেন।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে জুনেই ও নাসির নামে লাগোয়া রাজস্থানের দুজন মুসলিম যুবককে গাড়ি-সহ জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনায় ওই রাজ্যের পুলিশ মোনু মানেসরকে খুঁজছে – কিন্তু বিজেপি শাসিত হরিয়ানাতে তিনি প্রায় প্রকাশ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
নূহ ও মেওয়াটের মুসলিমরা তখন থেকেই প্রশ্ন তুলছেন, মোনু মানেসর কীভাবে আইনের নাগাল থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আর কীভাবেই তিনি মিছিলে যোগ দিতে পারেন?
গত বছরের অক্টোবরে এক লক্ষ সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা অতিক্রম করার পর ‘জনপ্রিয়’ এই ইউটিউবারকে গুগল ‘সিলভার প্লে বাটন অ্যাওয়ার্ড’ দিয়েও স্বীকৃতি জানিয়েছিল।
গত সোমবারের শোভাযাত্রায় ‘বিশ্ব হিন্দু পরিষেদের পরামর্শেই’ শেষ পর্যন্ত তিনি আর যোগ দেননি বলে মোনু মানেসর পরে জানিয়েছিলেন। তবে ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে।
দিনসাতেক হয়ে গেল মোনু মানেসর আর প্রকাশ্যে আসছেন না।
মোনু মানেসরের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কি না, এই প্রশ্নের জবাবে হরিয়ানা পুলিশের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, “আপনারা যার কথা বলছেন, তিনি ঘটনার সময় সেখানে ছিলেন এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।”
নূহ্-র দাঙ্গায় যে সব এফআইআর দায়ের করা হয়েছে, তার কোনওটিতেও মোনু মানেসরের নাম নেই।
সূত্র: বিবিসি বাংলা