বাংলা সাহিত্যে একুশের চেতনা

মাসুদুল জারিফ
মাসুদুল জারিফ
16 মিনিটে পড়ুন

“একুশ আমাদের জাগ্রত চেতনা
এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা,
একুশ মায়ের দুঃখ-বেদনা
একটি জাতির উদ্দীপনা।”

একুশ আমাদের অহংকার। একুশের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে আমাদের মাতৃভাষা। বাংলা সাহিত্য বাঙালির ভরসা। বাংলার ঐতিহ্য, বাংলার সংস্কৃতি, সবই বাংলা সাহিত্যে অক্ষয় হয়ে আছে। সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে অর্থাৎ হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত বাংলা সাহিত্য। চর্যাপদ থেকে শুরু করে বর্তমান শতকের বাংলা সাহিত্যে স্থান পেয়েছে যুগের বহু ঘটনা। এমনিভাবে বাঙালির জীবনে একুশের ঘটনা যেমন স্মরণীয় তেমনি একুশের চেতনা বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।

বাঙালি জাতির অন্যতম প্রধান সৃষ্টি মহান একুশ। একুশ একটি চেতনা, একটি বৈশ্বিক প্রতীক, একটি মহান বিপ্লব। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে বাঙালির জীবনোৎসর্গের ঘটনা গড়েছে এক অনন্য ইতিহাস। বাঙালি জাতিকে স্বতন্ত্র মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অমর একুশের রয়েছে সীমাহীন অবদান। একুশের চেতনায় উজ্জীবিত আজ সারাবিশ্ব। একুশ আর কেবল বাঙালির জাতীয় ইতিহাস নয় বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তা ভাষার মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। একুশের এ বিশ্বজয় সমগ্র বাঙালি জাতির গর্বের বিষয়। একুশের চেতনা ১৯৭১-এ পরিণত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। তারই অসামান্য ফসল আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতা। এ আমাদের ঐতিহাসিক অর্জন।

একুশের চেতনা আমাদের সাহিত্য অঙ্গনে ফেলেছে সুদূরপ্রসারী প্রভাব । একুশের প্রথম কবিতা মাহবুব উল আলম চৌধুরীর ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি।’ একুশের অনবদ্য দলিল হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলন। একুশের চেতনায় সৃষ্ট আরও অনেক সাহিত্যে ভরে আছে আমাদের অঙ্গন। প্রতি বছর একুশ উদ্‌যাপন উপলক্ষ্যে প্রকাশিত হচ্ছে অজস্র সাহিত্য সংকলন।

“মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো।” কবিগুরুর এ লাইনটি থেকে উপলব্ধি করা যায় বাংলা ভাষা কতটা শ্রুতিমধুর ও প্রাঞ্জল। বাংলা বাঙালির গর্বের ভাষা, প্রাণের ভাষা, অধিকার আদায়ের ভাষা। বাংলা ভাষা আমাদের অহংকার।

বাংলা এমনি একটি ভাষা, যে ভাষায় বাঙালিরা তাদের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোকে বিভিন্ন শব্দের মাধ্যমে খুব সহজভাবে প্রকাশ করতে পারে। তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের এই বাংলা ভাষা।

বাংলা সাহিত্যে একুশের চেতনা
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। চিত্র: আরিফুর রহমান, উৎস cartoonistarif.com

এই ভাষা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে বাঙালি জাতিকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। ভাষা আন্দোলন করার জন্য জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতনের স্টিম রোলার চালানো হয়েছিল বাঙালিদের ওপর।

দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। যাদের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও সাহসিকতায় সেদিন ভাষা আন্দোলন সফলতা লাভ করেছিল, ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

ভাষা আন্দোলনের সূচনা ঘটে সদ্যগঠিত পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে। সে দাবি উচ্চারিত হয় পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা উর্দুর ঘোষণায়। সে ঘোষণা ছিল জিন্নাহ-লিয়াকত থেকে মুসলিম লীগের সব শীর্ষনেতার কণ্ঠে। কিন্তু পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষা ছিল বাংলা।

আন্দোলনের সূচনাটি ছিল বেশ চমকপ্রদ। পাকিস্তান জনপরিষদের প্রথম অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একটি বাস্তব দাবি তোলেন, প্রস্তাবটি রাষ্ট্রভাষার নয়, গণপরিষদে ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে বাংলার অন্তর্ভুক্তি, যাতে গণপরিষদের বাঙালি সদস্যরা স্বচ্ছন্দভাবে নিজ মাতৃভাষা তথা বাংলায় বক্তৃতা করতে পারেন।

এই সাদামাটা দাবিটুকুই সহ্য হয়নি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী সহ অন্যান্য উর্দুভাষী ও অবাঙালি সদস্যদের; এমনকি কোনো কোনো বাঙালি মুসলিম লীগ নেতার। প্রধানমন্ত্রী তীব্র ভাষায় এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। এমনকি প্রসঙ্গক্রমে রাষ্ট্রভাষা বাংলার বিরোধিতার বিষয়টি উল্লেখ করতে ভুলেন নি।

১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে নিয়ে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র চলে। ২১শে ফেব্রুয়ারী ১৪৪ ধারা থাকা সত্ত্বেও মাতৃভাষাপ্রেমী ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আন্দোলন শুরু করে। পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার সহ নাম না জানা অনেক মায়ের সন্তান। এক সময় বন্ধ হয় আন্দোলন। এর ধারাবাহিকতায় অর্জিত হয় শুধু অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলাই নয়, সেই সঙ্গে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক ও গণতন্ত্রী প্রগতিবাদী জাতীয় চেতনার বিকাশ। একুশে ফেব্রুয়ারি চিহ্নিত হয় ও পালিত হতে থাকে ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে। আর শহীদ মিনার হয়ে ওঠে প্রতিবাদী সংগ্রামের প্রেরণার প্রতীক।

বাংলা সাহিত্যে একুশের চেতনা
একুশে ফেব্রুয়ারী শহীদ মিনারে পুষ্পাঞ্জলি। চিত্র: আরিফুর রহমান, উৎস: cartoonistarif.com

পলাশের লাল ফুল দেখলে মনে পড়ে, ৮ ফাল্গুনে মাতৃভাষার জন্য বাঙালির সেই মহান আত্মত্যাগের কথা। ভাষাশহীদদের কথা। বড় গর্বের, ঐতিহ্যের আর ভাষার জন্য রক্তদানের বৃহৎ ত্যাগে ভাস্বর এই দিনটি। ভাষার জন্য জীবনদানে, বিরল ত্যাগে, সালাম, রফিক, বরকতের স্বোপার্জিত প্রাণে মাতৃভাষার শৃঙ্খল মুক্তির দিন। তাই বিশ্বের মাঝে অনন্য, অসাধারণ, ঐতিহাসিক এই দিনটি। মাতৃভাষার জন্য পৃথিবীর আর কোনো জাতিকে এভাবে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে কি-না জানি না, তবে বাঙালি তা পেরেছিল অত্যন্ত বীরদর্পে।

একুশের চেতনার তাৎপর্য বহুমুখী। প্রথমত, বাঙালির জাতীয় চেতনাকে একুশ দিয়েছে স্ফটিকস্বচ্ছতা। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালির ওপর যে জাতিগত শোষণ ও নিপীড়ন চালিয়েছিল তার বিরুদ্ধে জাতীয় চেতনায় সংগঠিত হতে একুশ আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে। আমাদের সচেতন, সক্রিয় ও প্রাণিত করেছে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক চেতনায়। একুশের চেতনা ক্রমেই পরিণতি লাভ করেছিল স্বাধীনতার চেতনায়।

দ্বিতীয়ত, বাঙালির জাতিসত্তার স্বরূপ আবিষ্কারে একুশের অবদান অসামান্য। ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে সংকীর্ণ ধর্মাচ্ছন্নতাকে ছাপিয়ে উঠেছিল জাতিগত চেতনা। সেই চেতনা আমাদের এই মর্মে সচেতন করেছে যে, আমরা বাঙালি। আমরা জেনেছি, বাংলা ভাষা আমাদের অস্তিত্বের অঙ্গীকার, বাংলাদেশ আমাদের দেশ। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই আমরা ছেষট্টি, ঊনসত্তর ও একাত্তরে আমাদের আত্মপরিচয়, আমাদের ঠিকানা ও দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য লড়াই করেছি। একুশের পথ ধরেই এসেছে স্বাধীনতা।

তৃতীয়ত, আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এবং শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির চেতনার বিকাশে একুশে ফেব্রুয়ারি যেন হাজার তারের বীণা। তাতে কত না সুর, কত না ঝংকার। একুশের এই বীণায় ঝংকৃত হয়েছে আমাদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি। একুশের ফসল আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর অনন্য গানঃ ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’। এ গান আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশে উজ্জীবনী মন্ত্রের প্রেরণা। একুশের সাংস্কৃতিক চেতনার ধারায় আমরা ক্রমে অর্জন করেছি দেশাত্মবোধক গানের সমৃদ্ধ সম্পদ।

১৯৫২ সালের বিস্ময়কর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এর মর্যাদার স্বীকৃতিতে ইউনেস্কো দিনটিকে ঘোষণা করে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে যা বিশ্বের সব দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এ ঘটনা গর্ব ও অহঙ্কারের বিষয় বাংলা ভাষা-ভাষী মানুষের কাছে। এখানেই মূল তাৎপর্য ফুটে উঠেছে একুশে ফেব্রুয়ারীর।

“একুশ ভাষার প্রাণ
একুশ করেছে দান
একুশ মোদের পাথেয়
একুশকে করো নাকো হেয়।”

বাঙালি জাতির আত্মোপলব্ধির উত্তরণ ঘটে ঊনিশ’শ বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির সংগ্রামের মাধ্যমে।

বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ ডক্টর মুহাম্মদ এনামূল হকের মতে, “২১ শে ফেব্রুয়ারী কোনো বিশেষ দিন, ক্ষণ, বা তিথি নয়, একটি জাতির একটা জীবন্ত ইতিহাস। এ ইতিহাস অগ্নিগর্ভ যেন সজীব লাভা স্রাবক আগ্নেয়গিরি, কখনও অনৃতর্দাহে গর্জন করছে,আর কখনও চারিদিকে অগ্নি ছড়াচ্ছে। সত্যি এ ইতিহাস মৃত নয় একেবারে জীবন্ত।”

বাঙালি জাতীর চেতনার উপলব্ধির ক্রমবিকাশে এখানে এসে গাঢ়তায় রূপ নেয়। সমগ্র জাতি ভাবতে শেখে তার জাতীয় সত্তা এবং রাষ্ট্রীয় সত্তার কথা।

একুশ বাংলা সাহিত্য-অঙ্গনকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। ভাষার জন্য যে জাতি প্রাণ দিয়েছে, তার ইতিহাস বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি পরতে পরতে লেখা আছে। মায়ের মুখের ভাষা রক্ষায় বাংলার দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্তে পিচঢালা কালাে রাজপথ রঞ্জিত করেছিল। তাদের এ আত্মত্যাগের ফসল আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।

দেশ, দেশের মানুষ বা মাতৃভাষার জন্য এ আত্মত্যাগ পৃথিবীর অন্য কোন দেশের ইতিহাসে নেই। তাই একুশ জড়িয়ে আছে আমাদের সামগ্রিক ও জাতীয় চেতনায় সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন কবি-লেখকগণ তাদের সাহিত্যের মুখ্য উপকরণ হিসেবে একুশকে গ্রহণ করেছেন। আর সেসব মনীষীরা হলেন- ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুনীর চৌধুরী, জহির রায়হান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হুমায়ুন আজাদ, শওকত ওসমান, কবি শামসুর রাহমান প্রমুখ। একুশ সম্পর্কে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন- ‘মাতা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি প্রত্যেক জাতির কাছে পরম শ্রদ্ধার বিষয়।’ তিনি আরও বলেছেন, বাঙালির প্রাণের দাবি, মনের দাবি বাংলা ভাষা। এ ভাষায় তাদের কথা বলতে না দিলে তারা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হবে।’

“মোদের ভাষার প্রাণ
একুশ করেছে দান
একুশ মোদের পাথেয়
একুশকে করো নাকো হেয়।”

একুশ সম্পর্কে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর উক্তিটি বাংলা সাহিত্যে একুশের অবস্থানকে আরও দৃঢ় করেছে।

প্রথম কবিতা: ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে প্রথম কবিতা রচনা করেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী। নাম ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। পাকিস্তান সরকার সে কবিতা বাজেয়াপ্ত করল। হুলিয়া জারি হলো মাহবুব উল আলম চৌধুরীর ওপর। তিনি এবং তাঁর কবিতা হয়ে গেল ইতিহাসের অংশ। ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি-একুশের প্রথম কবিতা।

প্রথম গান: একুশের গান হিসেবে অধিক সমাদৃত “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো” গানটি। তবে এটি একুশের প্রথম গান নয়। ভাষা আন্দোলনভিত্তিক প্রথম গানটির প্রথম চরণ ‘ভুলব না, ভুলব না, একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না’। যার রচয়িতা ভাষা সৈনিক আ ন ম গাজিউল হক। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার আর্মানিটোলা ময়দানের জনসভায় গানটি গাওয়া হয়।

প্রথম গল্প: ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রজনতা হত্যার পর রচিত একুশের প্রথম গল্পের নাম ‘মৌন নয়ন’। গল্পটির রচয়িতা বিশিষ্ট কবি ও কথাশিল্পী শওকত ওসমান। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত একুশের প্রথম সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ গ্রন্থে গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়।

প্রথম সংকলন: ১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে একুশের প্রথম সংকলন সম্পাদনা করেছিলেন বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম কৃতী পুরুষ কবি হাসান হাফিজুর রহমান। প্রকাশক ছিলেন অন্যতম ভাষাসৈনিক মুহাম্মদ সুলতান। পুঁথিপত্র প্রকাশনার মাধ্যমে প্রকাশিত এই সংকলনের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন আমিনুল ইসলাম। রেখাচিত্র এঁকেছিলেন মর্তুজা বশীর। সংকলনটি পাইওনিয়ার প্রেসের পক্ষ ছাপা হয়। এই সংকলনে স্থান পেয়েছিল একুশের প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, গান, নকশা ও ইতিহাস।

প্রথম নাটক: মুনির চৌধুরী এবং তার রচিত নাটক ‘কবর’ এর নাম শুনেনি এমন মানুষ বিরল। ভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকার ‘অপরাধে’ ’৫২ সালে জেলে আটক ছিলেন মুনির চৌধুরী, রণেশ দাশগুপ্তসহ অনেক লেখক- সাংবাদিক। মুনীর চৌধুরী ’৫৩ সালে জেলে বসেই কবর নাটকটি রচনা করেন । ওই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি, রাত ১০টায় জেলকক্ষগুলোর বাতি নিভিয়ে দেওয়ার পর হ্যারিকেনের আলো-আঁধারিতে মঞ্চস্থ হয় কবর।

প্রথম উপন্যাস: একুশের প্রথম উপন্যাস জহির রায়হান রচিত ‘আরেক ফাল্গুন’। শহীদ দিবস পালন, শহীদ মিনার নির্মাণ ভাষা আন্দোলনের এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটানো হয় এই উপন্যাসে। ৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনার মাত্র তিন মাস পর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে রচিত হয় এই উপন্যাসটি।

প্রথম সিনেমা: একুশের চেতনা নিয়ে প্রথম নির্মিত সিনেমা ‘জীবন থেকে নেয়া’। ১৯৭০ সালে জহির রায়হান সিনেমাটি পরিচালনা করেন। সিনেমাটি সে সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরবর্তিতে স্বাধীনতা আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রাখে সিনেমাটি।

১৯৫৩ সালে শহীদ দিবস উদযাপন করতে গিয়ে তখনকার প্রগতিশীল কর্মীরা কালো পতাকা উত্তোলন, নগ্নপায়ে প্রভাতফেরি ও সমবেত কণ্ঠে একুশের গান, শহীদদের কবর ও মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে। সেই থেকে এসব কর্মসূচি বাঙালির জাতীয় চেতনার নবজাগরণের প্রতীক হয়ে দাড়িয়েছে। এখন এসবই আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এছাড়া ১৯৫৪ সালে বাংলা একাডেমীর প্রতিষ্ঠা এবং তারপর থেকে একুশ উপলক্ষে বাংলা একাডেমী প্রতি বছর অমর একুশের যেসব অনুষ্ঠানমালা এবং বইমেলার আয়োজন করে তার। সবকটিই একুশের চেতনার ফল।

একুশের চেতনা দেশের সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিবিদদের সাহিত্য রচনা করার প্রেরণা যুগিয়েছে। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃত হওয়ার পর বাংলা ভাষার পঠন-পাঠন ও চর্চার প্রতি আগ্রহ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলে। সেই সাথে শিল্পী ও সাহিত্যিকগণ বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর উদ্ভব, নানা পত্র-পত্রিকার জন্ম, গল্প-কবিতা, প্রবন্ধ উপন্যাস-নাটকে স্বাধিকার অর্জনে দীপ্ত মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে। তাই প্রখ্যাত সাহিত্যিক মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সার, কবি মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী প্রমুখ ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে লেখনী ধারণ করায় আজ নতুন প্রজন্ম তা সঠিকভাবে জানতে পারছে। এজন্য জাতি তাদের চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।

বাংলার তেজোময় সাহিত্যিকবৃন্দ তাঁদের সৃজনশীল সাহিত্যকর্ম দিয়ে জাতির বিবেককে বারবার নাড়া দিয়েছেন। বর্তমান বাংলা সাহিত্যে ভাষা আন্দোলনের অতীত স্মৃতিকে অধিকতর উজ্জ্বল করে তুলেছেন কবি শামসুর রাহমান, শওকত ওসমান, ড. নীলিমা ইব্রাহীম, হুমায়ুন আজাদ, আল-মাহমুদ, জাহানারা আরজু, আব্দুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখ সাহিত্যিক। এদেশের সাহিত্যিকগণ একুশের চেতনাকে অন্তরে ধারণ করে বাংলা সাহিত্যের পরিধিকে বর্ধিত করেছেন।

১৯৫২ সালের সেই ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তায় জন্ম নিয়েছিল একুশের চেতনা। এই চেতনা আমাদের জাতীয় জীবনে আত্মত্যাগের বীজমন্ত্র। পরবর্তীকালে প্রতিটি গণআন্দোলনের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে ভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলনের ভেতর দিয়ে সেদিন পূর্ব বাংলার অধিকার-বঞ্চিত মানুষের প্রথম সংগঠিত সংগ্রামের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। পরবর্তীকালে প্রতিটি গণআন্দোলনের প্রেরণাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে ওই আন্দোলন।

ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সে সময়ে বাঙালির আত্মসচেতনতা ও আত্মপরিচয়ের যে উদ্বোধন ঘটেছিল তা-ই নানা আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে রূপ নিয়েছিল স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে। এরপর একুশের পথ ধরেই আমরা বারবার পেরিয়ে এসেছি সংকটের নানা আবর্ত। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ভাববীজ আমরা পেয়েছি মহান ভাষা আন্দোলন থেকে।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের খবর সারা দেশে বিদ্যুৎবেগে ছড়িয়ে পড়লে দেশবাসী প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। উপায়ান্তর না দেখে শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৬ সালে প্রণীত সংবিধানে শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে।

১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো বাংলাকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।

বাংলা সাহিত্যে একুশের চেতনা
শহীদ মিনারে মা ও কন্যা। চিত্র: আরিফুর রহমান, উৎস: cartoonistarif.com

বায়ান্নর একুশে ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ।বাঙালি নস্যাৎ করেছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সকল চক্রান্ত। কিন্তু বায়ান্নর পরেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিরুদ্ধে নয়াঔপনিবেশিক শাসক-শাষোকদের চক্রান্ত থেমে যায়নি। সে জঘন্য তৎপরতা উপলব্ধি করেই বেদনার্ত হৃদয়ে কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন-

“এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি,
এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষমাস !
তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,
বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।”

এসব অপপ্রচেষ্টার মধ্যে ছিল বাংলা ও উর্দু মিলে একটা ভাষা তৈরি করা, বাংলা বর্ণমালা তুলে রোমান হরফে বাংলা প্রবর্তনকরা, রবীন্দ্রনাথকে বর্জনের চক্রান্ত, রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধকরণ, নজরুল সাহিত্যকে খণ্ডিতকরণের চেষ্টা, বাংলা সাহিত্যকে জোরপূর্বক পাকিস্তানিকরণ প্রচেষ্টা ইত্যাদি। কিন্তু একুশের চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে সকল হীনচক্রান্তকে প্রতিহত করেছে বাংলার সাধারণ মানুষ ও প্রগতিশীল ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিকের বলিষ্ঠ প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর।

শুধু মাত্র উৎসবের মধ্যে একুশকে সীমাবদ্ধ রাখা মোটেই আমাদের কাম্য হতে পারে না। একুশ আমাদের যে শিক্ষা দিয়েছে তা আমাদের দীক্ষা হিসেবে নিতে হবে। একুশ হবে আমাদের কর্মচাঞ্চল্যের উদ্দীপনা। ২১-এর সত্যিকার ইতিহাস আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। বাংলাভাষার বিকাশ ঘটানোর জন্য আমাদের সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে। যে লক্ষ্যে আমাদের দেশের মেধাবী ছাত্ররা জীবন দিয়ে গেছে সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদেরই পদক্ষেপ নিতে হবে।

বাংলা সাহিত্য এবং বাংলাদেশের সাহিত্য বলে দুটি কথা আছে। মূলত বাংলাদেশের সাহিত্যের যাত্রা একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে। এই একুশে ফেব্রুয়ারির পর থেকেই বাংলা সাহিত্যে বাংলাদেশি মানুষের জীবন প্রণালী উন্মোচিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। মূলত, বাংলা সাহিত্যে একুশের চেতনা সুদূর প্রসারী।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
অনুসরণ করুন:
মাসুদুল জারিফ একজন কবি, লেখক ও সাংবাদিক। তিনি ২০০৭ সালে বাংলাদেশের জামালপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ উপজেলার উত্তর গাবেরগ্রামে। তিনি বর্তমানে দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষার্থী। হলি মিশন স্কুল এন্ড কলেজ থেকে তার হাতেখড়ি হয় এবং তিনি বর্তমানে মাদারগঞ্জ উপজেলার শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় খেতাবপ্রাপ্ত বালিজুড়ী ফাজেল মোহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছেন। তিনি ছোট থেকেই লেখালেখি, কবিতা আবৃত্তি এবং সহপাঠ কার্যক্রমে আগ্রহী। তিনি বর্তমানে একজন শিশু সাংবাদিক। তিনি বাংলাদেশ স্কাউটস এর একজন সদস্য এবং বালিজুড়ী ফাজেল মোহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয় স্কাউট গ্রুপের একজন উপদল নেতা। সাময়িকীতে তার লেখা প্রথম দুইটি কবিতা “খোকাকে নিয়ে স্বপ্ন সবার”, “ভার্চুয়াল জগতে শিশু-কিশোর”। তিনি তার জীবনে লেখালেখি এবং নিজের ভাবনা প্রকাশের মাধ্যমে বিশ্বকে চমকে দিতে চান।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!