বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব দম্পতির জেষ্ঠ্য পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামাল। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। ১৯৪৯ সালের ৫ই আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন এই স্বপ্নদ্বষ্টা। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম ক্রীড়া সংগঠক এবং আবাহনী ক্রীড়াচক্রের প্রতিষ্ঠাতা।
বাইগার নদীর তীর ঘেঁষে প্রকৃতির সবুজ সমারোহে অপরূপ একটি গ্রাম টুঙ্গীপাড়ায় কেটে যায় শেখ কামালের শৈশবের কয়েকটি বছর। ১৯৪৯ সালের ১৪ অক্টোবর; শেখ কামাল যখন দু’মাস দশ দিন বয়সের ছোট্ট শিশু, তখন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের জন্য পিতা শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হন। শেখ কামাল বাবাকে দেখেনি এবং চিনেও না। হঠাৎ একদিন বড় বোন শেখ হাসিনাকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, “হাসু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি?”
১৯৫৬ সালে ডন্স কিন্ডারগার্টেন স্কুলে কেজি-১ শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার মাধ্যমে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হাতেখড়ি। সেই স্কুলে অধ্যয়নের পর ১৯৬১ সালে বিএএফ শাহীন স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন। তিনি বিএএফ শাহীন স্কুলের তিতুমীর হাউজ-এর ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি এই স্কুল থেকে ১৯৬৭ সালে এসএসসি পাশ করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৬৯ সালে এইচএসসি পাশ করেন।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধেও তিনি অবদান রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধে জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানির এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বঙ্গবন্ধুর জেষ্ঠ্য পুত্র।
খেলাধুলায় তার আবদান ছিল অনেক। টুঙ্গীপাড়া থেকে ঢাকায় আসার পর শৈশবে সেগুনবাগিচা নর্থ-সাউথ রোড ও বিজয় নগরের মাঝের মাঠটিতে খেলাধুলা করতেন। তিনি ১৯৬৭-৬৮ এর দিকে মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়ায় একটি মাঠে খেলতেন। তিনি ধানমন্ডি মাঠেও খেলাধুলা করতেন। ঐখানে তখন শিশু ও তরুণদের জন্য কোন ক্লাব ছিল না। এক্ষেত্রে তিনিই প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রথমে তিনি আবাহনী সমাজ-কল্যাণ সংস্থা গড়ে তোলেন, পরে মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে ১৯৭২ সালে ‘আবাহানী ক্রীড়াচক্র’ প্রতিষ্ঠা করেন।
শেখ কামাল ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রীড়া সংগঠক। ১৯৭২ সালে তিনি জার্মানির মিউনিখে ‘সামার অলিম্পিক’ দেখতে যান। ১৯৭৩ সালে জার্মানির বার্লিনে অনুষ্ঠিত ১০ম বিশ্ব যুব সম্মেলনে যোগদানের জন্য তিনি বাংলাদেশ থেকে ৭৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে গিয়েছিলেন। ক্রীড়াঙ্গণের সর্বক্ষেত্রেই তার দল জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। আন্ত:বিশ্ববিদ্যালয় বস্কেটবল প্রতিযোগিতায় তার দল চ্যাম্পিয়ান হয়েছিল। তিনি খেলাধুলায় উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য স্বাধীন দেশে প্রথম বিদেশী কোচ ব্রিটিশ নাগরিক মি. বিল হার্টকে নিয়োগ করেন। তার গৃহীত নানা উদ্যোগের ফলে এই ক্লাবের খ্যাতি সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে তিনি আবাহনী ক্রীড়াচক্রের জেলাশাখা প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি খেলাধুলার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেন। খেলোয়াড়দের স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি তিনি তাদের জন্য অবসর ভাতা প্রদানেরও উদ্যোগ গ্রহণ করেন। খেলোয়াড়দের নিরাপত্তার জন্য তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট হতে ১০ লাখ টাকার অনুদান নিয়ে ‘খেলোয়াড় কল্যাণ তহবিল’ গঠন করেন।
বাংলাদেশের প্রথম পেশাদার ফুটবলার কাজী সালাউদ্দিন বলেছেন, “আবাহনীর সঙ্গে আমার যে চিরস্থায়ী বন্ধন এর মূল কারণ শেখ কামাল। আমরা ছিলাম স্কুল ফ্রেন্ড। স্বাধীন দেশের ক্রীড়াঙ্গনে ভাল কিছু করতে চাচ্ছিল শেখ কামাল। তার ছোঁয়ায় আবাহনী হয়ে উঠেছে আধুনিক ফুটবলের ধারক ও বাহক।”
১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট ঘাটকদের নির্মম গুলির আঘাতে সপরিবারে নিহত হন শেখ কামাল। কিন্তু তার ক্রীড়াপ্রেমী মানসিকতা চিরদিন থাকবে স্মরণীয়।