সংবদনশীলতা

অপূর্ব দাস
অপূর্ব দাস
7 মিনিটে পড়ুন

এনজিওতে সুধাংশু’র কর্মজীবন শুরু। মাঝে দু-একবার স্বল্প সময়ের বিরতিসহ একযুগ পুর্ণ করে ফেলেছেন ইতোমধ্যেই। এই এক যুগের যাত্রায় অধিকার, মানবাধিকার, জেন্ডার, পপুলার থিয়েটার, তথ্য অধিকার সহ নানা বিষয়ে অসংখ্য প্রশিক্ষণ, কর্মশালা, সভা, সেমিনারে তাকে যোগদান করতে হয়েছে। হয়েছে বললাম এই কারণে এনজিওগুলি’র কিছু বিষয় থাকে যেমন ওয়ার্কপ্ল্যান, ডেডলাইন ইত্যাদি, ইত্যাদি। এখন ওয়ার্ক প্ল্যানে আছে, এই ট্রেনিং টা মার্চ মাসে করতে হবে। না হলে সেইটা আবার, এপ্রিল টু-জুন কোয়ার্টারে শিফট করতে হবে, সে এক মহা হ্যাপার ব্যাপার। ডোনারকে জাস্টিফিকেশন দাও, এনজিও ব্যুরো কে অবহিত কর ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন, কোনো এনজিও এই হ্যাপা নিতে চায় যৌক্তিক কারণে, কোনো এনজিও নিতে চায় না। পরিকল্পনায় যেহেতু মার্চে আছে, যেকোনোভাবে মার্চেই করে ফেলো। এখন এই মার্চের টা মার্চেই করতে গিয়ে দেখায় যায়, যিনি পটেনশিয়াল পার্টিসিপেন্ট, তার পরিবর্তে অন্য কাউকে জোর করে পাঠানো হয় ট্রেনিং এ কিংবা কর্মশালায়। দেখা যায়, এই একই টেনিং তিনি এই তো মাস দুয়েক আগেই পেয়েছেন। সুধাংশু যেহেতু ব্যাচেলর তাই, ট্রেনিং মানেই অফিস থেকে পার্টিসিপেন্ট হিসাবে তাঁর নাম এক প্রকার বাধ্যতামূলক। আর প্রক্সি তো আছেই। কারণ মিনিমাম পঁচিশ জন পার্টিসিপেন্ট ছাড়া তো আর একটা ট্রেনিং হয় না। যাই হোক, এভাবে তিনি অনেক বার জেন্ডার রিলেশন এনালিসিস ট্রেনিং পেয়েছেন। তার একটা দুর্নামও আছে, সেশনের মাঝে নাকি তিনি ঘুমান। একবার অফিস থেকে শো’কজ করা হয়েছিল। তিনি, জবাবে লিখেছিলেন, ট্রেনিং-এ যা আলোচনা হয়, তা তো আর আমার এন্টেনা’র উপর দিয়ে যায় না যে, সেইটা ধরার জন্য একেবারে চোখ কান-খোলা রেখে টানটান হয়ে বসে থাকতে হবে। সুধাংশু’র সুপারভাইজার সেই লিখিত জবাব আর প্রতিষ্ঠান প্রধান পর্যন্ত যেতে দেন নাই, তাঁর ধারণা এই জবাব প্রতিষ্ঠান প্রধান বরাবর গেলে, সুধাংশুর চাকরিটায় থাকবে না। কিন্তু সুধাংশু কিন্তু উল্টোটায় মনে করেন। তার ধারণা এই জবাব প্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছে গেলে তিনি সুপারভাইজারের উপস্থিতিতে সুধাংশুকে ডেকে জিজ্ঞেস করতেন, তুমি এই কথা কেন লিখেছ? কিংবা হতে পারে সুধাংশু’র অনুপস্থিতিতে তার সুপারভাইজারকে ডেকে জিজ্ঞাসা করতেন, ও এই কথা কেন লিখল, সেটা তোমার কাছেই আমি জানতে চাই।

শো’কজ লেটার যেহেতু সুপারভাইজারের মাধ্যমে এসেছিল, তিনি সুধাংশু’র জবাবটা তার কাছে আটকে রেখে কিভাবে বিষয়টাকে সামাল দিয়েছেন, সেটা তিনিই জানেন। কিন্তু সেই ঘটনার পর থেকে একাধিকবার তিনি সুধাংশুকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, তার চাকরিটা তিনিই সেবাবারের মত বাঁচিয়েছেন। সুধাংশু মনে মনে হাসেন। জবাবটা জায়গা মত পৌঁছালে, আপনারও হ্যাপা ছিল। সামলে নিয়ে শুধু আমাকে নয়; নিজেকেও বাঁচিয়েছেন। কারণ এক্সটারনাল নলেজ অডিটের একটা মেজর ফাইন্ডিংস ছিল, প্রতিষ্ঠানের একই ব্যক্তি একই প্রশিক্ষণ একাধিকবার পেয়েছেন। আবার থিমেটিক এরিয়ার খুব সাধারণ বিষয়ে পুরানো একাধিক কর্মীকে জিজ্ঞেস করেও যখন জবাব পাওয়া যায় নাই। কারণ হিসাবে দেখা গেছে, সেই কর্মীরা আসলে সেই বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণ কিংবা রিডিং ম্যাটেরিয়াল পান নাই। তারপরও অফিসে প্রশিক্ষণে পার্টিসিপেন্ট সিলেকশনে তেমন কোনো পরিবর্তন আসে নাই।

এখন এই যে বারংবার প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশিবার সুধাংশুকে অংশগ্রহণ করতে হয়েছে জেন্ডার ট্রেনিং-এ। তাই প্রশিক্ষকের পরিবর্তন সাপেক্ষে দু-এক জায়গায় একটু হেরফের বাদে, কোনটার পর কোন কন্টেন্ট, কোন গেইম, কি গ্রুপ ওয়ার্ক, প্রশিক্ষক আসলে অংশগ্রণকারীদের কাছ থেকে কি বের করে আনতে চাচ্ছেন, সেগুলি সুধাংশু’র কাছে মোটামুটি পরিস্কার। প্রশিক্ষণে, অফিসে একটা শব্দ শুনতে শুনতে সুধাংশু ক্লান্ত। সেইটা হল জেন্ডার সংবেদনশীলতা। এই জেন্ডার সংবেদনশীলতার বিষয়ে সুধাংশু’র কোনো এলার্জি আছে বিষয়টা এমন নয়। প্রশিক্ষণে, অফিসে সে যেটা বারবার বলার চেষ্টা করেছে, সেটা হল সামগ্রিকভাবে সংবেদনশীল একজন মানুষ হয়ে উঠা ছাড়া আসলে জেন্ডার সংবেদনশীল মানুষ হওয়া কস্টসাধ্য। কিন্ত দু-জায়গাতেই তাকে শুনতে হয়, না অনেক পুরুষই আছেন, যারা মানুষ হিসাবে দারুণ সংবেদনশীল কিন্তু বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে তাদের সেই সংবেদনশীলতা নারীর ক্ষেত্রে দেখা যায় না। নারীর ক্ষেত্রে ভাবনায় এবং আচরণে তারা এখনো সেই সনাতন ধারণায় বিশ্বাসী। সুধাংশুও যে এই বক্তব্য অস্বীকার করে তা নয়; কিন্তু সুধাংশু’র দৃঢ় বিশ্বাস সামগ্রিকভাবে সংবেদনশীল মানুষ হওয়া ছাড়া শুধুমাত্র ভিন্ন লিঙ্গের প্রতি সংবেদনশীল হওয়া যায় না।

সুধাংশু বিয়ে করেছেন বছর দুয়েক হল। বিয়েটা ঠিক প্রেমেরও নয়, আবার পারিবারিক আয়োজনেরও নয়। দু’জন দ’জনকে চেনাজানার জায়গা থেকেই একসাথে চলবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। চেনাজানাটা ভালভাবেই হয়েছে বলা যায়। সুধাংশু খেতে পছন্দ করেন। বীফ এবং পোর্ক কোনোটাতেই তার কোনো সংস্কার নাই। কিন্তু তার পার্টনারের আছে। আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয়েছে এই দুটো আইটেমের কোনো একটা খেলে তারা মিনিমাম তিনদিন আলাদা বিছানায় ঘুমাবেন। পোর্ক তো কালে-ভদ্রে খাওয়া হয়। সমস্যা হল বীফ নিয়ে। সম্প্রতি সুধাংশু আগের এনজিও ছেড়ে অন্য একটা এনজিওতে জয়েন করেছেন। এখানে তুলনামুলকভাবে ফিল্ড কম। মাসে একবার গেলেও যাতায়াত মিলিয়ে তিন চার দিনের বেশি নয়। সুধাংশু সিদ্ধান্ত নেয় সে আর বীফ খাবে না। কারণ সে বীফ খেত মূলতঃ ফিল্ড এসে এবং কোথাও নিমন্ত্রণে গেলে। এতদিনে বউয়ের সাথে বোঝাপড়াটাও আরো পোক্ত হয়েছে। বউ একদিন বলেছে, আমি বলব না, তুমি বীফ কিংবা পোর্ক খেয়ো না। তবে তুমি না খেলে আমার ভাল লাগবে। সুধাংশু’র ও মনে হয় এইটা তো তার পার্টনারের চাওয়াটাকে সম্মান দেখানো। এই সিদ্ধান্তের কয়েকদিনের মধ্যেই সুধাংশু’র আগের সুপারভাইজারের বাসায় নিমন্ত্রণ। সুধাংশু তার বউসহ গেছেন সেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। এই নিমন্ত্রণ মূলতঃ একটা আড্ডা। তো আড্ডা শেষে ডিনার টেবিলে গিয়ে সুধাংশু দেখেন আয়োজন হল, খিচুড়ি এবং বীফ। সুধাংশু খুবই অপ্রস্তুত। তার বউ কিন্তু খিচুড়ি এবং সালাদ নিয়ে রীতিমত স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই খাওয়া শুরু করেছেন। কিন্ত সুধাংশু’র হাতে কেন জানি আর খাবার উঠতে চায় না। তার পুরানো সুপারভাইজার সেটা লক্ষ্য করে বললেন, কি ব্যপার তুমি খাবার নিচ্ছ না যে? সুধাংশু ভদ্রতা রক্ষার জন্যই প্লেটে এক চামচ খিচুড়ি উঠিয়ে নিয়ে সালাদ দিয়ে খাওয়া শুরু করেন। এইটা দেখে তিনি বলেন, তুমি বীফ নিচ্ছ না কেন? পুরানো সহকর্মীরা বলেন, যা টেস্ট হইছে বীফ টা। সুধাংশু বলেন, না আমার ফ্যাটি লিভার তো ডাক্তার নিষেধ করেছে বীফ খেতে। তারপর শুরু হয়…
ডাক্তার নিষেধ করেছে নাকি বউয়ের ভয়ে?
আমরা তো ভেবেছিলাম সুধাংশু যেমন কথার মারপ্যাঁচ জানে, অন্তত ওর বউ ওকে মোটিভেট করতে পারবে না। বরঙ বউ-ই মোটিভেটেড হবে।
জানি, জানি বিয়ের বিয়ের আগে অনেক ছেলেই অনেক কথা বলে, বিয়ের পর সবাই বউয়ের আঁচলে মুখ লুকায়।
এভাবে একের পর এক বাণী বর্ষণ চলতে থাকে। শুধাংশু’র বউ খাওয়া শেষ করে ফ্রেশ হয়ে সকলের বাণী বর্ষণ শোনে আর হাসে। টেবিলের রাখা বড় পাত্রভর্তি বীফ এবং সকলের প্লেটের খাবার শেষ। কেবল সুধাংশুর প্লেটের সেই এক চামচ খিচুড়ি আর শেষ হয় না।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
তিনি একজন মানবাধিকার কর্মী। জন্ম এবং বেড়ে ওঠা যশোর জেলায়। লেখাপড়া সম্পন্ন করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মানবাধিকার, নারীর মানবাধিকার, জেন্ডার এবং নারীর ভূমির অধিকার নিয়ে তিনি কাজ করেছেন একাধিক জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনে। এছাড়াও যুক্ত আছেন লেখালেখি এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথেও। কর্মসূত্রে বর্তমানে বসবাস করছেন ঢাকাতে!
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!