বাংলা কবিতার পাঠক ও লেখক

তৈমুর খান
তৈমুর খান
9 মিনিটে পড়ুন

আমরা অনেকটাই ক্ষতি করে দিচ্ছি কবিদের। যে কবিরা সুনাম পাওয়ার যোগ্য নয়, অযথা তাদেরও সুনাম করছি। যে কবিতাকে আদৌ কবিতা বলে মনে হয়নি, তাকেও ‘খুব ভালো কবিতা’ বলে মন্তব্য করছি। কবি উৎসাহিত হয়ে আবারও ওই ধারার কবিতা গুচ্ছ গুচ্ছ প্রসব করছেন। লাইক এবং কমেন্ট করে আমরা তার সংখ্যা বাড়িয়ে তুলছি।

আমরা যে ভালো করি না, বরং কবির অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে সে কথা একবারও ভেবে দেখি না। কিন্তু এইসব কাজ করাতে কি শুধুই আমাদের দোষ? আমরা কি নেগেটিভ কথাবার্তা বলতে পারি না? আমরা কি নিরপেক্ষ সমালোচনা করতে পারি না?
হয়তো পারি না। আমাদের প্রকৃত দায়বদ্ধতা হারিয়ে গেছে। প্রকৃত ভালোবাসাও আর নেই। অথবা বিপরীতক্রমে কবি ব্যক্তিটির প্রকৃত ভালোবাসা সহ্য করার ক্ষমতা নেই। তাই আমরা নিজেকে আড়াল করতে চেয়েছি। নিরপেক্ষতা বিসর্জন দিয়েছি।

21DA22BD 2FC8 49D1 BEDE A505F6182E9E বাংলা কবিতার পাঠক ও লেখক
বাংলা কবিতার পাঠক ও লেখক 42

একটা ছদ্ম মুখোশ রূপ ধারণ করে আমরা কবিতার পাঠক হয়েছি। অথবা পাঠকও হইনি। না পড়েই মন্তব্য করেছি। লাইক দিয়েছি। বাহবা দিতে কার্পণ্য করিনি। তাহলে আমাদের কী করা উচিত ছিল?

অবশ্যই শাসন করা উচিত ছিল। ‘শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে’। কিন্তু সেই সোহাগ করাটুকু দিতে পারছি না। যাকে দেবো, অচিরেই সে ভুল বোঝে। অচিরেই সে শত্রু ভেবে বসে। কখনো কণ্ঠ দৃঢ় করে বলে: “আমাদের কবিতাতো পড়বেন না! লাইক কমেন্টও করবেন না। আমরা কত লাইক কমেন্ট করি আপনার কবিতায়। তার প্রতিদান কি পাই?”

এই প্রতিদান দিতে হয়। মাঝে মাঝে প্রতিদান না দিলে মুখ দেখাদেখিও বন্ধ করে দেয়। সম্পর্ক রাখতে চায় না। ভুল বোঝার পরিমাণ এতই বৃদ্ধি পায় যে, সেরকম দাঁড়িপাল্লা পাই না পরিমাপ করবার। “আমরাতো নতুন কবি, আপনারা উৎসাহ না দিলে আর কারা দেবে?” ইতিমধ্যেই এরা নিজেদের ‘নতুন কবি’ ভেবে নিতে পেরেছে, যা আমরা এখনও ভাবতে পারি না। এতো কবিতা লিখেও সর্বদা একটি কথাই মনে হয়: আজ পর্যন্ত ভালো লেখা একটাও লিখতে পারিনি। সারাজীবনে পারবো কিনা সন্দেহ। যে লেখা লিখেছি তা কোনোটাই কালোত্তীর্ণ নয়।

শুধুমাত্র মনের জ্বালা মিটিয়েছি আর নিজের আশ্রয় সন্ধান করেছি। তা আদৌ সাহিত্য হয়েছে কিনা নিশ্চয় করে কিছু বলতে পারি না। তবে কিছু কিছু লেখা দেখে নিশ্চিত করে বলতে পারি তা একেবারেই সাহিত্য হয়নি। ব্যক্তিগত পর্যায়ের ভালোলাগার উপলব্ধি সেইগুলিতে কখনোই জাগ্রত হয়নি। নিতান্ত বালখিল্য এবং শিশুর দেয়ালা মনে হয়েছে।

BB92DD3D A71E 4B3B 82BA B62BDD11FF8E বাংলা কবিতার পাঠক ও লেখক
বাংলা কবিতার পাঠক ও লেখক 43

দীর্ঘকাল কবিতার পথে হেঁটে কবিতার নতুনত্ব অনুধাবন করার একটা প্রয়াস সর্বদা সক্রিয়। তা চুম্বকের মতো হৃদয়কে আকর্ষণ করে। এক একটা শব্দও যে অভিঘাত সৃষ্টি করে তাতে ভেতর ভেতর আন্দোলিত হই। ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না সেই ভালো লাগার ক্ষণটিকে। তবে অপার্থিব অধরা এক বিস্ময়ের কাছে পথ হাতড়াতে থাকি। তখনই বলে দিতে পারি এটি ‘ভালো কবিতা’। কিন্তু সে কবিতার দেখা খুব কম পাই।

বহু কবি এখনো বাংলা বাক্য গঠনই করতে পারেন না। কবিতায় শব্দের গুরুত্বও অনুধাবন করতে পারেন না। ছন্দের নির্মাণ এবং ভাঙার ব্যাপারটিও তাদের আয়ত্তে নেই। এলেবেলে কিছু বাক্য গঠন এবং নজরুল-রবীন্দ্রনাথের মতো কবিতার কৌশলে ঘুরপাক খান। কৃত্তিবাসী-কাশীদাসী পয়ার-ত্রিপদীর অনুকরণ করেও লিখতে থাকেন। কারো কারো কবিতায় দেখি জীবনানন্দ দাশের কাছাকাছি পৌঁছানোর জোর অভ্যাস তৈরির প্রচেষ্টা।

সেক্ষেত্রে এমন উপমা তৈরি হয় যা উদ্ভট বা বীভৎস রসের জন্ম দেয়। কারো কারো কবিতায় শুধুই বক্তব্য আর বিবৃতির ছড়াছড়ি। কোনো বিষয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা। কোনো কাজের দীর্ঘ বিবৃতির ফিরিস্তি। কারো কারো কবিতায় নীতি-নৈতিকতার আদর্শ প্রয়োগ। জ্ঞানী পয়গম্বরের বক্তব্যের মতো মনে হয়। কবিতার মূল বা মৌলিক বিষয় বা নির্মাণশৈলী যে এসবের মধ্যে থাকে না, তা বলাই বাহুল্য। ফলে গতানুগতিক কবিতা চর্চার ধারায় প্রকৃত কবিও হারিয়ে যান। কবিতায় যেমন মেধার দরকার, তেমনি মেধাকেও হৃদয়ে সঞ্চার করার মতো উপলব্ধিও দরকার। তাই কবিতায় আসে শূন্যতা। স্তব্ধতা। নির্বাক স্পেস।

কেননা, প্রকৃত কবিতা আড়াল চায় – কবিতার নৈঃশব্দ্যে লুকিয়ে থাকে অপার রহস্য আর এই রহস্যই কবিতার সৌন্দর্য; তাই হয়তো মালার্মে বলেছেন: “Mystery and obscurity are the protection of poetry from the idle curiosity of the masses”. তাহলে দেখা যাচ্ছে দুর্বোধ্যতা ও রহস্যই কবিতার ঢাল।

সাধারণ মানুষ কবিতা বুঝতে চায় কবিতার অর্থ জানতে চায়; কিন্তু কবিতা কি সত্যি কোনো অর্থ করে কিংবা কবিতা কি বোঝার ব্যাপার – এসব নিয়ে অনেককাল আগে থেকেই শুদ্ধ শিল্পবাদী এবং জীবনবাদী কিংবা মার্কসবাদী নন্দনতাত্ত্বিকদের মধ্যে চলে আসছে বিতর্ক – আসলে শিল্প শিল্পের জন্যে না জীবনের জন্যে, এসব নিয়ে অনেকেই অনেকভাবে বলেছেন; আজকে সে-বিষয়ে আলোচনায় না গিয়ে শুধু এটুকুই বলা যায় যে, কবিতা কিংবা শিল্প জীবনের অসীমতায় দাঁড়িয়েই হয়ে ওঠে অপার রহস্য কিংবা সৌন্দর্যের আধার।

আমি বিশ্বাস করি কবিতায় সৌন্দর্য সৃষ্টির মধ্যেই বিষয় বা জীবনের খোঁজ পাওয়া সম্ভব এবং যে কবি শুধু সৌন্দর্য সৃষ্টির লক্ষ্যে লিখছেন, তিনিও নিরন্তর জীবনচর্চা করেই চলেছেন – এই বোধটা আমাদের তথাকথিত কাব্যসমালোচকদের মধ্যে জাগ্রত হওয়া দরকার এবং আমি মনে করি এটা মার্কর্সীয় চিন্তারই অনুগামী। প্রত্যেক চিন্তার পিছনে যেমন রয়েছে বস্তু, তেমনি প্রত্যেক সৌন্দর্য প্রেরণার উৎসও ওই বস্তু। এখানে কল্পনা বিষয়টিকে গৌণভাবে দেখার কোনো অবকাশই নেই, কারণ কল্পনাও বস্তুকেন্দ্রিক; কল্পনার অবস্থান সত্যের সারাৎসারে।

9C651D11 313C 4FFD 8F27 D98922FB55A5 বাংলা কবিতার পাঠক ও লেখক
বাংলা কবিতার পাঠক ও লেখক 44

কবিতা শব্দশিল্প; কবিতা গড়ে ওঠে শব্দের জাদুমন্ত্রে । মালার্মে তাই বলেছেন: “আমরা ভাবনা দিয়ে কবিতা লিখি না, শব্দ দিয়ে লিখি।” সুতরাং কবিতা বোঝার আগে শব্দ প্রয়োগের ঐন্দ্রজালিকতা তথা শব্দের এই চলনের নানাভঙ্গি ও রহস্যটাই সর্বাগ্রে অনুধাবন করা দরকার এবং সেইসাথে দরকার চৈতন্যের সর্বপ্লাবী জাগরণ। পরিবর্তিত বাস্তবতা এবং জীবনের মূল্যবোধ পাল্টানোর সাথে সাথে যেমন জীবনদর্শন ও মূল্যবোধের নতুন ধারণা সংযোজিত হয়, তেমনি শিল্পের আধার ও আধেয়ও পরিবর্তিত হয়। সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক বিন্যাস এবং সংযোজন-উপযোজনের অভিযাত্রায় শব্দের প্রায়োগিক রূপ বদলে যায়, বদলে যায় তার প্রতীকী ব্যঞ্জনাও।

নিরন্তর ভাঙন, রূপ পাল্টানোর মধ্য দিয়ে ক্রমাগত এক জটিল রহস্যের দিকে এই যে শিল্পযাত্রা, তা কিন্তু মনোসমীক্ষণেরই জটিল উৎসারণের অনিবার্য আস্বাদ। একটি কবিতার অংশে মালার্মে তাই লিখেছেন:
“Magical shadow with symbolic powers!
A voice from the distant past, an evocation,
Is it not mine prepared for incantation?”

অর্থাৎ
প্রতীকী শক্তির সাথে জাদুকরী ছায়া!
সুদূর অতীত থেকে একটি কণ্ঠস্বর, একটি উদ্দীপনা,
এটা কি আমার মন্ত্রের জন্য প্রস্তুত নয়?
সুতরাং কবিতা শুধু হাওয়ার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে না। জীবনের গভীর থেকে তার অন্বয় বা সম্মোহন উঠে আসে। একজন প্রকৃত বোধসম্পন্ন কবি তা অনুধাবন করতে পারেন।

তবুও আমরা অকবিতায় বাহবা দিতে থাকি, অকবিকেও সাবাস জানাই। কবিকে তার সঠিক উচ্চতায় পৌঁছানোর অপেক্ষা করি না। আসলে এতজন কবিকে প্রতিটি কবিতায় আলাদা আলাদাভাবে পাঠ করে সদা সত্য বার্তাটি দেওয়া সম্ভব নয়। কবির রাগ দুঃখ হতাশা যন্ত্রণা সাময়িকভাবে লাঘব করার জন্যই হয়তো এভাবেই দায় সামলাতে হয়। সমালোচনা সহ্য করার মতো তাদের মধ্যে সহনশীলতার অভাবও রয়েছে।

কোনো কবিকে একবার সমালোচনা করলে বারবার তিনি তার কবিতা সম্পর্কে মতামত জানতে চান। এভাবে কবিদের সংখ্যাও দীর্ঘ হতে থাকে। ফলে যিনি মতামত দেন তার পক্ষে এই রোগ সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। আরেক শ্রেণির পাঠক আছেন, যাদের কবিতা সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই, তারা যে কোনো কবিতার সুনাম করে বসেন। এই শ্রেণির পাঠকদের মধ্যে আমজনতার সঙ্গে অধ্যাপক-শিক্ষকেরও অভাব নেই।

9C38A9A0 EAFC 46DB 9256 EAEAB384500B বাংলা কবিতার পাঠক ও লেখক
বাংলা কবিতার পাঠক ও লেখক 45

কবিদের যখন নিজের উপরেই ভরসা হারিয়ে যায়, তখন তারা কাব্য রচনা করতে গিয়ে প্রথমেই কোনো অধ্যাপক বা শিক্ষকের কাছে বা তথাকথিত কোনো কবির কাছে কাব্যের ভূমিকা লিখে নেন। মনে করেন জাদরেল একটা সাপোর্ট পাওয়া গেল। যিনি ভূমিকা লিখছেন তিনি কবিতা কতটা বোঝেন, বা কবিতার নতুন ফরম বা বাঁক্ সম্পর্কে তিনি অবহিত কিনা সেই সম্পর্কেই আমার সন্দেহ হয়। কবির কবিতা নিজ গুণেই তার পরিচয় দিতে সক্ষম। কোথাও সাপোর্টের দরকার হয় না। তেমনি প্রকৃত কবিও লাইক বা কমেন্টের কাঙাল হতে পারেন না। তিনি তোয়াক্কাই করেন না কেউ তার কবিতা পড়ল বা না পড়ল। কিন্তু একজন প্রকৃত পাঠক ভালো লাগা কবিতা সম্পর্কে মন্তব্য না করে পারেন না। মন্তব্য না করাটাও তার কাছে অপরাধ হয়ে দাঁড়ায়।

সুতরাং মন্তব্য করার ক্ষেত্রে আমরা সচেতনভাবে যেমন পাপ করি, তেমনি পুণ্যও করি। ক্লিশে কবিতা, উদ্ভট বা বীভৎস কবিতা, বক্তব্য বা বিবৃতির কবিতা থেকে আসুন আমরা কবিতাকে বাঁচাই। কবিতার নতুন দিগন্ত সন্ধান করি।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
তৈমুর খান জন্ম ২৮ জানুয়ারি ১৯৬৭, বীরভূম জেলার রামপুরহাট ব্লকের পানিসাইল গ্রামে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে মাস্টার ডিগ্রি এবং প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতা নিয়ে পি এইচ ডি প্রাপ্তি। পেশায় উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহ শিক্ষক। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: কোথায় পা রাখি (১৯৯৪), বৃষ্টিতরু (১৯৯৯), খা শূন্য আমাকে খা (২০০৩), আয়নার ভেতর তু যন্ত্রণা (২০০৪), বিষাদের লেখা কবিতা (২০০৪), একটা সাপ আর কুয়াশার সংলাপ (২০০৭), জ্বরের তাঁবুর নীচে বসন্তের ডাকঘর (২০০৮), প্রত্নচরিত (২০১১), নির্বাচিত কবিতা (২০১৬), জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা (২০১৭) ইত্যাদি। কবিরুল ইসলাম স্মৃতি পুরস্কার ও দৌড় সাহিত্য সম্মান, নতুন গতি সাহিত্য পুরস্কার, আলোক সরকার স্মারক পুরস্কার সহ অনেক পুরুস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!