শপথ

তপন তরফদার
তপন তরফদার
6 মিনিটে পড়ুন

ডেপুটি ম‍্যাজিস্ট্রেট হওয়ার সুবাদে আমি আমন্ত্রিত হয়েছি জলপাইগুড়ির বাবুঘাট উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের হীরক জয়ন্তী বর্ষের উৎসবের উদ্বোধক। এই স্কুলে আমি প্রাইমারি শিক্ষা পেয়েছি। এখন যেখানে কমলদার চায়ের দোকান তার পাশেই মামার বাড়িতে থেকে। মঞ্চের পাশের সাজঘরে বসে আছি। খোলা আকাশের নিচে বিরাট সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। সামিয়ানা আকাশকে ঢাকতে পারিনি। আকাশ তার দূরত্ব বজায় রেখে সেই আকাশেই আছে। আকাশ এখন ঘোলাটে। শীতের কুয়াশা সরে যাচ্ছে অল্প অল্প করে রোদ বাড়ছে। প‍্যান্ডেল থেকেই মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন আমাদের স্কুলের হীরক জয়ন্তী অনুষ্ঠান এখনই শুরু হচ্ছে আমাদের প্রধান অতিথি মাননীয় সুশোভন পোদ্দার মশাই এসে গেছেন। কিছুক্ষণের মধ‍্যেই স্কুলের হীরক জয়ন্তী উৎসব শুরু হবে। ওরা জানে না আমার লেখাপড়ার কয়েক বছর কেটেছিল এই স্কুলে।

এখন স্কুলের খোলনলচে পাল্টে গেছে। তখন খড়ের ছাউনি দেয়া লম্বা একটা ঘর ছিল। কাঠের দেয়াল তুলে প্রথম শ্রেণী থেকে চতুর্থ শ্রেণীর বিভাজন ছিল। তিন জন শিক্ষক। একজন শিক্ষিকা। দিদিমনির সিঁথিতে সিঁদুর নেই। পরিণত বয়সে মাথায় সিঁদুর নেই বলে আমরা মনে করতাম উনার স্বামী নেই তাই ছেলেপুলে নেই। উনি থাকতেন স্কুলের কাছেই কমলদার চায়ের দোকানের পিছনে। দিদিমণির নাম ছিল ইভা বিশ্বাস। অনেক পরে জানতে পারি উনি খ্রিষ্টান। স্কুলের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সময়ের বিচারে এই পরিবর্তন স্বাভাবিক। স্কুল এখন পাকা বাড়িতে। স্কুলে শৌচাগার হয়েছে। পর্যাপ্ত জলের ব‍্যবস্থা করা হয়েছে। হাতে টেপা টিউকলটা নেই। নল দিয়ে সজল ধারার পানীয় জলে চৌবাচ্চা ভর্তি করা হয়। তখনকার সময়ে খনন করা বারোয়ারি ইন্দিরাটা এখনো আছে। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের মিড ডে মিলের ব‍্যবস্থা করতেই রান্নাঘর হয়েছে।

একটা গাছের পাতা বল্লমের মতো উড়তে উড়তে আমার মাথায় আস্তে করে ঠোকর মারলো। মেহগনি গাছের পাতা। সেই মেহগনি বিশাল বড় হয়েছে। লম্বা ও হয়েছে। গাছের পাতাটা বললো আমাকে কি ভুলে গেলে? পাতা ঝরে যায় আবার নতুন হয়ে ফিরে পায় গাছ তার পাতাকে। এ পাতারা গাছের বা জীবনের দিনলিপি মুছতে দেয় না। শীত শীত বিকেল আসতো কালজানি নদীর পাড়ে ভবঘুরে হয়ে ঘুরতাম। সোনালি বিকেল ক্রমশঃ অন্ধকাছর থেকে ঘন অন্ধকারে ডুবে যেত। এদিক ওদিক জোনাকির আলো। দূরের কোনো আঙিনায় টিপ টিপ করে জ্বলছে সন্ধ্যা প্রদীপ। অন্ধকারেই খেলার সাথীদের হাত ধরে পাশাপাশি হেঁটে বাড়ি ফেরা। প্রতিটি শীতের বেলা যেন অলস বেলা হয়ে কিভাবে যে টুপটাপ ঝরে যায়,কিছুই মনেই থাকেনা। শারীরিক অনুভূতিতে বারে বারে শীত অনুভব করি। মনে কোনো শীত নেই, রক্ত টগবগে।

সেই দিনের ছবিগুলো আজও এই আকাশের সঙ্গে হুবহু মিল।আকাশের পরিবর্তন নেই। এই গাছের তলায় আমরা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নামতা বলতাম চারদুকনে আট, পাঁচ দুকনে দশ, ছয় দুকনে বারো। এই খোলামেলা মাঠ, কালজানি নদীর ধারের আম গাছ জাম গাছ থেকে ফল পেড়ে খাওয়া। বাবুঘাটের বট গাছের ঝুড়ো ধরে ঝুলে দোলনার মতো দোল খাওয়া।থরে থরে সাজানো ইটের সারিতে কত লুকোচুরি খেলা। সব জলছবি হয়ে মনে পড়ে যাচ্ছে। স্কুল ছুটির পর আমরা ডানপিটের দল দাপিয়ে বেড়াতাম এই বনবাদাড়ে। তখনকার দিনে এখনকার দিনের মতো মা-বাবারা বাচ্চাদের পায়ে শিকল পরিয়ে রাখত না। স্কুলে প্রতিদিন কি পড়াশুনা হচ্ছে তার খোঁজ খবর রাখার প্রয়োজন মনে করতো না।

ওই দাপিয়ে বেড়ানোর ফলে লেখাপড়া শিকেয় উঠতো। ক্রমশঃ আমরা পিছিয়ে পড়তে লাগলাম। চতুর্থ শ্রেণীর হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষায় আমরা তিনজনে ফেল করলাম। দিদিমণির ভ্রকুটিমাখা চোখ আমাদের উপরে। সে দিনটা ছিল বড়দিন। আমরা তিন জন সকাল বেলাতেই ড‍্যাংগুলি খেলছিলাম চায়ের দোকানের পাশর ফাঁকা মাঠে। ইভা দিদিমণি আমাদেরকে গম্ভীর গলায় বললেন, আজ বিকেলে আমার ঘরে আসবি, তোদের সঙ্গে কথা বলবো। খেলার আনন্দ মাটি হয়ে গেল। ঘামতে শুরু করলাম। খুব ভয় পেয়ে গেলাম। দিদিমণি হয়তো বাড়িতে নিয়ে আমাদের শাস্তি দেবেন। উনি স্কুলে কোনোদিন কাউকেই শাস্তি দেননি। অন‍্যান‍্য শিক্ষকরা শাস্তি দেন। ওই বেতের বারি, কানমলা, গাঁট্টা আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। আমাদের আর ভয় লাগেনা। ইভা দিদিমণি কি শাস্তি দেবে কে জানে। কি হবে কে জানে।

রবিবার সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে, আকাশে ফিকে হলুদ রং। আমরা দিদিমণি ঘরের আঙিনায় গিয়ে দেখি চার ধারে যত্ন করে মরশুমি ফুলের গাছে ফুল ফুটে আছে। মাধবীলতা গাছ লতিয়ে লতিয়ে ঘরের কার্নিশকে ঢেকে দিয়েছে মাধবীলতার স্পর্শে রূপবতী মাথা মায়া বারান্দা। কাঠের দরজা খুলে বললেন, আয় ভেতরে আয় বস। সাদা ধবধবে চাদরে রঙিন সুতোর কাজ করা টানটান করে পাতা আছে। আমাদের বলল বস। ওই সাদা জায়গায় বসে ওটা কালো হয়ে যাবে, শাস্তির বহর আরো বেড়ে যাবে। আমরা শান্ত ছেলের মত দাঁড়িয়ে মাদার মেরীর ছবিটা দেখতে লাগলাম।

উনি আসলেন, হাতে কাঠের ট্রেতে চিনামাটির প্লেট ও শ্বেত পাথরের গ্লাস। প্লেটে সুন্দর কেক। আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন চটপট খেয়ে নে। আমরা আরো অবাক। ফেল করেছি কোথায় শাস্তি দেবেন তার বদলে একি হচ্ছে বুঝতে পারছি না। কেক নিয়ে কি করবো ভাবছি। উনি ধমক দিয়ে বললেন তাড়াতাড়ি খা তোদের জন‍্য আমি নিজে হাতে ফ্রুটকেক বানিয়েছি। খুব মিষ্টি কেক। খাওয়ানোর পর গ্লাস এগিয়ে দেওয়ার আগে বলেন তোদের আমি শপথ করাবো। খাওয়ার আগে প্রতিজ্ঞা করবি, বল এখন থেকে আমরা ভালো করে পড়াশোনা করে প্রথম বিভাগে পাশ করবো। তা না হলে আর এই জল খাব না। জীবনের অন‍্য নাম জল। প্রতিজ্ঞা কর ভাল ফল না করলে জল ও খাব না। আমাদের চোখে জল দিদিমনির পায়ে হাত দিয়ে বললাম আমরা পড়াশুনা করবো। আমরা তিনজনেই সুপ্রতিষ্ঠিত। সেই দিনের সেই শপথ আজও আমাদের নতুনভাবে বাঁচার পথ দেখায়।#

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

বিষয়:
এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!