হুমকির মুখে হাওড়-জীববৈচিত্র‍্য: কবিতার শাদাবক বন্দী হচ্ছে শিকারির টোপে

মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী
মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী
4 মিনিটে পড়ুন

শাদাবক- চেনানো হয়েছিল; কৈশোরের দুরন্তপনায়, শরতের বিকেলে ময়ূরের পেখম মেলা বক- হেলেদুলে শাদাপালক উড়ায়- হাওড়ের জোছনা-জলে। আকাশে উড়তে দেখেছি কতো মেঘের ডানায়, জীবনানন্দের কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে। খেতের আইলে হাঁটতে দেখেছি, উঁচিয়ে, দিগন্ত ছোঁয়া রাঙা-ঠোঁট। পাখিখেকোদের রাহুগ্রাসে নিঃশেষ হবার আগে- কবিতার জলচর-পাখি নিয়ে কথা হোক এইবার সবখানে..

কবিতার নান্দনিক শাদাবক, আজ বিপন্নের পথে। প্রতিদিন অব্যাহত নির্মম-হত্যাযজ্ঞে কেবল বক-ই নয় হাওড়-বাঁওড়ের জলজ পাখপাখালি অনেকাংশে কমে যাচ্ছে। হুমকির মুখে পড়েছে- প্রাণী ও পরিবেশ এবং খোদ হাওড়-জীববৈচিত্র। জলবায়ূ পরিবর্তন, পাখি-শিকারিদের লোলুপ থাবা, ফসলি জমিতে কীটনাশকের প্রয়োগ, হাওড়, নদী, বিল-ঝিল ভরাট এবং বৃক্ষ নিধন প্রভৃতি কারণে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে বিরল প্রজাতির শাদাবক। শীত, বসন্ত কিংবা শরতের সকাল, দুপুর, সূর্যধ্বসা রক্তাভ-জলে পাখিদের আগের মতো দেখতে পাওয়া যায় না। নিরাপত্তহীনতা এবং পরিচর্চার অভাবে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে হাওড়ের জলপাখিরা। হিজল করচ কিংবা সবুজ অরণ্যে কোথাও তেমন দেখা মিলে না ‘পাখি বাড়ি’। যেন উজাড়ে বিলীন আমাদের জীববৈচিত্র।

সাম্প্রতিক সময়ে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার বিভিন্ন হাওড়, বিল-ঝিলে পাখিখেকোদের দৌরাত্ম্য ক্রমইে বেড়ে চলেছে। ওতপেতে টোপ ফেলে পাখি শিকার করা যেনো শখের খোরাক হয়েছে শৃঙ্খলহীন কিছু মানুষের! প্রতিনিয়ত পাখি নিধন করা হলেও দেখার কেউ নেই! এখানকার দেখার হাওড়, নাইন্দার হাওড়, কাঙলার হাওড়সহ ছোটো-বড়ো হাওড়-বিলে শিকারির বিষ-টোপে আটকা পড়ছে পাখি! নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক পাখি শিকারি বলেছেন, তারা শখের বশে হাওড়ে বড়শি, বিষটোপ দিয়ে পাখি শিকার করছেন। মাছ-খেকো শাদাবকসহ অন্যান্য জলচর পাখি রয়েছে হাওড়পাড়ের শিকারিদের পছন্দের তালিকায়। সপ্তাহে দুই-চার দিন পাখির গোস্ত খেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তারা।

IMG20220929120919 হুমকির মুখে হাওড়-জীববৈচিত্র‍্য: কবিতার শাদাবক বন্দী হচ্ছে শিকারির টোপে
হুমকির মুখে হাওড়-জীববৈচিত্র‍্য: কবিতার শাদাবক বন্দী হচ্ছে শিকারির টোপে 39

কেই-বা রাখে পাখপাখালি কিংবা জীববৈচিত্র ধ্বংসযজ্ঞের সেসব খবর! দুই বছর আগেও আমাদের দোয়ারাবাজার উপজেলা সদরের কামারপট্রি এলাকায় পাখিদের অভয়াশ্রম ছিল। প্রশাসনের নাকের ডগায় পাখি খুনিদের নীরব অত্যচার-উৎপীড়নে এখন আর নেই পাখিরা। মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় শোনা যায় না পাখিদের মন মাতানো কলরব, দেখা মিলে না ডালে ডালে পাখির বাসা, ছানা পাখিদের ঠোঁটে মা-পাখিদের ঠোঁট ভেজানো চিরায়ত দৃশ্য। কালিউড়ী নদীর তীরঘেঁষা থানা ভবনের পুকুরপাড়ে এখন অল্প-সংখ্যক কালো-পানকৌড়ি বসবাস করছে। এখানেও হাঁফিয়ে লাফিয়ে বেঁচে আছে এরা। সুরক্ষা সঙ্কট, অপর্যাপ্ত গাছপালা এবং ডাল না থাকার কারণে বসবাস অযোগ্য পড়েছে। গাছের ডাল না থাকায় এবং সেদিকে কারোর দৃষ্টি-নজর না পড়ার কারণে প্রতিনিয়ত পাখির ছানা মাটিতে পড়ে গিয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। অথবা কুকুর, শিয়াল বিড়ালের খাবার হচ্ছে সদ্যফোটা পাখির ফুল।

- বিজ্ঞাপন -

স্থানীয়রা বলেছেন, প্রতিদিনই নির্বিচারে বকসহ হাওড়-পাখি নিধন করা হচ্ছে। পাখি ধরার জন্য শিকারিরা সবুজ ঘাস, প্যারাবন, জলাশয়, ধানখেতের বিভিন্ন স্থানে ফাঁদ পেতে রাখে। কখনও কখনও পোষা ডাহুক কিংবা বকের মাধ্যমেও স্বজাত পাখি আটক করা হয়। মাঝে মধ্যে হাট-বাজারে বিক্রি করতেও দেখা যায়।

দোয়ারাবাজার থানার ওসি দেবদুলাল বলেন, ‘আমাদের থানার পুকুর পাড়ে বেশ কিছু পানকৌড়ি বাস করে। কিন্তু তাদের বর্জ্য বিষাক্ত হওয়ায় গাছের পাতা সহসা ঝরে যায়। অধিকন্তু বিষাক্ত বর্জের কারণে পুকুরের পানি নষ্ট হয়ে পড়েছে। পুকুরটি ভররাট করে এখানে গাছ রোপন করতে পারলে পাখিরা এখানে নিররাপদে বসবাস করতে পারবে।’

হাওড়ে-জীববৈচিত্র রক্ষা নিয়ে কথা হয় উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) এবং নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট ফায়সাল আহমেদ এঁর সঙ্গেও। তিনি বলেছেন‘ হাওড়ের পাখি ও পরিবেশ রক্ষায় আমাদের দৃষ্টি-নজর আছে। গত বছর উপজেলার বিভিন্ন হাওড়পাড়ে অভিযান চালিয়ে শিকারিদের কাছ থেকে পাখি উদ্ধার করে অভমুক্ত করা হয়েছে। পাখি নিধনের সঙ্গে জড়িত কাউকে পেলে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

প্রসঙ্গত দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্ভাহী অফিসার ফারজানা প্রিয়াংকা বলেন, ‘পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পাখি নিধন প্রতিরোধে সকলকেই সচেতন হতে হবে। পাখি নিধন করছে এমন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সু-নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

আমরা জানি, বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন ১৯৭৪ এর ২৬ ধারা মতে- দুই বছরের কারাদন্ডের বিধান আছে। আইন তোয়ক্কা না করে এবং জনসচেতনতার অভাবে হাওড়জুড়ে অবাধে চলছে পাখি শিকার। প্রয়োজন আইনের যথাযথ প্রয়োগে প্রশাসন এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি। আমাদের প্রাকৃতিক ভারসাম্য এবং সৌন্দর্য্য রক্ষায় আমাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। নয় তো কবিতার বক একদিন হারিয়ে যাবে সুন্দর বাংলাদেশ থেকে।

- বিজ্ঞাপন -

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
দোয়ারাবাজার সুনামগঞ্জে বসবাস। সম্পাদক: শিল্প ও সাহিত্যের ছোটোকাগজ 'বাঁশতলা'। প্রকাশিত গ্রন্থ ৫ টি। লেখালেখি ঘিরেই কবির যাপনকাল।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

একটি অ্যাকাউন্ট নেই? নিবন্ধন করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!