ঔষধি গুল্ম দুধিয়া

জায়েদ ফরিদ
জায়েদ ফরিদ
6 মিনিটে পড়ুন

দুধিয়ার সাথে আমাদের অনেকেরই পরিচয় ঘটেছে খেলাঘরে। রান্নাবাটি খেলার পাশাপাশি এই খেলাটি ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। খেলাঘরে এর পরিচিতি ‘নাম-লেখা’ হলেও মিলন দিদি এই খেলার নাম দিয়েছিল ‘চিত্রলেখা’ কারণ খেলাতে শুধু নাম লেখা হতো না, ছবিও আঁকা হতো । দুধিয়ার পাতা বা কাণ্ড ছেঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসতো সাদা রঙের কষ। এই কষ দিয়ে হাতের উপর লেখা হতো নামের আদ্যক্ষর, কখনো আঁকা হত খরগোশ, পাখি ইত্যাদির রেখচিত্র। কষের উপর ছড়িয়ে দেয়া হতো কয়লার মিহি গুঁড়ো, একটু ঘষলেই চকচকে কালো রঙের লেখা বা ছবি ফুটে উঠত যা সহজে মোছা যেত না। নাম লিখে সবাই খুব খুশি হতো কিন্তু ছোট্ট ‘অমা’র মুখটা মলিন হয়ে যেত। তার হাতটা ছিল অমানিশার মতই কালো। খুব মন খারাপ লাগত, ছোটো হলেও এই হাশিখুশি মেয়েটি ছিল খেলাঘরের পাকা রাঁধুনী আর অনন্য শিশু-কবিরাজ। হাত কেটে গেলে অমা-র কাছে দৌড়ে যেতাম আমরা, আর সে বেশ যত্ন করে লাগিয়ে দিত দুধিয়া কিংবা লুচিপাতার রস

তখন উপরের ক্লাসে ব্লাকবোর্ডে লেখা হতো সাদা চক দিয়ে। একদিন টিফিন টাইমে ছোটো ছোটো চকের টুকরো চুরি করে এনেছি পকেটে পুরে। অমা ‘চিত্রলেখা’ খেলতে চায় না, তবু জোর করে খেলা হলো সেদিন। চকের গুঁড়ো হাতে লাগানোতে কালোর ভিতর এত চকচকে সাদা লেখা হলো যে অমার হাতই দেখতে সবচেয়ে সুন্দর হলো। তার চোখগুলো উজ্জ্বল হয়ে উঠল, আর আমি বলে উঠলাম, তোর কপালে এমন সাদা বর জুটবে দেখিস। অমা দৌড়ে পালালো। এরপর একযুগ কেটে গেছে। হঠাৎ মনের টানে বহুদূরের শহরতলীতে অমার সাথে দেখা। বাড়িতে সেদিন পূজো, হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যে প্রণাম করল অমা। পরিচয় করিয়ে দিল তার বরের সাথে, রং যার চকের মতোই সাদা। তাদের হার্বাল মেডিসিনের বিজনেস্‌। খাওয়াদাওয়ার পর দরজায় বিদায় নেয়ার সময় বললাম, খুব ভাল লাগলো তোমার বরকে দেখে অমা। অমার চোখে জল, মুখে উদ্ভাস, কন্ঠ রূদ্ধ, ‘তুমি যা বলেছিলে… ’।

2 9 ঔষধি গুল্ম দুধিয়া
দুধিয়া ফুল, যার পাপড়ি হয় না। ছবি: সংগৃহীত।

পরদিন অমাদের দোকানে গেলাম, অনেক কিছুর মধ্যে পাওয়া গেল চৈ-ঝাল, শুকনো ত্রিফলাসহ শুকনো দুধিয়ার আটি। দুধিয়া গাছ হাতখানেকের বেশি উঁচু হয় না। যেটি সচরাচর দেখা যায়, ইঞ্চি দেড়েক লম্বা সবুজ বা লালচে সবুজ পাতা সংবলিত তার নাম বড় দুধিয়া বা ক্ষীরুই। হিন্দিতেও এর নাম দুধিয়া, সংস্কৃতে ক্ষীরিণী যা ‘দুগ্ধ’ অর্থবোধক। এটি ইউফরবিয়াসিয়ি (Euphorbiaceae), স্পার্জ (Spurge) বা ভেন্না-পরিবারের উদ্ভিদ। এই পরিবারে পরিচিত উদ্ভিদদের মধ্যে রয়েছে কাসাভা, ভেন্না, রবার, গেওয়া, ক্রাউন অব থর্নস্‌, পানচেটিয়া (Poinsettia) ইত্যাদি। দুধিয়ার বৈজ্ঞানিক নাম ইউফরবিয়া হার্টা (Euphorbia hirta L.)। গ্রীক ইউফরবস্‌ ছিলেন মরিতানিয়ার রাজ-কবিরাজ, আর হার্টা অর্থ রোমশ। এই গাছের সর্বত্র, পাতার উপরে এবং নিচেও রোম থাকে।

এই গণে প্রায় ২০০০ উদ্ভিদ আবিষ্কৃত হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশ ও অস্ট্রেলিয়াতে এদের বেশি দেখা গেলেও সারা পৃথিবীর বহু উষ্ণ অঞ্চল জুড়েই বিস্তৃত এখন। বড় দুধিয়া ছাড়া আরো কয়েকপ্রকার দুধিয়া দেখা যায় যেগুলো ছোট দুধিয়া নামে বেশি পরিচিত। এদের ভিতর যেটির পাতা এক ইঞ্চির সিকিভাগ, মাটিতে নুয়ে পড়ে, শাখা ও কাণ্ড দেখতে তামাটে-লাল রঙের সেটি ‘লাল দুধিয়া’ (Euphorbia thymifolia)। আরেকটির কাণ্ড সবুজাভ সাদা বলে ‘সাদা দুধিয়া’ (Euphorbia microphylla)। এ ছাড়াও আছে hypericifolia, prostrata ইত্যাদি ক্ষুদে প্রজাতি। সবকটি প্রজাতিরই ঔষধি ব্যবহার প্রায় একই রকম।

3 9 ঔষধি গুল্ম দুধিয়া
ফিলিপাইনে দুধিয়া সংগ্রহ। ছবি: sunstar

দুধিয়ার রস লাগালে শুধু কাটা-ঘা নয় পচা-ঘা, দাদরোগও সেরে যায়। তবে সারা গায়ে ঘা থাকলে লাগানো ঠিক নয়। যে কোনো ইউফরবিয়ার কষই বিষাক্ত। এ-কারণে বিস্তৃত এলাকার জন্য নিমের পেস্ট ব্যবহার করা উত্তম। বিষাক্ত বলে প্রাচীন আমলে তীরের ফলায় দুধিয়ার কষ মাখানো হতো। আফ্রিকার বুশম্যান ও বান্টু উপজাতির মানুষ গুবরে পোকা থেকে এই বিষ সংগ্রহ করতো। শ্বাসকষ্ট, কফ, কাশি ইত্যাদি রোগে ব্যবহৃত হয় বলে এর ইংরেজি সাধারণ নাম অ্যাজমা প্লান্ট। সন্তান জন্মের পর অনেক ক্ষেত্রে মায়ের স্বাস্থ্য ভাল হওয়া সত্ত্বেও পরিমিত দুধ নামে না। এর সঙ্গে বাচ্চাকে দুগ্ধদানে অনীহা থাকলে পরিমাণ তা আরো কমে যায়। এক্ষেত্রে দুধিয়া পাতার ক্কাথ বা ডিকক্‌শান (Decoction) তৈরি করে সকালে ও রাত্রে খেতে হয় কিছুদিন। আয়ুর্বেদ মতে এই ক্কাথ তৈরিতে শুকনো দুধিয়ার গুঁড়া ৩ গ্রাম বা কাঁচা দুধিয়া ৫ গ্রাম পরিমাণ, ২ কাপ জলে জ্বাল করে শুকিয়ে সিকিভাগ হলে নামিয়ে নিতে হয়। তবে অন্তঃসত্ত্বা মেয়েদের এটা সেবন করা ঠিক নয় কারণ এতে গর্ভপাতের আশঙ্কা থাকে। আয়ুর্বেদে এই ক্কাথ পেটব্যথা, শ্বাসকষ্ট, শ্বেতপ্রদর, রক্তপ্রদর ইত্যাদি রোগেও ব্যবহৃত হয়। তবে বিষাক্ত বলে অভিজ্ঞ কবিরাজের পরামর্শ নেয়া ভালো।

4 6 ঔষধি গুল্ম দুধিয়া
ছোটো প্রজাতির লাল দুধিয়া। ছবি: Chamaesycethymifolia

ফিলিপাইনে ডেঙ্গু রোগের পথ্য হিসাবে এর বহুল প্রচলন আছে। মনে করা হয়, দুধিয়া সেবনে রক্তের প্লেটলেট তৈরি হয় বলে অভ্যন্তরীন রক্তপাত বন্ধ হয়ে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যেতে পারে মানুষ (DOST, Department of Science and Technology) তবে এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখনো চলছে। এ ছাড়া বক্ষপ্রদাহ, শূলবেদনা, মূত্রনালীর রোগ, কৃমি, কোষ্ঠকাঠিন্য, আমাশয়, ভগন্দর, হৃদরোগ, জন্ডিস, বিষাক্ত সাপ ও কীটের দংশন, ম্যালেরিয়া, রক্তস্বল্পতা, মুখের ক্ষত, সন্ধিবাত, এলার্জি, চক্ষুরোগ ইত্যাদি নানাবিধ চিকিৎসায় পৃথিবীর বহু দেশে দুধিয়ার ব্যবহার দেখা যায়।

আমাদের উপমহাদেশে প্রাচীনকালে এই ভেষজ আদৌ সমাদৃত ছিল বলে মনে হয় না। অথর্ববেদ, এবং পরবর্তীকালে চরকসহ অন্যান্য সংহিতাগুলোতে এর ব্যবহার দেখা যায় না। ভাবপ্রকাশ নিঘন্টুতে এর প্রথম উল্লেখ দেখা যায়, যেখানে এর নাম ছিল ক্ষীরিণী। যত্রতত্র জন্মানো এই সহজলভ্য ভেষজের অসাধারণ গুণাবলী নিয়ে গবেষণা এখনো অপ্রতুল। ডেঙ্গু রোগ আমাদের দেশে প্রচুর দেখা যায়। ডেঙ্গু-প্রতিষেধক বা রোগনিরাময়কারী হিসাবে এই ভেষজ ব্যবহারের গবেষণা আশাপ্রদ হলে মহোপকার সাধিত হবে।

.

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!