অকালবোধন

অবশেষ দাস
অবশেষ দাস
3 মিনিটে পড়ুন

এক নাগাড়ে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। ঝড়ো হাওয়া। রোদ্দুরের মাস‌ আশ্বিন এখন‌ বর্ষার অকালবোধনে জল-ঝড়ের মাস। সরমার মা আজ সারাদিন কিছু মুখে তোলেনি। ছেলের বউ ময়না খুব মারধোর করেছে। মাঝেমধ্যে এরকম হয়। বলা নেই কওয়া নেই, হাতের কাছে যা পায়, কোনোটাই বাদ যায় না। আজ ঝাঁটা দিয়ে মেরেছে। অকথ্য গালিগালাজ করেছে। রতন বউকে কিছু বলতে পারে না। রাগ করলে একটু নেশা করে। মাদুর পেতে দাওয়ায় শুয়ে পড়ে।
ময়নার সারাদিন ফোন আসে। কত ঠাট্টা-তামাশা। সবসময় ছেলেদের সঙ্গে কথা বলে। উপুড় হয়ে ফোনে কথা বলতে বলতে ‌বিছানায় পা দোলায়। কোনো কোনোদিন সেজেগুজে ময়না দুপুরের পর বেরিয়ে পড়ে। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফেরে।‌গতকাল ফিরতে রাতদুপুর‌ হয়ে গেছে। ব্যাগ ভর্তি জামাকাপড় এনেছে। ঘরে ঢুকতে গোটা ঘর কেমন যেন গন্ধ গন্ধ লাগে। বড়োলোকেদের মেয়েদের গায়ে এমন গন্ধ থাকে।
রতনের ক্ষমতা নেই। কিন্তু ময়নার জানাশোনা লোকজন সব দেয়। সংসার চালায়।
সরমার মা বলেছিল, “না খেতে পাই মরে যাব, তাই বলে ঘর পুরুষ ছেড়ে পর পুরুষ। ‌ ছিঃছিঃ!
তারপর উত্তম-মধ্যম ঝাঁটা দিয়ে মার। রতন ভয়ে কাঁপছিল। কাঁদছিল। বাঘিনীর হাত থেকে কে বাঁচাবে!
সারাদিন আলোর মুখ দেখা যায়নি। সকাল থেকেই কেমন অন্ধকার ! তবে রতনের সংসার আজ তারচেয়েও যেন বেশি অন্ধকার। মাতৃ আরাধনার মাস এই আশ্বিন-কার্তিক। সংসারে মা ও ছেলের কোনো জায়গা নেই। এটা ময়নার একার সংসার।

বিকেল হতে না হতেই মনে হচ্ছে সন্ধ্যে হয়ে গেল।এখনও সরমার মা মুখে কিছু তোলে নি।‌ সকাল থেকে ধুলোতে শুয়ে আছে। ‌ একনাগাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। বাড়ির বাইরে রাস্তা থেকে ছাতা মাথায় মনোরমার মা রতনের নাম ধরে ডাকছে।
“বাড়িতে রতন‌ আছিস?‌” ” হতভম্ব রতন বলে, ” হ্যাঁ কাকিমা আছি।‌ বলো। “
“আমাদের লালুটার দেখেছিস? কোন্ সকালে বেরিয়েছে, কোথায় যে যায়, কে জানে!‌ সারাদিন খেতে এলো না। তোদের এদিকে এসেছে কিনা দেখছি। দেখতে পাচ্ছি না। তুই কি দেখেছিস, লালুকে ? “
“এদিকে আসেনি তো। এদিকে এলে আমাদের বাড়ির দাওয়ায় এসে শুয়ে থাকে। লেজ নাড়ায়। দেওয়ালে টিকটিকি দেখলে ঘেউ ঘেউ করে ডাকে।”
‘দেখলে আমাদের বাড়ির দিকে তাড়িয়ে দিস তো।‌ একমুঠো না খেলে হয়, বেলা বয়ে গেল।’
‘ঠিক আছে, দেখলে ডেকে ডেকে তোমাদের বাড়িতে দিয়ে আসব।’
‘যাসস, বাবা, তাই যাস। যাই রে। বৃষ্টি তো থামবে না, দেখছি,মরণের বৃষ্টি লেগেছে।’
দু-এক কথা বলতে বলতে মনোরমার মা পাড়ার দিকে চলে যায়।
কিছু একটা ভেবে, রতন এবার হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে।’
‘হা ভগবান।‌ ওদের বাড়ির কুকুর সারাদিন খায়নি তাই ওরা খুঁজতে বেরিয়েছে। আর আমার মা সারাদিন ঝাঁটা খেয়ে শুয়ে আছে। সারাদিন কেটে গেল। এক ফোঁটা জল পেল না। তার খোঁজ নেবার কেউ নেই। আর এমন হতভাগা আমি যে মায়ের জন্যে কিছু করতে পারি না। মানুষ না হয়ে মা যদি কুকুর হত, মনোরমার মায়ের মতো কেউ না কেউ খুঁজতে বের হত। একমুঠো ভাত দিত, ভালবেসে। না হয় আমি সেই কুকুরের ছানা হতাম। দুঃখ থাকত না।”
রতন অনর্গল বৃষ্টির মতো হাউ হাউ করে কাঁদে। ছেলের কান্না শুনে মা আর ঠিক থাকতে পারে না। কাঁদতে থাকে। বৃষ্টি আরও ঝমঝমিয়ে আসে।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
জন্ম: দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা। বাবা গৌরবরণ দাস এবং মা নমিতা দেবী। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পাশাপাশি তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা। দুটোতেই স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। এছাড়া মাসকমিউনিকেশন নিয়েও পড়াশোনা করেছেন। বর্তমানে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বিদ্যানগর কলেজের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক। প্রথম লেখা প্রকাশ 'দীপশিখা' পত্রিকার শারদ সংখ্যায়। তাঁর কয়েকটি কবিতার বই: মাটির ঘরের গল্প ( ২০০৪), কিশোরবেলা সোনার খাঁচায় (২০১৪), হাওয়ার নূপুর (২০২০) সহ অজস্র সংকলন ও সম্পাদিত গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার আগেই তিনি একজন প্রতিশ্রুতিমান কবি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। কবিতা চর্চার পাশাপাশি প্রবন্ধ ও কথাসাহিত্যের চর্চা সমানভাবে করে চলেছেন। কবি দুই দশকের বেশি কাল ধরে লেখালেখি করছেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও সংকলনে। বেশকিছুদিন সম্পাদনা করেছেন ছোটদের 'একতারা' সাহিত্য পত্রিকা। এছাড়া আমন্ত্রণমূলক সম্পাদনা করেছেন বহু পত্র-পত্রিকায়। তিনি গড়ে তুলেছেন শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক দুটি অন্যধারার প্রতিষ্ঠান 'বাংলার মুখ' ও মেনকাবালা দেবী স্মৃতি সংস্কৃতি আকাদেমি।' তাঁর গবেষণার বিষয় 'সুন্দরবনের জনজীবন ও বাংলা কথাসাহিত্য।' পাশাপাশি দলিত সমাজ ও সাহিত্যের প্রতি গভীরভাবে মনোযোগী। ফুলের সৌরভ নয়, জীবনের সৌরভ খুঁজে যাওয়া কবির সারা জীবনের সাধনা। সবুজ গাছপালাকে তিনি সন্তানের মতো ভালবাসেন। সুন্দরবন তাঁর কাছে আরাধ্য দেবী। সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন অজস্র পুরস্কার ও সম্মান: সুধারানী রায় স্মৃতি পুরস্কার (২০০৪), বাসুদেব সরকার স্মৃতি পদক (২০০৬), রোটারি লিটারেচার অ্যাওয়ার্ড (২০০৬), ১০০ ডায়মণ্ড গণসংবর্ধনা (২০০৮), পাঞ্চজন্য সাহিত্য পুরস্কার (২০১০), শতবার্ষিকী সাহিত্য সম্মাননা (২০১১), এশিয়ান কালচারাল লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড (২০১৪), ডঃ রাধাকৃষ্ণন সম্মাননা (২০১৫), ডি.পি.এস.সি. সাহিত্য সম্মাননা (২০১৮), আত্মজন সম্মাননা (২০১৯), বিবেকানন্দ পুরস্কার (২০১৯), দীপালিকা সম্মাননা (২০১৯), সংহতি সম্মাননা (২০২০), সুকুমার রায় পুরস্কার (২০২০)।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!