শুভেন্দু ও একটি অনাহূত সন্ধ্যা

উস্রি দে
উস্রি দে
15 মিনিটে পড়ুন
সাময়িকী আর্কাইভ

টেলিভিশনের রিমোটটা আজ কিছুতেই কথা শুনছে না। শুভেন্দু অসহায় হয়ে চেয়ে রইল। স্থানীয় একটি বাংলা খবরের চ্যানেল থেকে চোখ সরাতে পারছে না আজ সে কিছুতেই। সেখানে ‘ব্রেকিং নিউজে ‘-এ বারে বারেই দেখানো হচ্ছে একটি বিশেষ খবর। দার্জিলিং থেকে শিলিগুড়ি ফেরার পথে পর্যটক সহ একটি জিপ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উলটে পড়েছে রাস্তার পাশের পাহাড়ি খাদে। যাত্রীদের তালিকায় বেশ কিছু বাঙালির নাম পাওয়া গেছে। জিপটি গড়িয়ে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে জিপের চালক বিপদ বুঝে ডানদিকে লাফিয়ে পড়ে ও প্রাণে বেঁচে যায়। এখন পর্যন্ত পাওয়া খবরে যাত্রীদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেই মনে করছে প্রশাসন। যাত্রীদের দেহগুলোর অনুসন্ধান চালাচ্ছেন স্থানীয় পুলিশ বাহিনী। প্রয়োজনে সেনা বাহিনীর সাহায্য চাওয়া হবে। এ পর্যন্ত খবরটিতে তেমন কোন বৈচিত্র্য নেই। কেননা এ ধরণের দুর্ঘটনার খবর প্রায় রোজই টিভি খুললে পাওয়া যায়। খবরটির বিশেষত্ব হল একজন মহিলাকে নিয়ে। আশ্চর্যজনকভাবে যার দেহ আটকে ছিল বহু নিচে খাদের ও একটি গাছের ডালের ফাঁকের স্বল্প পরিসরে। অচেতন অবস্থায় দেহটি আটকে থাকে বেশ কয়েক ঘন্টা। এই কয়েক ঘন্টার উদ্বেগ ও আশঙ্কাই খবরটিকে প্রাধান্য দিয়েছে ‘ব্রেকিং নিউজ’-এর। অবশেষে স্থানীয় দুই পাহাড়ি যুবক অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই খাদে নেমে তাকে উদ্ধার করে কিছু স্থানীয় মানুষ ও প্রশাসনের সাহায্যে। এ এক অভূতপূর্ব শ্বাসরোধকারী মিশন। এরপর সেই অচেতন মহিলাকে স্থানান্তরিত করা হয় শিলিগুড়ির সরকারি হাসপাতালে। তবে বিস্ময়কর ঘটনা হল, মহিলা বেঁচে আছেন। ও প্রান্তের সংবাদদাতা জানাচ্ছেন, আপাতদৃষ্টিতে ভদ্রমহিলার শারীরিক অবস্থা আশংকাজনক না হলেও, ওর জ্ঞান ফেরেনি এখনও।
অন্যান্য দিন এই সময়টাতে শুভেন্দু শুধুই চ্যানেল সার্ফ করে চলে। কখনও ‘ডিসকভারি, ‘কখনও ‘অ্যানিম্যাল প্ল্যানেট’ কিংবা কোন স্পোর্টস চ্যানেল। যার ফলে সোহিনীর সাথে ওর ঠোকাঠুকি লাগে রোজই। অফিস ফেরত বাড়ি ফিরে একটু ফ্রেশ হয়েই টিভি-র সামনে বসে পড়ে ও। চা আর হালকা কোন খাবার নিয়ে সোহিনীও এসে বসে। খেতে খেতে শুভেন্দুর হাতের রিমোট এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে। যেখানেই ইন্টারেস্টিং কিছু পায়, জমে যায়। ওদিকে সোহিনীও চটে যায়। একে তো সারাদিন পর দেখা হলেও কোন কথা নেই। সোহিনী একাই বকবক করে যায় সংসারের খুঁটিনাটি নিয়ে। শুভেন্দু মাঝে মধ্যে শুধু হুঁ হাঁ করে চলে। সোহিনীর ইচ্ছে থাকলেও অন্য কোন চ্যানেলে কিছু দেখার কথা বলতে পারে না। কেননা, শুভেন্দু এ ব্যাপারে কোনরকম কম্প্রোমাইজ করবে না। সোহিনী তো তাই বলে

–‘কত লাকি তুমি, ভেবে দেখেছ একবারও? অন্যদের মত তোমার বউ সিরিয়াল অ্যাডিকটেড নয়?’
মুচকি হাসে শুভেন্দু। সোহিনী আরও তেতে ওঠে-

– ‘হাসছো যে? আমি যদি অন্যদের মত হতাম?’

– ‘এইজন্যই তো তোমার তুলনা শুধু তুমি-ই!’

‘যাও যাও, ওসব কথা অনেক শুনেছি। আসলে তুমি ভীষণ স্বার্থপর! শুধু নিজের আনন্দেই মশগুল…’
বলতে বলতে উঠে পড়ে সোহিনী। ছেলেটা ঠিকমত পড়ছে কিনা, সেসবও ওকেই খেয়াল রাখতে হয় যে ! তার ওপর আছে রাতের রান্না। ডিনারে শুভেন্দুর জন্য ফ্রেশ কিছু বানিয়ে দিয়ে আসছে সোহিনী প্রথম থেকেই।
আজ কি হল শুভেন্দুর? অন্য দিনের মত চ্যানেল সার্ফ করতে গিয়েই আটকে গেছে এই বিশেষ চ্যানেলটিতে। আর প্রায় ঘন্টাখানেক হতে চলল, ওখান থেকে চোখ সরাতে পারছে না। অন্য সময় এই ধরণের খবরে একবার চোখ বুলিয়েই ও সরে যায় অন্য চ্যানেলে। কিন্তু আজ যখনই সেই অচেতন মহিলার মুখটা ক্লোজ আপে দেখিয়েছে, তখন থেকেই শুভেন্দুর যেন কোন সাড় নেই। রিমোটটা ওর হাতের মুঠোয়, হাতটা অবশ। কী দেখলো ও? ঠিক দেখেছে তো? এর মধ্যে বার কয়েক মহিলার মুখটা দেখানো হয়েছে, একই পজিশনে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না ও। এতদিন পরে…হয়ত কোথাও ভুল হচ্ছে ওর। এক ঝলকের দেখা তো! কিন্তু না, সেইরকমই মুখের আদল- চিবুক, ঠোঁট! আচ্ছা, একইরকম দেখতে অন্য কেউও তো…। নাঃ, বারবার দেখে ক্রমশঃ নিশ্চিত হয়েছে শুভেন্দু। ওর ভুল হতে পারে না। অনন্যা, হ্যাঁ অনন্যাই।
একুশ বছর! এক দীর্ঘ সময়! অনন্যার কথা মনে পড়তেই মনের আকাশ জুড়ে এক অদ্ভুত নীলিমা। গাঢ় নীল শাড়িতে অপরূপা অনন্যা, আয়ত চোখ দুটোর ভাষায় কী অপার রহস্য। শুভেন্দু তখন ইঞ্জিনিয়ারিং সেকেন্ড ইয়ার। ভদ্রেশ্বরে মাসির বাড়িতে এক অনুষ্ঠানে আলাপ। আর প্রথম সাক্ষাতেই শুভেন্দু এক্কেবারে বোল্ড। মাসতুতো দাদা রজতই লিঙ্কম্যানের কাজটা করেছিল।রজতদার পাড়ায় রবীন্দ্রজয়ন্তির অনুষ্ঠান। আবৃত্তিটা শুভেন্দু ভালই করত, যদিও সেটা সীমিত ছিল বন্ধুবান্ধবদের আড্ডায়। কিন্তু রজতদা একরকম জোর করেই টানতে টানতে স্টেজে তুলে দিল শুভেন্দুকে। নাম ঘোষণা হয়ে গেছে। মাইক্রোফোন হাতে কিছুটা নার্ভাস লাগলেও ভেতরে ভেতরে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিল শুভেন্দু। হঠাৎ উইংস-এর দিকে নজর পড়তেই বেসামাল! আবৃত্তির পরেই শুরু হবে নৃত্যনাট্য। নটীর সাজে অপেক্ষায় অনন্যা। আবিষ্ট শুভেন্দু থমকালো, জীবনে প্রথম আবৃত্তি করতে গিয়ে থমকে গেলো, যেমন থমকে আছে আজ, ওই একটি চ্যানেলে। ভাগ্য ভালো আজ সোহিনী বাড়ি নেই। ছেলেকে নিয়ে গেছে দূরে এক স্যারের কাছে টিউশন পড়াতে। নাহলে, এই পরিস্থিতিটা কিভাবে সামলাতো শুভেন্দু? বোধহয় ধরাই পড়ে যেত সোহিনীর কাছে।
আবার খবরে মন দিল শুভেন্দু। ও যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে! আজ এতদিন পর সেই অনন্যা! ওই তো আবার দেখাচ্ছে ওকে। হাসপাতালের বেডে, চিকিৎসা চলছে। কতদিন আগে ওকে শেষবারের মত দেখেছিলো শুভেন্দু? মনে হয় এক যুগ কেটে গেছে।
অনন্যারা ভদ্রেশ্বর ছেড়ে চলে যাচ্ছে, রজতদার কাছে খবরটা পেয়ে ছটফট করেছিল শুভেন্দু। কিন্তু তখন ওদের ফাইনাল সেমেস্টার চলছে। তাই ওটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত…। শেষ পরীক্ষা দিয়েই ছুটে গিয়েছিল ভদ্রেশ্বরে। রজতদাদের বাড়ির পাশেই ছিল অনন্যার মামাবাড়ি। বাবার অকাল মৃত্যুর পর ওখানেই থাকত অনন্যা ওর মায়ের সাথে। সেদিন ভদ্রেশ্বরে পৌঁছে অনন্যার সঙ্গে দেখা হয়নি শুভেন্দুর। আগের দিনই অনন্যা আর ওর মা ভদ্রেশ্বর ছেড়ে চলে গেছে। রজত দা বলেছিল–

– ‘সেই এলি, কিন্তু দেরি করে ফেললি…।‘
রজতের কাছে শুনেছিল অনন্যার বাবার এক দূরসম্পর্কের ভাই থাকেন বিলাসপুরে। সেখানেই চলে গেছে ওরা। কারণ মামাবাড়িতে আর থাকা সম্ভব হচ্ছিল না সম্মান নিয়ে। ওর কাকার বাড়ির কোন ঠিকানা রজতের জানা ছিল না, অনন্যাকে জিজ্ঞেস করার সুযোগও পায় নি। এক অব্যক্ত যন্ত্রণা বুকে নিয়ে হতাশ শুভেন্দু ফিরে এসেছিল সেদিন। মনে হয়েছিল, কেন এমন হল ? দেখা না হলেই তো ছিল ভালো। এর পরেও কয়েকবার রজতের কাছে খবর নিয়েছে শুভেন্দু যদি কোনভাবে অনন্যার ঠিকানাটা যোগাড় করা যায়। কিন্ত্য রজতের পক্ষেও কিছু খোঁজ করা সম্ভব হয় নি। কেননা অনন্যার মামানাড়ির কেউই ওদের ব্যাপারে মুখ খুলত না। আজ শুভেন্দুর মনে হয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষের জীবন কে কতটা প্রভাবিত করেছে ! কত রকমের সুবিধে এনে দিয়েছে হাতের মুঠোয়। মুঠোফোনই তো তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, কেউ কি কাউকে এভাবে হারিয়ে ফেলতে পারবে ?
দিনে দিনে শুভেন্দুর মন থেকে অনন্যার ছায়া সরে যেতে থাকল বাস্তবের চাপে একটু একটু করে। তারপর কেটে গেছে কতকাল! মাঝে বয়ে গেছে সময়, মুছে দিয়েছিল অনন্যাকে শুভেন্দুর জীবন থেকে। আচ্ছা, সত্যিই কী মুছে যায় সবকিছু সময়ের সাথে সাথে, ভাবে শুভেন্দু। জীবন পাল্টায় ঠিকই, নতুন নতুন চিন্তা, নতুন দিশা জীবন কে অন্য খাতে বইয়ে দেয়। যা ভাবা যায়, তা রূপায়িত হয় না। জীবনের শুরুতে যে ভাবনাগুলো ডানা মেলে, তারাই আবার ডানা গুটিয়ে ফেলে নতুন ভাবনাকে জায়গা করে দিতে। তবু, সব মুছে যায় না। অবচেতনে সুপ্ত থাকে, নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও। হঠাত নাড়া লেগে একসময় সেগুলো বুড়বুড়ি কেটে ভেসে ওঠে মনের অতল থেকে।
সোহিনী ঘরে ঢুকে দেখলো শুভেন্দু এক মনে টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে। এ চিরাচরিত দৃশ্য ওর গা সওয়া হয়ে গেছে। তাই প্রথমটায় অতটা খেয়াল করেনি। বাংলা কথা কানে যেতেই ও ফিরে তাকালো টিভির দিকে। তারপর অবাক হয়ে বলে ফেলল–

-‘কি ব্যাপার, আজ সূর্য কোন্ দিকে উঠেছিল বলো তো?’
-‘হুঁ?’ শুভেন্দু চমকে ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো সোহিনীকে।

– ‘বলছি, ব্যাপারটা কী?’

– ‘কিসের ব্যাপার!’ টিভির থেকে চোখ না সরিয়েই বলল শুভেন্দু।

– ‘কিসের ব্যাপার বুঝতে পারছো না? তুমি হঠাৎ বাংলা চ্যানেলে এত মগ্ন?’
মনে মনে একটু হোঁচট খায় শুভেন্দু। তারপর ইতঃস্তত করে বলে-

– ‘না, ওই একটা জিপ অ্যাক্সিডেন্ট করে খাদে পড়ে গেছে দার্জিলিং থেকে ফেরত আসার সময়, ওটাই দেখছিলাম আর কি।‘

– ‘ও বাব্বা, এসব খবরও দেখছো তাহলে আজকাল!’

– ‘কি যে বলো না! এতগুলো মানুষের প্রাণ, একটা মানবিকতা তো আছে … ’ওকে থামিয়ে দিয়ে সোহিনী বলে–

– ‘আহারে, এতদিন পরে আজ হঠাৎ মানবিকতা বোধ জেগে উঠলো! আগেও তো এইধরণের ঘটনা ঘটেছে, তোমাকে তো এত ইনভল্ভড হতে দেখিনি?’

– ‘না গো, এই ঘটনাটা এত মর্মান্তিক না ! তুমি দেখো, তোমারও …’

– ‘না বাবা, আমার অত সময় নেই। আজ সমুর স্যর সারপ্রাইজ টেস্ট নিলেন। যা দেরি হয়ে গেলো না! আমি খাবার গরম করছি। খেতে চলে এসো তাড়াতাড়ি। সমুর ঘুম পেয়ে গেছে।‘
বলতে বলতেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো সোহিনী। আর ঠিক এই ফাঁকটুকুই মনে মনে চাইছিল শুভেন্দু। ওর সমস্ত মন জুড়ে এখন শুধুই অনন্যা। এই মনটাকে এখন ভাগ করা যায় না কিছুতেই। আচ্ছা, এতদিন মনে পড়েনি কেন? আসলে স্মৃতিতে শ্যাওলা জমেছিল, কোন অদৃশ্য বেলচায় আজ তা চেঁছে দেওয়া হয়েছে, তাই সব স্পষ্ট, টলটলে।

পারিবারিক অশান্তি এড়াতে ডাইনিং টেবিলে বসতে হয়েছে শুভেন্দুকে। ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করে একসময় উঠে পড়েছে। সোহিনীর জিজ্ঞাসার উত্তরে জানিয়েছে ‘খিদে নেই।’ এখন রাত প্রায় এগারোটা। সোহিনী ঘুমিয়ে পড়েছে। বেচারি আজ খুব ক্লান্ত। পাশের ঘরে সমুও গভীর ঘুমে। শুভেন্দুর চোখে ঘুম নেই। নিজের মুখোমুখি দাঁড়াবার এই তো সময়! ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালো একটা। আকাশটা কেমন যেন থম মেরে আছে। আবহাওয়াটা গুমোট। ওর মনের পরদায় শুধু অনন্যার মুখ ভাসছে। ‘কেমন আছো, অনু? খুব কষ্ট হচ্ছে?’ ভেতরে ভেতরে ছটফট করতে থাকে শুভেন্দু। একবার চুপি চুপি ড্রয়িং রুমে ঢুকে টিভি টা অন করে সাউন্ড মিউট করে সেই বিশেষ চ্যানেলে গিয়েও আর কোন নতুন খবর পেল না শুভেন্দু, হতাশ হতে হল। এখন কি সব চাপান উতোর চলছে রাজনৈতিক নেতাদের, কোন একটা ইস্যুতে। টিভি অফ করে ব্যালকনিতেই চলে এলো ও।

অনুর কোন খবর আর পায় নি শুভেন্দু। রজতের কাছেও কোন খবর ছিল না। নিঃশব্দে রক্তপাত হয়েছিল অন্তরের অন্তঃস্থলে। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। আজও যেমন নেই! কি করবে ও? কিভাবে খবর পাবে অনন্যার? আচ্ছা, ওই নিউজ চ্যানেলের সাথে কোনভাবে যোগাযোগ করলে ওরা কি দিতে পারবে কোন আপডেট? যদি অনুর পরিবারের লোকজন সাথে থেকে থাকে, (সেটারই সম্ভাবনা বেশি বেড়াতে যাওয়ার ক্ষেত্রে) আর তারা কেউ বেঁচে না থাকে! তবে? তবে তো শুভেন্দুকেই এগিয়ে যেতে হবে খোঁজখবর করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে! নাহলে, ওইসব সরকারি হাসপাতালে ঠিকমত চিকিৎসার অভাবে শেষপর্যন্ত …। নাঃ, আর ভাবতে পারে না, শুভেন্দু। ভেতরে ভেতরে কাঁপছে ও। এই গুমোটেও কেমন শীত শীত করছে। ‘ অনু, তুমি কেমন আছো? আমি যাচ্ছি, আমি তোমার পাশে থাকব।‘ মনে মনে বিড়বিড় করে শুভেন্দু। আচমকা ওর মোবাইল টা বেজে উঠতেই ওর বুকে যেন হাতুড়ির ঘা পড়তে লাগল। কীসব ভাবছিলো ও এতক্ষণ পাগলের মত! সোহিনীকে কী বলবে ও? কোন অজুহাতে ছুটে যাবে অনুর কাছে? মোবাইল স্ক্রিনে কার নাম্বার ডিসপ্লে হয়েছে না দেখেই কাঁপা হাতে বোতাম টিপে গলা নামিয়ে বলল–

– ‘হ্যালো!’

– ‘হ্যালো শুভ, শুয়ে পড়েছিলি? ‘
ও প্রান্ত থেকে ভেসে এল রজতদার গলা। এত রাতে রজত দা ! তাহলে কি অনুর খবরটা দিতেই…! শুভেন্দুর গলা দিয়ে কোনমতে বেরোল –

– ‘না, এখনও শুই নি। কেন?’
উদ্বেগে, উত্তেজনায় ওর গলা প্রায় বুজে এসেছে।

– ‘কি রে, কী হয়েছে তোর? বাড়িতে সবাই ঠিকঠাক তো? সোহিনী, সমু?’

– ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এখানে সবাই ঠিকই আছে। তুমি বল কি বলবে।‘

– ‘বলছি বলছি, তুই এত ছটফট করছিস কেন, বল তো?’
একটু প্রকৃতিস্থ হওয়ার চেষ্টা করে শুভেন্দু। গলাটাকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে বলে –

– ‘কিছু হয়নি, আসলে এত রাতে তোমার ফোন, তাই…’

– ‘হ্যাঁ রে, রাত একটু বেশিই হয়ে গেছে। আসলে আমারই আজ কাজ থেকে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেলো ট্রেন লাইনে অবরোধের জন্য। তা তোকে একটা খবর জানাতেই ফোনটা করলাম। (একটু থেমে) অনুকে মনে আছে তোর, অনন্যা?’
এ প্রান্তে শুভেন্দু নিথর। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। নিজের হৃদস্পন্দন নিজেই শুনতে পাচ্ছে। তার মানে…তার মানে ও যা ভেবেছে, তাই-ই! রজতদা নিশ্চয়ই ওই দুর্ঘটনার ব্যাপারে অনেকটাই জানে।

– ‘কি রে, চুপ করে আছিস যে! ভুলে গেছিস তোর একসময়ের হার্টথ্রব কে?’

– ‘না না, ভুলবো কেন? তো কি হয়েছে অনন্যার?’ গলা কেঁপে যায় শুভেন্দুর।

– ‘হয়নি কিছুই। অনু আজ এসেছিল আমাদের বাড়ি।ও থাকে জব্বলপুরে, ওখানেই ওর হাজব্যান্ড ব্যাংকে আছে। ওর ছেলেটা ওয়েস্টবেঙ্গল জয়েন্টে বেশ ভালো র‍্যাঙ্ক করেছে, বুঝলি, ইঞ্জিনিয়ারিং-এ। তাই কাউন্সেলিং-এর জন্য কলকাতায় এসেছে ওরা। তা ওর মামাবাড়িতেতো এখন বড় মামাতোভাইটাই থাকে ফ্যামিলি নিয়ে। ওর মামা, মামি বেশ কিছুদিন হল গত হয়েছেন। তাই ওই ভাইয়ের কাছেই উঠেছে। সক্কাল সক্কাল এসে হাজির আমাদের বাড়িতে, মায়ের সাথে দেখা করতে। মা তো ওকে খুব স্নেহ করত, তুই তো জানিসই ! কথায় কথায় তোর খবরও জানতে চাইল। তবে অনু খুব মুটিয়ে গেছে , আগের সেই ছিপছিপে সুন্দর চেহারার সাথে মিল খুঁজে পাবি না। আমি তো প্রথমটায় চিনতেই পারি নি, জানিস? তারপর ও নিজে থেকেই যখন বলল, তখন…’
রজতদার কথাগুলো যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে।

– ‘হ্যালো শুভ, শুনতে পাচ্ছিস, হ্যালো?’
আকাশের দিকে তাকালো শুভেন্দু। আকাশটায় আজ কত তারা জ্বলজ্বল করছে। হঠাৎ কোত্থেকে এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা এসে লাগল ওর চোখেমুখে। সন্ধ্যের থেকে যে গুমোট ভাবটা ছিল, আচমকা সেটা কেটে গেলো। কোথাও বোধহয় বৃষ্টি হয়েছে। বুক ভরে ঠাণ্ডা বাতাস টেনে নিতে নিতে শুভেন্দু ভাবলো, একটা ভীষণ ঝড় উঠছিল, সবকিছু এলোমেলো করে দিত ওর জীবনে। কিন্তু না, সব আবার স্বাভাবিক হয়ে গেলো। এটাই চেয়েছিল ও মনে মনে?

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
লেখক: উস্রি দে
নিবাস পশ্চিমবঙ্গ। দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত আছেন।
১ টি মন্তব্য

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!