রুশ সেনারা ইউক্রেনের নারীদের ধর্ষণ করে

সাময়িকী ডেস্ক
সাময়িকী ডেস্ক
8 মিনিটে পড়ুন

কয়েকদিন আগে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ থেকে সরে গেছে রুশ সেনারা; কিন্তু রাজধানীতে অবস্থানের সময় যেসব কাণ্ডকীর্তি তারা করেছে, সেসবের ফলে সৃষ্ট আতঙ্ক থেকে সম্ভবত কোনো দিনই মুক্তি ঘটবে না কিয়েভ ও তার আশপাশের এলাকার বাসিন্দাদের।

কিয়েভ ও তার আশপাশের এলাকায় রুশ বাহিনীর ধর্ষণের শিকার কয়েকজন নারীর সঙ্গে যোগাযোগ করে এ বিষয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে বিবিসি। হতভাগ্য সেই নারীরা বিবিসিকে অকপটে বলেছেন তাদের সেই রোমহর্ষক অভিজ্ঞতার কথা।

বিবিসির এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে প্রথমেই এসেছে আন্না (ছদ্মনাম) নামের ৫০ বছর বয়সী এক নারীর ধর্ষণের বিবরণ। কিয়েভ থেকে ৭০ কিলোমিটার (৪৫ মাইল) পশ্চিমে একটি গ্রামীণ এলাকায় স্বামীসহ বসবাস করেন আন্না। গত ৭ মার্চ তার বাড়িতে জোর এক রুশ সেনা ঢুকে পড়ে। সে সময় স্বামীসহ বাড়িতেই ছিলেন তিনি।

বিবিসিকে আন্না বলেন, ‘আমার দিকে বন্দুক তাক করে সে (রুশ সেনা) আমাকে পার্শ্ববর্তী একটি বাড়িতে নিয়ে যায়, সেটি তখন ফাঁকা ছিল। সেখানে গিয়ে সে আমাকে কাপড় খোলার নির্দেশ দেয় এবং বলে আমি যদি তার কথা না মানি সেক্ষেত্রে সে আমাকে গুলি করবে।’

‘আমি প্রাণ বাঁচাতে তার নির্দেশ পালন করার পরই সে আমাকে ধর্ষণ করা শুরু করল।’

আন্না বলেন, ধর্ষণকারী ওই সেনা ছিল তরুণ ও কৃশকায় এক চেচেন যোদ্ধা। সে যখন আন্নাকে ধর্ষণ করছিল, সে সমম আরও চারজন রুশ সেনা সেই বাড়িতে ঢোকে।

‘নতুন চারজনকে দেখার পর আমার মনে হয়েছিল, আজই আমার জীবনের শেষ দিন। তবে তারা আমাকে ধর্ষণের জন্য নয়, বরং ধর্ষণকারী ওই সেনাকে নিয়ে যেতে এসেছিল।’

ধর্ষণকারী ওই সেনা চলে যাওয়ার পর কোনোমতে বাড়িতে ফিরে আসেন আন্না এবং দেখেন— ঘরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছেন তার স্বামী। রুশ সেনারা তার পেটে গুলি করেছে।

‘আমাকে বাঁচানোর জন্য সে ছুটে আসছিল, সে সময়ই তাকে গুলি করা হয়। তারপর আমরা এক প্রতিবেশীর বাড়িতে আশ্রয় নিই। চতুর্দিকে যুদ্ধ চলার কারণে আমি তাকে (স্বামী) হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারিনি। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বিনা চিকিৎসায় দু’দিন পর সে মারা যায়।’

বিবিসিকে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া এই ভয়াবহ ঘটনার বিবরণ যখন দিচ্ছিলেন, সেসময় অঝোরে কাঁদছিলেন আন্না। মৃত স্বামীকে বাড়ির পেছনের উঠোনে কবর দেওয়া হয় এবং বিবিসি প্রতিবেদককে সেই কবর দেখিয়েছেন তিনি। বাড়িতে টাকা-পয়সা যা ছিল, সেসব রুশ সেনারা নিয়ে গেছে বলেও বিবিসিকে জানিয়েছেন তিনি।

‘আমরা যখন প্রতিবেশীর বাড়িতে অবস্থান করছিলাম, সে সময় ওই রুশ সেনারা আমাদের বাড়িতে ছিল এবং তারা চলে যাওয়ার পর বাড়ি ফিরে আমি মাদক ও ভায়েগ্রা পেয়েছি।’

‘আগ্রাসনকারী রুশ সেনাদের অধিকাংশেই খুনী, ধর্ষণকারী ও লুটেরা। সামান্য কয়েকজন হয়তো স্বাভাবিক।’

যে এলাকায় আন্না থাকেন, সেখানেই আরও একটি রক্তহিম করা ভয়াবহ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে এবং সেটিও ঘটিয়েছিল আন্নাকে ধর্ষণকারী ওই চেচেন যোদ্ধা। ৪০ বছর বয়স্ক ওই নারীকে ধর্ষণের পর গলা কেটে হত্যা করা হয়।

নিজ বাসভবন থেকে ওই নারীকে জোর করে পার্শ্ববর্তী আরেকটি বাড়িতে নিয়ে যায় সেই চেচেন যোদ্ধা এবং সেই বাড়ির শয়নকক্ষে ওই নারীকে ধর্ষণের পর তার গলা কেটে দেয়। পরে ওই নারীকে কবর দেন আরেক দল রুশ সেনা।

কবর দেওয়ার পর ওই বাড়ির শয়নকক্ষের ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় লিপস্টিক দিয়ে সংক্ষিপ্ত নোট লিখে যান রুশ সেনারা। সেই নোটে লেখা ছিল, ‘অপরিচিত কারো হাতে নির্যাতিত ও নিহত এই নারীকে কবর দিয়েছে রুশ সেনারা।’

কবর দেওয়ার সময় নিহত সেই নারীর এক প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা বলেছিল রুশ সেনারা। ওকসানা নামের সেই প্রতিবেশী বিবিসিকে বলেন, ‘তারা (রুশ সেনা) আমাকে বলেছিল যে সে (নিহত নারী) ধর্ষণের শিকার হয়েছে এবং তার গলা কেটে দেওয়া হয়েছিল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই তার মৃত্যু হয়েছে। যে ঘরে তাকে হত্যা করা হয়েছে, সেখানে প্রচুর রক্ত ছিল বলে জানিয়েছে রুশ সেনারা।’

নিহত ওই নারীকে তার বাড়ির বাগানে কবরস্থ করা হয়। কবর দেওয়ার একদিন পর স্থানীয় পুলিশ ওই বাড়িতে আসে এবং কবর খুড়ে কফিন থেকে যে মরদেহ উদ্ধার হয়, সেটি ছিল নগ্ন ও গলা ও ঘাড়ে ছিল দীর্ঘ ও গভীর কাটার ক্ষত।

ইউক্রেন পুলিশের কিয়েভ শাখার প্রধান অ্যান্দ্রি নেবিতভ বিবিসিকে আরও একটি ধর্ষণের ঘটনা বলেন। এই ঘটনাটি কিয়েভ পুলিশ তদন্ত করছে বলেও উল্লেখ করেছেন নেবিতভ।

নেবিতভ বলেন, ‘গত ৯ মার্চ কিয়েভ থেকে ৫০ কিলোমিটার পশ্চিমের একটি গ্রামের এক বাড়িতে কয়েকজন রুশ সেনা ঢোকে। ওই বাড়িতে তরুণ এক দম্পতি তাদের একমাত্র শিশুপুত্রকে নিয়ে থাকতেন।’

‘বাড়িতে ঢোকার পর প্রথমেই তারা ওই নারীর স্বামীকে উঠোনেই গুলি করে হত্যা করে। তারপর তার শিশুপুত্রকে একটি ঘরে বন্দি করে ওই নারীকে কয়েক দফা ধর্ষণ করে দুই জন সেনা। এ সময় তারা হুমকি দিয়ছিল— যদি ওই নারী বাধা দেন, সেক্ষেত্রে তার শিশুপুত্রকেও হত্যা করা হবে।’

‘সন্তানের জীবন বাঁচাতে ওই নারী আর সেনাদের বাধা দেননি। ধর্ষণের পর চলে যাওয়ার সময় সেনারা ওই বাড়িটি জ্বালিয়ে দিয়ে যায় এবং তাদের পোষ্য কুকুরটিকেও হত্যা করে।’

রুশ সেনারা চলে যাওয়ার পর ওই নারী তার শিশুপুত্রকে নিয়ে ওই গ্রাম থেকে পালিয়ে যান এবং পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পুলিশ ইতোমধ্যে তার অভিযোগ রেকর্ড করেছে বলে বিবিসিকে জানিয়েছেন নেবিতভ।

হতভাগ্য ওই নারীর স্বামীকে প্রতিবেশীরা কবর দিয়েছেন। বিবিসিকে নেবিতভ বলেন, ‘আমরা ওই দম্পতির বাড়িতে গিয়েছিলাম। তার বাড়ির পুড়ে যাওয়া ধ্বংসাবশেষ দেখলাম, চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ওই পরিবারের ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিস…খুবই হৃদয়বিদারক দৃশ্য।’

ইউক্রেনের মানবাধিকার বিষয়ক সর্বোচ্চ সরকারি কর্মকর্তা ল্যুদমিলা দেনিসোভা বিবিসিকে জানান, অভিযানরত রুশ সেনারা নিয়মিত ইউক্রেনের নারীদের ধর্ষণ করছেন এবং এই ঘটনাগুলো তারা লিপিবদ্ধ করছেন। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

বিবিসিকে ইউক্রেন সংলগ্ন বুচা শহরে রুশ সেনাদের একটি দলবদ্ধ ধর্ষণের বিবরণ দেন তিনি।

ল্যুদমিলা বলেন, ‘রুশ বাহিনী যখন কিয়েভের আশপাশে অবস্থান করছিল, সে সময় বুচা শহরের একটি বাড়ির বেসমেন্টে ২৫ জন কিশোরী-তরুণীকে টানা কয়েকদিন ধরে পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে বেশ কয়েকজন রুশ সেনা। এই কিশোরী-তরুণীদের সবার বয়স ১৪ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে এবং তাদের মধ্যে ৯ জন ইতোমধ্যে গর্ভবতী হয়ে পড়েছে।’

‘ধর্ষণের আগে ও পরে রুশ সেনারা ওই কিশোরী-তরুণীদের বলত যে, তারা তাদের এমন মাত্রার ধর্ষণ করবে যে, ভবিষ্যতে কোনো পুরুষের সঙ্গে মেলামেশার কথা চিন্তা করলেও আতঙ্ক বোধ করবে ওই মেয়েরা।’

ল্যুদমিলা আরও বলেন, ’২৫ বছর বয়সী এক নারী আমাদের জানিয়েছেন, তার সামনে খোলা সড়কের ওপর তার ১৬ বছর বয়সী বোনকে ধর্ষণ করেছে কয়েকজন রুশ সেনা। এবং ধর্ষণের পর ওই রুশ সেনারা চিৎকার করে বলেছে— প্রত্যেক নাৎসী যৌনকর্মীর জন্য এই পরিণতি অপেক্ষা করছে।’

তবে এখন পর্যন্ত যত নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, তার খুব অল্পই লিপিবদ্ধ করা সম্ভব হয়েছে বলে বিবিসিকে জানিয়েছেন ল্যুদমিলা। তার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে এই সব ঘটনা লিপিবদ্ধ করার কাজটি আমাদের জন্য খুবই কঠিন। কারণ, সবাই যে তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ এই ঘটনার বিবরণ জানাতে চান— ব্যাপারটি এমন নয়। এছাড়া ধর্ষণের শিকার অধিকাংশ নারীই বর্তমানে মানসিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছেন। তাই আমরা তাদের সাক্ষ্য আপাতত নিতে পারছি না।’

তবে তিনি বলেছেন, ইউক্রেনের সরকার চায়— জাতিসংঘে এ বিষয়ে একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হোক এবং ইউক্রেনে ধর্ষণসহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধের জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী করা হোক।

আন্না নামের সেই নারী, যাকে দিয়ে শুরু হয়েছিল বিবিসির এই প্রতিবেদন— ভ্লাদিমির পুতিনের উদ্দেশে একটি বার্তা দিয়েছেন। বিবিসির মাধ্যমে তিনি পুতিনের উদ্দেশে বলেছেন, ‘আমি পুতিনের কাছে জানতে চাই, কেমন এমন হচ্ছে?’

‘আমি বুঝি না, আমরা তো আর এখন গুহামানবের যুগে বসবাস করছি না, তাহলে কেন তিনি (পুতিন) আলোচনা করছে না? কেন তিনি ইউক্রেন দখল ও এখানকার মানুষকে হত্যার অভিযান শুরু করেছেন?’
(সূত্র বিবিসি)

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!