গল্প: ফাঁপর ও উড়ন্ত চুমু

টিএম মিলজার হোসেন
টিএম মিলজার হোসেন
8 মিনিটে পড়ুন

জয় হোসেন একজন সাধারণ মানুষ, বয়স পঁয়ত্রিশ ছুঁই ছুঁই। একজন নির্ঝঞ্জাট, শান্ত, ঝামেলা বিহীন মানুষ। কারো আগে পিছে নেই। যেমন নিরাপদ জীবনযাপন করতে চান তেমনি সবাই নিরাপদে ও শান্তিতে থাকুক মনে প্রানে এটাই চান সব সময়।
পড়াপড়শী ও পরিচিত জনেরা তাকে ভিন্ন চিন্তা ধারার ব্যতিক্রম মানুষও ভাবেন এবং সম্মান করেন। তিনি অবশ্য নিজেকে খুবই সাধারণ মানুষ ভাবেন। জয় সাহেব মাঝে মধ্যে নিজেকে আবার চানাচুর ভাবেন, এই ধরেন একটু টক, ঝাল, মিষ্টি। হালকা মুখের মধ্যে ঝাটকা লাগা স্বাদের মতো।
জয় সাহেব বিয়ে-সাদি করেননি ফুল টাইম সিঙ্গেল। তিনি জীবনে কোন দিন প্রেমেও পরেননি। তাই বলে প্রেম করেননি বিষয়টা এমনও নয়।
তিনি মাঝে মধ্যে মজা করে বন্ধুদের বলেন—
‘প্রেমে পরে মুরগি আর মৎস্য
পুড়ে হয় ভস্ম
প্রেমে পরোনা বৎস।’
তাছাড়া প্রেমে পরার মতো এমন কাউকে এখন পর্যন্ত পাননি তিনি। ইতোমধ্যে যারাই তার জীবনে তাঁর কল্পনার প্রবল চাওয়া মহীয়সী মহামায়া ভান ধরে শিউলি ফুলের মতো সুবাস ছড়ানোর চেষ্টা করেছেন, তারাই কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে প্রকৃত ঢেঁড়শ সবজির মতো ঋতুর দায়ে বিদায় নিয়েছেন। তাঁদের কোন নিজস্ব দর্শন নেই, জীবনবোধ নেই। বড্ড বেশি একঘেয়েমি আদা, রসুন পটল বাহিনী, একটি পূর্ণ দৈঘ্য পটলা কাহিনী। জয় সাহেবের ভাষায়- পটলা মেয়ে মানে যারা পুরুষকে পটিয়ে থাকেন নিজ স্বার্থে এরা আবার পুরুষ পয়সায় রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেতে ভালবাসে। এসব মেয়েরা পুরুষের সঙ্গে শপিং কমপ্লেক্স ঘুরে ঘুরে জুতো, পোশাক ও প্রসাধনী সামগ্রী কিনে নেয় পুরুষের টাকায়। বায়না করে লং ড্রাইভে নিয়ে যাবার। এ পর্যন্ত তার জীবনে পটলা মেয়ে এসে জুটেছে অনেক, দ্রুত ফুটতেও হয়েছে। জয়ের পটলা মেয়ে একেবারেই পছন্দ না।
তিনি মাঝে মধ্যে একটু উদাস হয়ে বলে থাকেন “একটা কাব্যিক মহামায়ার সাথে দেখা হয়নি কভু”। সবই যেন ঢেঁড়শ খাদ্য, স্বল্প ঋতুর পিছলা ম্যাড়মেড়ে আষাঢ়ের সস্তা সবজির মত। আফসোস করে বলতে বলতে মুচকি হেসে ওঠেন।
তিনি সর্বদা মনে প্রানে একজন মহামায়া খুঁজেই বেড়ান। মহামায়া এক মহান মনের নারী, তিনি কৃষ্ণকলি হতে পারেন, কিন্তু তিনি মানসিক ভাবে অসম্ভব নয়, অসম্ভব তো অসম্ভবই, তিনি হবে মানসিক ভাবে সম্ভব সুন্দরী। তাঁর সহজ জীবনযাপন হবে অকৃত্রিম, সহজ। সহজ মনের মানুষ।
এই ধুলার পৃথিবীতে নীরবে খুঁজে বেড়ান মহামায়াকে জয়।
তবে তিনি কখনই কাউকে বিরক্ত করেন না।


এক ছুটির দিন সন্ধ্যা বেলা রাস্তার ধারে ফুটপাতের টং দোকানে এলাকার বন্ধুদের সাথে চা খাচ্ছিলেন জয়। চা খেতে খেতে চা দোকানীর চায়ের কাপে চামচ নাড়ার টুং টাং শব্দে উদাসীন হয়ে বসে আছে রাস্তামুখো বেঞ্চিতে।
হঠাৎ একটা মোটর বাইক এসে থামলো জয় সাহেব ও তাঁর বন্ধুদের সামনে। রাগান্বিত চোখে মুখে একটা পঁচিশ কি আটাশ বছরের ছেলে জয় সাহেবকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলছিল। জয় খেয়ালই করেনি, তিনি যেন কি আনমনে ভাবছিল। আলমের হাতের ধাক্কায় আর ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলেন।
এর পরে বন্ধুদের মুখে যা শুনতে পান, সেটা শুনে অবাক হয়ে থ বনে যান।
এমন কিছু তিনি করেননি, কিছু দেখেইনি সে। অথচ তার নামেই এমন ভয়ানক অভিযোগ?!
অবাক বিস্ময়ে তিনি খেয়াল করেন ছেলেটির সাথে ধবল চেহারার বাইশ পঁচিশ বছর বয়সী এক তরুণী দাঁড়িয়ে আছে।
জয় সাহেব অভিযোগের মাথা মুন্ডু কিছু না বুঝে অবাক বিস্ময়ে সহজ মনে তরুণীকে প্রশ্ন করেন- আমি কি করেছি?!
তরুণীটি চুপ থাকে।
জয় সাহেব আবারো সহজ মনে একই প্রশ্ন করেন। তরুণী এবার উত্তর দেয় জয় সাহেবকে উদ্দেশ্য করে –
আপনি আমাকে ‘পাপ্পি’ দিয়েছেন। জয় সাহেব এবার চেতনে আবুল হয়ে যান। তিনি চরম বিস্ময়ে বলেন – কি ?!
তরুণীটি বলেন– আপনি আমাকে হামি দিয়েছেন। জয় এবারো কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা জয়ের বন্ধু আলম বিস্ময়ের সাথে বলে জয় তুই তাঁকে ফ্লাইং কিস করেছিস, সেটা বলছে।
বিস্ময়ে কিছুটা হেসে ওঠেন জয়- হামি! পাপ্পি? আমি!!!
জয় বলে ওঠেন এই মেয়েকে আমি জীবনে মাত্রই দেখলাম। তাকে আমি পাপ্পি, হামি দিবো কোথা থেকে?!
পাশে থাকা বন্ধু আরিফুল, নাজমুল অবাক হয়ে যায়। তরুণীর সাথে থাকা তরুন রেগে-মেগে বলে আপনি স্যরি বলেন, না হলে খুবই খারাপ হবে। জয় চরম বিস্ময়ে বলে আমি কিছু করিইনি, স্যরি কেন বলবো?! আপনি কে ভাই? তরুন খুবই ভয়ানক ভঙ্গিতে বলেন আমি তাঁর হাসবেন্ড, আমি এসআই। পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা জয়ের বন্ধু জাহাঙ্গীরের পাল্টা প্রশ্ন করে আপনি কোন থানার এসআই? তরুণ উত্তর দেয় পল্লবী থানার। সঙ্গে সঙ্গে জাহাঙ্গীর পল্লবী থানার থাকা এসআই বন্ধুকে ফোন করে নিশ্চিত হয় এই তরুণ পল্লবী থানার কেউ নয়। এই শুনে সবাই নড়েচড়ে দাঁড়ায়। জয়ের বন্ধু আনোয়ার রেগে উঠে বলে জয় ভাই আপনি যেহেতু কিছু করেননি, স্যরি বলবেন না, দেখি সে কি করে। ওই তরুণ লোকটি তখন ৯৯৯ ফোন করে। এরই মধ্যে এলাকার জটলায় প্রায় দুইশত মানুষ হাজির। কিছুক্ষণের মধ্যে টহল পুলিশ চলে আসে। পুলিশ অফিসার ওই তরুণের পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন তিনি পুলিশ ট্রেনিং করেছেন। কোথাও জয়েন করেননি। তিনি পল্লবী থানার এসআই নন। সবাই হো হো হেসে ওঠে। পুলিশ অফিসার জয়ের পরিচয় জেনে নেন। এর পর পুরো ঘটনা জেনে নেন। এরই মধ্যে এলাকার বাসিন্দারা বলতে থাকে এরা এই এলাকার ছেলে, এদের নামে কোন বদনাম নাই, এরা ভালো ছেলে। এই ছেলেরা এই কাজ করতেই পারেনা।
এক দিকে হবু পুলিশের অভিযোগ অন্য দিকে জয় সাহেব ও তার বন্ধুদের অনড় অবস্থান, স্যরি বলবেন না, কারণ কাজটি জয় করেননি, অন্য দিকে এলাকার লোকদের সাপোর্টে পুলিশ পরলো কিছুটা বেকায়দায়।
পুলিশ অফিসার ইভটিজিংয়ের মামলার ভয় দেখায়, কোন জামিন হবে না, আরো গল্প ইত্যাদি ইত্যাদি।
জয়ের বন্ধু আলম হাল ছেড়ে দিয়ে বলল জয় অনেক হইছে, ঘটনা অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে, স্যরি বলে দে।
আনোয়ার বলছে না জয় ভাই আপনি স্যরি বলবেন না। কারণ আপনি কিছু করেননি।
জয় পানি খেয়ে মুখ পরিস্কার করে দুই পা সামনে এগিয়ে আনোয়ারের কথায় সম্মতি জানায় এবং পুলিশ অফিসার ও ঐ তরুণকে উদ্দেশ্য করে বলে- দেখেন আপনি আমাকে স্যরি বলতে বলেছিলেন প্রথমেই। আমি স্যরি বলে দিলে ব্যাপারটা এতো দূর গড়াতো না। পুলিশেরও ঘটনাস্থলে আসতে হতো না। আমি স্যরি বলছি না, কারণ কাজটি আমি করিনি। এবার বলেন আপনারা কি বলবেন? উপস্থিত এলাকাবাসীরাও জয়কে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছেন।
এবার পুলিশ অফিসার ঐ তরুণকে ডেকে নিয়ে আলাদা করে কিছুক্ষণ কথা বলে। এলাকার মানুষ তাঁদের উপর একটু বিরক্ত হতে শুরু করে। পুলিশ অফিসার সবার সামনে আসেন এবং বলেন—ভাইয়েরা যা হয়েছে সব বাদ। সবার পক্ষ থেকে পুলিশ স্যরি বলছে, আমি স্যরি বলছি, আপনারা যে যার কাজে যান। উপস্থিত সবাই হাতে তালি দিয়ে উল্লাস করতে শুরু করে। এরপরে পুলিশ চলে যায়। চলে যায় ওই তরুণ-তরুণীও।
এর পর এক সপ্তাহ কেটে যায়। জয় পরের সপ্তাহের ছুটির দিন শেষ বিকেলে ঘুম ঘুম চোখে উঠে খাটের পাশে বসতেই দেখতে পান কেউ একজন তাকে বোধ হয় উড়ন্ত চুমু দিয়েছেন। জয় চোখ বড় বড় করে তাকান। জয় খেয়াল করে ঘরে থাকা বড় আয়নায় নিজেকেই দেখেছে জয়।
আর মুখের আঁকাবাঁকা দাঁত সোজা করার জন্য যে ব্রেসেস পরিয়েছে ডেন্টিস্ট। তার সাথে একটা আলগা রিটাইনার পরানো হয়েছে। ওটাই জয় খুলেছে আর মনে হয়েছে ফ্লাইং কিস করেছে। জয় মুহূর্তে চলে যায় এক সপ্তাহ আগের ছুটির দিনের সন্ধ্যার চায়ের দোকানে। পাপ্পি, হামি ও উড়ন্ত চুমু- ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসি আর মনে মনে জয় ভাবে আমরা অনেক সময় নিজের চোখে যা দেখি, নিজের কানে যা শুনি সেটি সঠিক নাও হতে পারে। কিংবা যা ভাবি তাও সঠিক না হতে পারে। তবে সৎকাজ, সততা, জীবনবোধ ও আত্মবিশ্বাস, শুভাকাঙ্ক্ষী চিরবন্ধু হয়েই সাথে রয়।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!