গল্প: গিরগিটি

ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী
ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী
19 মিনিটে পড়ুন

(১)

খোলা জানালা। রাস্তা মুখো দরজাটাও। বাতাস ঢুকছে ঘরে। প্রাক বর্ষার ভারী বাতাস। বাতাসে আলসেমি। আদরের ছোঁয়া লাগছে মুখে। আরামে বুজে আসে চোখ। আলস্য জড়িয়ে ধরে শরীর। ঠাকুরদার আরাম কেদারায় ঘুম-ভাঙা শরীরটা ছেড়ে দিয়েছে নিতাই। মাঝে মাঝে চোখের বন্ধ পাতা মিটি মিটি খুলছে। ভোঁতা নজর গড়িয়ে যাচ্ছে দক্ষিণের খোলা জানালায়। ওপারে আলগা বৃষ্টি। ঘুম ভাঙা চোখে ঠাই বসে বসে দেখছিল নিতাই।

নিতাইয়ের ইদানিং এই বদ অভ্যাস। খোলা জানলায় চোখ রেখে বাইরেটা নজর করা। আর ঘরের দরজা জানলা হাট করে খুলে রাখা। বন্ধ ঘরে থাকলে নাকি হাঁপ ধরে যায়। বুকে কষ্ট হয়। এখন খোলা ঘরে কোন কষ্ট নেই। ঘর ভর্তি শুদ্ধ বাতাস। বড় একটা শ্বাস টেনে নির্মল বায়ু ভরে নিল বুকের খাঁচায়।
হঠাৎ বাইরে ঝম ঝম শব্দ। বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি আর এলোমেলো বাতাস। খোলা জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট ঘরে ঢুকছে। ভালই লাগছে নিতায়ের। ঘুম পাড়ানি শব্দ আর আর্দ্র বাতাস। চোখ বুজে আসে। খুব ভালো লাগছে নিতেয়ের। খুব ভালো।

তবে কত দিন যে ভাল লাগা থাকবে! ভাবছিল নিতাই। এ ঘরের ছাত চুইয়ে এখনও বৃষ্টির জল পড়েনি। অবশ্য বৃষ্টি তো সে ভাবে শুরুই হয়নি। আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি, কিন্তু ভাল বৃষ্টি ঝরেছে মাত্র দু-তিন দিন। এর মধ্যেই রান্না ঘরের ছাত থেকে টুপটাপ জল পড়েছে। বৃষ্টি বাড়লে এ-ঘরের ছাত দিয়েও ঝর ঝর জল ঝরবে। পাশের শোবার ঘরটা যত্ন পেলেও এখন বেহাল। পুরনো ছাতের মাথায় মিস্ত্রীকে দিয়ে পিচ চটের মোটা প্রলেপ লাগিয়ে ছিল নিতাই। কিন্তু গত শ্রাবণের তেরে ফুরে বৃষ্টি আটকানো যা্যনি। এবারের বিপদটা যে কী আকার নেবে! দক্ষিণ-মুখো জানালার দিকে তাকিয়ে ভাবছিল নিতাই।

ওদিক দিয়ে বসত বাড়ির বাগানের অর্ধেকটা নজরে আশে। পলক তাকাতেই চোখে পড়ল উঁচু ঘাস। বিছুটি ভ্যারেণ্ডা আর ভাঙা দেওয়ালে ভুঁইচাপার জঙ্গল। সবার মাথা ছাড়িয়ে টগর গাছটা বেয়াড়া রকম বেড়েছে। বৃষ্টি-ধোয়া ঝকঝকে সবুজ পাতা। ঝাঁকাল মাথা ভর্তি দোহারা ফুল। বাগানের কাদা-মাটিতে কয়েকটা ধবধবে সাদা ফুল নিতান্ত অবহেলায় পড়ে পড়ে ভিজছে।

টগরের পাশে একটা দশ-বছরের বড়সড় পঞ্চমুখী জবা গাছ। এ বছর ঝাঁপিয়ে এসেছে গাছ ভর্তি টকটকে ফুল। ফুল দেখতে দেখতে উপরের বড় একটা ডালে চোখ আঁটকে গেল নিতাই পাত্রর। ঘাড়টা একটু সোজা করে ড্যাবড্যাবে চোখে ভাল করে দেখল।

একটা গিরগিটি। খয়েরি লম্বা ল্যাজ। সবুজ পাতার আবডালে ঘাপটি মেরে বসে আছে। ফুল-পাতা-কান্ডের সাথে মিশে যাওয়া শরীর। সহজে বঝা যায় না। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে হয়। বোঝা যায়। ঘন ঘন রং বদল করছে। মুখ আর ঘাড়ের কাছটা এই হাল্কা সবুজ, পরক্ষনেই ধূসর। একটু পরেই লালচে সরু ঘাড় আবার সবুজ। পিঠের দিকে এ-মুহূর্তেই বেগুন রং আবার চোখের পলকেই খয়েরি, তারপর বাদামি। সতর্ক সরীসৃপ। বুদ্ধিমান প্রাণী। এত ঘন ঘন রং পাল্টায় কেন এরা? ভাবছিল নিতাই।

প্রাণীকুল কারণ বিনা তো কিছু করেনা। ভাবছিল নিতাই। দিঘির জলে কাতলা মাছ ঘাই মাড়ে, একটু বেশী বাতাস টানবে বলে। ঘন বর্ষার নির্জন আলপথ। পায়ের আওয়াজ পেলেই ফস করে ফনা তোলে গোখরো। সেটা ভয় খায় বলেই। তেমনি বাঁচার প্রয়োজনে গিরগিটিও রং পাল্টায়। আবার রং বদল করতে জানে, তাই খপাত করে শিকারও ধরতে পারে। বুদ্ধিমান প্রানী বটে!

লিকলিকে ক্ষিপ্র গিরগিটি। গুটিসুটি মেরে কয়েক পা এগিয়ে ঘণ পাতার আড়ালে হারিয়ে গেল। কেন, নিতাই জানে। অভিজ্ঞতার আঁচে পোক্ত নিতাই পাত্র। ও জানে, রং বদলানো সরীসৃপ এবার শিকার ধরবে। লম্বা জিভ বের করে ঝট করে কোন পোকা জাপটে মুখের ভিতর চালান করবে।

তখন ছোটবেলা। গিরগিটিকে খুব ভয় পেত। ভয় আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল ওর মা। বাগানে গিরগিটি দেখলে রান্না ফেলে এক দৌড়ে নিতাইকে কোলে তুলে নিত। বলত, ‘ওগুলান রক্তচোষা কাঁকলাস, তাকাবিনে ওদিক।’ তারপর হলুদ-মাখা হাতের তালুর আড়ালে ঢেকে দিত ছেলের দু-চোখ। দাদু আবার অন্য রকম বলত, ‘গাছের গিরগিটিকে এত ভয়, মানুষ গিরগিটি দেখলে কি করবি?’
ভয় কাটেনি নিতায়ের। যুবক বয়সেও গিরগিটির দিকে তাকাতো না। ওর জওয়ান বাবা মাঝে মাঝে বলত, ‘মনের মধ্যে ভয় পুষলে বাঁচতে পারবি?’

এখন বৃদ্ধ বয়স। নড়বরে শরীর। নজর খাটো। চোখে দূর থেকে গিরগিটি দ্যাখে নিতাই। তেমন ভয় পায় না, তবে দেখলে গা-টা অবশ্য একটু শিরশির করে। গায়ে হাল্কা শিরশিরানি নিয়ে নিতাই দেখতে পেল গিরগিটিটা। ঘাড় আর চোখের নিচে কুঁচকানো চামড়া। এ মুহূর্তে বেশ লাল। গাছের ডালের সাথে মিশে আছে খয়েরি সবুজ লেজ। তাকিয়ে থাকলে চোখে ঘোর লেগে যায়।

ঘোর কেটে গেল নিতায়ের। শোবার ঘর থেকে ভেসে আসছে হাল্কা আওয়াজ। সিংহাসনে নিদ্রিত কৃষ্ণ-গোপালের ঘুম ভাঙাচ্ছে কমলা। খয়েরি-পাড় শাড়ী পেঁচিয়ে নাম-গান গাইতে গাইতে ঠাকুরের মুখে তুলসি পাতা আর দুধ-সাদা দুটো বাতাসা ছুঁইয়ে দেবে। চোখ উল্টে লম্বা প্রণাম সারবে। তারপর রান্না ঘর। সসপ্যানে দুধ-জল-চা পাতা মিশিয়ে অনেকক্ষণ ফোটাবে। ময়নার বিয়ের পর থেকে ছ’বছর নিয়মের ব্যত্যয় হয়নি।

আজও ঠিক সময়ে বাইরের ঘরে ঢুকল কমলা। প্লাস্টিক ট্রেতে দু’কাপ চা, সঙ্গে শুকনো মুড়ি ভর্তি কাঁসার বাটি। প্লাস্টিকের ফাঁকা চেয়ারে ধপাস করে বসে শাড়ীর আঁচলে মুখের ঘাম মুছল কমলা। একটু দম নিয়ে বলল ’গোপীনাথ আসবে বলেছিল। কাল সন্ধ্যাবেলা আমতলার মাঠে কীর্তনের আসরে দেখা। রাত্রিতে তোমার হাঁপের টান উঠেছিল, তাই কিছু বলিনি। কেন আসবে বলেনি কিন্তু। তুমি কিছু জান?’
মেজাজটা একটু বিগড়ালো নিতাইয়ের। অলস সকালে গিরগিটি দেখতে আর ভাবতে ভালো লাগছিল ওর। ঠাকুরদা বলতেন, ‘যত দেখবি, ভাববি তত জানবি’। চাষবাস, বিষয় আশয় নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও ঘোর সংসারী মানুষটা এদিক-ওদিক থেকে জোগার করে বইপত্র পড়তেন। একেবারে বুড়ো–অথর্ব হয়ে পড়লে বড় বিছানাটায় শুয়ে বসে শুধু ভাবতেন। মাঝে মাঝে এই আরাম কেদারায় বসে বাড়ীময় ম-ম গন্ধ ছড়িয়ে গুরুক গুরুক তামাক খেতেন। দাদুর কথাটা অক্ষরে অক্ষরে ঠিক। ভাবলে আর দেখলে সত্যিই জ্ঞান আসে, বুদ্ধি খুলে যায়।

এজন্যই সকালে হাঁপের টান ভুলতে চেষ্টা করে নিতাই। ঘরের খোলা হাওয়ায় কোন একটা বিষয় নিয়ে ভাবে নিতাই। আজকেও গিরগিটির রং বদল দেখছিল আর ভাবছিল। ভাবনার রেশটা না-কাটতেই কমলার প্রশ্নে মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে গেল। ওর দিকে ফিরে বলল, ‘জানার কী আছে? গোপীনাথ আসবে মানে বড় একটা খসাবে। মিটিং-মিছিল-রক্তদান-জগদ্ধাত্রী-বাসন্তী-লক্ষী, চাইবার কারন কি কম?’।
একটু চুপ থেকে আকবার, ‘যা চাইবে যতটা চাইবে, ততটাই নিয়ে যাবে গোপীনাথ। ওর বাপের মত নিরীহ আর ভালো মানুষ তো নয়।’

গাল ভর্তি মুড়ি চিবিয়ে চায়ে বড় একটা চুমুক দিল কমলা। বলল, ‘গোপীনাথ টাকা চায় ঠিকই কিন্তু উপকারও তো করে! জমিটা বিক্রী করতে কম ঝামেলা হচ্ছিল!’
একটু থামল কমলা। তারপর চায়ের কাপটা মাটিতে নামিয়ে রেখে বলল, বিক্রী না-হলে ঝুনুর বিয়েটাই তো আটকে যেতো! গোপীনাথ একা হাতে সব সামল দিল। রেজিস্টারি আফিসেও কত খাতির ওর! সেদিন ও না এলে কী যে হত!’
–যা জানোনা তা নিয়ে বক বক করোনা। আমার কাছ থেকেও খেল আবার পানুবাবু, যে কিনল, তাকেও খসাতে হল। দু-পকেট ভড়ল গোপীনাথের। অবশ্য বিক্রিটা হল বলে সম্বন্ধটা আসতেই ঝুনুর বিয়েটা চুকিয়ে দিতে পারলাম। চাকুরিয়া পাত্র। জামাই বাবাজী আবার পণ নেয়নি, হাতেও টাকা-পয়সা কিছু থাকলো।
-পরেরটা বল। তোমারও কি লাভ হয়নি কিছু?
চায়ে শেষ চুমুকটা দিল নিতাই। বলল, ‘আমি তো স্বীকার করি। তোমার বুদ্ধিতে ব্যাঙ্কে রাখলাম না ঐ টাকা। ঝপাত করে গোপীনাথের ‘রামধনু’ আবাসনে ঢুকিয়ে দিলাম।
বাটির শেষ কটা মুড়ি মুখে পুরে কমলা বলল, ‘দু-কামরার দক্ষিণ-পূর্ব খোলা ফ্ল্যাট গো। কল খুললেই জল। ভদ্দর লোকের মত একটু বাঁচতে পারব।’
বড় একটা শ্বাস টানলো নিতাই। হাঁপের টান একটু কমে এলে ধীরে ধীরে পুরনো কথাই বলল, ‘বয়স হল, চাস-বাস আর আর পোষায় না। ঢালি পাড়ার ঐ এক চিলতে পটল ক্ষেত। ভোর বেলা ফুল ছোঁয়ানো… আর মন করেনা।’
-ঠিকই বলেছ’, কমলা বলল।
-একটুতে আজকাল টান উঠে যায়। তোমারও তো ভারী শরীর। নড়বড়ে হাঁটু। এ-বয়সে চাষের কাজকাম! বাপ-ঠাকুরদার জমিতে হাল মেরে জন খাটিয়ে এত দিন তো চালালাম। জমি বিক্রি করে করে দু’বোন, দু’মেয়ের বিয়েও দিলাম। এখন সম্পত্তি শেষ। শুধু ঠাকুরদার এই বসত ভিটা আর ঢালি পাড়ার পটল-ক্ষেত।’
একটু থামল নিতাই। বৃষ্টিও থেমেছে তখন। বাইরে একবার তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলল, ‘ঝুনুর নামে বসত ভিটা আর ময়নার নামে ঢালি পাড়ার জমিটা। সব লিখে দিব। তারপর নতুন ফ্ল্যাটে বাকি দিনগুলো কাটাবো…।’
হঠাৎ কথা থেমে গেল নিতায়ের। দরজার বাইরে মোটর সাইকেলের কান-ফাটানো হর্ন। খোলা দরজা দিয়ে গট গট করে ঘরে এসে ঢুকলো গোপীনাথ। হাসি মুখ, ঝকঝকে দাঁত। গোপীনাথের সাদা জামা, সাদা প্যান্ট, সাদা জুতো। ঝকঝকে কামানো দাড়ি, নিখুঁত ছাঁটাই গোঁফ। ধারালো চোখ। গলায় দু’ভরি সোনার চেন। ডান কব্জীতে লাল সুতো, হাতের আংটিতে হিরের ঝিলিক। গোপীনাথের ধবধবে সাদা মোটর সাইকেল। দুধ-সাদা পোশাকে গ্রামের রাস্তায় কান-ফাটানো আওয়াজ তুলে রাজকাজে যায় গোপীনাথ।
মেলা কাজ ওর। দল মজবুত রাখা। এলাকার এক ডজন উঠতি ছেলের রুটি-রুজি-কামাইয়ের ব্যবস্থা করা। নিজের প্রমোটারি আবার সাতাশ কাঠা শালি জমিতে মন্ত্রীর বেনামী ‘কৃষ্ণকুঞ্জ’ আবাসনের দেখভাল। একা হাতে জবরদস্ত কায়দায় রাজত্ব সামলায় গোপীনাথ।
গোপীনাথকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো কমলা আর চেয়ারে বসে নিতাইয়ের চোখে চোখ রাখল গোপিনাথ, ‘কালই তো বড় মিটিং। মন্ত্রী আসবেন গ্রামে। আপনারা যাবেন, বক্তৃতা শুনবেন। সবইতো বুঝতে পারছেন কাকা। এবার একটু বেশী চাঁদা দিতে হবে। সামনেই ভোট। আমাদের সময় খুব খারাপ যাচ্ছে এখন।’
-একশ টাকা নাও।
-কী বলেন কাকা! হাজার টাকার নীচে নামবই না। পটল বিক্রীর তো ভালো লাভ হয়েছে এবার।
-হাজার টাকা চাঁদা? অসম্ভব কথা বলছ তুমি। সারা মাস খাবো কি?
-খাবার ব্যাপারটা আমি দেখবো। ক-মাস পরে তো নতুন ফ্ল্যাটে চলে যাবেন। খরচাপাতি অনেক কমে যাবে।
-বাবা গোপীনাথ, পূজার পর ফ্ল্যাটটা পাবো তো?
-কাকা, একদম পাক্কা। আজ অবধি কথার খেলাপ করেছি?
একশো টাকার দশটা নোট ডান পকেটে গুঁজে চলে গেল গোপীনাথ। মোটর সাইকেলে গম্ভীর ডিক ডিক আওয়াজ তুলে গোপীনাথ মিলিয়ে যেতেই ঘরের দরজা বন্ধ করে কমলা ফুঁসে উঠল, ‘অত গুলো টাকা তুমি দিয়ে দিলে! ঘরে নুন-তেলে টান পড়ছে তুমি জানো না?’
-জানি, সবই জানি। এদের সাথে ঝগড়া করে কি মরব? জলে বাস আর কুমির চটাবো?’ নিতাইয়ের অসহায় কণ্ঠস্বর।
চেয়ারে বসে প্রথমে একটু ইনিয়েবিনিয়ে কাঁদল কমলা তারপর একে বারে হাউ-হাউ করে। চোখের সব জল ঝরে এলে নিচু গলায় বলল, ‘আমি শুনেছি গোপীনাথ হুমকি দিয়ে টাকা তোলে। ও নাকি বড় তোলাবাজ। মোহনের দোকানে গত মাসে জোর করে অনেক টাকা নিয়েছে। প্রথমে দিতে চায়নি মোহন। পরে দিয়েছে। বাজারের মধ্যে ওর মনিহারি দোকানের সামনে চড়-থাপ্পড় খেয়ে ঘাবরে গিয়ে ছিল ও। মোহনের পোয়াতি বউ কাঁদতে কাঁদতে সব বলেছে আমাকে।’
কমলার কথা গুলো শুনল নিতাই। গম্ভীর মুখ। গভীর একটা শ্বাস টেনে বলল, ‘যতটা সহ্য করা যায়, কর। আমার ফ্ল্যাটের দামটাও বেশী নিয়েছে। নানা ছুতো নাতায় টাকা নিয়েছে।’
‘আমরা কিছু করতে পারি না? যখন তখন চাঁদা, জুলুম। দেশে পুলিস টুলিস নাই?’ কমলার বুক ঠেলে কথাগুলো বেড়িয়ে এল।
-আছে। সব আছে। তবে সবের উপর আছে পার্টি, দল। এবার তো গোপীনাথের উল্টো দলেরও অনেক তাকত। মধুসূদনের লোকজন কাজ করছে চুপচাপ। মধুসূদন সৎ ছেল। ওর বাবা পটাশপুরের কৃষ্ণমোহন। রাধাকৃষ্ণের নিত্য ভোগ হত ওদের বাড়ী। মাত্র তিন দিনের কাঁপুনি জ্বরে পট করে মরে গেল লোকটা। ঝুনুর যে বছর বিয়ে হল গো! অবশ্য বয়সও হয়েছিল। মধূসুদনের সাথে আমি দেখা করেছি। কাউকে ব’লো না। ভোটে ওকে একবার জিততে দাও, ফ্লাটটা হাতে পাই। তারপর গোপীনাথের কী অবস্থা হয় দেখবে।’
–বড় অশান্তি গো। মনে একটা কু-ডাক ডাকছে। গোপীনাথের হাতেই তাইলে আমাদের ভাগ্য ঝুলছে।
কমলার কথা শেষ হতেই গোপীনাথ পৌঁছে গেল তে-মাথা মোড়ের পেল্লাই পার্টি অফিসে। পার্টি অফিসের ছাতে অনেক উঁচুতে তাল গাছের মাথা ছাড়িয়ে পতপত করে দলের পতাকা ওড়ে। দক্ষিণ দিকে কুলি পাড়ার বিধবা-বৌ গুলো পালা করে কাঁদ। দলের নিশানা দেখতে দেখতে পিচিক করে পানের পিক ফেলে বলে, ‘ওটা পাটির অফিচ? ওটা তো কশাই-খানা।’

(২)

রাত্রি। খেতে বসেছে ওরা। ভাত, সঙ্গে বিউলির ডাল আর পটল ভাজা। টিভিতে খবর দেখাচ্ছিল তখন। উত্তর বাংলায় জোর বর্ষা নেমেছে। বিপদ সীমার ছাড়িয়ে প্রবল গর্জনে দাপাচ্ছে নদী গুলো। দক্ষিণ বাংলায় জলের অভাবে লাটে উঠছে চাষবাস। বিরোধীদের প্রবল চাপে সারের দামে ভর্তুকি দেবার কথা বিবেচনা করছে সরকার।
শেষ খবরটা শুনে মনটা একটু উরু-উরু করছিল নিতাইয়ের। কমলার পিঠে হাত রেখে বলল, ‘সত্যি জনদরদী পার্টি। মানুষের কথা এরাই ভাবে। দলের ছেলেগুলো যা খাটছে না!’
কথাটা শেষ করে কাঁচা লঙ্কায় একটা ছোট কামড় বসাল নিতাই। ঠিক তখন দরজায় টোকা। খুলতেই ঝুনুর শ্বশুর মনোরঞ্জন। হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢুকে ধপ করে বসে পড়ল। একটু থেমে বলল, ‘নিজের চোখে সব দেখলাম ভায়া। তোমাকে না বলে শান্তি নাই। তাই চলে এলাম।’
ভাতের থালা সামনে রেখেই কথা শুনতে বসল নিতাই-কমলা। শুরু করল মনোরঞ্জন, ‘ফুটবল মাঠে জমাটি মিটিং ভাঙল। তারপর মন্ত্রীকে বড় রাস্তায় বিদায় জানিয়ে গ্রামে ঢুকছিল গোপীনাথ। রাত ন’টা হবে। সাইকেল ঠেঙিয়ে আমি ঘরের পথে। বাঁশুলি তলার মোড়ে পচাইের দলবল চোখের নিমেষে ঘিরে ধরল গোপীনাথকে। বাঁশ ঝাড়ের কাছটা আবছা অন্ধকার। ভাঙাচোরা রাস্তায় যেই গোপীনাথ বাইকটায় ব্রেক কষল ওমনি দশ-বারোটা জওয়ান মর্দ ভূতের মত হাওয়ায় উড়ে এসে ওকে গোল করে ঘিরে নিলো।’
-তারপর তারপর?’ খাওয়া শেষ করে কমলা জানতে চাইল।
-যারা ঘিরে নিল, সবাই মধুসূদনের দলের ছেলে। ক্লাব ঘরের চোয়ানো আলোয় পরিস্কার দেখেলাম। গোপীনাথ কোমরের পিস্তলটা বাগিয়ে ধরবার আগেই পচাই ডাণ্ডা ঝাড়ল। দুড়ুম করে কাটা পাঁঠার মত মাটিতে আছড়ে পড়ল গোপীনাথ। তারপর আরও কয়েকটা লাঠির বাড়ি। ছটফট করতে লাগল গোপীনাথ। মুখে গ্যাঁজলা উঠছে। তাগড়া শরীটায় উঠে দাঁড়াবার বল নাই। একটু পরে মর মর গোপীনাথকে একটা লাশের মত উঠিয়ে নিয়ে গেল থানার টহলদারী জিপ গাড়িটা। তোমাকে জানিয়ে গেলাম সব। ও মরে গেলে তোমার ফ্ল্যাট পাবার আশা তো বিশ বাঁও জলে ভায়া।’


(৩)

আকাশ বহুরূপী। কখনো মেঘ দুমদাম বৃষ্টি পরক্ষনেই গনগনে রোদ। গতকাল আকাশ ফর্সা ছিল অনেকক্ষণ। ছাতা হাতে নিয়ে ফ্লাট তৈরি দেখে এসেছে নিতাই। আজ খুশির মেজাজ। উৎসব আর আনন্দের দোলা লেগেছে গ্রামে। আগের দলকে গো-হারা হারিয়ে বিরোধী দল ক্ষমতায় এল। খুশির আবহে চা খেতে খেতে নতুন ফ্লাটে ঢুকবার আলোচনায় ডুবে ছিল নিতাই-কমলা।
হঠাৎ ঢিকি ঢিকি আওয়াজ। বাড়ীর সামনে ইটের রাস্তায় গোপীনাথের সাদা মোটর সাইকেল। খোলা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকল গোপীনাথ। সাদা জামা, সাদা প্যান্ট, সাদা জুতো। ঝকঝকে কামানো দাড়ি, নিখুঁত ছাঁটাই গোঁফ। ধারালো চোখ। গলায় দু’ভরি সোনার চেন। ডান কব্জীতে লাল সুতো, হাতের আংটিতে হিরের ঝিলিক।
কলকাতার দামী নার্সিংহমে চিকিৎসা করিয়ে গোপীনাথ আবার আগের মত। আগের মতই নিতাইয়ের চোখে চোখ রেখে বলল, ‘কাকা ফ্লাটটা আপনাকে দিতে পারবো না।’
নিতাইয়ের বুকে হঠাৎ নবমীর ধরাস ধরাস ঢাক আর একশ কাঁসি বাজলো। ঢাকের শব্দে বুকটা বোধ হয় ফেটে যাবে। গলা শুকিয়ে কাঠ, পা কাঁপছে ঠক ঠক, শিরদাঁড়ায় ঠাণ্ডা স্রোত। জানালার দুটো শিক ধরে কোন মতে শরীরটা সামাল দিল। নইলে মেঝেতে আছাড় খেয়ে মৃগী রুগীর গোঙানি বের হত।
ঠাকুরদার আরাম কেদারায় কিছুক্ষন থম মেরে বসে থাকল নিতাই। তারপর মুখ তুলে গোপীনাথের চোখের দিকে তাকাল। বলল, ‘কেন দিতে পারবে না? ফ্ল্যাটতো তৈরী আছে দেখলাম!’
গোপীনাথের হাসি মুখ। নিতাই বলে চলেছে, ‘অর্ধেক দাম দিয়ে পাঁচ বছর আগে বুক করলাম। তারপরে আবার লেখাপড়া করে সিকি ভাগ দিলাম। বিদ্যুতের খুঁটি বসবে বলে আবার অনেকগুলো টাকা নিলে। আর এখন বলছ ফ্ল্যাট দিতে পারবে না! পয়সার অভাবে এ বাড়ীও সারাতে পারিনি, এখন খাবারেও টান…।’
-আমি জানি কাকা।’ গোপীনাথের গম্ভীর স্বর। চেয়ারে বসে পা নাচাল, ‘আমি কিন্তু ফ্ল্যাট দিতে পারব না। কাউকেই দেব না।’। ভারী গলা গোপীনাথের। ‘জানেন, মধুসুদন দাদাকে দুটো ফ্ল্যাট দিতে হবে! অন্য দাবীদারও আছে। মধুদা বাঁচালেন বলে আপনাদের সেবা করতে পারছি। আপনি চিন্তা করবেন না…। এ বাড়ীতেই ফ্ল্যাট বানিয়ে আপনাকে দেব।’
নিতাইয়ের চোখে হঠাৎ অঝোর ধারায় বৃষ্টি। উৎকণ্ঠায় বাকরুদ্ধ। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘আমরা থাকবো কোথায়?’
-কেন, আপনার পটল বাগানে। অত সুন্দর ডাঙা! চক জমি। পটল বুনে কেউ নষ্ট করে।’ শান দেওয়া গলায় চট জলদি জবাব দিয়ে গোপীনাথ উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘হাতে অনেক কাজ কাকা।’
কমলা পিঠ বেঁকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। হাঁপের সাঁই সাঁই টান উঠেছে নিতাইয়ের। বড্ড ধরফর করছে বুক। খোলা জানলা দিয়ে বাগানের দিকে চোখ সরলো নিতাইয়ের। জবা গাছটায় সবুজ পাতার আড়ালে নিশ্চল গিরগিটি।
গিরগিটির কালচে রঙ এখন লাল। একটু পরেই আবার সবুজ। বাঁচবে বলে কত রঙ পাল্টায়! প্রানীটাকে লোকে ভয় খায়। ঘেন্নায় মারতেও যায়না কেও। মরা কুকুর-বিড়াল-টিকটিকি চোখে পড়ে। কিন্তু মরা গিরগিটি? এত বয়সেও নিতাই দ্যাখেনি। গিরগিটি কি অমর? কাঁকলাস কি সত্যিই রক্তচোষা? ভাবতে ভাবতে কাশি উঠল নিতাইয়ের। জানালার বাইরে এক রাশ থুথু ফেললো। কান্না জড়ানো গলায় কমলার অসহায় আর্তনাদ, ‘রক্তচোষা গুলো মরেনা কেন, বলতো?’ জানালার বাইরে চোখ নিতায়ের। বলল, ‘মরবে কেন? রক্তচোষা কাঁকলাসগুলো…,শালা অমর। রক্তবীজের ঝাড়। রঙ পালটে পাল্টে বেঁচে থাকে ওরা।’
এ বার প্রতিবাদে ফুঁসে উঠল কমলা, ‘দেশে কি আইন আদালত নাই?’
নিতায়ের বুক ঠেলে বেরিয়ে এল গভীর দীর্ঘশ্বাস। সঙ্গে স্বগতোক্তি, ‘থানা পুলিশ আইন থাকলে কি হবে। আমার কথা শুনলে থানাবাবুর পেট ভরবে?’
হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে কমলার বিলাপ, ‘পাপ পুন্য কিছু নাই? হে ঠাকুর, হে জনার্দন সব নেতাই শুধু নিরিহ মানুষগুলোকে চুষবে?’

(৪)

গোপীনাথের সাদা মোটর সাইকেলের ধকধক আওয়াজ মন্দিরতলা মোড়ে নোতুন দলের অফিসে এসে থেমেছে। গাম্ভীর্য পূর্ণ সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। দলের জাতীয় সম্পাদক উপস্থিত। আদি আর নব কর্মী সম্মেলন। গোপীনাথকে মোটা গাঁদা ফুলের মালা পরিয়ে ভিতরে ঢোকাল আদিপন্থী গদাই হারু হাত-কাটা মঙ্গল। পচাই আসেনি। ওকে বেআইনি অস্ত্র রাখার অপরাধে রাজ্য পুলিশ খুঁজছে।

অফিসের তিন তলার ছাতে পতপত করে উড়ছে নতূন পতাকা। বড় দলের রঙিন নিশান। তখন লাল ফুল ভর্তি পঞ্চমুখী জবা গাছে ঘন সবুজ পাতার আড়ালে দ্রুত রঙ পাল্টে খপাত করে একটা গঙ্গা-ফড়িং ধরল গিরগিটি। বহুরূপী কাঁকলাসের লকলকে জিভে বাঁধা পড়ে প্রাণ বাঁচানোর প্রবল তাগিদে ছটফট করছে পোকাটা। প্রবল প্রতিপক্ষের পরিকল্পিত ঝটিকা আক্রমণে ধরাশায়ী ফরিঙ। রক্ত চোষার মুখের ভিতর ক্রমাগত পিষ্ট নিরীহ পোকাটার বাঁচবার আর কোন পথ নেই। অসম যুদ্ধে পর্যুদস্ত দুর্বল শিকার।
ফরফর আওয়াজ করছে পোকাটা। পতঙ্গের নিশ্চিত মৃত্যু দেখতে দাঁড়িয়ে রইল অশ্রু সজল নিতাই।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
ড.সৌমিত্র কুমার চৌধুরী, ভূতপূর্ব বিভাগীয় প্রধান ও এমেরিটাস মেডিক্যাল স্যায়েন্টিস্ট, চিত্তরঞ্জন জাতীয় কর্কট রোগ গবেষণা সংস্থাণ, কলকাতা-700 026. প্রকাশিত গ্রন্থ- বিজ্ঞানের জানা অজানা (কিশোর উপযোগী বিজ্ঞান), আমার বাগান (গল্পগ্রন্থ), এবং বিদেশী সংস্থায় গবেষণা গ্রন্থ: Anticancer Drugs-Nature synthesis and cell (Intech)। পুরষ্কার সমূহ: ‘যোগমায়া স্মৃতি পুরস্কার’ (২০১৫), জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকায় বছরের শ্রেষ্ঠ রচনার জন্য। ‘চৌরঙ্গী নাথ’ পুরস্কার (২০১৮), শৈব ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত উপন্যাসের জন্য। গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরষ্কার (2019), পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও জৈবপ্রযুক্তি দফতর থেকে), পঁচিশ বছরের অধিক কাল বাংলা ভাষায় জনপ্রিয় বিজ্ঞান রচনার জন্য)।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!