রাস্তা

মুর্শিদ এ এম
মুর্শিদ এ এম
7 মিনিটে পড়ুন
লেখক মুর্শিদ এ এম

রাস্তাকে কি পথ বলা সংগত? পথ মানে দিশা, রাস্তা দিয়ে সে-ব্যঞ্জনার কতটুকু ধরা যায়। তবে সে-এক রাস্তাই। কিংবা আদিগন্ত শুয়ে থাকা এক ভার্জিন ভূখণ্ড। আমরা ওপরের দিকে উঠছি। পাহাড় চূড়ায় উঠছি। তখনই সহিস বলল সে কথা।
ভ্রামণিক আমরা, কতিপয় সাধারণ মানুষের মতো চেখে দেখতে চাইছি এই ভূস্বর্গের স্বাদ। সঙ্গে পাঁচ ঘোড়া, ঘোড়ার সহিস। কতদিনের না-কাচা বাদামি আলখাল্লা, চুলে তেল পড়েনি কতকাল। শরীরময় ধ্বস্ত চিনার পাতার কারুকাজ। চোয়ালের দু-পাশে রোদের তীব্র প্রহারের দাগ। অথচ অসম্ভব উজ্জ্বল দুটি আয়ত চোখ।
আমাদের শিশুটি তার মাকে জড়িয়ে ধরে ঘোড়ার পিঠে থাকতে পারছে না। তার একার জন্যে একটা আলাদা ঘোড়া নিলে আঠারোশো টাকা। তা বড়ো কথা নয়, একা চারবছরের বাচ্চা অশ্বের পিঠে নিজেকে রাখবে কীভাবে! অগত্যা হাঁকডাক। সমতলের সহিসদের পাংশু চোখ তখনও এদিকেই। ঘোড়ার ঘেমে যাওয়া লাগাম হাতে। যেন জানেই আমাদের প্রয়োজন হতে পারে। এক কিশোর সহিস, এক হাতে ঘোড়া, উঠে এল। পিঠে বাঁধল শিশুকে। এভাবে চড়াইয়ে। সেখানে পথ নেই, ছিল রাস্তাই। সমস্ত ভূখণ্ড জুড়ে অজস্র মোলায়েম ঘাসের রাস্তা। ছেলেটি পথ তৈরি করে চলেছে—পেছনে আকাশের সুনীল আরাম কেদারায় হেলান দেয়া ধবল পর্বতশ্রেণি। নিবিড় আর মৌন। রোদ্দুরের আদর পেয়ে তার সারা শরীর রঙ ছড়িয়ে ডাকে। সে-ডাক উপেক্ষা করার মতো মনের জোর নেই আমাদের। কিন্তু সাড়া দিতে গেলে ততোধিক সবলতা চাই মনের। দেহেরও। দৃশের অন্তরালে চলে যাচ্ছে কখনো বা সেই শিশুবাহক। যেন হারিয়ে ফেলবে। আমাদের উদবিগ্ন প্রাণ নুয়ে আসে তার ভেসে ওঠায়। ক্রমে অনেক ওপরে, যেন ছুঁয়ে ফেলা যাবে প্রকৃতির সেই ধবল মাখনের চাদর—আমরা মিলিত হলাম নতুন এক রাস্তায়। মনে হল আগে কেউ সে-রাস্তায় হাঁটেনি। কেউ অনুসন্ধান করেনি সম্ভাব্য পরিণামের কথা। পেরেছি আমরা ক-জন। পেরেছে নির্ভীক কিশোর সহিস। তবে দূরে সে-রাস্তার দু-পাশে নেমে যাওয়া ঢালে চরে বেড়ায় অগুনতি ভেড়া। পেছনে ভেড়াপালক। হাতে অদ্ভুত এক বাঁশি। ভেড়ার মধ্যে কোনো অতিবাস্তববাদী যদি রাস্তা ভোলে, তখন ফুঁ দেয় বাঁশিতে। ভেড়াটি ফিরে আসে চারণভূমির নিজস্ব রাস্তায়। মিলিত হয় দলবদ্ধ পশুদের সঙ্গে। হয়তো সেখানে বান্ধবমনস্ক কেউ নেই। প্রেম-পীরিতের ভয়ানক টানাপোড়েন, মনুষ্যষ্যসমাজের মতো, তবু থাকতে হয়ই—ভেড়াপালকের ইশারাই যেখানে শেষ কথা। ইশারা বাঁশি আর লাঠি। যখন যেটি প্রয়োগ করতে হয়। মেষপালক সম্যক শিখেছে, বিশ্বাস করাতে পেরেছে অনুগামীদের। তবু সে বিষণ্ণ নয়। নিরাকার এক মহিমায় উদ্ভাসিত । ভারি মানানসই এই চরাচরের ভূমে।
ভেড়াপালক বলে, পশু বা মানুষ–ফিরে যাওয়ার রাস্তা নির্দিষ্ট। সেটাই কি পথ? বলতে চেয়েছিল পালক? আমাদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রাস্তার মানুষের মতো অবয়ব তাকিয়ে দেখছিলেন ঈশ্বর। কেননা সেখানে কোনো মানুষের দৃষ্টি হানা সম্ভব নয়। আর দেখছিল কতিপয় অবোধ অশ্ব এবং তাদের পালক।
সেই কিশোর সহসা ভাঙা ভাঙা শব্দে জিজ্ঞেস করে, তোমরা বাংলায় থাকো, কলকাতায়?
— হ্যাঁ, কেন?
— আমার ইচ্ছে করে জানো। এই দুর্গম রাস্তা ছেড়ে তোমাদের মসৃণ কলকাতা মহানগরীর রাস্তায় ঘুরে বেড়াই। এখানে বড্ড কষ্ট! খাওয়া পরা। সারাদিনে এই জন্তুর সঙ্গে আমরাও যেন একেকটি অশ্ব, অশ্বেতর…রাত হলেই গুলির শব্দ। যখন-তখন বন্দুক তাক করে আমাদের। রাস্তায় দিন কাটে। সকালে পড়ে থাকে লাশ, এলোমেলো রক্ত। নিয়ে যাবে কলকাতায়?
চোখ ফিরিয়ে নিতে হয় অসম্ভব কাব্যিক ধবল শিখর থেকে। যেখানে কোনো পথ নেই আপাতত। আমাদের রাস্তার চারধারে গুলিগোলার ক্ষতচিহ্ন। বিশৃঙ্খল নকশায় ছড়ানো লাশের জন্যে সুশৃঙ্খল জওয়ানদের রুট মার্চ। সকালে সন্ধ্যায়। ঈশ্বরের অনুশাসনের মতো চাপ, কটা জঙ্গি ধরা পড়ল? ধরা তো দেবেই না। সুতরাং দেহ হলেই কার্যসিদ্ধি। মৃত কোনো দিন বলে যায় না, সে জঙ্গি না সাধারণ নাগরিক। গোলাগুলির করিশমা কবে যেন দেখেছিল এই লাশেরা যখন কথা বিনিময় করত, ভালোবাসার কথা বলত হয়তো—সে এক শবেবরাতে। চাঁদ দেখার আনন্দে চাঁদরাতে, প্রেমিকার থরো থরো মেহেদি হাত আর দোপাট্টার নিবিড় সুবাসে। ইদ উল ফিতরে। কিংবা পশতু সংগীত সহযোগে বিবাহ আসরে। ভীষণরকম আতসবাজির উল্লাসে।
ডাললেক নিথর জলাশয় শুধু। শ্যাওলা বর্জ্য নোংরা অধ্যুষিত। অতলে কথা জাগে না। ‘কাশ্মীর কি কলি’-র মধুমাখা সংগীত সহস্র প্রাণপাতে মেলতে চায় না ডানা। শিকারার শরীরে ছিন্ন পোশাক, সজ্জা, যুবতীচিহ্ন নিভু নিভু। বৃদ্ধ শিকারাচালক, পুত্রের শোক কাটিয়ে ধরে আছেন হাল।
কেউ আসে না, জানেন। কোনো টুরিস্ট আসতে চায় না। বললেন একটা কথাই। আমাদের আপেলবাগান, পুরোটা জ্বালিয়ে খাক করে দিল। ওই ছেলেটাকে হিরাসতে নিয়ে যাওয়ার পরে পরেই। ভেবেছিলাম সুবিচার পাব, নাহ। এনকাউন্টার, তারপর সব শেষ। নিথরের বুক তখন দাঁড়ের শব্দও বুঝি শুষে নেয়। আমাদের দৃষ্টির সামনেই। কোন রাস্তায়, কেউ উল্লেখ করে না।
রাস্তায় এত এত বৃক্ষ, সবুজবাগান। ফল আর ফুলের সম্ভার। প্রাণভরে আয়ুর সংস্থান তবু স্তম্ভিত। রাস্তার দু-পাশে থেকে থেকে সঙ্গিন উঁচিয়ে আমাদের রক্ষক ভাইয়েরা। তাদের জলপাই উর্দি, কঠোর চোখ, আঙুলে ট্রিগার-সন্তোষ। বাতাস মানানসই পথ না-পেয়ে এখানে কণ্ঠ রোধ করে পাক খায়। দণ্ডিপথ যেমন। এই আছে, এই অস্পষ্ট বিভীষিকা। কাকেই বা ভরসা। পাকদণ্ডি পথ বলে দেবে? সমতল রাস্তা? উপত্যকার ঢাল?
–শুধু মসৃণ রাস্তার জন্যে? জিজ্ঞেস করি।
–না। মসৃণ পথের মানুষেরা সহজ হয় সরল হয়।
–ভুল। কলকাতা শহরের মানুষদের তুমি বিশেষ চেনো না। ভাঙাচোরা রাস্তার মতো। উদভ্রান্ত, টেনসড, কচালে ওস্তাদ। আর হামবড়াই তো বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
–তবু। স্কুলের বাচ্চাদের শুট করে পরীক্ষা ভণ্ডুল করা হয় না কোথাও। আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষা আর পড়াশোনার সেখানেই ইতি। তোমাদের শহরের কথা শুনলে মনে হয়, আমরা অন্য এক দেশে থাকি।
–তোমরা অন্য দেশ তো চাইছ, চাইছ না? একদম দেশভক্তের স্বরে বলি। বলতে সাহস লাগল না।
–বাজে কথা, রটনা। আমরা নিজেদের মতো বাঁচতে চাইছি। এই এই চরাচরের মতন, পড়ে থাকা ভার্জিন রাস্তার মতন। স্বাধীন শৈলশিখরের মতন। বিশৃঙ্খল ডেডবডির মতন নয়!
–পথ খুঁজতে চাইছ, আসলে।
–বোধ হয়! সহিস স্তব্ধ হয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর স্বপ্নের ঘোর কাটিয়ে ওঠার মতো অশ্বচালনায় মন দেয়।
আমি তার দিকে চেয়ে এতক্ষণে বুঝি, সহিস ঠিকঠাক কিশোর না, যুবক হওয়ার প্রতিবন্ধকতা পেরোতে পারছে না আর। পথ নেই।
তার পাংশু মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সূর্য নেমে যাচ্ছে দ্রুত। বিপরীতে ধবল গিরিশ্রেণি, সারি সারি হাত ধরাধরি পাইন-সবুজ। ছাপ পড়ে আছে শেষ রৌদ্রের, মিইয়ে আসা শস্ত্র-বারুদ যেমন। যত নামছে, ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছে আমাদের প্রকৃত রাস্তা। জানতাম না। সেরকমটাই জানাল বালক, তার ভেজা ভেজা দৃষ্টি দিয়ে।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
মুর্শিদ এ এম গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। যৌবনের প্রারম্ভে নাটক লিখে মঞ্চস্থ ও অভিনয় করেছেন। বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখা ছাড়াও পরিচালনা করেছেন চারটি শর্ট ফিল্ম। প্রান্তিক, ব্রাত্য জীবনই তাঁর লেখা আর ছবির বিষয়। সাম্প্রদায়িক ক্ষত মোছা ও তার কারণ অনুসন্ধানের আকাঙ্ক্ষায় লেখায় পড়ায় মজে থাকেন। লিটল ম্যাগাজিন প্রিয় মাধ্যম হলেও লিখেছেন একাধিক প্রথম শ্রেণির পত্র-পত্রিকায়। প্রথম গল্পগ্রন্থ-‘জাড়কাঁটা’ (১৯৯৩), প্রথম উপন্যাস-‘ছন্নভূমি’ (২০০১)। সম্পাদনা করেছেন ‘উত্তরাধুনিক ছোটোগল্প সংকলন’ ছাড়া আরও কয়েকটি প্রবন্ধগ্রন্থ। প্রয়াত কবি, সম্পাদক সমীর রায়চৌধুরী প্রবর্তিত ‘হাওয়া ৪৯’ পত্রিকা সম্পাদনার বর্তমান দায়িত্বে আছেন। গ্রন্থনির্মাণ ও প্রকাশনা তাঁর নেশা। পেয়েছেন বেশকিছু বেসরকারি মান্য সাহিত্য পুরস্কার।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!