দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্বে আস্থা হারাচ্ছে ফিলিস্তিনের তরুণ প্রজন্ম

সাময়িকী ডেস্ক
সাময়িকী ডেস্ক
8 মিনিটে পড়ুন
রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে ক্রমবর্ধমান হতাশার মধ্যে গজিয়ে উঠছে নতুন নতুন অসংখ্য জঙ্গী গোষ্ঠি, যারা সশস্ত্র অভ্যূত্থানের প্রস্তুতিও নিতে শুরু করেছে। ছবি ইপিএ

দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্বে আস্থা হারাচ্ছে ফিলিস্তিনের তরুণ প্রজন্ম

ফিলিস্তিনে যাদের বয়স ৩০ এর কম, তারা কখনই সেখানে কোন নির্বাচনে কোনদিন ভোট দেবার সুযোগ পাননি এবং অনেকেই বলেন ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের প্রতি তাদের আস্থা খুবই কম। বিবিসিকে এমন কিছু তথ্য দেয়া হয়েছে যা আর কারো হাতে আসেনি, যেখানে বলা হচ্ছে, এই তরুণ সম্প্রদায় ইসরায়েল ফিলিস্তিনি সঙ্কট সমাধানে যে দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্বের কথা বলা হয় ক্রমশই তা প্রত্যাখ্যান করছে।

“খুবই গতানুগতিক এই ‘দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান’ – পশ্চিমের তৈরি। এখানে বাস্তব পরিস্থিতির দিকে নজরই দেয়া হয়নি,” প্রশ্নের উত্তরে বেশ তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই বললেন ১৭-বছর বয়সী জান্না তামিমি। তার প্রশ্ন: “সেটাই যদি হবে, তাহলে সীমান্ত কোথায়?”

জান্না জানালেন, তিনি বিশ্বে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত সবচেয়ে কম বয়সী সাংবাদিকদের একজন। মাত্র সাত বছর বয়সে মায়ের টেলিফোন ধার করে অধিকৃত পশ্চিম তীরে তার নিজের শহর নাবি সালাহ থেকে প্রতিবাদের খবর রিপোর্ট করতে শুরু করেন তিনি।

“আমি [ইসরায়েলি বাহিনীর] রাতের বেলা এবং দিনের বেলাতেও হানা দেবার খবর দিই, এসব অভিযান চালানো হয় প্রায়শই। আমি সবগুলোর ভিডিও তুলতে পারি না, তবে আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করি। আসলে স্কুল আর অন্য সব দিক সামলে কাজটা একটু কঠিন হয়ে পড়ে। তার পরেও সবসময়ই দেবার মত খবর থাকে।”

ইন্তিফাদার প্রতি সমর্থন ঊর্ধ্বমুখী

জান্নার জন্মের পর থেকে ফিলিস্তিনি এলাকায় একটাও সাধারণ নির্বাচন বা প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়নি। শেষবার নির্বাচন হয়েছিল ২০০৬ সালে। যার অর্থ হল ৩৪ বছরের কম বয়সী কেউই জীবনে কখনও ভোট দেবার সুযোগ পাননি।

fele 2 দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্বে আস্থা হারাচ্ছে ফিলিস্তিনের তরুণ প্রজন্ম
ফিলিস্তিনে সবশেষ নির্বাচন হয় যে বছরে সে বছরে জন্ম জান্নার

শেষবার ভোটের পর থেকে যেটা হয়েছে সেটা হল ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি মানুষের আস্থা ভেঙে পড়েছে। একই সঙ্গে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান তত্ত্বের প্রতি সমর্থনের পাল্লাও ক্রমশ নিম্নমুখী হয়েছে, যে তত্ত্বের মূল ফর্মূলা হল ইসরায়েলের পাশাপাশি একটা স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের মধ্যে দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা।

পশ্চিম তীরে প্যালেস্টাইন সেন্টার ফর পলিসি অ্যান্ড সার্ভে রিসার্চ নামের একটি সংস্থা গত দুই দশকে জনসাধারণের মধ্যে মনোভাবের পরিবর্তন কীভাবে ঘটেছে সে বিষয়ে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছে এবং ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের ওপর চালানো তাদের গবেষণার তথ্য তারা একমাত্র বিবিসির সাথে শেয়ার করেছে।

ওই সেন্টারের গবেষণার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন ফিলিস্তিনি অথরিটি (পিএ)র প্রতি এই প্রজন্মের সমর্থন স্পষ্টভাবে কমছে এবং গত দশকে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান তত্ত্বের প্রতি সমর্থনও নিরবচ্ছিন্নভাবে নিম্নমুখী হয়েছে।

“বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অসন্তোষের মূল কারণ হল প্রধানত রাজনৈতিক পদ্ধতির মধ্যে তাদের দৃষ্টিতে বৈধতার অভাব। দেখুন, আমাদের একজন প্রেসিডেন্ট আছেন, যিনি গত ১৪ বছর ধরে নির্বাচনী বৈধতা ছাড়াই শাসন চালিয়ে যাচ্ছেন,” ব্যাখ্যা করছিলেন ওই সেন্টারের পরিচালক ড. খালিল শিকাকি।

“আমাদের রাজনৈতিক কাঠামো মূলত কর্তৃত্বপরায়ণ। এই ব্যবস্থা প্রধানত এক-ব্যক্তি কেন্দ্রিক। কাগজে কলমে আমাদের একটা সংবিধান আছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা সংবিধানের তোয়াক্কা করি না।”

একই সাথে, ৩০ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাতের প্রতি সমর্থন খুবই বেশি। এদের ৫৬%ই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইন্তিফাদা বা অভ্যূত্থানের পক্ষে- এই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে মার্চ মাসে চালানো সবশেষ জরিপ থেকে।

felestin 3 1 দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্বে আস্থা হারাচ্ছে ফিলিস্তিনের তরুণ প্রজন্ম
ইসরায়েল ফিলিস্তিনি সংঘাত সমাধানে দুই রাষ্ট্র গঠনের তত্ত্বের ওপর আস্থা হারাচ্ছে তরুণ ফিলিস্তিনিরা

গত এক বছরে পশ্চিম তীরে উত্তরাঞ্চলীয় দুই শহর নাবলুস আর জেনিনে অসংখ্য নতুন জঙ্গী গোষ্ঠি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, যারা ক্ষমতাসীন পিএ-র নিরাপত্তা বাহিনীর বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।

এদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হল লায়ন্স ডেন এবং জেনিন ব্রিগেডস্, যারা পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনী ও বসতি স্থাপনকারীদের ওপর হামলাও চালিয়েছে।

বলপ্রয়োগের ভাষা

জেনিন বিগ্রেডের সদস্যদের সঙ্গে এক রাতে দুটোর সময় আমরা যোগ দিয়েছিলাম। তখন তারা জেনিন শরণার্থী শিবিরের গোলকধাঁধাঁর মত অলিগলিতে প্রশিক্ষণ মহড়া চালাচ্ছিল।

দলের প্রত্যেক সদস্যের হাতে ছিল এমসিক্সটিন অ্যাসল্ট রাইফেল। আপাদমস্তক তাদের ঢাকা ছিল কালো পোশাকে। নিঃশব্দে তারা এসে দাঁড়াল একটা লাইনে। বন্দুকগুলো সামনে ধরে অলিগলি আর ছাদের মাথা নিশানা করে তারা এগোতে লাগল।

এদের বেশিরভাগই পুরুষ যাদের বয়স বিশের কোঠায়। তাদের দাবি তারা কোন বড় জঙ্গী গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত নয় বা তাদের অংশও নয়- তারা স্বাধীনচেতা গোষ্ঠি এবং ফিলিস্তিনি অঞ্চলের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কোনরকম সংশ্রব তারা প্রকাশ্যেই প্রত্যাখ্যান করে থাকে।

felestin 4 দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্বে আস্থা হারাচ্ছে ফিলিস্তিনের তরুণ প্রজন্ম
ফিলিস্তিনি তরুণদের মতপ্রকাশের সুযোগ নেই, নেই রাজনীতিতে তাদের কোনরকম প্রতিনিধিত্ব

একজন যোদ্ধা, ২৮-বছর বয়সী মুজাহিদ আমাদের বললেন যে বর্তমান নেতৃত্ব তাদের প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করে না।

“গত ৩০ বছরের রাজনৈতিক পদ্ধতির ওপর ফিলিস্তিনের তরুণরা আর আশা রাখতে পারছেন না, তাদের আশা ভঙ্গ হয়েছে,” তিনি বললেন।

তাহলে কি তিনি সহিংস পথে সমাধানে বিশ্বাসী? – এ প্রশ্নে তার জবাব:

“দখলদাররা প্রতিদিন এখানে ঢোকে, প্রকাশ্য দিবালোকে ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন করে,” ইসরায়েলি বাহিনীকে লক্ষ্য করে তিনি এই মন্তব্য করলেন। “এই দখলদাররা শুধু বলপ্রয়োগের ভাষাই বোঝে।”

রাজনৈতিক তাপমাত্রা

ফিলিস্তিনে দীর্ঘদিন সাধারণ বা প্রেসিডেন্ট নির্বাচন না হওয়ায় রাজনৈতিক তাপমাত্রা বোঝার একমাত্র ব্যারোমিটার হল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নির্বাচনগুলো। পশ্চিম তীরে বিরজেইৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক পরিবেশে এবং সেখানকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে নির্বাচনগুলোতে ওই অঞ্চলের রাজনৈতিক মনোভাব প্রতিফলিত হয়।

সেখানেও মনোভাবের স্পষ্ট পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। ফাতাহ ছাত্র সংগঠন, যা শাসক গোষ্ঠি ফিলিস্তিনি অথরিটিতে প্রভাবশালী ফাতাহ পার্টির ছাত্র শাখা, তারা সবসময়ই বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতিতে বিরোধী ইসলামপন্থী দলের চেয়ে এগিয়ে ছিল, এমনকি ফাতাহর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হামাসের ছাত্র শাখাও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে তেমন সুবিধা করতে পারেনি। কিন্তু গত বছর পরিস্থিতি বদলেছে।

felestin 5 দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্বে আস্থা হারাচ্ছে ফিলিস্তিনের তরুণ প্রজন্ম
হতাশ ফিলিস্তিনি তরুণদের মধ্যে পরিবর্তনের হাওয়া স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ছবি ইপিএ

“সেটা ছিল একটা বড় বিস্ময়,” বললেন মুস্তাফা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২২এর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দল ডেমোক্রাটিক ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অফ প্যালেস্টাইনের ছাত্র প্রতিনিধি তিনি।

“সাধারণত ফাতাহ আর হামাসের ছাত্র শাখার মধ্যে হারজিত হয় এক থেকে দুই আসনের ব্যবধানে। এবারে হামাস জিতেছে ১০টি আসনের ব্যবধানে।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নির্বাচনে হামাসের এই অভূতপূর্ব এবং নিরঙ্কুশ বিজয়কে প্রধানত দেখা হচ্ছে শাসক পিএ-র বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ হিসাবে। গত মাসের নির্বাচনেও হামাস এই কৃতিত্ব ধরে রাখতে পেরেছে যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠতার হার এবারে কিছুটা কম ছিল।

“যদি সাধারণ নির্বাচন হতো সেখানেও বিরজেইৎ-এর মতই ফলাফল আসত,” বলছিলেন মুস্তাফা। “কারণ ফিলিস্তিনি অথরিটি (পিএ) যেভাবে সব কিছুর মোকাবেলা করছে তাতে মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছে, সেটা রাজনৈতিক কারণে আটক, কর, হত্যা, বা বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার মত যেকোন ইস্যুতে।”

ধামাচাপার হাতিয়ার

ফিলিস্তিনি এলাকার ভবিষ্যত নিয়ে মতপ্রকাশের সুযোগ না পেয়ে বেড়ে উঠেছে যে প্রজন্ম, তাদের কাছে এটা আত্মপরিচয় নিয়ে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

সংস্কৃতি ও শিক্ষা নিয়ে কাজ করে নিরপেক্ষ একটি সংস্থা কাত্তান ফাউন্ডেশানের কিউরেটর হিসাবে কাজ করেন মজিদ নাসরাল্লাহ। তার কর্মস্থল পশ্চিম তীরের রামাল্লা শহরে, কিন্তু তার জন্ম উত্তর ইসরায়েলের একটি শহরে।

ইসরায়েলি জনসংখ্যার ২০% হলেন ইসরায়েলের আরব নাগরিকরা। তার প্রজন্মের অনেকের মত তিনিও নিজেকে “ফ্রম ৪৮” হিসাবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। “ফ্রম ৪৮” বলতে তাদের বোঝায় যারা ১৯৪৮ সালে যে ভূখণ্ড ইসরায়েল রাষ্ট্র হয়ে যায়, সেখানেই থেকে গেছেন। ফলে মজিদকে ফিলিস্তিনি সমাজের অংশ হিসাবে বিবেচনা করা হয় না।

felestin 6 দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্বে আস্থা হারাচ্ছে ফিলিস্তিনের তরুণ প্রজন্ম
মজিদ: “ফিলিস্তিনি শাসন ব্যবস্থায় আমার কোন স্বীকৃত স্থান নেই”।

“পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি শাসন ব্যবস্থায় আমার কোন স্বীকৃত স্থান নেই,” মজিদ বলেন। “[ফিলিস্তিনের নির্বাচনে] আমার ভোট দেবার কোন অধিকার নেই। আসলে, ইসরায়েলের আইন অনুযায়ী আমার এখানে [রামাল্লায়] থাকারই কথা নয়।”

ইসরায়েলি আইনে ইসরায়েলের কোন নাগরিকের নিরাপত্তার কারণে পশ্চিম তীরের কোন ফিলিস্তিনি এলাকায় যাওয়া নিষেধ।

ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তার কোন কণ্ঠ না থাকায় মজিদও দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান তত্ত্বে বিশ্বাস করেন না।

“দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের বিষয়টি আসলে একটি রাজনৈতিক প্রকল্পের লাশমাত্র। ফিলিস্তিনিদের ওপর নিপীড়ন নির্যাতন চালিয়ে যাবার জন্য এটা ধামাচাপা দেবার একটা হাতিয়ার,” তার মন্তব্য।

“আমাকে যদি জিজ্ঞস করেন, আমি বলব এখানে রাষ্ট্র গঠনের কোন ব্যাপারই নেই। মানচিত্রের দিকে তাকালে একটা পাঁচ বছরের শিশুও বলে দিতে পারবে এটা অবাস্তব এবং অকার্যকর।”

সূত্র: বিবিসি

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!