ঈদুল ফিতরের মাত্র ক’দিন বাকি রয়েছে। প্রতি বছরই তাঁতবস্ত্র ব্যবসায়ের ভরা মৌসুমের এ সময়ে দিনরাত ব্যতিব্যস্ত থাকতে দেখা গেলেও এবার শাহজাদপুরের তাঁত শ্রমিকদের হাতে পর্যাপ্ত কাজ ও অর্থ না থাকায় তাদের মাঝে নেই ঈদের আমেজ; আছে কেবল হতাশা।
করোনার কারণে গত প্রায় ১ বছর ধরে দেশের তাঁতশিল্পের কেন্দ্রবিন্দু শাহজাদপুরের সিংহভাগ তাঁত বন্ধ থাকায় শ্রমিকেরা বেকার হয়ে এমনিতেই হাঁ-হুঁতাশ করছে। এরই মধ্যে তাদের বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। ফলে পরিবার পরিজনের জীবনজীবিকা নিয়ে প্রতিটি মুহুর্ত চরম উদ্বেগ আর উৎকন্ঠায় তাদের দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। করোনার প্রভাবে একের পর এক তাঁত কারখানা বন্ধ, নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি, রং, সুতাসহ তাঁতবস্ত্র উৎপাদনের সকল কাঁচামাল ও উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি এবং উত্তরাঞ্চলের সর্ববৃহৎ শাহজাদপুর কাপড়ের হাটে বেচা-কেনা না থাকা, বিভিন্ন এনজিও, সুদখেকো ব্যবসায়ী, সমিতি ও ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের বোঝা বহন, ক্রয়-ক্ষমতা হ্রাস, তাঁতবস্ত্র উৎপাদনের ন্যায্য মজুরি প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিতসহ নানাবিধ কারণে এলাকার তাঁত শ্রমিকদের ভাগ্যাকাশে বর্তমানে বিরাজ করছে কালো মেঘের ঘনঘটা । শাহজাদপুরের ঐহিত্যবাহী তাঁতশিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত প্রায় লাখো তাঁত শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিয়ে, ভাগ্যোন্নয়নে, চলমান সংকট নিরসনে, জীবন জীবীকা আর রুটি রুজি নিশ্চিত ও ন্যায্য মজুরি প্রাপ্তির নিশ্চয়তা নিয়ে কারোও ভাবনা না থাকায় শ্রমিকের দুর্ভোগ-দুর্গতি ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে, চির অবহেলিত, চির পতিত, চির অপাংক্তেয়, হৎদরিদ্র শাহজাদপুরের ভাগ্যবিড়ম্বিত লাখো তাঁত শ্রমিকের সীমাহীন দুঃখ-কষ্টে তাদের বুক ফাঁটলেও মুখ ফুঁটছে না! ওদের বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতেই কাঁদছে!
শাহজাদপুর তাঁত শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্রে জানা গেছে, শাহজাদপুর পৌর এলাকাসহ ১৩ টি ইউনিয়নে তাঁতশিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত রয়েছে প্রায় দেড় লাখ শ্রমিক। এদের কেউ তাঁত বুঁনন করে, কেউ কাপড় ভাঁজ করে, কেউ রং করে, কেউ চরকায় সুতা কাটে, কেউ লেবেলিং, প্যাকেটজাতকরণের কাজ করে, আবার কেউ শানা বয়াসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজে নিয়োজিত রয়েছে। এদের মধ্যে স্থানীয় শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি, আর বাদবাকি উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন মঙ্গাপীড়িত এলাকা থেকে আগত। বর্তমানে এসব শ্রমিকের গড় আয় প্রায় ২’শ থেকে আড়াই’শ টাকা। আগে সপ্তাহে ৭ দিনই শ্রমিকরা তাঁতে কাজ করলেও করোনার ক্রান্তিকালে সপ্তাহে তাদের ৩-৪ দিন বসে থাকতে হচ্ছে। তাও আবার অনেক কারখানায় সকাল বেলা কাজ থাকলেও বিকেলে বন্ধ থাকে তাঁত। চাল, ডাল, ভোজ্য তেলসহ সকল প্রকার নিত্যপণ্যের সীমাহীন উর্ধ্বগতিতে এই আয় দিয়ে বর্তমানে জীবন চালানো তাদের পক্ষে খুবই কষ্টকর হয়ে উঠেছে। আবার এমন অনেক শ্রমিক রয়েছেন যাদের ১ জনের আয়ের ওপর পুরো পরিবার নির্ভরশীল। এমন শ্রমিকদের ও তাদের পরিবারের বর্তমানে কিভাবে দিন কাটছে তা পল্লী এলাকায় গিয়ে নিজে চোখে না দেখলে ঠাহর করার উপায় নেই । এ বিশাল সংখ্যক শ্রমিকের সিংহভাগই ‘দিন আনি দিন খাই’-এ নীতিতেই জীবন চলে। কোন দিন কাজ বন্ধ থাকলে তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে অর্ধাহারে বা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হয়। ফলে ওইসব শ্রমিকেরা পুঁজি ভেঙ্গে, সম্পদ বেঁচে, ধার-দেনা করে, এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে অতিকষ্টে কোন ভাবে প্রতিটি দিন অতিবাহিত করছে। আবার এদের ধারদেনা ও ঋণের মাশুল দিতে হচ্ছে প্রতিটি দিনে প্রতিটি ক্ষণে। নিত্যপণ্যের উর্ধ্বগতিতে এমনিতেই ওদের বেহাল অবস্থা ,তার পরেও ‘মরার ওপার খাড়ার ঘা’এর মতো ঋণের কিস্তি টানতে টানতে ঋণ শোধের পরিবর্তে নতুন করে তারা ঋণের অধৈ জলে আটকা পড়ে শাহজাদপুরের তাঁত শ্রমিকদের দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে আর হাঁ-হুঁতাশ করছে।
স্থানীয় তাঁত শ্রমিকদের ভাষ্যমতে, ‘কাজ করে এলাকার তাঁত শ্রমিকেরা চায় দু’বেলা দু’মুঠো ভাত খাবার নিশ্চয়তা, চায় পরিবার পরিজন নিয়ে একটু ভালভাবে বেঁচে থাকতে, চায় মেহনত করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে। কিন্তু ওদের ওই চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করার, ওদের পাশে একটু সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিতে কেউই এগিয়ে আসছে না। বর্তমানে তেলের মাথায় তেল দেওয়ার প্রবণতা বেশী পরিলক্ষিত হওয়ায় ওইসব শ্রমিকরা সর্বক্ষেত্রে উপেক্ষিত হওয়ায় চরম অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ আর উৎকন্ঠায় বর্তমানে প্রতিটি দিন তারা অতিবাহিত করছে।’

শাহজাদপুর তাঁত শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারন সম্পাদক পৌর কাউন্সিলর আল-মাহমুদ জানান, ‘করোনার প্রভাবে পুঁজি হারিয়ে সিংহভাগ তাঁতই বন্ধ করে দিয়েছে এলাকার তাঁতী-মহাজনেরা। শাহজাদপুর উপজেলার দেড় লাখ তাঁতের সিংহভাগই বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বেকার হয়ে পড়েছে অসংখ্য শ্রমিক। এছাড়া, বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় ও জীবনযাত্রার ব্যয় বহুলাংশে বেড়ে যাওয়ায় এলাকার কমবেশি প্রায় সব তাঁত শ্রমিকই প্রতিনিয়ত অবর্ণনীয় দুর্ভোগ, দুর্গতিতে নিমজ্জিত হয়ে মানবেতর দিনযাপন করছে।’
তাঁঁতী ও শ্রমিকেরা আরও জানায়, তাঁতবস্ত্র উৎপাদনের কাঁচামালসহ সকল প্রকার উপকরণের মূল্যবৃদ্ধিতে উৎপাদিত তাঁতবস্ত্রের উৎপাদন ব্যায় বেড়েছে। কিন্তুকাপড়ের হাটে উৎপাদিত তাঁতবস্ত্র লাভজনক দামে বিক্রি করতে না পেরে তাঁত শ্রমিকদের সময়মতো মজুরি দিতে পারছেন না তাঁতী ও মহাজনেরা। এর ক্ষতিকর প্রভাব সরাসরি গিয়ে পড়ছে খেটে খাওয়া মেহনতী হাজার হাজার তাঁত শ্রমিকদের ওপর। বর্তমানে কাপড়ের হাটে তাঁতবস্ত্রের বেচাবিক্রি না হওয়ায় তাঁতীরাও চোঁখে চোখেমুখে অন্ধকার দেখছে। ফলে সার্বিকভাবে শাহজাদপুরে ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পের সাথে সম্পৃক্ত বিশাল শ্রমিক এ জনগোষ্ঠির জনজীবন বিষিয়ে ও তেঁতো হয়ে উঠেছে। পক্ষাস্তরে, আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক যুগের প্রভারে শাহজাদপুরে বিদ্যুৎ চালিত পাওয়ারলুমের সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে। একজন তাঁত শ্রমিক দিনভর মেহনত করে যে পরিমান তাঁতবস্ত্র উৎপাদন করে, পাওয়ারলুমে তার চেয়ে ৫/৬ গুণ বেশী তাঁতবস্ত্র উৎপাদিত হলেও আনুপাতিক হারে শ্রমিকেরা বেশী মজুরি পাচ্ছে না। ফলে তাঁতসমৃদ্ধ এ জনপদে দিনে দিনে বেকার তাঁত শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আবার অনেকেই সময়মতো মজুরি না পেয়ে জীবীকার তাড়নায় পেশা বদলিয়ে অন্য পেশায় ঝূঁকছে। ফলে সার্বিকভাবে খুব কষ্টেই তাদের দিন চলছে। এদিকে, শাহজাদপুরের বিসিক এলাকায় স্থাপিত বাংলাদেশ তাঁতবোর্ড স্থানীয় তাঁতী ও তাঁত শ্রমিদের ভাগ্যেন্নয়নে কতটুকু কাজে আসছে তা নিয়েও এলাকার তাঁতী ও তাঁত শ্রমিকদের মধ্যে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। চলমান সংকট নিরসনে এলাকার অসহায় লাখো তাঁত শ্রমিকেরা সরকারি-বেসরকারি সহযোগীতা কামনা করেছে।