লেখক শেখ মুজিবুর রহমানের সাহিত্যসত্তার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

মোহিত কামাল
মোহিত কামাল
24 মিনিটে পড়ুন
ছবি সংগৃহীত

রাজনীতিবিদ বঙ্গবন্ধু, অসাধারণ এক বক্তা বঙ্গবন্ধু, কারাকুঠুরির বঙ্গবন্ধু, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি ও স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবুন্ধ―এসব সত্তা ছাপিয়ে লেখক শেখ মুজিবুর রহমানকে আমরা আবিষ্কার করি তাঁর লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী (২০১২), কারাগারের রোজনামচা, (২০১৭) ও আমার দেখা নয়াচীন (২০২০) বই তিনটির মধ্য দিয়ে।

বুকভাঙা আর্তনাদ নিয়ে শুনে এসেছি পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট একদল বিপথগামী সেনা-সদস্যের হাতে স্বপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। শুধুই কি বিপথগামী সেনা-সদস্য, নাকি জড়িত ছিল গভীর কোনো ষড়যন্ত্র? মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় বিদেশে থাকার জন্য বেঁচে গেছেন তাঁর দুই কন্যা―শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগে আমরা দেখেছি তাঁর যাপিতজীবন মানেই রাজনৈতিক জীবন। এ সময় আমরা দেখেছি এক ক্ষুরধার সাহসী বক্তা, জীবন ঘনিষ্ঠ কথা বলার অনন্য নেতা বঙ্গবন্ধুকে। তাঁর রাজনৈতিক-সত্তা হিমালয় চূড়ায় উঠে বসে আছে। সেই চূড়া থেকে তিনি একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন।

তাঁর মৃত্যুর পরও আমরা কথা বলেছি তাঁর জেলজীবন আর সংগ্রাম মুখর রাজনৈতিক-সত্তা নিয়ে। ২০১২ সালের আগ পর্যন্ত কথা বলেছি দেশ গড়ায় তাঁর স্বপ্ন নিয়ে। একজন রাজনীতিবিদের স্বপ্ন থাকে, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তিনি কাজ করে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দেখেছি তা বাস্তবায়নের জন্য তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি দেশের উন্নয়নের কথা ভেবেছেন, দুঃখী মানুষের কথা ভেবেছেন, মানুষের ঘরে ঘরে দুমুঠো ভাত তুলে দেওয়ার কথা ভেবেছেন, বিধ্বস্ত দেশ গড়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছিলেন, দুর্ভিক্ষ দূর করার জন্য গ্রহণ করেছিলেন নানা প্রকল্প। তাঁর প্রজ্ঞা, জীবনদর্শন আমরা দেখেছি ২০১২ সাল পর্যন্ত তাঁর রাজনৈতিক সত্তার উঁচু স্তর থেকে।

বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয়দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের  এগারো দফা আন্দোলন এবং অসহযোগ আন্দোলন, সর্বোপরি ৭ই মার্চের ভাষণে আমরা কথক বঙ্গবন্ধুকে আবিষ্কার করি, অনলবর্ষী এক বক্তাকে আবিষ্কার করি, আবিষ্কার করি দার্শনিক বঙ্গবন্ধুকে, আবিষ্কার করি বুদ্ধিজীবী বঙ্গবন্ধুকে, আবিষ্কার করি এক স্বপ্নবাজ রাজনৈতিক নেতাকে। আবিষ্কার করি তাঁর ভেতরে লুকিয়ে থাকা সাহিত্যসত্তা―রাজনীতির কবিকেও।

বঙ্গবন্ধুর লেখায় কল্পকাহিনির বিবরণ নেই, নেই অতিরঞ্জন। বঙ্গবন্ধু কথা বলেছেন প্রাণের ভেতর থেকে মায়ের মুখের শব্দে। মায়ের ভাষায় তিনি উচ্চারণ করে গেছেন সব অমর বাণী। ভাষণে এভাবে ভাষা ব্যবহারে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছেন রাজনীতির কবি হিসেবে―‘পয়েট অব পলিটিক্স’ অ্যাখ্যা পেয়েছেন।

মানুষের বুকে আলোড়ন তোলার জন্য তিনি নিজের আলোড়নে আলোড়িত হয়েছেন। নিজের চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। ভেতর থেকে জেগে উঠেছেন নিজের মতো করে। তার পরে তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণে লোকভাষা আর আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের মধ্য দিয়ে রাজনীতির মাঠে তো বটেই, সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতেও বিপুল ঢেউ তুলেছেন।

কবি-সাহিত্যিক কিংবা লেখকের কাজ স্বপ্ন দেখা। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতেই হবে তা তাঁর দায়িত্বের বিষয় নয়। কিন্তু আমাদের বঙ্গবন্ধু কেবল স্বপ্ন দেখেননি, তিনি লেখক হিসেবে, অন্তর্গত লেখক সত্তার আলোয়ও উদ্ভাসিত করেছেন মানুষের স্বপ্নময় জীবন আর আশা-আকাঙ্ক্ষাকে। একই সঙ্গে তা বাস্তবায়নের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। বিশ্বের অন্যান্য রাজনীতিবিদদের সঙ্গে এখানে বঙ্গবন্ধুর রয়েছে বিরাট পার্থক্য।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা হয়েছে বহু নির্বাচিত গল্প, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা হয়েছে উপন্যাস, প্রচুর প্রবন্ধ বা মননশীল বই, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা হচ্ছে অজস্র শিশুতোষ ছড়া-কবিতা গল্প-উপন্যাস, শিশুতোষ জীবনীগ্রন্থ এবং আমরা লক্ষ করি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা হয়েছে জারি-সারি গান, অজস্র কবিতা, ভাট কবিতা, লোকসাহিত্য লোকসংস্কৃতিতেও শব্দের অক্ষরে বঙ্গবন্ধু বিলীন হয়ে আছেন―কোটি কোটি শব্দ-বর্ণ ও অক্ষর স্রোতে বঙ্গবন্ধুর সত্তা মিশে গেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, তাঁর বই নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, অনূদিত হচ্ছে তাঁর বই। এসব কিছু তাঁর রাজনৈতিক সত্তার পাশাপাশি লেখকসত্তাকেও উজ্জ্বলতর করে তুলেছে।

সাতই মার্চের ভাষণ শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে বিশ্বদরবারে উন্নততর মর্যাদায় আসীন হয়েছে। ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’-এর অংশ হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি নিয়ে বিশ্বের মর্যাদাপূর্ণ ভাষণের তালিকায় তা উঠে গেছে। সে ভাষণ তো আছেই, বঙ্গবন্ধুও মানুষের অন্তরে মিশে উজ্জ্বল আসন অর্জন করেছেন, বিলীন হয়ে গেছেন কাব্যে-ছন্দে। যেভাবেই আমরা চাই না কেন, এখান থেকে আর বঙ্গবন্ধুকে বিলীন করা যাবে না। বঙ্গবন্ধুকে আর বিলীন বা বিকৃত করার কোনো ক্ষমতা কারও থাকবে বলে বিশ্বাস করি না। কারণ তিনি শব্দ-জোয়ারে ভেসে আছেন, শব্দস্রোতে ভেসে আছেন, সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের মতো শব্দের ঢেউয়ে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছেন।

তিনি কেবল বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন, কালজয়ী হবেন লেখক হিসেবেও, নিশ্চিত বিশ্বাস।

বঙ্গবন্ধুর সাহিত্য-মানস

তাঁর লেখার জগৎ থেকে কিছু কোটেশন বা উদ্ধৃতি তুলে ধরছি:

১. ‘আমার ঘরটার কাছের আম গাছটিতে রোজ ১০টা-১১টার সময় দুইটা হলদে পাখি আসে। ওদের খেলা আমি দেখি। ওদের আমি ভালোবেসে ফেলেছি বলে মনে হয়। ১৯৫৮ সালে দুইটা হলদে পাখি আসত। তাদের চেহারা আজও আমার মনে আছে। সেই দুইটা পাখির পরিবর্তে আর দুইটা পাখি আসে। পূর্বের দুইটার চেয়ে একটু ছোট মনে হয়।’শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা, (ঢাকা : বাংলা একাডেমি, ২০১৭), পৃ. ২১৮

২. ‘দুপুরের দিকে সূর্য মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারতে শুরু করেছে। রৌদ্র একটু উঠবে বলে মনে হয়। বৃষ্টি আর ভাল লাগছে না। একটা উপকার হয়েছে আমার দূর্বার বাগানটার। ছোট মাঠটা সবুজ হয়ে উঠেছে। সবুজ ঘাসগুলো বাতাসের তালে তালে নাচতে থাকে। চমৎকার লাগে, যেই আসে আমার বাগানের দিকে একবার না তাকিয়ে যেতে পারে না। বাজে গাছগুলো আমি নিজেই তুলে ফেলি। আগাছাগুলোকে আমার বড় ভয়, এগুলো না তুললে আসল গাছগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে। যেমন আমাদের দেশের পরগাছা রাজনীতিবিদ―যারা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক তাদের ধ্বংস করে, এবং করতে চেষ্টা করে।’ কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ১১৭

৩. ‘আমার ঘরের দরজার কাছে একটা কামিনী ও একটি শেফালী গাছ। কামিনী যখন ফুল দেয় আমার ঘরটা ফুলের গন্ধে ভরে থাকে। একটু দূরেই দুইটা আম আর একটি লেবু গাছ। বৃষ্টি পেয়ে গাছের সবুজ পাতাগুলো যেন আরও সবুজ আরও সুন্দর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বড় ভাল লাগল দেখতে।’ কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ১১৯

৪. ‘পরের দিন নৌকায় আমরা রওয়ানা করলাম… পথে পথে গান চলল। নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালী গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন… গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে।…আমি আব্বাসউদ্দিন সাহেবের একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, “মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলা কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালোবাস, এর মাধুর্য ও মর্যাদা নষ্ট হয়ে যাবে। …বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে”।’ শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, (ঢাকা : দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০১২), পৃ. ১১১

সাহিত্য বিশ্লেষণ: ॥এক॥ (১ থেকে ৪ কোটেশন)

একজন লেখকের ধারাল পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা থাকতে হয়। চারপাশকে দেখার মতো করে দেখতে হয়। কোনো ঘটনা বা পরিবেশ হালকাভাবে নাকি গভীরভাবে দেখছি, তার আলোকে চারপাশটা ব্রেনে ছাপ ফেলে দেয়। দেখার ইচ্ছা জোরালো হলে ভালো করে দেখা যায়। ইচ্ছার আড়াল থেকেও মনোযোগী মন ক্যামেরার মতো চারপাশের ছাপ ফেলতে পারে স্মৃতিসত্তায়। এটা এক ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত শিক্ষণ। পরবর্তী কোনো সময়ে লিখতে বসলে তা তরতর করে বেরিয়ে আসবে কলমের নিব দিয়ে। ডিটেলিং বা অনুপুঙ্খ বর্ণনা এভাবে ঋদ্ধ করতে পারে যেকোন সৃজনশীল রচনা। আর সাহিত্যের বড় অনুষদই হচ্ছে মানুষের জীবন, জীবন ঘিরে থাকা পরিবেশ-প্রকৃতি। জীবনের সঙ্গে এ প্রকৃতিঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ না-থাকলে সৃষ্টিশীল লেখা জীবন্ত হয়ে ওঠে না। জীবনঘনিষ্ঠ হয় না। যেকোন সৃষ্টি বা সৃজনশীল রচনা এ জীবনকেই ধরতে চায়, সেখানেই শিল্পের সার্থকতা। মানুষ প্রকৃতির ভেতর থেকে বেড়ে ওঠে। প্রকৃতি রস-রসায়ন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারে। গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে প্রকৃতির শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজের জীবনে তা একাকার  করে দিতে পারে। সমাজ জীবনেও। সাহিত্যের এই নির্ভেজাল উপাদান আমরা দেখতে পাই বঙ্গবন্ধুর রচনার ওপরে উল্লেখিত চারটি কোটেশনে।

জেলখানার কক্ষের পাশে একটা আমগাছ আছে। এটা স্বাভাবিক চোখে দেখা যায়। দুটো হলদে পাখি এসে এ গাছে বসে। এটাও নজর দিলে দেখা যাবে। পাখি দুটোর গায়ের রঙ হলুদ। ওরা খেলা করে। রঙ আর খেলার বিষয়টা হালকা চোখে দেখায় প্রভাব ফেলতে পারে। ঠিক আছে। কিন্তু ওরা রোজ ১০-১১টার সময় আসে। এটার মধ্যে একটু গভীরতা আছে। সময়-জ্ঞানের গভীরতা কেবল ঘড়ি দেখে হিসাব করে দেখার বিষয় নয়। ১৯৫৮ সালেও দুটো হলদে পাখি আসত। এই তুলনামূলক দেখার ক্ষমতার পেছনে লুকিয়ে আছে প্রখর মনোযোগের বিষয়। ইচ্ছাকৃতভাবে  চোখ বড় বড় করে দেখে ওদের বিচার করেননি তিনি। মনের চোখে দেখার স্মৃতিও এখানে উজ্জ্বল। এই উজ্জ্বলতর চোখের চাউনি সৃজনশীল রচনার ঐশ্বরিক শক্তি। এর পেছনে আছে সৃষ্টিশীল মনের টান, আগ্রহ। জীবন এভাবে সাহিত্যের ভাষা পায়। জীবন এভাবে নির্মিত হয়ে যায় সাহিত্যে।

লেখক শেখ মুজিবুর রহমান সাহিত্য রচনা করতে বসেননি। তবে তিনি যে বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন, শিল্প-সাহিত্যের প্রতি যে তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল, তাঁর মানসপটে যে লেখকসত্তা লুকিয়ে ছিল, লেখকসত্তার সুপ্ত প্রতিভার শেকড় বিন্যস্ত ছিল; তাঁর জীবনকথা বা জীবন-কাহিনির ভেতর থেকে তা জাদুর কাঠির স্পর্শের মতো বেরিয়ে এসেছে।

তাঁর স্ত্রী রেণু যখন জেলগেটে এসে একদিন বললেন, “বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী।” বললাম, “লিখতে যে পারি না; আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়!” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী), পৃ. ১

কি বিনয়ী কথা!

আমরা দেখতে পাই নিজের লেখা সম্পর্কে লেখকের আরও কিছু বিনয় কথন: ‘আমি লেখক নই; অনুভব করতে পারি মাত্র, লেখার ভিতর দিয়া প্রকাশ করার মতো ক্ষমতা খোদা আমাকে দেন নাই।’ শেখ মুজিবুর রহমান, আমার দেখা নয়াচীন, (ঢাকা : বাংলা একাডেমি ২০২০), পৃ. ৬৬

এ বিনয়ী স্বীকারোক্তির ভেতরই লুকিয়ে আছে নিরহংকারী অথচ প্রজ্ঞাবান এক ক্ষুরধার লেখকের নীরবসত্তা। সেই সত্তার আলো দেখা যায় তাঁর রচনায়। তাই কেবল আকাশ আর আকাশের মেঘ ও সূর্যকে দেখেন না তিনি। দেখেন মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সূর্য। ‘উঁকি’ শব্দটার ভেতর থেকে রোদ ঝলমলে দিনের মতো তাঁর সাহিত্যসত্তা পাঠক-মনে আলো ঢেলে দিয়ে যায়। রোদ আর মেঘ কেবল আকাশে সীমাবদ্ধ থাকেনি। একই সঙ্গে প্রকৃতির সবুজ হয়ে ওঠা মাঠটাও সেই ছোঁয়া আর আদরে নাড়া খেয়েছে। উপকার হয়েছে দুর্বার বাগানটার। ‘সবুজ ঘাসগুলো বাতাসের তালে নাচতে থাকে’―সাধারণ চোখ কি এ নৃত্যসংগীত দেখা ও শোনার সুযোগ পায়? প্রকৃতির এ অপরূপ রূপ-রসের সন্ধান পায়?

পায় না। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুভবে তা দোল জাগায়। আর তাই তিনি সহজ ভাষায় লিখতে পেরেছেন, প্রকৃতির ছবি আকতে পেরেছেন তাঁর রচনায়।

‘কবি গল্পকার চিত্রকর, সকলে জীবনের কথা লেখেন, আঁকেন। জীবন ব্যতীত কোনও সৃষ্টি শিল্প নির্মাণ অসম্ভব এক ব্যাপার।’ সুমন সেনগুপ্ত (কলকাতা: দেশ, ১৭ ডিসেম্বর ২০২০), পৃ.৭

পাঠক অবাক হয়ে লক্ষ করবেন রাজনীতিবিদ লেখক শেখ মুজিবুর রহমান কী অসাধারণ সাহিত্য শিল্পশস্য উপহার দিয়ে গেছেন! কী শিল্প নির্মাণ করে গেছেন স্বভাবজাত লেখকসত্তার ভেতর দিয়ে!

রূপের মধ্যেও আছে খাদ, আছে জঞ্জাল, আছে পরগাছা। আগাছা আসল গাছগুলোকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে, ক্ষতি করতে পারে। অনন্য এ রূপকের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় রাজনীতির মাঠের পরগাছারা। এদের দৌরাত্ম্যে প্রকৃত দেশপ্রেমিক ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। কী দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বোধ, অনুভব, চিন্তা, দর্শন! প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়কালেই শেখ মুজিবুর রহমানের নিজের জীবন বলি হয়েছে এসব পরগাছা আর ষড়যন্ত্রকারীদের গোপন মিশনের অবিশ্বাস্য হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে।

তাঁর ঘরের দরজার কাছে আছে একটা কামিনী ও একটা শেফালী গাছ। একটু দূরে আছ আম আর লেবু গাছ। কামিনীর ফুলের গন্ধে তাঁর ঘরটা ভরে যায়। আর বৃষ্টিস্নাত আম আর লেবু গাছ আরও সবুজ হয়ে ওঠে। প্রাণ ভরে দেখেন, অনুভব করেন তিনি এ সৌন্দর্য। মন ভরে ওঠে প্রকৃতির রূপ-রসে। তার সন্ধান আমরা পেয়ে যাই তার বিনয়ী লেখনীর অক্ষরস্রোতে:

‘আমি লেখক নই, অনুভব করতে পারি মাত্র।’

এ কথার আড়াল থেকেও সূর্য হাসে। শব্দস্রোতে ভেসে আসা সূর্যটাকে পাঠক দেখার সুযোগ পেয়ে যায়। তখন আর লুকিয়ে থাকতে পারে না লেখক শেখ মুজিবুর রহমানের সাহিত্যসত্তা। দিনের মতো ঝলমল করে তা ভেসে আছে তাঁর সৃজনকর্মে, জানান দেয় পাঠককে।

আব্বাসউদ্দিনের ভাটিয়ালী গান কেবলই আমাদের লোকসংস্কৃতির বিনোদনমূলক অনুষদ নয়। শহুরে সংস্কৃতিতেও তার আবেদন অমলিন। রেকর্ডিংয়ে এখনও তার গান প্রাণ কাড়ে। শেখ মুজিবও সে গান শুনেছেন। কিন্তু ভিন্ন পরিবেশে নৌকায় যাত্রার সময় নদীর বুকে সরাসরি আব্বাসউদ্দিনের গান শোনার অভাবনীয় ভালো লাগা লেখক শেখ মুজিবকে একদম গভীর থেকে নাড়িয়ে দেয়। এই গভীরতম তলেও ছিল তাঁর সুপ্ত সাহিত্যসত্তা। আর তাই তিনি কেবল গান শুনছেন না। একই সঙ্গে তাঁর মনে হচ্ছিল নদীর ঢেউগুলোও মগ্ন হয়ে আব্বাসউদ্দীনের গান শুনছে। এই যে প্রকৃতির উপাদান, তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়ে গেছে মানব-মন; ঘনিষ্ঠ সংযোগ ঘটে যায় পাঠকেরও। এটা মৌলিক সম্পর্ক, প্রকৃতি ও জীবনের শুদ্ধ সম্পর্ক। শেখ মুজিবের এ সৃজনক্ষমতার মধ্যে কেবল মানবজীবনের বস্তুগত রূপ বা সম্পর্ক তৈরি হয়নি, আবার প্রকৃতির হুবহু অনুকরণও ঘটেনি। ঘটে গেছে তারও অধিক―ইন্দ্রীয় শক্তির বাইরের অনুভবে পরমাত্মা ঋদ্য হয়ে ওঠে, শুচিশুভ্র হয়ে ওঠে। এটাই সৃষ্টিশীল সাহিত্যের অসাধারণ এক উপহার। যা লেখক তাঁর বিনয়ী লেখকসত্তার ভেতর থেকে পাঠককে উপহার দিয়ে গেছেন নিজের অগোচরে। আর তাই এসব উদ্ধৃতি বিশ্লেষণ করতে বসে মনে হয়েছে লেখক শেখ মুজিবুর রহমান পাঠকের মনোজগতে সাহিত্যের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে গেছেন। সেই বাতির আলো চারদিকে ছড়াবেই। অক্ষরভেলায় চড়ে তা এগোতে থাকবে। কালকে জয় করে বন্দি করবেই এ স্বল্পকথার অবিশ্বাস্য আলো।

বাংলা ভাষা, ভাষা-আন্দোলন এবং মাতৃভাষা, নিয়ে বঙ্গন্ধুর কথা

৫. বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বঙ্গবন্ধু:

‘আমরা বাঙালি। আমরা জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি। আমি যদি ভুলে যাই আমি বাঙালি, সেদিন আমি শেষ হয়ে যাব। আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ, বাংলার মাটি, আমার প্রাণের মাটি, বাংলার মাটিতে আমি মরবো, বাংলার কৃষ্টি, বাংলার সভ্যতা আমার কৃষ্টি ও সভ্যতা।’

(মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন (সম্পাদক), বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ঢাকা: চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, ২০১২, পৃ. ১১৪; বিশ্বজিৎ ঘোষ, ঢাকা : শব্দঘর, ডিসেম্বর ২০২০), পৃ. ২১

৬. ভাষা-আন্দোলন, ভাষাপ্রেম ও বঙ্গবন্ধু:

‘আমি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বন্দি অবস্থায় চিকিৎসাধীন। সেখানেই আমরা স্থির করি যে, রাষ্ট্রভাষার উপর ও আমার দেশের উপর যে আঘাত হয়েছে ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে তার মোকাবেলা করতে হবে। সেখানেই গোপন বৈঠকে সব স্থির হয়।… কথা হয়, ১৬ই ফেব্রুয়ারি আমি জেলের মধ্যে অনশন ধর্মঘট করব, আর ২১ তারিখে আন্দোলন শুরু হবে। জেলে দেখা হয় বরিশালের মহিউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে। তাঁকে বললাম আমরা এই প্রোগ্রাম নিয়েছি। তিনি বললেন, ‘আমিও অনশন ধর্মঘট করবো। ১৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে আমরা অনশন ধর্মঘট করলাম। এর দরুন আমাদের ট্রান্সফার করা হলো ফরিদপুর জেলে। সূচনা হয় ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের।’ (মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন, পূর্বোক্ত, পৃ. ১০২; বিশ্বজিৎ ঘোষ, (ঢাকা : শব্দঘর, ডিসেম্বর ২০২০), পৃ. ২১

৭. পাঞ্জাবি ভাষা, সিন্ধি ভাষা, বেলুচি, পশতু ও উর্দু ভাষা: বঙ্গবন্ধুর উদার মনোভাব

‘বাংলা পাকিস্তানের শতকরা ছাপ্পান্ন ভাগ লোকের মাতৃভাষা। তাই বাংলাই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। তবুও আমরা বাংলা ও উর্দু দুইটা রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছিলাম। পাঞ্জাবের লোকেরা পাঞ্জাবি ভাষা বলে, সিন্ধুর লোকেরা সিন্ধি ভাষায় কথা বলে, সীমান্ত প্রদেশের লোকেরা পশতু ভাষায় কথা বলে, বেলুচরা বেলুচি ভাষায় কথা বলে। উর্দু পাকিস্তানের কোনো প্রদেশের ভাষা নয়, তবুও যদি পশ্চিম পাকিস্তানের ভায়েরা উর্দু ভাষার জন্য দাবি করে, আমরা আপত্তি করব কেন?’ শেখ মুজিবুর রহমান, (অসমাপ্ত আত্মজীবনী), পৃ. ৯৮

৮. শিক্ষার ম্যাধমে মাতৃভাষা চালুর আহবান:

‘পাকিস্তানের সর্ব অঞ্চলে মাতৃভাষাকে সর্বোচ্চ শিক্ষার মাধ্যমরূপে গ্রহণ করিতে হইবে। পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষার সর্বস্তরে বাংলা ভাষাকে যত শীঘ্র সম্ভব শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রচলন করিতে হইবে এবং পাকিস্তানের সরকারি ও বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানের এবং ব্যবসা বাণিজ্য ও ব্যবসায়িক জীবনে বাংলা ভাষার ব্যাপক প্রসারের চেষ্টা করিতে হইবে। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার উন্নতি ও বিকাশের জন্য কার্যকরী উৎসাহ প্রদান করিতে হইবে এবং সকল প্রকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হইবে।’ (আবুল কাসেম (সম্পাদক), বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও আওয়ামী লীগ: ঐতিহাসিক দলিল, ঢাকা: জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ২০০১ পৃ. ২৪০; বিশ্বজিৎ ঘোষ, ঢাকা: শব্দঘর, ডিসেম্বর ২০২০), পৃ. ২১

৯. বাংলা ভাষার সংবিধান রচনা ও সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহার:

‘স্বাধীনতার পর অতি অল্প সময়ে বাংলা ভাষায় সংবিধান রচনা করার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। আদলতের রায় বাংলা ভাষায় লেখার নির্দেশ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। যথাযথ পরিভাষা না থাকার কারণেই রাষ্ট্রের সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহারে সমস্যা দেখা দিতে পারে―এ কথা অনুধাবন করে ১৯৭১ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধু বলেন―‘আমি ঘোষণা করছি, আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পণ্ডিতরা পরিভাষা তৈরি করবেন, তারপর বাংলা ভাষা চালু হবে, সে হবে না। পরিভাষাবিদরা যত খুশি গবেষণা করুণ, আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেব, সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে।’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ঢাকা : ১৬ই ফেব্রুয়ারি ১৯৭১; বিশ্বজিৎ ঘোষ, ঢাকা: শব্দঘর, ডিসেম্বর ২০২০), পৃ. ২৩

বিশ্লেষণ দুই ॥ (কোটেশন থেকে ৯)

…‘আমি বাঙালি বাংলা আমার মায়ের ভাষা, বাংলা আমার দেশ’…

কী নিখাদ উচ্চারণ। কী অন্তর্ভেদী কথা তিনি বলে গেছেন সহজ কথায়! মর্মমূল নাড়িয়ে দেওয়া এসব কথা প্রমাণ করে বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর কী দরদ, মমতা আর কী মৌলিক শুদ্ধ ভালোবাসা লুকিয়ে ছিল। এ কেবল কথার কথা নয়। কথাকে কাজে প্রমাণ করে গেছেন জীবন দিয়ে। আমাদের জন্য রেখে গেছেন বাংলা ভাষার স্বাধীন এ ভূখণ্ড, দেশ। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকা; জেলে বসে ১৬ ফেব্রুয়ারি অনশনের পরিকল্পনা, ২১ তারিখে আন্দোলন শুরু করার ডাক―বাঙলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনের এ সূতিকাগার অবিষ্কার করে আমরা শ্রদ্ধায় অবনত হই। কেবল পরিকল্পনা নিয়ে বসে থাকেননি, জেলে থাকা বরিশালের মহিউদ্দিন সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে অনশন শুরু করলেন। ফলে ট্রান্সফার করা হলো ফরিদপুর জেলে। ইতিহাস কী তাঁর এসব অবদানের কথা ভুলে যেতে পারে. রাঙালি কি তাঁর সঙ্গে বেঈমানি করতে পারে!

পারে। পেরেছে।

আগাছা আর পরগাছারা পারে। স্বার্থান্বেষী ষড়যন্ত্রকারীরা তা পারে। নিষ্ঠুরতম ইতিহাস তারা আবারও রচনা করেছে, পলাশীর পর ৩২ নম্বর বাড়িতে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে।

মীরজাফরা যুগে যুগে ছিল, থাকবে। মনে রাখতে হবে তাঁর সুযোগ্য কন্যাদ্বয় ও তাঁর উত্তরপ্রজন্মকে, তাঁর রাজনীতির মাঠের পরীক্ষিত সৈনিকদেরও।

আমরা তাঁর প্রতি যেন কৃতজ্ঞ থাকি, তাঁর ঋণ আমরা শোধ করতে পারব না। কিন্তু ইতিহাসের শীর্ষ শিখড়ে যেন তাঁর মর্যাদা ধরে রাখার যুদ্ধে থাকি, প্রাণে যেন তার পতাকা উড্ডীন রাখি। মায়ের ভাষায় যেন চিৎকার করে বলতে পারি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু, লেখক শেখ মুজিবুর রহমান, জাতির জনক, জাতির পিতা।

মাতৃভাষার প্রতি তাঁর ভালোবাসা কোনো সংকীর্ণ শৃঙ্খলে বাঁধা ছিল না। তিনি স্বার্থপর ছিলেন না। পাকিস্তানের সব অঞ্চলের মানুষের মায়ের ভাষার প্রতিও ছিলেন শ্রদ্ধাশীল, তাঁর উদার মনোভাব প্রমাণ আমরা পাই ৭ ও ৮নং উদ্ধৃতির মধ্যে। সব অঞ্চলের মাতৃভাষাকে তিনি শিক্ষার মাধ্যমরূপে মর্যাদা দেওয়ার ডাক দিয়েছিলেন। আর স্বধীনতার পর পরই বাংলার সংবিধান প্রণয়ন, আদালতের রায় বাংলায় লেখার নির্দেশ, পরিভাষা-ভাষারীতি ও এর ব্যবহারিক রূপরেখা তৈরির জন্য ঐতিহাসিক আহ্বান জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর দূরদৃষ্টি ভাবনার কারণে আজ আমরা পেয়ে গেছি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। একুশে ফেব্রুয়ারি স্বীকৃতি পেয়েছে, উঠে গেছে বিশ্বমর্যাদায় শীর্ষ চূড়ায়। আমরা কৃতজ্ঞ। বন্ধু, বঙ্গবন্ধু, শ্রদ্ধায় অবনত হই এ প্রজন্মের আমরা। গ্রহণ করুন আমাদের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও সালাম।

ইতোমধ্যেই বলা হয়েছে রাজনীতির কবি―‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ উপাধি পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এটি কেবল অতি আবেগের প্লাবনে উৎসারিত কোনো বিশেষণ নয়। বিশ্বজিৎ ঘোষের মতে, ‘মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য মধ্যবিত্তের শাহরিক ভাষার পরিবর্তে তিনি ব্যবহার করেছেন লোকভাষা। তাঁর লেখা ও বক্তৃতায় লোকভাষা-আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের বিস্ময়কর সার্থকতা লক্ষ করা যায়।’ বিশ্বজিৎ ঘোষ (ঢাকা: শব্দঘর, ডিসেম্বর ২০২০), পৃ. ২৪

আর আমরা জানি জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্য যাপিতজীবনের কথা বলে। কথাসাহিত্যে সৃষ্ট চরিত্ররা নিজেদের মুখের ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করে আপন আলোয় ফুটে ওঠে। সমাজ সচেতনতা ও সামাজিক উপযোগিতার ভেতর থেকে মানুষকে জাগিয়ে তোলে কথ্যভাষার স্বতঃস্ফূর্ত শব্দজোয়ার।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণে আমরা যে লোকভাষা-আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার দেখেছি তা প্রত্যক্ষ করি লেখক শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা তিনটি বইয়েও: অসমাপ্ত আত্মজীবনী (২০১২), কারাগারের রোজনামচা (২০১৭) ও আমার দেখা নয়াচীন (২০২০)। এর মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় ‘বই দু’খানি বাংলাদেশের প্রকাশনা ও বই বিক্রির ইতিহাসে এক নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। ইতোমধ্যে অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র লক্ষাধিক কপি বিক্রি হয়েছে এবং কারাগারের রোজনামচা বইটিও এক বছরের কম সময়ের মধ্যে ৭০ হাজার কপি নিঃশেষিত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রকাশনার ইতিহাসে আর কোনো রচনা এমন বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি।’ শামসুজ্জামান খান (ঢাকা: শব্দঘর, ডিসেম্বর ২০২০), পৃ. ১০

শামসুজ্জামান খানের এ কথায় প্রমাণ পাওয়া যায় আমার দেখা নয়াচীন বইটির ঈর্ষণীয় বিক্রি দেখেও।

কেবল বিক্রি এবং জনপ্রিয়তার বিচারে নয়, তিনটি বই পাঠ করলে অনুসন্ধিৎসু পাঠক চমকে উঠবেন। গ্রন্থগুলোতে জীবনঘনিষ্ঠ, জীবনছোঁয়া জীবনখোঁড়া যে-ভাষা, পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তা সৃজনশীল সাহিত্যেরই বড় অনুষদ। সহজ-সরল বর্ণনার মাধ্যমে লেখক শেখ মুজিবুর রহমান একদিকে যেমন জেলের পরিবেশ-প্রকৃতি, পরিবেশের নিয়মকানুন প্রাজ্ঞতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন অন্যদিকে আবেগ-দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনার খবর দিয়েছেন নিষ্ঠার সঙ্গে।

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের বিশ্লেষণ থেকেও আমরা লেখক শেখ মুজিবুর রহমানের তিনটি বইয়ের শিল্প-সুষমার স্বরূপ দেখতে পাই : ‘তিনটি বই সুখপাঠ্য ও তথ্যসমৃদ্ধ। সময়কে খুঁজে পাওয়া যায় তিনটি বইয়ে। এখানে একদিকে ব্যক্তি হিসেবে শেখ মুজিবের চিন্তার মগ্নতা গভীরভাবে রূপায়িত হয়েছে, অন্যদিকে নিজের রাজনৈতিক জীবন তখনকার সময়ের পটভূমিতে চমৎকারভাবে তিনি উঠিয়ে এনেছেন। পাশাপাশি চোখ রেখেছেন জগতের নানা দিকে। খুঁটিনাটি নানা বৃত্তান্ত এবং নিজের অনুভবের সারাৎসারে তাঁর প্রতিটি বই হয়ে উঠেছে অনন্য। এই বইগুলোতে কেবল একজন রাজনীতিকের দৃষ্টিভঙ্গিই নয়, লেখকের দায়বোধও ফুটে উঠেছে। ফলে বলা যায়, রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে শিল্পের সুষমা―এটিই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তিন বইয়ের একমাত্রিক ব্যঞ্জনা।’ সেলিনা হোসেন (ঢাকা: শব্দঘর, ডিসেম্বর, ২০২০) পৃ. ১৫

সাহিত্যের এসব ‘কনটেন্ট’ তাঁর বইয়ের লেখার ‘কাঠামো’র মধ্য দিয়ে যেভাবে ঢেলে দিয়েছেন তা একজন সাহিত্যিকের মানসচিত্র আর তাঁর কলমের শক্তিমত্তা এবং তীক্ষè পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা পাঠকের সামনে তুলে ধরে। এই নিবন্ধে উল্লেখিত ও আলোচিত এসব কোটেশনের টুকরো টুকরো চিত্রের মধ্য থেকে আমরা বিপুল আলোরছটা দেখার সুযোগ পাচ্ছি। বিশ্বাস রাখি, আরও গবেষণা হলে লেখক শেখ মুজিবুর রহমানের সাহিত্যসত্তার সেই বিপুল আলো দেখার সুযোগ ঘটবে পরবর্তী প্রজন্মেরও।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের জন্ম ১৯৬০ সালের ০২ জানুয়ারি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলায়। তাঁর বাবার নাম আসাদুল হক এবং মায়ের নাম মাসুদা খাতুন। তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম ও খালিশপুর, খুলনায়। বর্তমান নিবাস ধানমন্ডি, ঢাকা। স্ত্রী মাহফুজা আখতার মিলি, সন্তান মাহবুব ময়ূখ রিশাদ, পুত্রবধূ ইফফাত ইসলাম খান রুম্পা ও জিদনি ময়ূখ স্বচ্ছকে নিয়ে তাঁর সংসার। চার ভাই এক বোনের মধ্যে চতুর্থ সন্তান তিনি। তাঁর অ্যাফিডেভিট করা লেখক-নাম মোহিত কামাল। তিনি সম্পাদনা করছেন শুদ্ধ শব্দের নান্দনিক গৃহ, সাহিত্য-সংস্কৃতির মাসিক পত্রিকা শব্দঘর। তাঁর লেখালেখির মুখ্য বিষয় : উপন্যাস ও গল্প; শিশুসাহিত্য রচনার পাশাপাশি বিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণাধর্মী রচনা। লেখকের উড়াল বালক কিশোর উপন্যাসটি স্কলাস্টিকা স্কুলের গ্রেড সেভেনের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে; ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্যও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচি (ঝঊছঅঊচ) কর্তৃকও নির্বাচিত হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কথাসাহিত্য ৩৭ (উপন্যাস ২৪, গল্পগ্রন্থ ১৩)। এ ছাড়া কিশোর উপন্যাস (১১টি) ও অন্যান্য গ্রন্থ মিলে বইয়ের সংখ্যা ৫৫। জাতীয় পুরস্কার: কথাসাহিত্যে অবদান রাখার জন্য তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (২০১৮), অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কার ১৪১৮ বঙ্গাব্দ (২০১২) অর্জন করেছেন। তাঁর ঝুলিতে রয়েছে অন্যান্য পুরস্কারও; হ্যাঁ (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০২০) উপন্যাসটি পেয়েছে সমরেশ বসু সাহিত্য পুরস্কার (২০২০)। পথভ্রষ্ট ঘূর্ণির কৃষ্ণগহ্বর (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১৪) উপন্যাসটি পেয়েছে সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার (২০১৪)। সুখপাখি আগুনডানা (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০০৮) উপন্যাসটি পেয়েছে এ-ওয়ান টেলিমিডিয়া স্বাধীনতা অ্যাওয়ার্ড ২০০৮ এবং বেগম রোকেয়া সম্মাননা পদক ২০০৮―সাপ্তাহিক দি নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস-প্রদত্ত। না (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০০৯) উপন্যাসটি পেয়েছে স্বাধীনতা সংসদ নববর্ষ পুরস্কার ১৪১৫। চেনা বন্ধু অচেনা পথ (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১০) উপন্যাসটি পেয়েছে ময়মনসিংহ সংস্কৃতি পুরস্কার ১৪১৬। কিশোর উপন্যাস উড়াল বালক (রোদেলা প্রকাশনী, ২০১২; অনিন্দ্য প্রকাশ, ২০১৬) গ্রন্থটি ২০১২ সালে পেয়েছে এম নুরুল কাদের ফাউন্ডেশন শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০১২)। তিনি মনোচিকিৎসা বিদ্যার একজন অধ্যাপক, সাবেক পরিচালক জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ,ঢাকা
১ টি মন্তব্য

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!