নাটোরের রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা দেবীর আত্মকথন

মাহাবুব খন্দকার
মাহাবুব খন্দকার - নাটোর প্রতিনিধি
7 মিনিটে পড়ুন
রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা দেবী।

নাটোর জেলা ট্রেজারিতে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে পাওয়া যায় রুপার ফ্রেমে বাঁধাই করা এক তরুণীর ছবি। বেশ পুরনো আমলের ফ্রেম। ছবির তরুণীর সাজপোশাকও আগের দিনের, তবে তার আভিজাত্য স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। ছবির এক কোণে লেখা আছে ‘ইন্দুপ্রভা দেবী।’

নাটোর প্রশাসনের তৎকালীন কর্মকর্তারা আরো খোঁজখবর করে নিশ্চিত হলেন, ছবির নারী নাটোরের রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা দেবী দিঘাপাতিয়ার রাজা প্রমথনাথ রায়ের কন্যা। ইন্দুপ্রভা দেবীর এ ছবি যখন উদ্ধার হয়, তখন নাটোর জেলা প্রশাসন স্থানীয়ভাবে তল্লাশি চালাচ্ছিল রাজপরিবারের বেহাত হওয়া জিনিসপত্র উদ্ধারের জন্য।

উত্তরা গণভবনে একটি সংগ্রহশালার মাধ্যমে এসব ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণ করাই ছিল এ অভিযানের উদ্দেশ্য। একই সঙ্গে জেলার ট্রেজারিতেও তল্লাশি চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ তল্লাশিতে রাজপরিবারের অনেক নিদর্শন পাওয়া যায়। বড় এক সিন্দুকের ভেতর পাওয়া যায় একটি ট্রাংক।

এ ট্রাংকের ওপর লেখা ছিল ‘ইন্দুপ্রভা দেবী।’ ট্রাংকটির ভেতর পাওয়া গেল আরেকটি ট্রাংক। পুরনো দিনের রাজপরিবারের কোনো রহস্য যে এতে লুকিয়ে আছে, সেটা নিশ্চয়ই উপস্থিতরা বুঝতে পারছিলেন। এমন কাজে যুক্ত ছিলেন প্রশাসনের যে কর্মকর্তারা, তারা নিশ্চয়ই সেদিন দারুণ রোমাঞ্চের স্বাদ পেয়েছিলেন !

ট্রাংকের ভেতরে থাকা ট্রাংকটি খোলার পর বের হলো ইন্দুপ্রভা দেবীর হাতে লেখা কাব্যগ্রন্থ, ১০ খণ্ড ডায়েরি, একটি আত্মকথা, রাজকীয় কলম, দোয়াত, সিলমোহর, হাতির দাঁতের গহনাসহ আরো কিছু ব্যক্তিগত ব্যবহার্য জিনিসপত্র।

ট্রাংকে আবার ছিল এক গোপন কুঠুরি, সেই কুঠুরিতে পাওয়া গেল রাজকুমারীকে লেখা তার স্বামী মহেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর প্রেমপত্র একটি-দুটি নয়, ২৮৫টি। বিয়ের আগে ও পরে তিনি চিঠিগুলো লিখেছিলেন। ২০১৮ সালের ৫ মার্চ ট্রাংকটি থেকে ইন্দুপ্রভা দেবীর এসব ব্যক্তিগত জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়।

2 15 নাটোরের রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা দেবীর আত্মকথন
নাটোরের রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা দেবীর আত্মকথন 42

স্থানীয়ভাবে জেলা প্রশাসনের চালানো অভিযানে সংলগ্ন গ্রামবাসীদের কাছ থেকে উদ্ধার হয় রাজবাড়ির সিন্দুক, রাজপরিবারের ছবি এবং আরো অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন। ইন্দুপ্রভা দেবীর আত্মকথাটি নাটোর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে রাজকুমারী ইন্দুপ্রভার আত্মকথা শিরোনামে ২০১৮ সালের অক্টোবরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে।

রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা দেবীর পরিচয় : ১৭৩৪ খ্রিস্টাব্দে নাটোর শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে দিঘাপাতিয়ার জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন দয়ারাম রায় (১৬৮০-১৭৬০)। দিঘাপাতিয়া রাজবাড়ি (বর্তমানে উত্তরা গণভবন নামে বিখ্যাত) নাটোর শহর থেকে ২ দশমিক ৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

মুর্শিদকুলী খাঁ দয়ারামকে ‘রায়-রায়ান’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তার চতুর্থ বংশধর রাজা প্রমথনাথ রায়ের ছিল চার পুত্র ও এক কন্যা। এই চার পুত্র ছিলেন প্রমোদনাথ রায়, বসন্তকুমার রায়, শরত্কুমার রায় ও হেমন্তকুমার রায়। আর একমাত্র কন্যা ছিলেন ইন্দুপ্রভা দেবী।

পূর্ব বাংলার আরো অনেক জমিদার পরিবারের মতো এ পরিবারটিও স্থানীয় সমাজ-সংস্কৃতিতে অনেক অবদান রেখেছিলেন। ১৯১০ সালে শরত্কুমার রায় তার ভাই প্রমোদনাথ রায়ের দান করা জমিতে বাংলাদেশের প্রথম জাদুঘর ‘বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠা করেন।

দিঘাপাতিয়া রাজগণ তাঁদের মহত্ত্ব ও জনকল্যাণের জন্য খ্যাত ছিলেন। বিশেষ করে রাজশাহী জেলা এ পরিবারের কাছে ঋণী এ কারণেই যে তাঁরা ওই এলাকায় কতিপয় পাবলিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেন এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করেন।

দয়ারাম রায় যে প্রাসাদ ও আনুষঙ্গিক ভবন তৈরি করেছিলেন, সেগুলো ১৮৯৭ সালের বিরাট এক ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর প্রমোদনাথ রায় পুরো প্রাসাদ কমপ্লেক্স পুনর্নির্মাণ করান।

3 11 নাটোরের রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা দেবীর আত্মকথন
নাটোরের রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা দেবীর আত্মকথন 43

ইন্দুপ্রভা দেবীর জন্ম ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে; ১২৮৮ বঙ্গাব্দে। ইন্দুপ্রভা দেবী তার আত্মকথার শুরুতেই নিজের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে : ‘আমার জীবন অতি চমৎকার। ইহা দ্বারা নভেল বা নাটক রচনা করা যায়। আমাদের বাড়ী রাজশাহীর মধ্যে দিঘাপাতিয়া গ্রামে। আমরা ৫ ভাইবোন। আমি শৈশবে পিতৃহীন।

শুনিয়াছি আমার পরে আরও একটি ভাই হইয়াছিল। কিন্তু সে জন্মমৃত। এখন সর্ব্বাপেক্ষা আমিই ছোট। আমার ৪ দাদা।’ এই আত্মকথা থেকে জানা যাচ্ছে, ইন্দুপ্রভার বয়স যখন দুই বছর দুই মাস, তখন তার বাবা মারা যান। এখানে আরো একটি লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, রাজশাহী অঞ্চলকে সে সময় রামপুর নামে ডাকা হতো।

ইন্দুপ্রভার লেখায় রামপুর নামটিই ব্যবহূত হয়েছে। যা হোক, অল্প বয়সে বাবাকে হারিয়ে পরিবারে ইন্দু কিছুটা একা হয়ে পড়েন। ‘আমি বাবার বড় আদরের ছিলাম। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর একমাত্র অবহেলার পাত্র হইলাম।’ ইন্দুর ভাইয়েরা লেখাপড়া করতেন রাজশাহী বা রামপুরে।

আর ইন্দু থাকতেন নাটোরের দিঘাপাতিয়ার রাজবাড়িতে। ছোটবেলায় কিছুদিন ইন্দু মা’র সঙ্গে কলকাতায় সাতপুকুরের বাসায় ছিলেন। সেখান থেকে নৌপথে রাজশাহী ফিরেছিলেন। যদিও কেন সে সময় তারা কলকাতায় গিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে ইন্দু কোনো ধারণা দিতে পারেননি। কলকাতায় তারা মাস ছয়েক ছিলেন।

‘তারপর কেন জানি না মা-দিদির সঙ্গে আমিও কলিকাতায় সাতপুকুরের বাসায় আসিয়া থাকিলাম।…কিছুদিন পর নৌকা পথে আমরা সেখান হইতে রওনা হইয়া জানি না কোন পথ দিয়া দিঘাপাতিয়া ঘুরিয়া রামপুরে দাদাদের নিকট আসিলাম এবং কাছেই একটা ভিন্ন বাসায় থাকিলাম।’

4 8 নাটোরের রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা দেবীর আত্মকথন
নাটোরের রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা দেবীর আত্মকথন 44

ইন্দুপ্রভাব আত্মকথার ভাষা এবং বিবরণী সাবলীল। কোথাও অতিকথন নেই। পুরো লেখায় সেভাবে কোনো ছন্দপতন নেই। আত্মকথা পড়ার সময় পাঠক ক্লান্ত হবেন না, বরং রাজপরিবারকে নিয়ে লেখা কোনো গল্প পড়ছেন বলেই মনে হবে। ইন্দুপ্রভার লেখা অকপট।

১২০ বছরের কিছু আগে লেখা আত্মকথায় বাঙালি কিশোরী ইন্দুপ্রভা তার প্রেম নিয়ে যে বিবরণী লিখেছেন, তা সাহিত্য রসে সিক্ত এবং সাহসী। জীবনের আত্মসমালোচনা করেছেন নির্দ্বিধায়; এখানে তার প্রবল ব্যক্তিত্বের লক্ষণ দেখা যায়।

নিজের বড় হয়ে ওঠার সময় ইন্দু পারিবারিক স্নেহ থেকে কিছুটা বঞ্চিত হয়েছিলেন। মায়ের স্নেহ সেভাবে পাননি। সেই কলকাতায় যাওয়ার সময়েই তিনি লিখেছিলেন, ‘জন্মাবধি কখনও মা চিনি না। বরাবর দিদির কাছেই ছিলাম। এখন দিদি যাওয়ায় বড় কষ্ট হইল।

তাহাতে আবার মাও প্রায় সর্ব্বদা সামান্য কারণেও বকিতেন।’ এরপর আরো লিখেছেন, ‘জন্মাবধি আমি প্রায় সর্ব্বদাই চাকরাণীদের কাছেই থাকিতাম। কেহ বড় যত্ন করিত না। কেবল মাঝে মাঝে দাদাদের ও দিদির একটু আদর পাইতাম। কখনও উপযুক্ত সঙ্গী পাই নাই।

অনবরত চাকরাণীদের কাছে থাকিয়া ও চাকরাণীদের মেয়েদের সঙ্গে খেলা করিয়া হূদয়ের ঘোর অবনতি হইল। হিংসা, দ্বেষ, রাগ, আবদার ইত্যাদি নীচতায় হূদয় পূর্ণ হইল। সর্ব্বদা দোষ করিলে মিথ্যা বলিতাম ও নানা প্রকার দুষ্টামি খেলা খেলিতাম। যদিও পারিতাম বটে, কিন্তু তাহাতে কিছুই ফল হইতেছিল না।’

ইন্দুর বাবা তাদের এক আত্মীয়ের পুত্রের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করে গিয়েছিলেন। ইন্দু সে কথা জ্ঞান হওয়ার পর থেকে জেনে এসেছেন। ইন্দুর বাবা সেই ছেলেকে তাদের বাড়িতে রেখে লেখাপড়া শেখার ব্যবস্থা করিয়েছিলেন। ইনিই মহেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী।

5 7 নাটোরের রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা দেবীর আত্মকথন
নাটোরের রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা দেবীর আত্মকথন 45

‘ছেলেবেলা হইতে লোকমুখে সমস্ত শুনিয়া তাঁকেই স্বামী বলে মনে করিতাম এবং যদিও তিনি প্রায়ই আমাদের বাড়ীতেই থাকিতেন ও দেখা হইত, তবুও লজ্জায় কখনও কথা বলি নাই।’ কিন্তু ইন্দুর মা জানালেন, তিনি সেই পাত্রের বড় ভাইয়ের সঙ্গে ইন্দুকে বিয়ে দেবেন।

‘বাবার মৃত্যু পর আমার নির্দয় জননী তাঁকে দেখিতে পারতেন না এবং তাঁর বড় ভাইয়ের সঙ্গে (লিখিত মরিতে ইচ্ছা করে) আমার বিবাহ দিতে ইচ্ছা করেন।’ কিন্তু মায়ের এ ইচ্ছাকে কোনোভাবেই মেনে নেননি ইন্দু। নিজের বয়স যখন ১০-১১ তখন থেকেই তিনি লিখছেন।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
লেখক: মাহাবুব খন্দকার নাটোর প্রতিনিধি
সাংবাদিক এবং লেখক
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!