সমুদ্র দর্শনে আরও একবার (পর্ব ১৩)

কামরুল হাসান
কামরুল হাসান
13 মিনিটে পড়ুন
জোয়ারে ডুবে যাওয়া সোনাদিয়া দ্বীপে যাওয়ার সেতু

আটটি বাঁশের খুঁটি ধরে রেখেছে চারটি ছনের চাল। মাঝের গোল টেবিল ও পেছনের কাঠের বেঞ্চি বলে দেয় এটি সমুদ্র দর্শনে আসা অতিথিদের জন্য বানানো। গোল টেবিলটি দাঁড়িয়ে আছে একটি অমসৃণ কাণ্ডের উপর, সরু বৃক্ষের দেহের কোনো অংশ – পা কিংবা ঊরু। বীচে শায়িত ভঙ্গিতে বিশ্রাম নেওয়া বা সমুদ্র দেখার জন্য যেরকম কাঠের আসন পাতা থাকে তেমনি এক কাঠের হেলানো আসন, এগুলো সুইমিং পুলের পাশেও পাতা থাকে, সাঁতার কেটে উঠে জিরোনো বা বসে বসে জলে সন্তরণরত নগ্নিকাদের দেখার আসন, একটি বেঢপভাবে ঢুকে আছে ওই চতুষ্কোণ ছাউনির ভেতর। তাতে সুবিধাই হয়েছে আমাদের দলটির, কেউ কেউ বসেছে সেটিতে, সকলের বসার জায়গা তবু নেই, অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। এরকম ছাউনি থেকে সারাদিন বসে বসে সমুদ্র দেখা যায়। মনে হবে একঘেয়ে, কিন্তু দিনের প্রহরে প্রহরে বদলে যায় সমুদ্রের রূপ, আলো আর আকাশ বারংবার তার রূপ বদলায়। দিনের শেষে সূর্যাস্ত দেখা চিত্তাকর্ষক! আর যদি আবহাওয়া তার রূপ বদলায়, দিগন্তে বিস্ফারিত হয় কালো মেঘের পাল, আকাশ চিরে যায় বিদ্যুতের রেখা, মেঘের ডাক আর বজ্রপাত কাঁপিয়ে তোলে হৃদয়, আর নেমে আসে বৃষ্টি তবে তা হবে বোনাসের পর বোনাস। আর যদি আপনি খুব সৌভাগ্যবান হন তবে সমুদ্র ঝড় দেখা হবে বিস্মরণ অযোগ্য এক অভিজ্ঞতা। আর এ সবই দেখতে পাবেন এমনি একটি ছাউনির নিচে বসে। কেবল বাতাসের বেগ প্রবল হলে আপনাকে ছাউনি ছেড়ে একটি দালানে বা ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে হবে। যা আপনি চাইবেন না, ক্যামেরার জন্য অবশ্য বিরল শট, তা হলো সুনামী, ঢেউয়ের হঠাৎ করে কাল নাগিনীর মতো মাথা তুলে ছোবল দিতে আসা।

খালের তীরে কবি ও ভ্রামণিকগণ সমুদ্র দর্শনে আরও একবার (পর্ব ১৩)
খালের তীরে কবি ও ভ্রামণিকগণ

ছাউনির নিচে বসে মনে হলো ‘আমরা এখানে কেন এখানে কী কাজ আমাদের?’ তখন মনে পড়লো আমাদের চা-পানের কথা। চায়ের পরিবর্তে পেলাম টা অর্থাৎ বিস্কিট। ঝোলা থেকে বেরুল আম্রপালি আম। ছোটো আম, কিন্তু স্বাদ মিষ্টি। কাল খেয়েছিলাম কাঁঠাল, আজ আম। দুটোই সুস্বাদু। তৃতীয় ফল হিসেবে এলো কলা, সঙ্গে পাউরুটি। টা-য়ের ষোলো কলা পূর্ণ হলো, চা রইল শূন্যে। অর্থাৎ প্রাতরাশের আট আনাই বাকি রইল। দেখি দুটি বাঁশের খুঁটির সাথে কালকের ব্যানারটি টাঙ্গাচ্ছে তরুণ কবিরা। তার মানে দ্বিতীয় দফা সম্বর্ধনা হতে যাচ্ছে কবি হাফিজ রশিদ খানের। তাকে ‘মৈনাক সম্মাননা’র ক্রেস্ট প্রদান করলো ‘দীপাঞ্চল সাহিত্য অঙ্গন’। এরপরের বিস্ময় চিত্রশিল্পী আর. করিমের আঁকা হাফিজ রশিদ খানের পোট্রেট। প্রধানত সবুজ রঙে আঁকা হাফিজ রশিদ খানের চেহারাটি তার সবুজ কালের। অবয়ব সুন্দর ফুটেছে। এটা অনুমেয় ছিল। যা অনুমেয় ছিল না, তা হলো আর. করিম আমারও একটি পোর্ট্রেট এঁকেছে। এর রঙ প্রধানত খয়েরি ও হলুদ। আমি অভিভূত হলাম। পোর্ট্রেট নিয়ে বিভিন্ন কম্বিনেশন পারমুটেশনে ছবি তোলার পর কবি রুদ্র সাহাদাৎ তার এবছর প্রকাশিত ‘কবিমন হাঁটে দরিয়ানগরে’ বইটি আমাদের উপহার দিল। কবি সাইয়্যিদ মঞ্জু উপহার দিল তার সাম্প্রতিক কাব্য। দুটি গ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকেছেন কবি ও চিত্র শিল্পী নির্ঝর নৈঃশব্দ্য। ভারি মনোরম প্রচ্ছদ। ব্যাক কভারে রঙিন উজ্জ্বল ছবি। মঞ্জুর বইতে সাম্পান আর রুদ্রর বইতে সৈকতের হেলানো চেয়ার ও ছাতার ছবি। যেভাবে বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয়, সেভাবে বই দুটি নিয়ে আমরা দাঁড়িয়ে দলবদ্ধ ছবি তুলি।।আমি হাফিজ ভাইয়ের জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম আমার প্রথম ভ্রমণগ্রন্থ ‘বিলেতের দিনলিপি’ আর মঞ্জুর জন্য চতুর্থ ভ্রমণগ্রন্থ ‘সিমলা মানালির পথে।’ কবিতার দুটি বই ছিল সাথে, দুজন শিল্পী তা নিয়ে নিল সাগ্রহে। তরুণ কবিদের আমার প্রথম কাব্য ‘সহস্র কোকিলের গ্রীবা’র (দ্বিতীয় মুদ্রণ) দিয়েছিলাম তাদের সাথে দেখা হওয়ার প্রথম দিনেই, গত মার্চে।

শিল্পী আর. করিমের আঁকা ছবি নিয়ে কবি হাফিজ রশিদ খান ২ সমুদ্র দর্শনে আরও একবার (পর্ব ১৩)
শিল্পী আর. করিমের আঁকা ছবি নিয়ে কবি হাফিজ রশিদ খান

এই ছাউনির অদূরে আরেকটি ছাউনি দেখলাম, প্রহরের প্রহারে জর্জরিত হয়ে বসার উপযোগী আর নেই, কাঠের এক ভাস্কর্য হয়েছে। আমরা গেলাম উত্তরদিকে সেই সীমানাঘেরা পর্যটক কেন্দ্রের দিকে। সীমানার গেট পেরিয়ে দুপাশে দুটি যত্নে নির্মিত, খুব বড়ো নয় এমনি ফুলের বাগান দেখি আর দেখি পুবের বেড়ার ধার ধরে স্থাপিত গোল টেবিলগুলো; চারকোণা ছাউনির টেবিলটির অনুরূপ। যে ভদ্রমহিলা আমাদের চা খাওয়াতে চেয়েছিলেন, জানি না, আমরা কেন খাইনি, তিনি আমাকে ও রশিদ খানকে ঘরটির ভেতরে নিয়ে গেলেন। তার দুটি ছোট ছেলেমেয়ে বেরিয়ে এলো। একপাশে হেঁশেল, তাকের উপর রাখা চায়ের কাপ (আচ্ছা, এত প্রকার তৈজস থাকতে আমার চোখ কেবল চায়ের পাত্রের দিকে যায় কেন?)। পাশের ঘরটি পুরো ঘরের ৭০%, তার মেঝেটি আসবাবশূন্য, একপাশে প্লাস্টিক চেয়ার একের উপর আরেক এইভাবে স্তূপাকার করে রাখা, দেয়ালে কয়েকটি তাঁবু ঝুলছে। তিনি যে আমাদের আগ্রহ নিয়ে সব দেখাচ্ছেন এর কারণ তিনি বুঝতে পেরেছেন আমরা ভ্রামণিক, আমরা নিসর্গপ্রেমী, আমরা আবারও আসতে পারি সোনাদিয়া দ্বীপে (হয়ত পাখি নয়, মানুষের রূপে)। তাতো পারিই, খোকন কায়সার ত্রিশবার পারলে আমরা দুইবার পারব না? তিনি আমাদের দেখালেন বড়ো চরে যা নেই – বিদ্যুৎ ও কলের পানি, তা এখানে আছে। দেখলাম তাই, ঘরের লাগোয়া পানির কলটি অটুট, চোর এখনো নিতে পারেনি।

শিল্পী আর. করিমের আঁকা ছবি নিয়ে লেখক সমুদ্র দর্শনে আরও একবার (পর্ব ১৩)
শিল্পী আর. করিমের আঁকা ছবি নিয়ে লেখক

আমাদের সাথীরা ফের এগিয়ে গেছে সমুখে। বুঝলাম এটা হলো পশ্চিম চরের সেই জায়গা যেখান লম্বা কাঠের জেটিতে আমাদের নৌকা প্রথম ভিড়েছিল। সেই হলুদরঙা উঁচু ঠ্যাঙ ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রটিকে দেখতে পেলাম কিন্তু কাঠের জেটিটিকে দেখতে পেলাম না। কারণ সেটি ডুবে গেছে জোয়ারের পানিতে, কেবল কাছের খুটিগুলোর মাথা জলের উপরে। দুটি গ্রাম্যবালিকা আশ্রয় কেন্দ্রের পেছনের ঘরবাড়িগুলোর দিকে হেঁটে গেল সরল চপলতায়। কয়েকটি মাছ ধরার ট্রলার ও সাম্পান ল্যান্ডস্কেপে নৌকার শিল্প এঁকে দিল। তারা ফটো শিকারীদের ক্যামেরার সামনে মডেল হয়ে গর্বিত দাঁড়াল। গুগলের আবহাওয়ার পূর্বাভাষকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কাল ও আজ দুদিনেই চমৎকার রৌদ্রময় দিন, রাত চারটের ঝিরঝির ছাড়া বৃষ্টি হয়নি, বজ্রপাত তো নেই-ই। আমরা নোয়া চর খালের পাশে নৌকা ও ট্রলারকে ব্যাকড্রপে রেখে দলবদ্ধ, যুগল ও একক ছবি তুলি, মানে যতরকম তোলা যায়।

কে যেন বলেছিল ঘাটের কাছে চা-দোকান আছে, কোনোপ্রকার দোকানের চিহ্নমাত্র নেই। কিছু ভেড়া চরছিল মাঠে। একটি সাইনবোর্ডে লেখা কচ্ছপ ও কচ্ছপের ডিম সংরক্ষণের অনুরোধ। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে নিযুক্ত একটি এনজিওর সাইনবোর্ড যার শিরোনাম, ‘আসুন আমরা কাছিম সংরক্ষণ করি।’

এই দ্বীপে যেমন চিংড়ির পোনা সংগ্রহ করা হয়, তেমনি পালন করা হয় কচ্ছপ। এর পুবে মগচরে রয়েছে শুটকি মাছের একটি কেন্দ্র, আর পশ্চিমে বেরাকাডিয়ায় রয়েছে চিংড়ির পোনা সংগ্রহের কেন্দ্র। বেরাকাডিয়ার দিকটায় খালের প্রশস্ততা অনেক বেশি। আমরা অবশ্য দেখিনি। সেখানে আরও কিছু কাডিয়া আছে। আরও উত্তরে হাঁসচর।

মাঝি নৌকা টেনে নিয়ে যাচ্ছে তীরে সমুদ্র দর্শনে আরও একবার (পর্ব ১৩)
মাঝি নৌকা টেনে নিয়ে যাচ্ছে তীরে

এখন ফিরে যাবার পালা। নৌকার দরদাম করছিল আয়োজকরা। ঘাটে আছে একটি ফাইবার গ্লাসের নৌকা, গলুই কাঠের তৈরী, এটি একটু বড়ো। এ সময় আরেকটি ফাইবার গ্লাসের নৌকা কিছু যাত্রী নিয়ে ঘাটে ভিড়ল, এটি ছোটো, ফ্লাট স্পিডবোটের মতো। আমাদের জন্য এই বোটটিই হতো আদর্শ, কিন্তু ঘাটে সিরিয়াল আছে, সে যেতে পারবে না। যেটি সিরিয়ালে আছে ভাড়া হাঁকল বারোশত। কেনাকাটায় এই হয়। ক্রেতা ও বিক্রেতা দুপ্রান্ত থেকে শুরু করে, ক্রেতা কিছুটা বাড়ায়, বিক্রেতা কিছুটা ছাড় দেয়। এভাবে তারা মধ্যবর্তী একটি আপোষবিন্দুতে পৌঁছায়। নৌকার মাঝি ৮০০ তে এসে স্থির হয়। মঞ্জু ও অন্যান্যরা দরদাম শুরু করেছিল ৪০০ থেকে, পরে বাড়াতে বাড়াতে ৭০০ পর্যন্ত যায়। ওরা ভেবেছিল ওটাই আপোষের ভাড়া। আমরা নৌকায় উঠতে গেছি, কেউ কেউ উঠেও গেছে, নৌকার মাঝি যখন শুনল আমরা ভাড়া দিব ৭০০, সে বেশ কর্কশভাবে আমাদের নৌকা থেকে নেমে যেতে বল্ল। লোকটির রূঢ়তা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। নৌকার গলুইয়ে দাঁড়ানো মালকোঁচা মারা লোকটিকে জলদস্যু মনে হচ্ছিল। পরে আমরা ৮০০ই মেনে নিলাম। এমনি সময়ে নৌকার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে এক বয়স্ক লোক ও এক নারী। দয়াপরবশ হয়ে আমরা তাদের নৌকায় তুলে নেই। তখন আরও কিছু যাত্রী এসেছে, কিন্তু সেই মাঝিকে আর দেখি না। পরে টের পেলাম সে গেছে গ্রাম থেকে নতুন যাত্রী ডেকে আনতে। দুজন বয়স্কলোক, দুজন নারী, দুজন যুবক ও তিন বালিকাসহ নতুন যাত্রী হয়েছে ৯ জন। আমরা ১২, তারা ৯। এখানে গানবোটে বা নৌকায় জনপ্রতি ভাড়া হলো ৩০ টাকা। আমরা যখন এদের কাছ থেকে, কারণ তারা তো প্রস্তুত ভাড়া দিতে, ৩০ x ৯ = ২৭০ টাকা তোলার পরিকল্পনা করছি, তখন জলদস্যু মাঝির অন্য হিসাব। অতিরিক্ত ৯ জনের ভাড়া আর আমাদের ৮০০ মিলিয়ে সে এক হাজারের টার্গেট পূর্ণ করবেই। ঘাটের ট্যাক্স নাকি তিনশ, এক হাজার টাকা না পেলে তার পোষায় না। তর্কাতর্কি হলো কিছু চাটগাঁইয়া ভাষায় কিন্ত শেষাবধি এই মাস্তান মাঝির কাছে আমাদের হার মানতে হলো। অথচ ত্রিশ টাকা হিসেবে ধরলে আমাদের ১২ জনের ভাড়া হয় ৩০ x ১২ = ৩৬০ টাকা। একহাজারের লক্ষ্য পূরণ করে জলদস্যু শান্ত হলো, আমরাও প্রকৃতিতে নিমগ্ন হলাম।

ফিরে আসার পথটি তো আমাদের চেনা, কাল যখন দ্বীপের দিকে যাচ্ছিলাম, তখন চোখেমুখে ছিল অদেখাকে দেখা আর অজানাকে জানার কৌতুহল। আজ সেটা নেই। আজ ধীরস্থির পর্যবেক্ষণ। এই নৌকাটি আগের নৌকাটি থেকে বড়ো ১২ + ৯ = ২১ কেন, সে নিতে পারতো আরও লোক। এক হাজারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে তাকে কমপক্ষে ১০০০/৩০ = ৩৪ জন যাত্রী নিতে হবে এবং এরা তা নেয়ও। আমি বসেছি পেছনের উঁচু গলুইয়ে পা ঝুলিয়ে। আমার পাশে হাফিজ রশিদ খান, টিশার্ট বদলে সবুজ প্রিন্টের শার্ট পরেছেন ফের। পেছনে সেই দুজন নারী, রোদ থেকে বাঁচতে বা নিজেদের লুকাতে তারা মেলে ধরেছে ছাতা। স্থানীয় যাত্রীরা বেশির ভাগ নৌকার ডানপাশে আর আমরা বেশিরভাগ নৌকার বাম পাশে ও সম্মুখ দিকটায়। এখানে নৌকার কিনারায় বসে নিচে পা রাখার একটি জায়গা আছে বেঞ্চের মতো। সেখানে পা রেখে বামপাশে বসেছে চার সঙ্গীত শিল্পী, আমার কাছাকাছি বসেছে শাফায়াত জামিল দিদার। রোদ থেকে বাঁচতে সেও এক কালো ছাতা মেলে ধরেছে। একটু আগে দেখেছি সে মুখে সান ক্রিম মেখেছে। তাতে বুঝতে পারলাম নারীর মতো সৌন্দর্য সচেতন এই ফর্সা ও সুদর্শন যুবক। দিদারের পাশে পরপর বসেছে রশিদ খান, জাহান এ বি ও জাহেদ সরওয়ার। গানের পাখিরা কী করে এক ডালে এসে বসল, ভাবি। নৌকার অগ্রভাগে তিন তরুণ কবি রুদ্র সাহাদাৎ, সুব্রত আপন ও মিজান মনির। এপাশে তিন বালিকা, চিত্রী আর. করিম ও কবি গোলাম সামদানী, এরপরে স্থানীয় দুই যুবক, সবশেষে কবি সাইয়্যিদ মঞ্জু। নৌকা তখনো ঘাট ছাড়েনি, সেসময়ে সে হঠাৎ নৌকা থেকে খালে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এই সুনন্দ সকালে ‘কেন তার মরিবার হলো এত সাধ’ প্রথমে বুঝিনি, পরে বুঝেছি গরমে অতীষ্ঠ হয়েই ওই জলে অবগাহন। সে যে সাঁতার জানে, ভালোই জানে এই সার্টিফিকেট পাওয়ার পরই সে জল থেকে উঠল। সকাল থেকে দেখেছি সে তার পোষাক পাল্টেছে, লুঙ্গি ও শার্ট ছেড়ে শর্টস ও স্যান্ডো গেঞ্জি পরেছে। এখন নৌকায় বসে শরীর ও পোষাক শুকাচ্ছে মাতা সূর্যের অকৃপণ রৌদ্রে।

নৌকার হাল ধরে আছে মাঝির ছেলে। রিজার্ভ যাওয়ার সময় আমরা যেমন ঘনিষ্ঠ হতে পেরেছিলাম এখন এই মিশ্র যাত্রী সমাবেশে তা সম্ভব হলো না। গোলাম সামদানী কাল আক্ষেপ করেছিলেন, দ্বীপে পাখি নেই দেখে। কে যেন বলেছিল, মানুষের আগমনে, ইঞ্জিন বোটের ভটভট শব্দে পাখিরা চলে গেছে নির্জন অঞ্চলে। সে সময়েই আমরা একটি পাখির মালা দেখেছিলাম মিইয়ে আসা আলোয় কূলায় ফিরছে। তাদের বিন্যাস ছিল সামরিক কুচকাওয়াজে এ্যাক্রোবেটিক দেখানো যুদ্ধ বিমানগুলোর মতো। কে কার কাছে থেকে শেখে? আমরা পাখিদের কাছ থেকে না পাখিরা আমাদের কাছ থেকে? মনে হয় প্রথমটিই সত্য। যেমন ওই ওড়ার আকাঙ্ক্ষা! আজ তার মনোযোগ আকর্ষণ করি জলে ডোবা গাছগুলির একটিতে বসে থাকা তিনটি পাখির প্রতি।

আমরা এসে দেখি জেলে গ্রামের উঠোনটি, সোনাদিয়া সেতুর মাটিতে ধপাস করে বসে পড়া পথটি সব জোয়ারে তলিয়ে গেছে। এখন আমরা নামি কীভাবে? ওপাশে একটি নির্মাণাধীন বরফকল তীর বাঁচাতে বালুর বস্তা ফেলেছে, সেখানে নৌকা ভেড়ানো যায়, কিন্তু ভিড়তে দিবে না বরফ কলের কর্মীরা। বস্তুত কোনো নৌকা যেন ভীড়তে না পারে তাই তারা বেড়া দিয়ে রেখেছে। সেখানে পানি অল্প, মাঝি নেমে পড়েছে কোমর অবধি পানিতে, এক মোটা রশি দিয়ে সে টেনে চলেছে তার নৌকাটি, মনে হলো আটকের পর আমাদের জলযানটিকে ডাঙায় টেনে নিচ্ছে এক জলদস্যু।

(চলবে)

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
কামরুল হাসানের জন্ম ২২ ডিসেম্বর, ১৯৬১ সালে বাংলাদেশের শরীয়তপুর জেলায়। তিনি আশির দশকের কবি। প্রথম কাব্য ‘সহস্র কোকিলের গ্রীবা’ প্রকাশিত হয় ১৯৯১ সালে। এরপরে আরও ১১টি কাব্য প্রকাশ করেন। ২০১২ সালে প্রকাশিত হয় ‘নির্বাচিত কবিতা’। কবিতার পাশাপাশি গল্প ও কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ লেখেন এবং বিদেশি সাহিত্য থেকে অনুবাদ করেন। ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয় একমাত্র গল্পগ্রন্থ ‘মধ্যবিত্ত বারান্দা ও অন্যান্য গল্প’। ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয় প্রবন্ধের বই ‘প্রহরের প্রস্তাবনা’। ভ্রমণপিপাসু এ কবি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সুপ্রচুর ভ্রমণকাহিনী লিখছেন। এপর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে চারটি ভ্রমণকাহিনী। ছাত্রাবস্থায় তার কবিতা সাপ্তাহিক ‘দেশ’ ও ত্রৈমাসিক ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তার অনুদিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই। ২০০৩ সালে সমীর রায়চৌধুরী ও তুষার গায়েনের সাথে সম্পাদনা করেন দুই বাংলার যৌথ সংকলন Post Modern Bangla Poetry 2003। তিনি বেশ কয়েকবার আমন্ত্রিত কবি হিসেবে দক্ষিণ এশীয় সাহিত্য উৎসবে যোগ দিয়েছেন। কবিতার জন্য পেয়েছেন ‘মৈনাক সন্মাননা স্মারক’ ও ‘কবিকুল, কক্সবাজার কবিতা সম্মাননা‘। ছাত্রজীবনে মেধাবী কামরুল হাসান ভারতের বিখ্যাত আইআইটি খড়গপুর থেকে প্রকৌশলবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তী পড়াশোনা ব্যবসায় প্রশাসনে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। পেশাগত জীবনে বহুবার চাকরি বদল করেছেন। করপোরেট জগৎ থেকে শিক্ষকতায় যোগ দেন। গত ১৫ বছর ধরে পড়াচ্ছেন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সটিতে। তিনি বিবাহিত ও চার সন্তানের জনক। সম্প্রতি তিনি মহেশখালির দক্ষিণে সোনাদিয়া দ্বীপে সেখানকার তরুণ কবিদের আমন্ত্রণে কবি হাফিজ রশিদ খানের জন্মদিন পালনে গিয়েছিলেন। সে ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা ‘সমুদ্রদর্শনে আরও একবার’।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!