একাধারে যোদ্ধা, সাংবাদিক এবং লেখক

সিদ্ধার্থ সিংহ
সিদ্ধার্থ সিংহ
6 মিনিটে পড়ুন

১৮৯৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়েস-এর ওক পার্কে জন্মানো যে ছেলেটি ডাক্তার বাবার সঙ্গে মাত্র দু’বছর বয়সেই ছিপ ধরে বসতেন কোনও জলাশয়ের ধারে, বছর সাতেক বয়সে ট্রিগার টিপতে শিখে দশ বছর বয়সেই তৈরি করতে পেরেছিলেন অভ্রান্ত লক্ষ্য, তাঁর মতো দুরন্ত ছেলেরা যে একটু-আধটু স্কুলটুল পালাবেন, তা আর এমন কথা কী? কিন্তু মায়ের মন তো! ঠিক সময়ে ছেলে বাড়ি না ফিরলেই তিনি বেরিয়ে পড়তেন থানার দিকে, আবার কখনও সখনও হাঁটা ধরতেন হাসপাতালের রাস্তা।

বাবা তেমন কোনও দুশ্চিন্তা না করলেও, আগে দেখতেন ছিপ আর বন্দুক ঠিক জায়গায় আছে কি না… থাকলে‌ বিন্দুমাত্র চিন্তা করতেন না। কিন্তু না থাকলেই পোষা কুকুর আর একটা টর্চ নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়তেন। কাছাকাছি কোনও জলাশয়ের দিকে অথবা আশপাশের জঙ্গলে। এবং অদ্ভুত ব্যাপার, প্রায় প্রতিবারই তিনি ধরে নিয়ে আসতেন তাঁর ছেলে হেমিংওয়েকে।
যদিও একবার ব্যর্থ হয়েছিলেন। সে বার সপ্তাহখানেক চলেছিল খোঁজাখোঁজি। তার পর নিজেই একদিন বাড়ি ফিরে এসেছিলেন সেই ছেলে। তখনও তাঁর বয়স পনেরো বছর হয়নি।
তবু ডাক্তারি পড়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সমস্ত বন্দোবস্ত যখন ঠিক হয়ে গেছে, ঠিক তখনই হেমিংওয়ে জানালেন, তিনি আর পড়বেন না। চাকরি করবেন।

অগত্যা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে লাভ নেই দেখে, বাবা আর তেমন কোনও অমত করলেন না। অবশেষে নিজেই জোগাড় করে নিলেন দ্য কানসাস সিটি স্টার সংবাদপত্রের একটা প্রতিবেদন লেখার কাজ। করলেনও কয়েক মাস। কিন্তু তার পরেই আবার তাঁকে দেখা গেল বাড়িতে। জানা গেল, তিনি খবরের কাগজের চাকরিটি ছেড়ে দিয়েছেন। নতুন চাকরি নিয়ে চলে যাচ্ছেন বিদেশে। তাই যাবার আগে দেখা করতে এসেছেন মা-বাবার সঙ্গে।

এ খবর শুনে সকলেই ভাবলেন, নিশ্চয়ই তিনি আরও বড় কোনও চাকরি পেয়েছেন। ভাল অফিস। বেশি মাইনে। কিন্তু পরে জানা গেল— না, এ সব কিছুই নয়। তিনি নিয়েছেন যুদ্ধক্ষেত্রে অ্যাম্বুলেন্স চালানোর কাজ।

এ খবরে সকলেই বেশ নিরাশ হলেন। মর্মাহতও। তবু হেমিংওয়ে চলে গেলেন ইউরোপে। ইতালির মাটিতে। তখন সেখানে প্রথম মহাযুদ্ধের শেষের দিক। যুদ্ধক্ষেত্রে কোনও সৈন্য আহত হলেই তাঁকে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ছুটে যেতে হয় তৎক্ষণাৎ।

বেশ কিছু দিন এ রকম ভাবে কাজ করার পর হঠাৎ তিনি ভাবলেন, আহত সৈন্যদের আনা-নেওয়ার কাজ তো মেয়েরাও করতে পারে। তাই গোলা বর্ষণের পর শত্রুপক্ষ ভেদ করে এগিয়ে যাবার গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়ে তিনি নাম লেখালেন ইতালির পদাতিক বাহিনীতে। বয়স তখন সবে উনিশ।

ফিরে আসার পরে, যুদ্ধে এত দিন তাঁর কী ভাবে কেটেছে, তা প্রায় সকলেই জানতে চাইলেন। জানালেনও হেমিংওয়ে। তবু যেন অনেক কিছু বাদ থেকে যাচ্ছে। তাই পুরোপুরি তাঁর অভিজ্ঞতার কথা সবাইকে জানানোর জন্যই দেশে ফেরার প্রায় বছর দশেক বাদে তিনি লিখে ফেললেন তাঁর যুগান্তকারী উপন্যাস— এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস। যা বিক্রি হয়েছে লক্ষ লক্ষ কপি।

তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের মতো বৈবাহিক জীবনও ছিল বেশ অদ্ভুত।‌ ১৯২১ সালে তিনি হ্যাডলি রিচার্ডসনকে বিয়ে করেন এবং তার পর‌ প্যারিসে চলে যান। ১৯২৭ সালে সেই হ্যাডলির সঙ্গে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়। কালবিলম্ব না করে সেই বছরেই তিনি ফের বিয়ে করেন সাংবাদিক পলিন ফাইফারকে। সেই বিয়েও তাঁর ভেঙে যায়। ফলে সেই বছরেই, মানে ১৯৪০ সালে তিনি আমার বিয়ে করেন মার্থা গেলহর্নকে। কিন্তু সেই বিয়েও তাঁর টিকল না। ‌ তিন-তিনটে বিয়ে ভেঙে যাবার পর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যাঁর সঙ্গে লন্ডনে তাঁর পরিচয় হয়েছিল, সেই ম্যারি ওয়েলশকেই তিনি বিয়ে করেন।

এর পর নানা সাংঘাতিক-সাংঘাতিক সব বাধা বিঘ্ন কাটিয়ে, অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ খুব সাফল্যের সঙ্গে শেষ করে, মহাবিশ্বযুদ্ধে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করে আহত হলেন বার কতক।

সেই সময় এমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন তিনি যে, ফার্স্ট আর্মির মেজর জেনারেল বারটন সাহেব একদিন এক সাংবাদিক বৈঠকে জানিয়েছিলেন, হেমিংওয়ে কোথায়, কখন, কী ভাবে আছেন, তা বোঝার জন্য আমার ম্যাপে সব সময় একটা আলপিন গাঁথা থাকে।

এবং এর সঙ্গে ঠিক সেই সময়ে হেমিংওয়ের অবস্থান ও কাজকর্ম নিয়ে উনি যে খবর দিয়েছিলেন, তা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছিল। অর্থাৎ হেমিংওয়ে তখন তাঁর বাহিনী নিয়ে লড়াই তো করছেনই, এমনকী শত্রুসৈন্যের যাবতীয় গতিবিধি নিয়েও খবর পাঠাচ্ছেন মুহুর্মুহু।

এর অনেক পরে, শুধুমাত্র আফ্রিকার জঙ্গলের সৌন্দর্য দেখার জন্য তিনি যখন বিমানে চড়ে বসেন, তখন সেটা আচমকা মাঝ আকাশে ভেঙে পড়ে। তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে আগুনের হলকার মতো। দুঃখে ভেঙে পড়েন সমস্ত দেশবাসী। শোক সংবাদ ছাপা হয়ে যায় তৎকালীন প্রভাতী সংবাদপত্রগুলোতে। পরে অবশ্য জানা যায়, তিনি মারা যাননি। বেঁচে আছেন। তবে অবস্থা বেশ সঙ্কটজনক।

এই গুরুতর অবস্থাই তাঁকে একটু কাবু করে দিয়েছিল। জীবনে যিনি বিপদকে ভালবেসে, নানান যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণপণ লড়াই করে, ফাঁকি দিতে পেরেছিলেন বুনো ষাঁড় এবং হিংস্র জন্তুজানোয়ারকে, ঈশ্বরের অসীম কৃপায় একটুর জন্য বারবার বেঁচে গিয়েছিলেন গোলাবারুদের হাত থেকে, সেই তিনিই ১৯৬১ সালের ২ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেচাম-এর আইডাহোতে আকস্মিক ভাবে নিজের গুলিতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

জীবিত অবস্থায় প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর সাতটি উপন্যাস, ছটি ছোটগল্পের সংকলন এবং দুটি অকল্পিত সাহিত্যগ্রন্থ। মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয় তিনটি উপন্যাস, চারটি ছোটগল্পের সংকলনগ্রন্থ‌ এবঃং তিনটি অকল্পিত সাহিত্যগ্রন্থ।

আর এই সাহিত্যের জন্যই ১৯৫৩ সালে তিনি পান পুলিৎজার পুরস্কার। এবং তার পরের বছরেই, মানে ১৯৫৪ সালে পান‌ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। তিনি‌ ‘হেমিংওয়ে’ নামে পরিচিত হলেও তাঁর‌ পুরো নাম কিন্তু— আর্নেস্ট মিলার হেমিংওয়ে।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
২০২০ সালে 'সাহিত্য সম্রাট' উপাধিতে সম্মানিত এবং ২০১২ সালে 'বঙ্গ শিরোমণি' সম্মানে ভূষিত সিদ্ধার্থ সিংহের জন্ম কলকাতায়। আনন্দবাজার পত্রিকার পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, স্বর্ণকলম পুরস্কার, সময়ের শব্দ আন্তরিক কলম, শান্তিরত্ন পুরস্কার, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার, কাঞ্চন সাহিত্য পুরস্কার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা লোক সাহিত্য পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার, সামসুল হক পুরস্কার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, অণু সাহিত্য পুরস্কার, কাস্তেকবি দিনেশ দাস স্মৃতি পুরস্কার, শিলালিপি সাহিত্য পুরস্কার, চেখ সাহিত্য পুরস্কার, মায়া সেন স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ছোট-বড় অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। পেয়েছেন ১৪০৬ সালের 'শ্রেষ্ঠ কবি' এবং ১৪১৮ সালের 'শ্রেষ্ঠ গল্পকার'-এর শিরোপা সহ অসংখ্য পুরস্কার। এছাড়াও আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত তাঁর 'পঞ্চাশটি গল্প' গ্রন্থটির জন্য তাঁর নাম সম্প্রতি 'সৃজনী ভারত সাহিত্য পুরস্কার' প্রাপক হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!