একাত্তরে শরণার্থীদের আহার যোগাতে মঞ্চে অভিনয় করতেন শিল্পী মমতাজ বেগম

মাহাবুব খন্দকার
মাহাবুব খন্দকার - নাটোর প্রতিনিধি
5 মিনিটে পড়ুন
অভিনয় শিল্পী মমতাজ বেগম

দুপুর গড়িয়ে বিকেল, খাওয়া হয়েছে কোন রকম সেই দুপুরে কিন্তু রাতে কি খাওয়া জুটবে? আগামীকাল তো অনিশ্চিত। একদিন হাজার হাজার দর্শকের করতালি, আদর, আপ্যায়ন আর ভালোবাসায় সিক্ত হলেও আজ মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন সমাজের এক কোনায়।

সহায় সম্বল বলতে কিছুই নেই। অভিনয় জগতে সারা জীবন দিয়ে গেলেন নিজেকে উজার করে। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও বঞ্চিত হচ্ছেন সর্ব মহলে। অভিনয়ে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য পেয়েছেন স্বর্ণ-রুপার মেডেল সহ অনেক পুরস্কার। সেই অভিনয় শিল্পী মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তিনি দু-মুঠো খাবারের জন্য।

তবুও খোঁজ রাখেননা কেউ। জীবনের বিচিত্রতায় হারিয়ে যায় বা যেতে হয় আামদের সমাজের অনেককেই। কিন্তু ব্যস্ত সমাজ যে বড় নিষ্ঠুর মনে রাখে না পিছিয়ে পড়া মানুষের অবদান। সে-ই সময়েই বা কোথায় এ সমাজের লোকেদের।

এমনই একজন অভিনেত্রী নাটোরে মমতাজ বেগম। যিনি সারা জীবন ব্যয় করেছেন অভিনয়ে অথচ আজ পাদপ্রদীপের নিচের অন্ধকারের মত তার জীবন। নাটোর পৌরসভার বর্তমান ০২ নং ওয়ার্ডের লালবাজার মহল্লার, কদমতলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন দরিদ্র বাবা-মায়ের ঘরে।

এখন বসবাস করছেন নাটোর পৌরসভার ০১ নং ওয়ার্ডের উত্তর চৌকিরপাড় মহল্লায়। একটি ভাড়া ঘরে একলাই জীবন কাটাচ্ছেন। দুই কন্যা সন্তানের জননী মমতাজ বেগম। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন, স্বামী সংসার পেতেছেন অন্যজনকে নিয়ে।

১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পরিবারের সঙ্গে ভারতের বালুরঘাটে শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন তিনি। দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকে সেখানেও করেছিলেন অভিনয় দেশের সেবার জন্য।

বালুরঘাটে তৎকালীন সময়ে পুলিশে কর্মরত সাংস্কৃতিক কর্মী সুবল সরকার‘এর সহযোগিতায় বালুরঘাট, কোলকাতা, শিলিগুড়ি, মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মঞ্চনাটকে অভিনয় করেছেন শরণার্থী খাদ্য সংগ্রহের জন্য।

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে উল্ল্যেখযোগ্য নাটক ছিল, এক মুঠো অন্ন, বাগদত্তা, ভাগ্যলক্ষী, কিন্তু, মা যদি মন্দ হয়, আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দাও, কিছু খেতে দাও সহ প্রায় ৩০টি মঞ্চনাটকে অভিনয় করেছেন শরণার্থীর সাহায্যার্থে।

এক সময়ের নামী অভিনেত্রী মমতাজ বেগম স্থানীয় একটি কিন্ডার গার্ডেন স্কুলে আয়া হিসেবে চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। করোনাকালীন সময়ে কিন্ডারগার্ডেন স্কুলটি বন্ধ থাকায় প্রকট ভাবে খাদ্যসংকটে পড়েছেন তিনি। বর্তমানে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবন কাটাচ্ছেন তিনি।

অস্বচ্ছল সংস্কৃতিসেবী ভাতা এবং করোনাকালীন সময়ে অসচ্ছল সাংস্কৃতিক শিল্পীদেরকে সরকারি প্রণোদনা দিলেও তার কপালে সেই প্রণোদনার অর্থ জোটেনি কেন সেটা কেউ জানেন না। অথচ এই অভিনয়শিল্পী একদিন উপমহাদেশের নামিদামি অভিনেতা অভিনেত্রীর সঙ্গে করেছেন অভিনয়।চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করার পরে আর স্কুলে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

পিতার সংসারের হাল ধরতে রোজগারের আশায় মাত্র ১৫ বছর বয়সে অভিনয় শুরু করেছিলেন। অভিনয় জীবনের শুরুতেই প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন তৎকালীন সময়ে সারা জাগানো অভিনয় শিল্পী শ্রী বগাই সাহা‘এর কাছে।আরো ভালো অভিনয় শেখার জন্য তৎকালীন সময়ের সেরা প্রশিক্ষক মোছা: আমেনা বেগমের কাছে অভিনয় জগতের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।

তৎকালীন সময়ে নাটোর জেলার সাড়াজাগানো অভিনেতা সাকাম সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা আমিনুল হক গেদু, অলক মৈত্র, পুতুল রায়, অনিমা দে টুনি, অনিতা পাল, গীতা রায়, নাজমুল হক লালা সহ আরো অনেকের সঙ্গে করেছেন মঞ্চনাটকে অভিনয়।

বালুরঘাটে “কিছু খেতে দাও” নাটকে একই মঞ্চে অভিনয় করেছেন তৎকালীন সময়ের সাড়া জাগানো নন্দিত চিত্রনায়িকা কবরী ‘বিশিষ্ট অভিনেতা আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে “মা যদি মন্দ হয়” নাটকে। এছাড়াও কমেডিয়ান মতি, টেলিসামাদ সহ দেশ সেরা অনেক অভিনয় শিল্পীর সঙ্গে একই মঞ্চে অভিনয় করেছেন।

নাটোরের তৎকালীন সময়ের বষী’য়ান রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা রমজান আলীর সঙ্গে একই মঞ্চে অভিনয় করেছেন মেয়ের ভূমিকায় “কিছু খেতে দাও” নাটকে। নাটকটি নাটোর শহরে হরিশপুরে অবস্থিত বর্তমান শের-ই-বংলা স্কুল মাঠে মঞ্চস্থ হয়েছিল।

এ ব্যাপারে নাটোরের সুশীল সমাজের নাগরিক ও বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, অধ্যাপক অলক মৈত্র জানান, ‘অভিনয় জগতে ওকে আমরা মায়া নামে জানতাম। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে নাটোরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মায়ার অবদান রয়েছে।

সেই সময়ে একজন মেয়ে পরিবার ও সমাজের বিভিন্ন ধরনের বাধার সম্মুখীন হয়েও সে যে, অভিনয় জগতে টিকে ছিল, নাটোরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তার অবদান অনস্বীকার্য। সরকারিভাবে প্রবীণ এই শিল্পীকে সার্বিক সহযোগিতা করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।’

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যে শিল্পী অভিনয় করে শরণার্থীদের খাদ্য সংগ্রহ করেছেন আজ সেই শিল্পী, নিজের জন্য দুমুঠো খাদ্যের সন্ধান করছেন দ্বারে দ্বারে। শিল্প ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কেউ তার কোন খোঁজ রেখেছেন কি? এই দায়বদ্ধতা কার? এর জন্য দায়ী কে ?

আমরা নাকি অন্য কেউ? এমন প্রশ্ন অনেকের মনে থাকলেও সেটি হয়ত গোপন ভাবে রয়েছে কিন্তু সব কিছুর আগে মমতাজ বেগম একজন মানুষ, আমাদের সমাজের একজন সদস্য সেটি ভুলে গেলে চলবে? সুষ্ঠভাবে বাঁচার অধিকার কি মমতাজের নেই?

নাটোরের স্বপ্নজয়ী অভিনেত্রী মমতাজ বেগম সাময়িকীকে জানান, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে শরনার্থীর জন্য খাদ্যের সন্ধান করেছিলাম ! আজ আমার ঘরেই খাদ্য নেই! গতবছর করোনাকালীন সময়ে অসচ্ছল সংস্কৃতি শিল্পী হিসেবে আবেদন করেছিলাম। অসচ্ছল সংস্কৃতি শিল্পীর তালিকা আমার নাম আসেনি। হয়তো অসচ্ছল সংস্কৃতি শিল্পীর তালিকার যোগ্য আমি নই।’

প্রিয় পাঠক স্বপ্নজয়ী অভিনেত্রী মমতাজ বেগমের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কারা এই আটজন? যাদের নতুন তালিকায় নাম এসেছে! এই তালিকায় মোট কত জনের নাম আছে? তারাইবা কারা? তাই জানতে এবং জানাতে সাময়িকীর অনুসন্ধান চলবে…

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
লেখক: মাহাবুব খন্দকার নাটোর প্রতিনিধি
সাংবাদিক এবং লেখক
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!