নাটোরে বসতি স্থাপনার কারণে উজার হয়েছে বেত ঝাড়

মাহাবুব খন্দকার
মাহাবুব খন্দকার - নাটোর প্রতিনিধি
6 মিনিটে পড়ুন
ছবি: মাহাবুব খন্দকার

নাটোর জেলার গ্রাম থেকে শহরের সংযোগ কাঁচা সড়কের দুই পাশ জুরে, দেখা মিলত ক্ষুদ্র ও বৃহত আকারের বেতের বন। যা এখন শুধুই স্মৃতি। তবে অনেক স্মৃতি মুঠোফোনে বন্দী হলেও, বেত বনের সেলফিও চোখে পড়ে না। সড়কের দুই পাড়ে চোখে পরে কেবল বসতি। ভরাট হচ্ছে জলাশয়, অবরুদ্ধ হচ্ছে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের পথ। বাড়ছে জনসংখ্যা, কমছে বন, জমি ,জলাশয়।

প্রকৃতি হারাতে বসেছে ভারসাম্য। উজার হয়েছে বেত বন, ব্যবহার বন্ধ হয়েছে বেতের তৈরি সকল পন্য। বেত বর্তমানে নাটোরে আবাসন সংকটের জন্য এক বিপন্ন প্রজাতি। বেতগাছ সাধারণত নাটোরের বিভিন্ন গ্রামের রাস্তার পাশে, বসতবাড়ির পেছনে, পতিত জমিতে ও বনে কিছুটা আদ্র জায়গায় জন্মে নিত। কিছুদিনের মধ্যেই বেত ঘন হয়ে ঝাড়েও পরিণত হত।

বেত এক প্রকার সপুষ্পক উদ্ভিদ। বেত ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলের ভেজা ও জংলা নিচু জমিতে ভাল জন্মে। এটি বাংলাদেশ, ভুটান, কম্বোডিয়া, লাওস, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ভারত, জাভা ও সুমাত্রা অঞ্চলের উদ্ভিদ। বেতগাছের বৈজ্ঞানিক নাম Calamus tenuis, যা Arecaceae পরিবারভুক্ত। বেতগাছ জঙ্গলাকীর্ণ কাটাঝোপ আকারে দেখা যায়।

চিরসবুজ এই উদ্ভিদটি পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় ৪৫ থেকে ৫৫ ফুট এবং কখনো তার চেয়েও বেশি লম্বা হয়ে থাকে। সাধারণত ছয় প্রজাতির বেত পাওয়া যায়। এদের কান্ড দেখতে চিকন, লম্বা, কাঁটাময় ও খুবই শক্ত এবং শাখাহীন। নলাকার কান্ড প্রস্থে সাধারণত ৫-১৫ মিলিমিটার লম্বা হয়। প্রতিটি কান্ডের আগা থেকে নতুন পাতা বের হয় ও বেড়ে ওঠে। কান্ড বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর নিচের অংশ পোক্ত হতে থাকে।

- বিজ্ঞাপন -

কোনো ধারককে ধরে রাখার জন্য কাটাযুক্ত ধারক লতা বের হয়। বেতে ফুল ধরার আগে গাছ থেকে একধরনের মিষ্টি ঘ্রাণ আসে। তখন মৌমাছি, পিঁপড়া, মাছি এই রস খেতে বেত গাছে ভিড় জমায়। বেত গাছের ফলকে বেতফল বেত্তুন, বেথুন, বেথুল, বেতগুলা, বেত্তুইন ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। এই ফল গোলাকার বা একটু লম্বাটে গোলাকার, ছোট ও কষযুক্ত টকমিষ্টি। এর খোসা শক্ত হলেও ভেতরটা নরম। বীজ শক্ত।

কাচা ফল সবুজ ও পাকলে সবুজাভ ঘিয়ে বা সাদা রঙের হয়। এটি থোকায় থোকায় ফলে। প্রতি থোকায় ২০০টি পর্যন্ত ফল হয়। বেতগাছে ফুল আসে অক্টোবর মাসে আর ফল পাকে মার্চ-এপ্রিল মাস। এটি অপ্রচলিত ফল হলেও অনেকের কাছে খুবই প্রিয়। শুকনো বেত দিয়ে বিভিন্ন হস্তশিল্প জাতীয় জিনিসপত্র তৈরি করা হয়, যেমন-চেয়ার, টেবিল, মোড়া, ডালা, কুলা, চাঙ্গারী, মুড়া, হাতপাখা, চালোন, গোলা, ডোল, ধামা, পাতি, বই রাখার তাক, সোফা, দোলনা, খাট, ঝুড়ি, টেবিলল্যাম্প, ল্যাম্পশেড ইত্যাদি।

এটি গৃহনির্মাণ কাজেও ব্যবহার করা হয়, বিশেষ করে রেস্তরা ঘর বা অফিসের শৌখিন পার্টিশন হিসেবে এর ব্যাপক ব্যবহার হয়ে থাকে। এছাড়া লম্বা বেত ফালা করে নানা কিছু বাধার কাজেও ব্যবহার করা হয়। ফলের জন্য বেতের চাষ করা হয় না। বেতের প্রধান ব্যবহার হস্তশিল্প সামগ্রী তৈরির কাঁচামাল হিসেবে। তবে ফল খেতে সুস্বাদু ও অনেকেরই প্রিয়।

নাটোর পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের বলারীপাড়া গ্রামের খন্দকার আনিছুর রহমান জানান, তার বেশ মনে পড়ে আশির দশকের কথা। তার পিতার প্রায় চার বিঘা জায়গা জুরে ছিল প্রকান্ড বাগান। বাগান জুরে ছিল বিভিন্ন জংলা গাছ, ফলজ গাছ সহ বাঁশ বন আর বেত বন। বাগান জুড়ে এখন শুধুই নির্মাণ হয়েছে ইমারত। বসতির কারণেই উজার হয়েছে বাগানের গাছ গাছালি আর বেত বন।

নাটোর সদর উপজেলার দিঘাপতিয়া ইউনিয়নের মো. জাহাঙ্গির হোসেন বলেন, ছোট বেলায় বেত ফল খেয়েছি মনে আছে। পশ্চিম হাগুড়িয়া থেকে তেগাছি ঘাটে যেতে রাস্তার দুই পাশে জুরে বেত বন ছিল, এখন আর নেই। তেবাড়িয়া ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. কাজিম আলি বললেন বছর দশেক আগে বেত ফল খেয়েছি। খেতে একটু কষ্টা হলেও সুস্বাদু এই ফল। তবে এখন সেখানে আর বেত বন নেই। তৈরি হয়েছে গৃহায়ন।

- বিজ্ঞাপন -

নিচাবাজারে হস্তশিল্প বিপনন প্রতিষ্ঠান নিতাই ষ্টোরের মালিক শ্রী নিতাই বসাক জানান ৯০ দশকে তিনি বেতের তৈরি পন্য বিক্রি করতেন। এখন আর পাওয়া যায় না, ক্রেতারাও চায় না।প্লাষ্টিক পণ্যের ভিড়ে হারিয়ে গেছে হস্তশিল্পের অনেক পন্য। আগে প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ বাঁসের, বেতের তৈরি অনেক কিছুই ব্যবহার করতো। এখন বিলাসিতা আর সৌখিনতায় অনেকে এগুলো ব্যবহার করে।

নলডাঙ্গা উপজেলার হাপানিয়া গ্রামের শ্রী নিরেন সরকার বলেন, তাদের গ্রামে একদা প্রচুর পরিমান বেত বন ছিল কিন্তু এখন আর নেই। বেতের জালি ডগা দিয়ে তরকারি খেতেন, বেতের ফল খেতেন তাদের গ্রামের অনেক মানুষ বেত দিয়ে বিভিন্ন ধরনের নিত্য ব্যবহারযোগ্য পন্য তৈরি ও সরবরাহ করতেন যা তাদের আয়ের উৎস ছিল। এখন বেত বন নেই। নেই সেই কর্ম। স্মৃতির পাতায় সেই সব দিন উকি দিয়ে শুধু দেখা।

নাটোর জেলা বন কর্মকর্তা সত্যেন্দ্রনাথ জানালেন, সরকারিভাবে নাটোরে বেত বন করার কোন পরিকল্পনা নেই এবং জায়গাও নেই। তবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় সরকারিভাবে বেতের আবাদ করা হয়। তার মধ্যে উত্তরবঙ্গের রংপুর, গাইবান্ধা, রাজশাহী জেলার ধামুর হাটের শাল বনের ভিতরে বেতের চাষ করা হয়। নাটোর জেলায় সেই ধরনের বন বা জায়গা নেই। আর ব্যক্তি মালিকানার জায়গায় যে সমস্ত বেত বন ইতি পূর্বে ছিল সেই সমস্ত জায়গায় বসতি গড়ে উঠার কারনে বেত বন উচ্ছেদ হয়েছে বলে তিনি জানালেন।

- বিজ্ঞাপন -

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
নাটোর প্রতিনিধি
সাংবাদিক এবং লেখক
মন্তব্য নেই

Log In

Forgot password?

Don't have an account? Register

Forgot password?

Enter your account data and we will send you a link to reset your password.

Your password reset link appears to be invalid or expired.

Log in

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!