প্রহরণ

রঞ্জনা রায়
রঞ্জনা রায়
7 মিনিটে পড়ুন
সাময়িকী আর্কাইভ

প্রত্যেকের জীবনে থাকে স্বপ্ন। স্বপ্ন জীবনকে যোগায় বেঁচে থাকার অক্সিজেন। বাস্তব পৃথিবীর পারিপার্শ্বিক প্রবাহে লোভ, হতাশা, বিষাদ, ষড়যন্ত্র প্রতিহিংসার যেমন একটি অন্ধকারময় আবর্তন আছে তেমনি আবার অন্যদিকে আছে বিশ্বাস, সম্প্রীতি, শ্রদ্ধা, আস্থা, নির্ভরতা এবং অনিঃশেষ ভালোবাসা। ভালোবাসা জীবনকে করে সার্থক,করে মহনীয়। জীবনের অনেকটা বছর পার হয়ে এসেও রুমেলা আজও বুঝতে পারেনা কিভাবে মানুষ চিনতে হয়। প্রায় চুয়াল্লিশতম বসন্ত পার করে এসেও মনে হয় জীবনটা বড়ই সাদামাটাভাবে কেটে গেছে। জীবনে কিছুই করা হলোনা। চাকরি আর সংসার এই দুই প্রান্তিক বিন্দুর মধ্যেই জীবনের ঘুরপাক পিংপং বলের মত। জীবনের সঞ্চয় কি? জীবনের সার্থকতা কোথায়? এইসব কঠিন প্রশ্নে মাঝে মাঝে আক্রান্ত হয়।
                             
“রুমি তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্টটা রেডি করো, আজ ফার্স্ট আওয়ারে একটা মিটিং আছে। “অর্ণব সেভ করতে করতে বলল। এই সকাল ছটা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত রুমেলার নিঃশ্বাস ফেলার সময় থাকে না। অর্ণব, ঝিমলি আর তার নিজের ব্রেকফাস্ট রেডি করা, রান্নার মাসিকে বলে যাওয়া দুপুরে, রাতে কি কি রান্না হবে।মন্টির মাকে দিয়ে বাসনপত্র, ঘরদোর পরিষ্কার করানো, তার সঙ্গে মেয়েকে রেডি করে বাসস্টপ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসা সবই একা হাতে সামলাতে হয়। এই সব সামলে নিজে রেডি হয়ে নটার মধ্যে মধ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে অফিসের জন্য। সবকিছুই বেশ গুছিয়ে টিপটপ করে করতে হয়, বিশেষ করে অর্ণব স্বভাবে একটু কেতাদুরস্ত। খাওয়া-দাওয়া পোশাক-পরিচ্ছদ সবকিছুই তাঁর ফিটফাট হওয়া চাই।
“মা আমি প্রোজেক্টের খাতাটা পাচ্ছিনা, একটু খুঁজে দাও প্লিজ। আমি লাস্ট অংকটা করছি।” ঝিমলি হাঁক দেয়।ঝিমলির সবই ভালো কিন্তু নিজের জিনিসপত্র কিছুতেই গুছিয়ে রাখতে পারে না। লেখাপড়ায় ঝিমলি চিরকালই ভালো। ফার্স্ট সেকেন্ড হয়। গানের গলা ভালো। এখন মেয়ের শখ হয়েছে ক্যারাটে শিখবে, রুমেলা বলে দিয়েছে পড়াশোনা সামলে যদি করতে পারো আমার আপত্তি নেই। কিন্তু অর্ণবের আপত্তি আছে, তার মতে মেয়েদের ওসব শিখে কি হবে, ওসব ছেলেদের ব্যাপার। ছেলেদেরই এইসব শোভা পায়। ঝিমলি এবার ক্লাস এইটে উঠবে।মেয়ে আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। প্রতিদিন নিউজ পেপার খুললেই যেসব ঘটনা পড়ছে তাতে মনে হয় মেয়েদের একটু আত্মরক্ষার কৌশল শিখে রাখা ভালো। রুমেলা ভাবে সামনের মাস থেকে ওকে ক্যারাটে ক্লাসে ভর্তি করে দেবে। অর্ণবকে এই ব্যাপারে একটু বুঝিয়ে বলবে।
রুমেলা দেখল খাটেই ঝিমলির প্রোজেক্টের খাতা পড়ে আছে। সে খাতা নিয়ে ব্যাগে ঢোকাতে গিয়ে মেয়েকে একটু বকলো। বললো, “বড় হচ্ছ ঝিমলি, নিজের জিনিস নিজে গুছিয়ে রাখতে শেখো। তোমার দিদুন কোনদিনই আমাদের বই-খাতা ব্যাগ গুছিয়ে দেয় নি। আমি কতদিক সামলাবো!” মেয়ে মায়ের বকুনি গায়ে মাখে না, হেসে মাকে জড়িয়ে ধরে।
                         
লিফট থেকে বেরিয়ে একতলার করিডরে পা রেখেই রুমেলা বুঝতে পারল বাইরে ভালই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ব্যাগ থেকে ছাতাটা বার করলো। শীতের শুরুতে এই অকাল বৃষ্টি, আজকাল আবহাওয়ার স্বভাবে খুবই পরিবর্তন ঘটছে। রাত প্রায় সাড়ে নটা বাজে, বাড়ি ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি। মিস্টার মুখার্জির কাছে অনেকটা সময় দিতে হলো। তার মত যাদের টার্গেট নির্ভর চাকরি তাদের কাজের সময়ের হিসেব করলে চলবেনা। মিস্টার মুখার্জি একজন এন.আর.আই কাস্টমার। তিনি যা ইনভেস্ট করলেন তাতে রুমেলার এক মাসের টার্গেট পূরণ হয়ে গেল। তাই রাত হলেও মনে একটা শান্তির ভাব। বিদেশি ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে আয় মোটামুটি ভালই হয়, কিন্তু প্রচুর খাটতে হয়। সংসারের সব সময় ঠিকমতো সময় দিতে পারে না। মেয়েটা কি করছে কে জানে! যাক আর ভাবলে চলবে না, ছাতা মাথায় দিয়ে ওড়না ঠিক করে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। নিউটাউনের এই অঞ্চলে চারিদিক খুব শুনশান। রাস্তার একপাশে শুধু বড় বড় হাইরাইজ বিল্ডিং এ লোকজন খুবই কম। একটু দূরে একটা অটোস্ট্যান্ড আছে। সেখান থেকে অটো ধরে বাইপাসে গিয়ে বাড়ি যাবার বাস ধরতে হবে। রাত্তিরে এই অঞ্চলের রাস্তা এমনিতেই ফাঁকা থাকে এখন আবার বৃষ্টি পড়ছে তাই জনমানবহীন। স্ট্রিটলাইট ও খুব উজ্জ্বল নয়। পেছন থেকে হঠাৎ একটা বাইক এসে আচমকা তার রাস্তা বন্ধ করে দাঁড়ালো। রুমেলা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাইক থেকে একটা রোগা মত ছেলে নেমে এসে তার সামনে দাঁড়ালো আর বাইকে যে ছেলেটি বসে আছে সে একটা নোংরা খিস্তি দিয়ে তার দিকে খুব একটা বাজে ইঙ্গিত করল। এই সময়েই যে ছেলেটি তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সে ওর হাতটা ধরতে গেল। রুমেলা বিস্মিত হলেও সাহস হারায়নি। হাতের কাছে কিছু না পেয়ে ছাতাটাই ওই ছেলেটার মুখ লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিল। ছেলেটা হঠাৎ এই আক্রমণ সামলাতে না পেরে যে ছেলেটি বাইক চালাচ্ছিল তার উপর গিয়ে পড়ল। এই ফাঁকে রুমেলা প্রাণপণে সামনের দিকে দৌড় দিল। দৌড়াতে দৌড়াতেই বুঝলো যে ছেলেগুলো বাইক স্টার্ট দিয়ে তাকে ধাওয়া করতে আসছে। এমন সময় দূরে দেখতে পেল একটা গাড়ির হেডলাইট, আর গাড়িটা তার দিকে এগিয়ে আসছে। রুমেলা “হেল্প ,হেল্প” বলে চেঁচিয়ে গাড়িটাকে থামানোর জন্য প্রাণপণে সেই দিকেই ছুটতে লাগলো। গাড়িটা তার থেকে একটু দূরে থেমে গেল। গাড়ি থেকে মিস্টার মুখার্জি নামলেন।
“কি ব্যাপার রুমেলা, আপনি এভাবে রাস্তায় দৌড়াচ্ছেন কেন? আপনি যে পুরোপুরি ভিজে গেছেন, কি হয়েছে?”
রুমেলার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। সে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছে। কাঁপতে কাঁপতে পেছন ফিরে মিস্টার মুখার্জিকে হাতের ইঙ্গিত করল। “রুমেলা ওদিকে কি আছে? আচ্ছা ঠিক আছে,  আপনি আগে গাড়িতে উঠুন তারপর সব কথা বলবেন।”

মিস্টার মুখার্জি জলের বোতলটা ওর হাতে দিয়ে বললেন “নিন একটু জল খান, তারপর বলুন কি হয়েছে। রুমেলা আস্তে আস্তে সব ঘটনা বলল। “ম্যাডাম সবার আগে আপনি আপনার এই মোবাইলটা ধরুন। বাড়িতে জানান যে আপনি ঠিক আছেন। আপনি এই মোবাইলটা আমার ওখানে ফেলে এসেছিলেন। বাড়ি থেকে অনেকবার আপনাকে কল করেছে। মোবাইলটা ফেরত দেবার জন্য আমি গাড়ি নিয়ে আপনাকে খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। থ্যাংক গড, ভাগ্যিস মোবাইলটা ফেলে এসেছিলেন, তাই আপনাকে এতবড় একটা বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারলাম। আমি আপনাকে বাড়ি পৌছে দিচ্ছি।”
রুমেলা এখন অনেকটাই ধাতস্থ হয়েছে। সে বলল “না না আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমি একটা উবের বুক করে নিচ্ছি।”
কিন্তু মিস্টার মুখার্জি কোন কথাই শুনলেন না রুমেলাকে নিয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিলেন। যেতে যেতে সে মনে মনে একটা প্রতিজ্ঞা করল যে আগামীকাল ঝিমলিকে সে অতি অবশ্যই ক্যারাটে ক্লাসে ভর্তি করবে। অর্নবের কোন আপত্তিই শুনবে না। কারণ মেয়েদের লেখাপড়া শিখে শুধুমাত্র সরস্বতী হলেই চলবে না, তাদের আত্মরক্ষার কৌশলও জানতে হবে। চারপাশে নানা বেশে অসংখ্য অসুর তাই প্রহরণ যে মেয়েদের একান্তই প্রয়োজন।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
অখণ্ড মেদিনীপুর জেলার দাঁতন থানার অন্তর্গত কোতাইগড়--- তুর্কা এস্টেটের জমিদার বংশের সন্তান রঞ্জনা রায়। জন্ম, পড়াশুনা ও বসবাস উত্তর কলকাতায়। বেথুন কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে সাম্মানিক স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর উপাধি লাভ করেন। ১৯৭০ সালের ৩০শে মে রঞ্জনা রায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম স্বর্গীয় জগত কুমার পাল, মাতা স্বর্গীয় গীতা রানি পাল। স্বামী শ্রী সন্দীপ কুমার রায় কলকাতা উচ্চ ন্যায়ালয়ের আইনজীবী ছিলেন। রঞ্জনা উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করছেন সাহিত্যপ্রীতি। তাঁর প্রপিতামহ স্বর্গীয় চৌধুরী রাধাগোবিন্দ পাল অষ্টাদশ দশকের শেষভাগে 'কুরু-কলঙ্ক’ এবং 'সমুদ্র-মন্থন’ নামে দু'টি কাব্যগ্রন্থ রচনা করে বিদ্বজনের প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। ইতিপূর্বে রঞ্জনা রায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'এই স্বচ্ছ পর্যটন’ প্রকাশিত হয়েছে এবং তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'ট্রিগারে ঠেকানো এক নির্দয় আঙুল' সাহিত্যবোদ্ধাদের প্রভূত প্রশংসা পেয়েছে। তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ 'নিরালা মানবী ঘর' (কমলিনী প্রকাশন) ও চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ 'ইচ্ছে ঘুড়ির স্বপ্ন উড়ান' (কমলিনী প্রকাশন) দে’জ পাবলিশিংয়ের পরিবেশনায় প্রকাশিত। বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় কবির কবিতা নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে প্রকাশিত হয়ে চলেছে।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!