ডাইনি কুয়ো

সিদ্ধার্থ সিংহ
সিদ্ধার্থ সিংহ
6 মিনিটে পড়ুন
ছবি: সংগৃহীত

তুহালা গ্রামটা ভারী সুন্দর। চারিদিকে এত ঘন গাছগাছালিতে ভরা যে, এটাকে ঠিক গ্রাম নয়, জঙ্গল বলাই ভাল। সেই জঙ্গলের মধ্যেই আছে মানুষের তৈরি করা একটা কুয়ো। এই কুয়োটাকে সবাই বলে— ডাইনি কুয়ো।

এই কুয়োর জন্য শুধু তুহালা গ্রামটাই নয়, এই গ্রামটি যেই দেশে, সেই উত্তর-পূর্ব ইউরোপের বাল্টিক সাগরের এস্তোনিয়ার দেশটির নাম এখন সবার মুখে মুখে।

Screenshot 20210601 211057 2 ডাইনি কুয়ো
ডাইনি কুয়ো 45

প্রায় তিন হাজার বছর আগে, যখন এই গ্রামে জলের জন্য সবাই হাহাকার করছিল, তখন গ্রামের লোকেরা জলের খোঁজ করতে করতে সন্ধান পায় এই জায়গাটির। মাটি ছুঁয়েই তাঁরা বুঝতে পারেন, এখানে জল পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে।

মাত্র আড়াই মিটার খুঁড়তেই বেরিয়ে আসে বিশুদ্ধ জল। গ্রামবাসীরা হাফ ছেড়ে বাঁচেন। কুয়োর চারপাশটা কোমর সমান পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়। যাতে কোনও বাচ্চাকাচ্চা হুমড়ি খেয়ে ভিতরে পড়ে না যায়। উপরে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয় একটি কাঠের বালতি। যার যখন যতটা জল দরকার, এখান থেকে তুলে নিয়ে যাবেন।

Screenshot 20210601 211103 2 ডাইনি কুয়ো
ডাইনি কুয়ো 46

প্রথম প্রথম সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু একদিন এক গ্রামবাসী জল নিতে এসে দেখেন, যে জল অনেকটা নীচে থাকার কথা, সেই জল কুয়ো থেকে আপনা-আপনিই উপরে উঠে উপচে পড়ছে।
অবিশ্বাস্য এই দৃশ্য দেখে সে দৌড়ে চলে গিয়েছিল গ্রামের সবাইকে জানাতে। সঙ্গে সঙ্গে সবাই ছুটে এসেছিল ব্যাপারটা কী, দেখার জন্য। গ্রামের সবাই কুয়োর কাছে এসে একদম অবাক।

Screenshot 20210601 211009 2 ডাইনি কুয়ো
ডাইনি কুয়ো 47

এই বিচিত্র দৃশ্য দেখে কারও মনে জন্ম নিল ভয়, কারও মনে আতঙ্ক। আবার কারও কারও মনে হল, এটা নিশ্চয়ই ঈশ্বরের অসীম কৃপা।

তখন ওই গ্রামেরই এক খুনখুনে বুড়ি শোনালেন, তাঁর স্বপ্নে দেখা এক অদ্ভুত গল্প। যেটা পরে লোকগাঁথায় পরিণত হয়।

তিনি বললেন, চাঁদের জ্যোৎস্না মাখা এক অদ্ভুত অলৌকিক রাতে একদল ডাইনি বেরিয়েছিল ঘুরতে। আকাশের বুক দিয়ে যেতে যেতে এ জায়গাটি দেখে তাদের খুব পছন্দ হয়। তাই সঙ্গে সঙ্গে তারা নেমে আসে এই জঙ্গলে। কিছুটা ঘুরতেই তাদের চোখে পড়ে এই কুয়োটি। কুয়োটির মধ্যে আয়নার মতো স্বচ্ছ ঝকঝকে জল দেখে তারা সেই কুয়োর ভিতরে নেমে পড়ে। একেবারে তলদেশে পৌঁছে যায়। তুমুল আনন্দে তারা জলের নীচে হাত-পা ছুড়ে হইহই করে স্নান করতে থাকে।

Screenshot 20210601 211132 2 ডাইনি কুয়ো
ডাইনি কুয়ো 48

ঠিক তখনই, আনন্দের চোটে কারও হাত বা পা বুঝি কারও গায়ে দুম করে লেগে গিয়েছিল, সেই নিয়ে শুরু হয়ে যায় তুমুল ঝগড়া। মারপিট। আর তাদের সেই লাফালাফি-ঝাপাঝাপি, মারামারির দাপটেই কুয়োর জল ছিটকে উপরে এসে উপচে পড়তে লাগল। চারপাশ ভরে যেতে লাগল বাধ না মানা জলের স্রোতে। তৈরি হয়ে গেল একটা বিশাল পুকুর। তবু ডাইনিদের সেই তাণ্ডব যেন কিছুতেই বন্ধ হতে চায় না!

এই গল্প শুনে অনেকেই ভিড়মি খেল। এই কুয়োর ভেতরে ডাইনি আছে! ব্যস, লোকের মুখে মুখে এই কুয়োর নাম হয়ে গেল— ডাইনি কুয়ো।

Screenshot 20210601 211033 2 ডাইনি কুয়ো
ডাইনি কুয়ো 49

অল্প কিছু দিনের মধ্যেই এস্তোনিয়ার এই কুয়োর খবর ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। ফলে এই অদ্ভুত কুয়োর অবারিত জলের ধারা দেখার জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে পর্যটকেরা এসে ভিড় করতে লাগলেন।

কিন্তু না, বছরের বারো মাসই যে এই কুয়োর জল এই ভাবে উপচে পড়ে, তা কিন্তু নয়। মূলত শীতকাল আর বর্ষাকালেই পড়ে।

হিসেব করে দেখা গেছে, এই কুয়ো থেকে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় পাঁচ হাজার লিটারের উপর জল উপচে পড়ে। টানা এক থেকে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত। আর একটা কথা, কুয়োর উপরে যখনই কোনও কাঠের বালতি রাখা হয়, কিছুক্ষণের মধ্যেই কী করে যেন সেটা ডাইনিদের মতো দেখতে হয়ে যায়।

Screenshot 20210601 211016 2 ডাইনি কুয়ো
ডাইনি কুয়ো 50

এই কুয়োকে ঘিরে আরও অনেক গল্প প্রচলিত আছে। অনেকে বলেন, তাঁরা নাকি রাত্রিবেলায় এই কুয়োর উপর দিয়ে আগুনের গোলক উড়ে যেতে দেখেছেন। যেটা অশুভ।
কেউ কেউ আবার মনে করেন, এই কুয়ো সৃষ্টিকর্তার এক অলৌকিক নিদর্শন, যা গ্রামের মধ্যে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।

নানান জন নানান কথা বললেও, এই কুয়োটি কিন্তু নজর কাড়েছে অনেক বিজ্ঞানীরাও। অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদও আসেন এই কুয়োটি সরজমিনে পরীক্ষা করতে। অনেক খোঁড়াখুঁড়িও করা হয়েছে এই জলের উৎসের খোঁজে।

তাদের মতে, কুয়োর মূল রহস্য লুকিয়ে আছে এর ভৌগোলিক গঠনে। বাল্টিক সাগরের উত্তরে অবস্থিত হওয়ায় এস্তোনিয়ার চার পাশে ছড়িয়ে রয়েছে অনেকগুলো নদী। তেমনি তুহালা অঞ্চলের ভূগর্ভেও লুকিয়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট নদী এবং শাখা নদী।

Screenshot 20210601 211140 2 ডাইনি কুয়ো
ডাইনি কুয়ো 51

শীতকালে এ সব অঞ্চলে প্রচুর তুষারপাত হয়। দিনের বেলায় রোদের তাপে সেই বরফ গলতে শুরু করে। সেই বরফ গলা জল ভূগর্ভস্থ নদীগুলোর মধ্যে প্রবল বেগে বইতে থাকে। ফলে ভূগর্ভস্থ এই সব নদীর জল অনেক বেড়ে যায়। আর এই কুয়ো যখন খোঁড়া হয়, তখন হয়তো কোনও নদী বা শাখা নদীর সঙ্গে কুয়োটির তলাটা মিশে গেছে। ফলে নদীতে যখন জলের স্রোত বাড়ে, তখন কুয়োর মুখ থেকে সেই জল হু হু করে বেরিয়ে আসে। আর বর্ষাকালেও এই একই জিনিস হয়।

তবে কাকতালীয় ভাবেই হোক কিংবা পরিকল্পনা মাফিকই হোক, কোনও অলৌকিক কারণে যে এই জল মাটির ভূগর্ভ থেকে উপরে উঠে আসছে না, তা এখন রীতিমত পরীক্ষিত।

তবু ২০১২ সালে এস্তোনিয়ানরা এই কুয়োটাকে দেশের শ্রেষ্ঠ বিস্ময় বলে দাবি করেছেন। ফলে এই কুয়োর প্রতি মানুষের আগ্রহ আরও বেড়ে গেছে। তাই দেশ ও দেশের বাইরে থেকেও বহু মানুষ এখন দেখতে আসছেন প্রকৃতির এই বিস্ময়— ডাইনি কুয়ো।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
২০২০ সালে 'সাহিত্য সম্রাট' উপাধিতে সম্মানিত এবং ২০১২ সালে 'বঙ্গ শিরোমণি' সম্মানে ভূষিত সিদ্ধার্থ সিংহের জন্ম কলকাতায়। আনন্দবাজার পত্রিকার পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, স্বর্ণকলম পুরস্কার, সময়ের শব্দ আন্তরিক কলম, শান্তিরত্ন পুরস্কার, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার, কাঞ্চন সাহিত্য পুরস্কার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা লোক সাহিত্য পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার, সামসুল হক পুরস্কার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, অণু সাহিত্য পুরস্কার, কাস্তেকবি দিনেশ দাস স্মৃতি পুরস্কার, শিলালিপি সাহিত্য পুরস্কার, চেখ সাহিত্য পুরস্কার, মায়া সেন স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ছোট-বড় অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। পেয়েছেন ১৪০৬ সালের 'শ্রেষ্ঠ কবি' এবং ১৪১৮ সালের 'শ্রেষ্ঠ গল্পকার'-এর শিরোপা সহ অসংখ্য পুরস্কার। এছাড়াও আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত তাঁর 'পঞ্চাশটি গল্প' গ্রন্থটির জন্য তাঁর নাম সম্প্রতি 'সৃজনী ভারত সাহিত্য পুরস্কার' প্রাপক হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!