পরজন্মে পৌঁছনোর জন্য দল বেঁধে আত্মহত্যা

সিদ্ধার্থ সিংহ
সিদ্ধার্থ সিংহ
7 মিনিটে পড়ুন
ছবি: সংগৃহীত

বনি নেটলস ছিলেন একজন নার্স আর মার্শাল অ্যাপেলহোয়াইট ছিলেন সেন্ট থমাস ইউনিভার্সিটির সঙ্গীত বিভাগের অধ্যাপক।

হাসপাতালে পরিচয় হবার পর দু’জনেরই মনে হয় তাঁদের জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক। এবং তাঁদের মনে বদ্ধমূল ধারণা হয়, ঈশ্বর তাঁদের দূত করে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।

তাঁরা মনে করতেন, বাইবেলে তাঁদের এই পৃথিবীতে আসার কথা উল্লেখ আছে। তাঁরা দু’জন সাধারণ মানুষের চেয়ে ওপরের স্তরের। পৃথিবীর মানুষকে পথ দেখানোই তাঁদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য।

তাঁদের বিশ্বাস ছিল, একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর পর পৃথিবী ধ্বংস হয় এবং নতুন করে সব কিছু আবার শুরু হয়।

এ বার ধ্বংসের সময় ভিনগ্রহবাসীরা স্পেসশিপে করে তাঁদের সবাইকে নিয়ে যাবে অন্য এক জগতে। সেখানে তাঁদের দেওয়া হবে মানব শরীরের চেয়ে অনেক ধাপ উন্নত শরীর। তখন জীবন হবে আরও সহজ এবং সুন্দর। সেটাকে তাঁরা বলতেন, TELAH (The Evolutionary Level Above Human)।

এই মনুষ্য শরীর তাঁদের কাছে ছিল একদম গুরুত্বহীন। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করতেন, এর চেয়ে উন্নত শরীর ভিনগ্রহবাসীরা তাঁদের দেবে। পরকালকে তাঁরা বলতেন, ‘দ্য নেক্সট লেভেল’।

তাঁদের এই মতবাদকে বিশ্বাস করে, এমন মানুষ খুঁজে বের করার জন্য ওরেগনে প্রথম প্রচারে নামলেন অ্যাপেলহোয়াইট ও নেটলস। কিছু ধর্মীয় সংগঠন তাঁদের এই মতবাদের চূড়ান্ত বিরোধিতা করলেও, অল্প কিছু দিনের মধ্যেই প্রায় কুড়ি জন সদস্য জোগাড় করে ফেললেন তাঁরা। এবং তাঁদের নিয়েই ১৯৭৪ সালে গড়ে তুললেন— হেভেন’স গেট কাল্ট।

তাঁরা প্রচার করলেন, ‘দ্য নেক্সট লেভেল’–এর শান্তিপূর্ণ জীবনের জন্য পৃথিবীতে কঠোর সংযম পালন করা দরকার। জাগতিক সমস্ত বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলে তবেই পরমানন্দের দেখা মিলবে।

এই মতবাদে বিশ্বাস করে আত্মীয়-স্বজন পরিবার-পরিজন, সম্পত্তি সব কিছু ছেড়েছুড়ে এক রকম লুকিয়েই জীবনযাপন করতে লাগলেন কাল্টের সদস্যরা।

2 3 পরজন্মে পৌঁছনোর জন্য দল বেঁধে আত্মহত্যা
পরজন্মে পৌঁছনোর জন্য দল বেঁধে আত্মহত্যা 39

এই নতুন জীবনে এসে তাঁরা প্রত্যেকেই নতুন নাম নিলেন। অ্যাপেলহোয়াইট ও নেটলস নিজেদের নাম দিলেন ‘ডু’ আর ‘টি’।

তাঁরা সবাই এক রকম পোশাকও পরতেন। তাঁদের জীবন ছিল যৌনতা থেকে শতহস্ত দূরে। সেটা বজায় রাখার জন্য অ্যাপেলহোয়াইট-সহ বেশ কয়েক জন পুরুষ সদস্য স্বেচ্ছায় খোজা পর্যন্ত হন।

হেভেন’স গেটের তরফে বলা হয়েছিল, যিশুখ্রিস্টের শরীরে যে ভিনগ্রহবাসীর আত্মা বাস করত, অ্যাপেলহোয়াইটের শরীরেও সে-ই আত্মাই বাস করছে। আর নেটলস হচ্ছেন স্বয়ং ঈশ্বরের মূর্তরূপ। তাঁদের দাবি ছিল, তাঁরা ভিনগ্রহবাসীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।

কিন্তু ১৯৮৫ সালে নেটলস হঠাৎ করেই ক্যান্সারে মারা যাওয়ার ফলে দলের বিশ্বাসের ভিত নড়বড়ে হয়ে যাওবার আশঙ্কা দেখা দেয়। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে, যিনি নিজেকে ঈশ্বর বলে দাবি করতেন, তিনি কী ভাবে মরতে পারেন?

তা ছাড়া, নেটলসের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁদের বোঝানো হয়েছিল, তাঁদের এই মনুষ্য শরীরই ‘দ্য নেক্সট লেভেল’-এ তাঁদের সঙ্গে যাবে। তাই নেটলসের মৃত্যু বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।

অ্যাপেলহোয়াইট তখন নতুন মতবাদ প্রচার করলেন। তিনি বললেন, অন্যান্য মানুষের মতো তাঁদেরও মৃত্যু হবে। তবে ভিনগ্রহবাসীরা তাঁদের আবার নতুন শরীর দিয়ে জীবনদান করবে। তাই তাঁদের এই মানব-শরীর ধ্বংস হয়ে গেলেও ক্ষতি নেই। তিনি এমন করে বোঝালেন যে, এই নতুন মতবাদ কাল্টের সদস্যরা মাথা পেতে মেনেও নিলেন।

শুধু এটাই নয়, তাঁরা বিশ্বাস করতেন, বিশ্বের প্রধান প্রধান রাষ্ট্রীয়, আর্থিক, সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠন এমন সব ভিনগ্রহবাসীদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে, যারা মানুষকে ধ্বংস করে দিতে চায়। এই সব গোষ্ঠী তাঁদের কাছে ‘দ্য লুসিফেরিয়ান্স’ নামে পরিচিত ছিল।

এ ভাবেই চলছিল। এর মধ্যেই ১৯৯৫ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানী অ্যালান হেল ও থমাস বপ একটি ধূমকেতু আবিষ্কার করেন, যেটা তাঁদের নামানুসারে নাম হয়— ‘হেল-বপ ধূমকেতু’। এই দুই জ্যোতির্বিজ্ঞানী বলেন, ১৯৯৭ সালে এটি পৃথিবীর খুব কাছ ঘেঁষে যাবে।

এই কথা শুনেই, কাল্টের লোকজনেরা বিশ্বাস করতে লাগলেন, এই ধূমকেতুর আড়ালে লুকিয়ে আছে বহু প্রতীক্ষিত সেই এলিয়েন স্পেসশিপ, যেটা তাঁদের নিতে আসছে।

পৃথিবীর কাছ ঘেঁষে এই ধূমকেতুটির যাওয়ার দিনক্ষণ যত এগিয়ে আসতে লাগল, কাল্টের সদস্যদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ততই বাড়তে লাগল। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন, মার্চের শেষ দিকে ঠিক যে মুহূর্তে হেল-বপ পৃথিবীর কাছ ঘেঁষে যাবে, তখন তাঁরা সবাই আত্মহত্যা করবেন। আর তাঁরা আত্মহত্যা করা মাত্রই নাকি ধূমকেতুর আড়ালে থাকা এলিয়েন স্পেসশিপ তাঁদের আত্মাগুলোকে টপাটপ তুলে নেবে।

সেই বিশ্বাসে ভর করেই তাঁরা নানা রকম প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। স্পেসশিপের মাধ্যমে কী ভাবে তাঁদের আত্মা পরবর্তী পর্যায়ে পৌঁছবে, সেটা বর্ণনা করে অ্যাপেলহোয়াইট একটি ভিডিও-ও তৈরি করলেন।

তাঁরা ঠিক করলেন, সবাই এক রকম জুতো পরবেন। তাই নাইকির সাদা-কালো রঙের ডেকেড মডেলের স্নিকার কেনা হল লট ধরে। ঠিক হল, এক রকম আর্মব্যান্ডও পরবেন তাঁরা, যাতে লেখা থাকবে— Heaven’s Gate Away Team.

অবশেষে এল ১৯৯৭ সালের সেই দিন। ক্যালিফোর্নিয়ার একটি ভাড়া বাড়িতে মার্চ মাসের ২২ তারিখ থেকে, কারও কারও মতে ২৬ তারিখ থেকে তাঁরা ধাপে ধাপে আত্মহত্যা করতে শুরু করে।

৩৯ জন সদস্য কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে এক-একটি দল ভদকার সঙ্গে ফেনোবারবিটাল মেশানো অ্যাপেল সস খেয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। এই মারাত্মক বিষ যদি কাজ না করে! তাই মৃত্যুটাকে নিশ্চিত করার জন্য প্লাস্টিকের ব্যাগের মধ্যে মাথাটা ঢুকিয়ে নিলেন তাঁরা।

এক-একটি দল যখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছিল, বাকি দলের সদস্যরা তাঁদের মৃতদেহগুলোকে পরিপাটি করে শুইয়ে বেগুনী রঙের চাদর দিয়ে ঢেকে দিচ্ছিল। এ ভাবে ৩ দিন ধরে দফায় দফায় চলল তাঁদের আত্মহত্যা এবং এ ভাবেই, ৩৯ জনই মৃত্যুবরণ করলেন।

মৃত্যুর আগে অ্যাপেলহোয়াইটের বানানো ভিডিও-সহ বাকি সদস্যদের রেকর্ড করা বার্তা গণমাধ্যম, প্রশাসন, কয়েকটি স্বনামধন্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং স্থানীয় থানা-সহ নানান জায়গায় পাঠানো হয়েছিল। সেই সূত্র ধরেই পুলিশ ৩৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করে।

আত্মহত্যার আগে তাঁরা অবশ্য বাড়ির পেছনের দরজাটা খুলে দিয়েছিলেন, যাতে ওই বাড়িতে ঢুকতে কারও অসুবিধা না হয়।

শুধু আমেরিকা নয়, এই ঘটনাটি নিয়ে গোটা পৃথিবী জুড়ে ব্যাপক তোলপাড় হয়। এত দিন পরেও এই কাল্ট নিয়ে মানুষের আগ্রহ কিন্তু এতটুকুও কমেনি।

হেভেন’স গেট নিয়ে তৈরি হয়েছে পডকাস্ট, যেখানে এই কাল্ট আআর এই গণ-আত্মহত্যা নিয়ে আলোচনা হয় এবং উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়। অ্যামাজন প্রাইমে তৈরি হয়েছে তথ্যচিত্র। এ ছাড়া অনেক গান, টিভি সিরিজ ও চলচ্চিত্রের সংলাপে ফিরে ফিরে এসেছে এই কাল্টের নাম। শুধু তা-ই নয়, এমন বহু মানুষের সন্ধান পাওয়া গেছে, যাঁরা এখনও বিশ্বাস করেন কাল্টের সমস্ত কথা!

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
২০২০ সালে 'সাহিত্য সম্রাট' উপাধিতে সম্মানিত এবং ২০১২ সালে 'বঙ্গ শিরোমণি' সম্মানে ভূষিত সিদ্ধার্থ সিংহের জন্ম কলকাতায়। আনন্দবাজার পত্রিকার পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, স্বর্ণকলম পুরস্কার, সময়ের শব্দ আন্তরিক কলম, শান্তিরত্ন পুরস্কার, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার, কাঞ্চন সাহিত্য পুরস্কার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা লোক সাহিত্য পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার, সামসুল হক পুরস্কার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, অণু সাহিত্য পুরস্কার, কাস্তেকবি দিনেশ দাস স্মৃতি পুরস্কার, শিলালিপি সাহিত্য পুরস্কার, চেখ সাহিত্য পুরস্কার, মায়া সেন স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ছোট-বড় অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। পেয়েছেন ১৪০৬ সালের 'শ্রেষ্ঠ কবি' এবং ১৪১৮ সালের 'শ্রেষ্ঠ গল্পকার'-এর শিরোপা সহ অসংখ্য পুরস্কার। এছাড়াও আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত তাঁর 'পঞ্চাশটি গল্প' গ্রন্থটির জন্য তাঁর নাম সম্প্রতি 'সৃজনী ভারত সাহিত্য পুরস্কার' প্রাপক হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!