মানবসভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে নানা জাতি-গোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। বহু সংস্কৃতি সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেলেও কিছু প্রাচীন সংস্কৃতি আজও টিকে আছে, যদিও পরিবর্তনের ছোঁয়াও এসেছে। এখানে আমরা তুলে ধরেছি এমন ১০টি উল্লেখযোগ্য সংস্কৃতির কথা, যেগুলো হাজার হাজার বছর ধরেও তাদের মূল পরিচয় বা ঐতিহ্যের ধারা বজায় রেখে আজও বহাল রয়েছে।

১. চীনা সংস্কৃতি
- প্রাচীনত্ব: প্রায় ৫০০০ বছর ধরে ক্রমাগত বিকাশমান।
- বৈশিষ্ট্য: কনফুসিয়ান চিন্তাধারা, তাওবাদের প্রভাব, ঐতিহ্যবাহী উৎসব (চীনা নববর্ষ, মিড-অটাম ফেস্টিভ্যাল)।
- বর্তমান প্রভাব: আধুনিক প্রযুক্তি আর বিশ্বায়নের সাথে তাল মিলিয়ে চীনা ভাষা, খাদ্যাভ্যাস ও পারিবারিক মূলনীতি আজও সমানভাবে সমৃদ্ধ ও প্রভাবশালী।

২. ভারতীয় (সনাতন) সংস্কৃতি
- প্রাচীনত্ব: বৈদিক যুগ থেকে (প্রায় ১৫০০ খ্রিস্টপূর্ব) শুরু করে ক্রমাগত ধারাবাহিকতা।
- বৈশিষ্ট্য: হিন্দুধর্মের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান, গুরু-শিষ্য পরম্পরা, একাধিক ভাষার মেলবন্ধন ও বৈচিত্র্যময় খাবার।
- বর্তমান প্রভাব: আজকের ভারত তথা ভারতীয় উপমহাদেশে পরিবার, সমাজ ও উৎসবের ধরন এই প্রাচীন সংস্কৃতির ওপরই দাঁড়িয়ে আছে।

৩. ইহুদি (Jewish) সংস্কৃতি
- প্রাচীনত্ব: প্রায় ৪০০০ বছরের ঐতিহ্য, আব্রাহামীয় ধর্মের শিকড় এখানেই।
- বৈশিষ্ট্য: তোরা ও তালমুদ-ভিত্তিক ধর্মীয় নিয়মকানুন, নানা উৎসব (পাসওভার, হনুক্কাহ) এবং ইসরায়েলের ইতিহাসের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ।
- বর্তমান প্রভাব: ইহুদি ডায়াস্পোরা বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত, কিন্তু ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আচার এখনো মূলভাব অক্ষুণ্ন রেখেছে।

৪. পারস্য (ইরানি) সংস্কৃতি
- প্রাচীনত্ব: আকেমেনিড সাম্রাজ্যের সময় (খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০-৩৩০) থেকেও আগে; জোরোয়াস্ট্রিয়ান ঐতিহ্য।
- বৈশিষ্ট্য: নওরোজ (নতুন বর্ষ) উদযাপন, পারস্য ভাষার সাহিত্য (ফিরদৌসির শাহনামা, হাফিজ, রুমি), স্থাপত্যশৈলী।
- বর্তমান প্রভাব: আধুনিক ইরানি সমাজে ইসলামের প্রভাব থাকলেও প্রাচীন পারস্যের কৃষ্টিকালচার এখনো নানা আচার-অনুষ্ঠানে স্পষ্ট।

৫. মিশরীয় সংস্কৃতি
- প্রাচীনত্ব: নীলনদের তীরে গড়ে ওঠা সভ্যতা (খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৩১০০ থেকে)।
- বৈশিষ্ট্য: প্রাচীন মন্দির, পিরামিড, হায়ারোগ্লিফিক (চিত্রলিপি), এবং ফারাওদের ঐতিহাসিক ঐতিহ্য।
- বর্তমান প্রভাব: আরবীকরণ সত্ত্বেও স্থানীয় খাদ্য, পোশাক, লোকগাথা ও ঐতিহ্যে মিশরীয় সংস্কৃতির নির্দিষ্ট ছাপ আজও স্পষ্ট।

৬. গ্রিক সংস্কৃতি
- প্রাচীনত্ব: হোমের যুগ (প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ৮০০) থেকে স্ফুরিত, পরবর্তীতে ক্লাসিকাল গ্রিস।
- বৈশিষ্ট্য: দার্শনিক ঐতিহ্য (সোক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল), অলিম্পিক গেমসের উদ্ভব, মন্দির স্থাপত্য ও পৌরাণিক কাহিনি।
- বর্তমান প্রভাব: আধুনিক গ্রিসে খ্রিস্টীয় (ইস্টার্ন অর্থোডক্স) সংযোগ থাকলেও ভাষা, খাদ্য, উৎসব, নৃত্য ও সংস্কৃতিতে প্রাচীন গ্রিক চেতনার ছাপ অটুট।

৭. জাপানি সংস্কৃতি
- প্রাচীনত্ব: খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ বা তার আগের জম্মোন যুগ থেকেই চর্চিত।
- বৈশিষ্ট্য: শিন্তো ও বৌদ্ধধর্মের মিশ্রণ, সামুরাই ঐতিহ্য, চা অনুষ্ঠান, কিমোনো পোশাক, ডায়েট ও মার্শাল আর্ট (কারাতে, জুডো)।
- বর্তমান প্রভাব: অতীব প্রযুক্তিনির্ভর হলেও, ঐতিহ্যবাহী উৎসব (মাতসুরি), রীতিনীতি এবং পারিবারিক মূল্যবোধ অদ্যাবধি অক্ষুণ্ন।

৮. অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী (Aboriginal) সংস্কৃতি
- প্রাচীনত্ব: প্রায় ৫০,০০০ বছর আগে থেকেই অস্ট্রেলিয়ার আসল অধিবাসী।
- বৈশিষ্ট্য: ড্রিমটাইম কাহিনি, রং এবং প্রতীকী শিল্প, ডিজেরিডু (Didgeridoo) বাদ্যযন্ত্র, প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে ভারসাম্যময় বসবাস।
- বর্তমান প্রভাব: যদিও ইউরোপীয় উপনিবেশের কারণে অনেক পরিবর্তন হয়েছে, তবু তারা তাদের সঙ্গীত, নৃত্য, পৌরাণিক গল্প ও আচারকে এখনও ধরে রেখেছে।

৯. মায়া (Maya) সংস্কৃতি
- প্রাচীনত্ব: খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সাল থেকে ক্রমে বিকাশমান; মধ্য আমেরিকায় প্রসার লাভ।
- বৈশিষ্ট্য: জটিল লিপি (Hieroglyphics), জ্যোতির্বিদ্যা ও ক্যালেন্ডার সিস্টেম, অনন্য পিরামিড ও মন্দির স্থাপত্য।
- বর্তমান প্রভাব: মায়া জনগোষ্ঠীর বংশধরেরা এখনো স্পেনীয় প্রভাবের পাশাপাশি তাদের ভাষা, ঐতিহ্য ও ধর্মীয় আচার মেনে চলে।

১০. আদিবাসী আমেরিকান (Native American) বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি
- প্রাচীনত্ব: আমেরিকা মহাদেশে হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে বসতি স্থাপন।
- বৈশিষ্ট্য: শিকার, চাষাবাদ, টোটেম, নৃত্য, গানের ঐতিহ্য, এবং প্রকৃতির সাথে নিবিড় সম্পৃক্ত জীবনযাপন।
- বর্তমান প্রভাব: ইউরোপীয় উপনিবেশের প্রভাব সত্ত্বেও অনেক উপজাতি আজও তাদের ভাষা, শিল্পকলা (বিডওয়ার্ক, কার্ভিং), ও উৎসবের মাধ্যমে আদি ঐতিহ্য সংরক্ষণ করছে।
শীর্ষ ১০ সংস্কৃতি
এইসব প্রাচীন সংস্কৃতি মানবসভ্যতায় বহমান জ্ঞানের ধারাকে টিকিয়ে রেখেছে। স্থান, সময় ও সামাজিক পরিবর্তনের ঢেউয়ে বহু সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়ে গেলেও উপরে আলোচিত সংস্কৃতিগুলো আজও জেগে আছে—নানা রূপান্তরের মধ্য দিয়ে। তাদের শিল্প, সাহিত্য, ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান কেবলমাত্র সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মানুষের পরিচয় নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের জন্যই মূল্যবান ঐতিহ্যের ভাণ্ডার। বিভিন্ন সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত মূল স্পিরিট বা আত্মা আমাদের বর্তমান জীবনকেও সমৃদ্ধ করে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক টেকসই শিকড়ের দিশা দেখায়।
✍️এই নিবন্ধটি সাময়িকীর সুন্দর এবং সহজ জমা ফর্ম ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। আপনার লেখা জমাদিন!